ডিজিটাল স্পেসে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন এখনই

Posted: 12 অক্টোবর, 2025

বর্তমান বিশ্ব প্রযুক্তিনির্ভর সমাজে পরিণত হয়েছে। ইন্টারনেট এখন মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ, যেখানে শিক্ষা, কর্ম, বিনোদন, যোগাযোগ–সবকিছু অনলাইন মাধ্যমে সম্পন্ন হচ্ছে। কিন্তু এই ডিজিটাল উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে এক নতুন ধরনের অপরাধ–অনলাইন হেনস্তা বা সাইবার হয়রানি, যার প্রধান ভুক্তভোগী নারীরা। এই হেনস্তা কখনো ঘটে সোশ্যাল মিডিয়ায়, কখনো মেসেজের মাধ্যমে, আবার কখনো ছবির অপব্যবহার বা ভুয়া অ্যাকাউন্ট তৈরি করে প্রতারণার মাধ্যমে। কোনো নারী তার এজেন্সি বা কর্তাসত্তা দাবি করলে, নারী অধিকার নিয়ে সোচ্চার হলে, নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুললে, নারীর ক্ষমতায়ন অথবা অন্যান্য সামাজিক ব্যাধি যেমন- বাল্যবিবাহ, যৌতুক, পারিবারিক সহিংসতা ইত্যাদির প্রতিবাদ করলেও তাকে নোংরাভাবে আক্রমণ করতে থাকে অনলাইনে। আক্রমণকারীরা এই আক্রমণের টুল হিসেবে মিসইনফরমেশন, ডিসইনফরমেশন ব্যবহার করে এবং ভুয়া অডিও-ভিডিও বানিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, এখন একদল লোক সদা প্রস্তুত থাকে নারীদের কমেন্ট বক্সে অযৌক্তিক নোংরা মন্তব্য করার জন্য। এই পরিস্থিতি নারীদের মনে তীব্র মানসিক চাপ সৃষ্টি করছে প্রতিনিয়ত। অনেক নারী হতাশা থেকে অথবা আর আক্রমণের শিকারে পরিণত হতে চান না বলে নিজেকে গুটিয়ে ফেলেন। এর ফলে তার মানসিক ও সামাজিক স্বাধীনতা যেমন ক্ষুণ্ন হয় তেমনই তার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হয়। বিভিন্ন জরিপেও অনলাইনভিত্তিক হেনস্তার ভয়াবহতা উঠে এসেছে। জার্মানভিত্তিক উন্নয়ন এবং ন্যায়বিচার সংক্রান্ত সহযোগিতা সংস্থা এনইটিজেড বাংলাদেশের ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, নির্যাতনের শিকার নারীদের শতকরা ৭৮ ভাগেরও বেশি প্রযুক্তি সহায়ক সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। এই জরিপে অংশ নেয়া অন্তত ৫০ ভাগ নারী বলছেন তারা অনলাইন নির্যাতন/সহিংসতা এড়াতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছেড়ে দিয়েছেন। আর ৩৫ ভাগ নারী এসব হয়রানির কারণে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। বাংলাদেশ পুলিশ সাপোর্ট ফর উইমেন (পিসিএসডাব্লিউ) জানাচ্ছে, ২০২০ সালে তাদের কার্যক্রম শুরুর পর থেকে ২০২৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৬০ হাজার ৮০৮ জন নারী সাইবার আক্রমণের শিকার হয়ে প্রতিকার চেয়ে অভিযোগ করেছেন। প্রাপ্ত অভিযোগ থেকে অনলাইনে হেনস্তার ধরনের মধ্যে দেখা গেছে- ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশ, ফেসবুক হ্যাকিং, ব্ল্যাকমেইলিং, ফেক আইডি, সাইবার বুলিং, আপত্তিকর পোস্ট, ফোনালাপ, মেসেজিং ইত্যাদি। এছাড়া “টেকনোলজি ফ্যাসিলিটেড জেন্ডার বেইজড ভায়োলেন্স: গ্রোইং থ্রেটস অ্যান্ড এক্সপ্লোরিং রিমিডিজ” শিরোনামে এক গবেষণায় সাইবার স্পেসে ৯ ধরনের অপরাধ চিহ্নিত হয়েছে। যেমন- সেক্সটোরশন, ব্যক্তিগত ছবি ব্যবহার করে অপরাধ, ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশ করার হুমকি, সাইবার বুলিং, স্টকিং, হ্যাকিং, হেট স্পিচ, অনলাইন ইমপার্সোনেশন এবং প্রযুক্তির সহায়তায় অবস্থান নির্ণয় করে হুমকি ইত্যাদি। ২০২৩ সালে অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, অনলাইন ব্যবহারকারী নারীদের মধ্যে প্রায় ৬৪ শতাংশ নারী জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে সাইবার হেনস্তার শিকার হয়েছেন। এই হেনস্তার মধ্যে রয়েছে-অশালীন বার্তা পাঠানো, অনুমতি ছাড়া ছবি প্রকাশ করা, ব্ল্যাকমেইল করা, অপমানজনক মন্তব্য করা, কিংবা যৌন প্রস্তাব দেওয়া ইত্যাদি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যেমন ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক ইত্যাদি প্ল্যাটফর্মে এসব ঘটনার হার সবচেয়ে বেশি। অনেক নারী তাদের ব্যক্তিগত ছবি বা তথ্য অনলাইনে প্রকাশ করার পর হ্যাকার বা অসাধু ব্যবহারকারীর হাতে পড়ে বিভিন্নভাবে ব্ল্যাকমেইলের শিকার হচ্ছেন। এমনকি অনেকে লজ্জা ও সামাজিক চাপের ভয়ে মামলা করতে বা প্রকাশ্যে প্রতিবাদ জানাতে সাহস পান না। এতে অপরাধীরা আরও উৎসাহিত হয় এবং একটি ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি হয়। এই সমস্যার পেছনে বেশ কিছু সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক কারণ কাজ করে। সমাজে নারীর প্রতি বিদ্যমান বৈষম্য ও পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি অনলাইন জগতে প্রতিফলিত হয়। অনেক পুরুষ মনে করেন নারীর উপস্থিতি অনলাইনে “নিয়ন্ত্রণের” বা “মূল্যায়নের” বিষয়। তারা নারীর এজেন্সি স্বীকার করতে চান না, বরং মনে করেন নারীর ভুল ধরিয়ে দেয়া, শালীনতার বেড়াজালে আটকে ফেলা, চলাফেরা, পছন্দ-অপছন্দ, ভালো-মন্দ ইত্যাদি সকল কিছু ঠিক করে দেয়ার দায়িত্ব তাদের। এমনকি তারা শাসন করার ক্ষমতাও রাখেন। এই পিতৃতান্ত্রিক মনস্তত্ত্বের কারণে কারো ওপর শাসন-নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা যে তিনি রাখেন না সেটা ভুলে যান। অন্যদিকে নারীকে শাসনের নামে নিয়ন্ত্রণকে সমাজ বেশ লুফে নেয়। একইভাবে কোনো নারীকে অপমান কিংবা দমন করতে চাইলেও একই পদ্ধতিতে অনলাইনে হেনস্তা, বেশ্যাকরণ করা হয়। এগুলোর সবকিছুর পেছনে থাকে মূলত নারীর অগ্রগতিকে বাধা দেয়ার চেষ্টা। নারীর প্রযুক্তির ব্যবহার সম্পর্কে সচেতনতার অভাব তাকে আরো বিপদে ফেলে। ভয়ে নিজেকে গুটিয়ে নেয় এবং ফলশ্রুতিতে নারীর উন্নয়ন বা বিকাশ সেখানেই শেষ হয়ে যায়। একজন নারীর জন্য নিরাপদ অনলাইন প্ল্যাটফর্ম যেমন তৈরি করা যায়নি, একইভাবে অনলাইনে হেনস্তাকারীদের বিরুদ্ধে আইনের কার্যকর প্রয়োগও নেই। বর্তমানে সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ-২০২৫ এ এ বিষয়ে সুরক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও, তা ব্যবহারকারীদের বিশেষ করে নারীদের কার্যকরভাবে সুরক্ষা দিতে এখনো পুরোপুরি সফল নয়। অনলাইন হেনস্তা মনস্তাত্ত্বিকভাবে নারীর জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে। এতে ভুক্তভোগীরা আতঙ্ক, উদ্বেগ, আত্মসম্মানহানি ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতায় ভোগেন। কেউ কেউ সামাজিক যোগাযোগ বন্ধ করে দেন, কেউ আবার মানসিক আঘাতে ভোগেন দীর্ঘদিন। গবেষণায় দেখা গেছে, এ ধরনের হেনস্তা অনেক সময় বিষণ্নতা ও আত্মহত্যার চিন্তাকেও উস্কে দেয়। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সমন্বিত উদ্যোগ জরুরি। নারীদের ডিজিটাল নিরাপত্তা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া, স্কুল-কলেজে সাইবার সচেতনতা অন্তর্ভুক্ত করা, সামাজিকভাবে নারীকে দোষারোপের সংস্কৃতি দূর করা–এসব জরুরি পদক্ষেপ। একই সঙ্গে, অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোকেও দায়িত্ব নিতে হবে–দ্রুত রিপোর্টিং ব্যবস্থা, হেনস্তাকারীকে ব্লক ও শাস্তি দেওয়ার কার্যকর প্রক্রিয়া তৈরি করতে হবে। অন্যদিকে, দেশের প্রচলিত আইনে ভুক্তভোগী যেন দ্রুত আইনি পদক্ষেপ নিতে পারে সেদিকে সংশ্লিষ্টদের মনোযোগ দিতে হবে; কারণ বর্তমানে যে প্রক্রিয়ায় আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয় তা সময় সাপেক্ষ এবং জনবান্ধব নয়। দ্রুত এবং কার্যকর পদক্ষেপ ছাড়া যেকোনো অপরাধকে সহজে কমিয়ে আনা সম্ভব নয়। সবশেষে বলা যায়, অনলাইন হেনস্তা কেবল প্রযুক্তিগত নয়- এটি একটি সামাজিক ও মানবিক সংকটও। নারীর সম্মান, মর্যাদা, নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হলে সমাজের প্রতিটি স্তরে সচেতনতা, সম্মিলিত পদক্ষেপের পাশাপাশি দ্রুত আইনি পদক্ষেপ হতে পারে কার্যকর পথ। এর মাধ্যমে ভয়মুক্ত চিত্তে অনলাইনে নারী অবাধে বিচরণ করুক–এটিই সকলের প্রত্যাশা।