বর্ষবরণ, না দুর্বৃত্তবরণের উৎসব

Posted: 16 এপ্রিল, 2017

আহমদ রফিক : বৈশাখী নববর্ষের ঐতিহ্যবাহী উৎসব-অনুষ্ঠান নিয়ে আমাদের গর্ব ও অহংকারের শেষ নেই। এ উপলক্ষে দৈনিক পত্রিকাগুলোও ঢাকঢোল পিটিয়ে সোচ্চার, কাগজের পাতাগুলো ‘নবপল্লবে সজ্জিত’। আপত্তির কারণ নেই এ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য পালনে। কিন্তু আনন্দ-উৎসবের বর্ষবরণ যখন দুর্বত্তবরণে পরিণত হয় তখন ঐতিহ্যের নামে লজ্জায় মুখ ঢাকার উপায় থাকে না। সংস্কৃতিচর্চার প্রতি ধিক্কার জানিয়েও ক্ষুব্ধ মন শান্ত হয় না। বলতে হয়, এই হলো আমাদের ‘গর্ব ও অহংকারের জপ! এই হচ্ছে আমাদের ঐতিহ্যিক সংস্কৃতিচর্চা! ‘গর্ব ও অহংকার’ শব্দ দুটো বারকয়েক উল্লেখ করার কারণ এ শব্দ দুটো আমরা নানা উপলক্ষে দেদার ব্যবহার করে থাকি, বিশেষত করে তরুণ প্রজন্ম। একুশে উদ্যাপন নিয়েও শুনি একই কথা; ‘একুশ আমার গর্ব ও অহংকার’। সে গর্ব ও অহংকার কিছুসংখ্যক দুর্বৃত্ত তরুণ ধূলায় মিশিয়ে দিয়েছিল তিয়াত্তরের মধ্যরাতের একুশে উদ্যাপনে। আর বৈশাখী বর্ষবরণ নিয়ে গত ১৪২২-এ ঘটনা ঘটেছিল, তার দায় কে নিয়েছিল? গর্ব ও অহংকারের প্রতিনিধি বর্ষবরণের উদ্যোক্তারা, নাকি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, নাকি সবার ওপরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তথা পুলিশ? এ ঘটনা কিন্তু নতুন কিছু নয়। কয়েক দশক আগে এমনই এক বৈশাখী উৎসব-অনুষ্ঠানে দিনদুপুরে প্রকাশ্যে রমনা অশথমূল প্রাঙ্গণে লাঞ্ছিত হয়েছিলেন কয়েকজন তরুণী। তাদের লজ্জায় আনত মুখ দেখে আমাদেরই এক বিদেশিনী অতিথি গভীর আক্ষেপে স্বগতোক্তি করেছিলেন : ‘আহা রে কী কষ্ট মেয়েটির’। লজ্জায় মাথা কাটা গিয়েছিল। দীর্ঘ সময় পরে হলেও অনুরূপ ঘটনা বর্ষবরণ উৎসব উপলক্ষে আবারও ঘটেছে, যেমন ২০১১ সালে, এমন উল্লেখ দেখেছি সংবাদপত্রে। এর পরও সতর্ক হয়নি পুলিশ কিংবা যথাযথ কর্তৃপক্ষ। কেন? তারা এ অনুষ্ঠানকে ‘ফ্রি স্টাইল’ দুর্বৃত্তপনার আসর হিসেবে সাজিয়েছিল! এত মানুষ, এত চটকদার সংস্কৃতির প্রকাশ, এত নিরাপত্তা বাহিনী ও সিসি ক্যামেরা, কী দরকার এসব লোকদেখানো নিরাপত্তাব্যবস্থার? এসবের পরিণাম কী? না, অন্ততপক্ষে জনাবিশেক নারী আমাদের অসভ্য সমাজের প্রমাণ রেখে লাঞ্ছিত হলেন। ‘লাঞ্ছিত’ শব্দটাই ব্যবহার করছি, কারণ প্রকৃত শব্দটি কলমে আসছে না। একটি দৈনিক শিরোনাম ছিল : ‘বর্ষবরণে টিএসসিতে পুলিশের সামনেই পাশবিকতা’। এই পাশবিকতা শব্দটি আমরা এ ধরনের সামাজিক দুর্বৃত্তপনায় হরহামেশা ব্যবহার করে থাকি। কিন্তু আমার তাতে বরাবরই ঘোর আপত্তি। কারণ পশুরা এ ধরনের আচরণে অভ্যস্ত নয়, তারা মানুষের তুলনায় সংস্কৃতি বিচারে অনেক সভ্য। বরং এ ঘটনা বোঝার মতো মস্তিষ্কক্ষমতা থাকলে তারা লজ্জায় মাথা নুইয়ে থাকত, থাকত সুসভ্য আধুনিক মানুষের আচরণ দেখে। দুই. আমাদের তথাকথিত সমাজ যে কতটা পচে গেছে, তার গায়ে যে কত দুষ্টক্ষত (যা ঢাকা থাকে রংবেরঙের পোশাকে), সে হিসাব ও বিচার-ব্যাখ্যা আমরা করি না। করেন না আমাদের তথাকথিত সুধীজন। কাগজগুলোর বিবরণে-প্রতিবেদনে ঘটনার যে পৈশাচিক উল্লাস প্রকাশ পেয়েছে, তা আবার উল্লেখ করার কি কোনো প্রয়োজন আছে? যা বলা হয়েছে, লেখা হয়েছে, তাই তো যথেষ্ট। হয়তো যথেষ্ট নয় তাদের জন্য, যারা বর্ষবরণের ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন। দু-একটি কাগজে প্রকাশিত কর্তাব্যক্তিদের আচরণ আমাদের বলতে বাধ্য করছে যে, এদের ঘরে কি মা-বোন-মেয়ে নেই? কিভাবে মুখ দেখাবে তারা তাদের কাছে; নাকি আমাদের শিক্ষিত শ্রেণির ভোগবাদী সমাজে এসব আচরণ জলচল হয়ে গেছে, এতে কিছু যায়-আসে না! আমাদের শিক্ষিত সমাজ, সুধীসমাজ বিষয়টিকে কিভাবে নিয়েছে, তার প্রমাণ মেলে তাদের কাণ্ডজ্ঞানহীন প্রতিক্রিয়ায়। একটি কাগজে শিরোনাম ছিল : ‘পহেলা বৈশাখে/বখাটেপনা’। ২০ জন নারী এত লোকের সামনে বিবস্ত্র হলেন, নির্যাতিত হলেন, এর নাম বখাটেপনা? এ কেমনতরো সাংবাদিকতা? নাকি এসব ঘটনা তাদের চোখে ডালভাত! আধুনিকতার উদ্যাম প্রকাশ! আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাই যখন পড়ি, সংস্কৃতিবান হাজার হাজার মানুষের সামনে মাত্র ১০-১৫ জন পাষণ্ড (কাগজের ভাষায় ‘উচ্ছৃঙ্খল তরুণ’) ‘নারীদের পরনের কাপড় ধরে টানাটানি করছে’ আর তাঁরা তা নীরবে দেখছেন? নাকি তাঁরা বস্ত্রহরণ কাণ্ড উপভোগ করছিলেন, মহাকাব্যের নায়িকার তো এত অপমান, এত নির্যাতন ভোগ করতে হয়নি। যেমন করতে হলো ২০ জন বাঙালি নারীকে গত ১৪২২ বঙ্গাব্দে? ঘটনার সবচেয়ে বড় আপত্তিকর দিক হলো, পুলিশ বাহিনীর সামনে এতজন নারীর বিবস্ত্র-লাঞ্ছনার ঘটনা। কোন দায়িত্ব, কী দায়িত্ব পালন করছিল তারা, তারা কি মজা দেখছিল? এ দায়িত্বহীনতার কী জবাব দেবেন পুলিশ বাহিনীর উচ্চবর্গীয় কর্তাব্যক্তিরা? একজন বলেছেন, ‘ফুটেজ সংগ্রহ করে তদন্ত চলছে। দায়িত্বে অবহেলা থাকলে পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ দু’বছর অতিবাহিতের পর প্রশ্ন জাগে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল কোথায়? আমাদের প্রশ্ন হলো, এ কেমন কথা পুলিশের একজন বড় কর্তার মুখে? ‘দায়িত্বে অবহেলা’ না থাকলে পুলিশের সামনে একসঙ্গে এতজন নারী নির্যাতিত হতে পারতেন? এমন নয় যে ভিড়ের মধ্যে একজনের ওপর আক্রমণের ঘটনা। সংবাদপত্রের বিবরণে কয়েকজন তরুণের জবানবন্দিতে যা প্রকাশ পেয়েছে, তা কি পড়েননি পুলিশের বড় কর্তারা? বৈশাখী ভিড়ে তাদের কোনো মেয়ের এ অবস্থা হলে কী বলতেন তাঁরা, কী করতেন তাঁরা? আমাদের জানা নেই। তবে ঘটনাদৃষ্টে এটুকু বুঝতে পারছি, পুলিশ এখন আর পুলিশ নেই। যে পুলিশকে আমরা ১৯৭১ সালে দেখেছি সে পুলিশ মরে ভূত হয়ে গেছে। তাদের উত্তরসূরিদের মধ্যে দায়িত্বহীনতার ও দুর্নীতির প্রেত নৃত্য! বড়রা তা দেখেও দেখেন না, শুনেও শোনেন না। অপরাধ করে পুলিশ সদস্য বড়জোর পুলিশ লাইনে ‘ক্লোজড’ হন। অন্যায় বা অপরাধে সাধারণ নাগরিকের যে শাস্তি, পুলিশেরও একই রকম শাস্তি হওয়া উচিত। জানি না, আমাদের প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থা এ বিষয়ে ভিন্ন কথা বলে কি না। নিয়মকানুন ভিন্ন কি না। যদি ভিন্ন হয়ে থাকে, তাহলে তার পরিবর্তন দরকার জনবান্ধব চরিত্রে। দুর্বৃত্তপনায় বাধা দিতে গিয়ে যে ছাত্র আহত হয়েছেন, তাঁর ও অন্য আরো দু-একজনের সাক্ষ্যে স্পষ্ট যে পুলিশ তার কর্তব্য করেনি, তাঁদের আহ্বানে সাড়া দেয়নি, এমনকি ধৃত দুজনকে নাকি ছেড়ে দিয়েছে। কী শাস্তি হওয়া উচিত এই সব পুলিশের? পুলিশের দুষ্কর্মের যথাযথ শাস্তি যদি হতো কিংবা দুর্বৃত্ত ছাত্রদের যদি যথাযথ সাজা হতো, তাহলে এ ধরনের ঘটনা নিয়মমাফিক কমে আসত। বিচার হয় না, সাজা হয় না বলেই সমাজ এতটা দূষিত হতে পেরেছে, তার শরীরে পচন ধরতে পেরেছে, যে পচন পচন নয়, বোধ হয় গর্ব ও অহংকারের অথবা আধুনিকতার আলামত। তবে বড় কথা হচ্ছে, পুলিশ বাহিনীতে যদি নীতিগত-আদর্শগত আমূল পরিবর্তন আনা না যায়, তাহলে এ পুলিশ বাহিনীর কী প্রয়োজন? তারা কি আছে শুধু রাজনৈতিক কাজে ব্যবহারের জন্য? সে ক্ষেত্রে জনগণের ট্যাক্সের টাকায় এত বড় বাহিনী পোষার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। সরকার কি বিষয়টা নিয়ে ভেবে দেখবে? আর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের (ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর) যে প্রতিক্রিয়া কাগজে পড়েছি, তা আমার কাছে দায়সারা গোছের বলে মনে হয়েছে। যেন এ ধরনের ঘটনা তো হরহামেশাই ঘটে থাকে, এ সম্পর্কে যা করার পুলিশ করবে। কিন্তু তাঁরা ভুলে যান কেন যে এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রও জড়িত থাকতে পারে, সে ক্ষেত্রে তাঁরা দায়মুক্ত নন। ছাত্র ইউনিয়নের সংশ্লিষ্ট কর্মীরা ঘটনার জন্য পুলিশের নির্লিপ্ততা ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে দায়ী করেছে এক সংবাদ সম্মেলনে। এ ক্ষেত্রে জবাব দেওয়ার দায় উভয় পক্ষেরই। এ আলোচনার মর্মার্থ হলো আলোচ্য ঘটনায় আমাদের সভ্য নামধারী সমাজের মুখোশ খুলে পড়েছে, তার নগ্ন রূপ বেরিয়ে এসেছে। যার অন্য একদিক আমরা দেখেছি জনারণ্যে অভিজিৎ খুনের ঘটনায়; এবার তার বিকৃতরূপ দেখা গেল এতজন নারীর শ্লীলতাহানিতে, এবং তা একই স্থানে ও প্রায় একই চরিত্রে জনসমক্ষে। সেখানেও পুলিশ ছিল নিষ্ক্রিয় দর্শক। এবারও তাই। তিন. এসব কিসের আলামত? সমাজ ও সংস্কৃতির কী চরিত্র প্রকাশ করছে অবাঞ্ছিত এসব ঘটনা? সেই সঙ্গে প্রশাসন ও আমাদের শিক্ষা পরিবেশেরও কী পরিচয় দিচ্ছে! তবে কিছুটা হলেও স্বস্তির অবকাশ যে দূষিত তারুণ্যের বাইরে একাংশে এখনো তারুণ্যর শুদ্ধরূপ দেখা গেল। অন্তত কিছুসংখ্যক আদর্শবাদী তরুণ প্রতিবাদে ও প্রতিকারে সাহসী ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু তাদের সংখ্যা তো আরো বেশি হওয়া উচিত ছিল। তাহলে অন্তত আক্রান্ত নারী চরম লাঞ্ছনা থেকে মুক্তি পেতে পারতেন। এ ঘটনা আমাদের নির্বাচনবিলাসী রাজনৈতিক মহলকে কতটা স্পর্শ করেছে এ পর্যন্ত তার বড় একটা প্রমাণ মেলেনি। বোঝা যায়নি কথিত নাগরিক সমাজের প্রতিক্রিয়াও, যে নাগরিক সমাজ, সুধীসমাজকে রাজনৈতিক প্রয়োজনে বা তেমন স্বার্থের টানে সোচ্চার হতে দেখি, মানববন্ধনে প্রতিবাদী হতে দেখি। কিন্তু দূষিত সমাজের শুদ্ধির তৎপরতায় তাদের বড় একটা দেখা যায় না। ব্যতিক্রম দু-চারজন। বাকি তারা কি বর্তমান বাংলাদেশের দূষিত সমাজেরই অংশ? কথাটা ভেবে দেখতে বলি। সর্বশেষ কথা হলো, আমরা দু’বছর পূর্বের সেই ঘটনার যথাযথ তদন্ত আজও চাই। চাই দোষীদের শনাক্ত করে বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা। দায়সারা কিছু নয়, যা ঘটে থাকে রাজনৈতিক স্বার্থপরতার ক্ষেত্রে আর সমাজের অভিভাবক বলে কথিত সুজনদের জন্য, সময় এসেছে প্রমাণ করার যে তারা কি সত্যই সুধী ও সুজন, নাকি দুর্জনের দুষ্কৃতির দিকে চোখ বুজে-থাকা বুদ্ধিজীবী। আর পুলিশিব্যবস্থা সম্পর্কে শেষ কথা হচ্ছে, অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের ঘটনার মতো বার বার শোনা যায় তিন স্তরের নিরাপত্তাব্যবস্থার কথা। কিন্তু তা এমনই নিশ্চিদ্র যে সে ছিদ্র ভেদ করে জনাকয়েক দুর্বৃত্ত তরুণ অনায়াসে এতজন নারীর শ্লীলতাহানির সময় ও সুযোগ পেয়ে যায়। কী জবাব দেবেন পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা? তবে আমাদের অস্বস্তি আর তাঁদের স্বস্তির কারণ, তাঁরা কখনো দায়ভার গ্রহণ করেন না, অভিযোগ সত্য হলেও তা মানতে চান না। অতীতের ঘটনা যেন আর না ঘটে ১৪২৪-এ এসে–সেটাই প্রত্যাশা। লেখক : কবি, গবেষক ও ভাষাসংগ্রামী