সংবিধান নিয়ে সিপিবির ভাবনা
Posted: 12 অক্টোবর, 2025
দীর্ঘ দিনের ধারাবাহিক গণ-সংগ্রামের পরিণতিতে ১৯৭১ সালে এ ভূখণ্ডের মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক নীতিমালার ক্ষেত্রে এক অনন্য ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সেসব নীতিমালাকে ঘিরে সে বছরের ১০ এপ্রিল ঐতিহাসিক ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ জারি করা হয়। এ ঘোষণাপত্রকে সামনে রেখে মহান মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে গঠিত হয় বাংলাদেশ।
স্বাধীন দেশে ‘জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা’ এই চার মূলনীতিকে ভিত্তি করে প্রণয়ণ করা হয় সংবিধান। তা নিয়ে ১৯৭২ সাল থেকে শুরু করে ২০২৪ সালে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিটির সভাতেও বিভিন্ন ভাবনা, সংযোজন-বিয়োজন বা সংশোধনের কথা জানিয়েছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবি। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু দলিল-চিঠি তুলে ধরা হল একতার পাঠকদের জন্য।
সংবিধান বিল সম্পর্কে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির অভিমত
(১৯৭২ সালে ১৮ অক্টোবরে সিপিবির সম্পাদকমণ্ডলীতে গৃহীত প্রস্তাব)
এক প্রচণ্ড রক্তক্ষয়ী লড়াই এর ভিতর দিয়া আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের এক বছরের মধ্যেই আমাদের দেশের জন্য একটি সংবিধান গৃহীত হইতে চলিয়াছে। ইহা দেশের ভবিষ্যতের জন্য আশাপ্রদ ও কল্যাণকর।
দেশ শাসন ও গঠনের ক্ষেত্রে দেশের সংবিধান একটি মৌলিক দলিল। সমগ্র দেশের স্বার্থ ও ভবিষ্যতের সাথে ইহা সম্পর্কিত। সুতরাং গণপরিষদ কর্তৃক এই দলিল গৃহীত হইবার পূর্বে সময়াভাবে সমগ্র দেশবাসীর মধ্যে ইহা প্রচার করা এবং তাহাদের মতামত গ্রহণ করা অসুবিধাজনক হইলেও, এই বিষয়ে অন্ততঃ স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী সকল দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলসমূহ এবং প্রতিষ্ঠানগুলির পরামর্শ গ্রহণ একান্ত জরুরী ছিল। সংবিধানের পক্ষে সমগ্র জনতার পরিপূর্ণ সমর্থন লাভের ক্ষেত্রে উহা সহায়ক হইত। মনে হয় শাসক দলের সংকীর্ণ দলীয় চিন্তার ফলে তাহা সম্ভব হয় নাই।
যাহা হউক, গণ পরিষদের সদস্যবর্গ এবং সরকারী দল যথোপযুক্ত গুরুত্ব দিয়া বিবেচনা করিবেন, এই আশায় আমরা সংবিধান বিল সম্বন্ধে কয়েকটা প্রস্তাব উপস্থিত করিতেছি।
সংবিধান বিল সম্পর্কে আমাদের বিস্তৃত বক্তব্যে আসার পূর্বে একটা কথা স্পষ্ট করিয়া নেওয়া দরকার যে সংবিধানের বিল গণপরিষদে উত্থাপন করা হইয়াছে উহাকে আমরা একটা সমাজতান্ত্রিক সংবিধান বলিয়া মনে করি না। সমাজতন্ত্রের মর্মকথা হইল, জমি, কলকারখানা প্রমুখ সমুদয় উৎপাদনের উপায়গুলির উপর ব্যক্তিগত মালিকানার বিলোপ করিয়া সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা করা এবং মানুষের উপর মানুষের শোষণ চিরতরে দূর করা। সমাজতান্ত্রিক সমাজে সমুদয় জাতীয় সম্পদের মালিক হইল শ্রমিক, কৃষক তথা দেশের সমগ্র মেহনতী জনগণ। সমাজতান্ত্রিক সংবিধানে এই মেহনতী মানুষের স্বার্থ ও কল্যাণ সাধনের উপরই সামগ্রিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়। আমাদের দেশের বর্তমান সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থায় এবং বর্তমান গণ পরিষদের নিকট হইতে আমরা একটা সমাজতান্ত্রিক সংবিধান আশা করি না। সংবিধান বিলে রাষ্ট্রের যে সকল মূল নীতি ঘোষণা করা হইয়াছে, যথা গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র, ক্রমে সেইগুলি পূরণ করিবার ক্ষেত্রে সংবিধানের ধারাসমূহ সহায়ক হইবে কিনা তাহাই আমাদের মূল বিবেচ্য।
গণপরিষদে যে সংবিধান বিল উত্থাপন করা হইয়াছে সাধারণ ভাবে উহাকে আমরা একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান বলিয়া বিবেচনা করি। কিন্তু সংবিধান বিলে এমন কতকগুলি ধারা-উপধারা রহিয়াছে যেগুলি অগণতান্ত্রিক এবং এই বিলে এমন কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উল্লেখ নাই যাহার ফলে জনকল্যাণের পক্ষে বিঘ্ন সৃষ্টি হইতে পারে। সেইগুলি বিবেচনা করিয়া সংবিধানকে একটা প্রকৃত গণতান্ত্রিক ও জনকল্যাণকর সংবিধানে পরিণত করিবার জন্য, সংবিধান বিলটি সংশোধন করিবার জন্য আমরা একেবারে নিম্নতম কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব উত্থাপন করিতেছি। আমাদের প্রস্তাবগুলি নিম্নরূপ:
রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি বিষয়ক
১. সংবিধান বিলের দ্বিতীয় ভাগে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিগুলির মধ্যে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, আমাদের দেশ হইতে সকল প্রকার সাম্রাজ্যবাদী, সামন্তবাদী ও আধা-সামন্ততান্ত্রিক এবং অবাধ ধনতান্ত্রিক শোষণ উচ্ছেদ করা হইবে। সংবিধানের ১৪ নং ধারাটি এই মর্মে সংশোধন করা চলে বা নূতন একটি ধারা সংযোজন করিয়াও রাষ্ট্রের এই মৌলিক দায়িত্বের কথা উল্লেখ করা যায়। একথা বলা বাহুল্য যে, সকল প্রকার সাম্রাজ্যবাদী, সামন্ততান্ত্রিক ও অবাধ ধনতান্ত্রিক শোষণ হইতে দেশকে মুক্ত না করিয়া মেহনতী মানুষকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তিদানের আশ্বাস শুধু আশ্বাসই থাকিয়া যাইবে।
২. সংবিধান বিলের দ্বিতীয় ভাগে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসাবে ইহাও ঘোষণা করা প্রয়োজন যে, রাষ্ট্রায়ত্ত খাতকে জাতীয় অর্থনীতির মূল, প্রধান এবং সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ খাতে পরিণত করা হইবে; এবং ব্যক্তিগত মালিকানাধীন শিল্পের পরিচালনা, নিয়ন্ত্রণ ও মুনাফা বণ্টনের ক্ষেত্রে আইন প্রণয়ন করিতে পারিবে। সংবিধান বিলের ১৩নং ধারায় মালিকানা সম্বন্ধে যে সকল কথা বলা হইয়াছে সেই সঙ্গে উপরোক্ত মর্মে দুইটি ধারা না থাকিলে ক্রমে ব্যক্তিগত মালিকানাকে খর্ব করিয়া সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি গঠনের পথে অগ্রসর হওয়ার ঘোষণা একটা বাগাড়ম্বরে পরিণত হইবার আশঙ্কা রহিয়াছে। বর্তমানে ১৩নং ধারা যেভাবে আছে তাহাতে ব্যক্তিগত মালিকানাই, প্রধান মালিকানা ব্যবস্থাতে পরিণত হওয়ার পক্ষে কোন রকম বাধা নাই।
৩. দ্বিতীয় ভাগে মূল নীতির মধ্যে এমন একটি ধারা থাকা দরকার যাহাতে সমাজ হইতে দুর্নীতি দমনকে রাষ্ট্র একটা মৌলিক দায়িত্ব হিসাবে গ্রহণ করে। সামজিক দুর্নীতি যে আমাদের দেশে জনজীবনের একটা প্রধান সমস্যা সে কথা উল্লেখ না করিলেও চলে। তাই মূল নীতির মধ্যে এই ধরণের একটি ধারা যোগ করা দরকার:
“ভোজ্যপণ্য ও ঔষধে ভেজাল, ঘুষ, দুর্নীতি, চোরাকারবার, মজুতদারী ও মুনাফাখোরী সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করা রাষ্ট্রের অন্যতম মূল দায়িত্ব হইবে।”
৪. গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারত এবং সোভিয়েট ইউনিয়ন সহ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলির সাথে মৈত্রী ও সহযোগিতা ব্যতীত যেমন আমাদের স্বাধীনতা অর্জন সুকঠিন ছিল তেমন এই সকল রাষ্ট্রের সাহায্য ও সহযোগিতা ছাড়া আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে সুরক্ষিত করা এবং আমাদের দেশের অগ্রগতিও সম্ভব নয়। তাহা ছাড়া সাম্রাজ্যবাদী জোটগুলির সাথে গাঁটছড়া বাঁধা থাকিলে দেশের অর্থনীতি যে নিজ পায়ে দাঁড়াইতে পারে না বরং দেশের সামাজিক অর্থনৈতিক ও গণতান্ত্রিক বিকাশের ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপের সুযোগ দেওয়া হয়—-এগুলি আমাদের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা। তাই মূলনীতির ২৫ নং ধারাকে নিম্নরূপে সংশোধন করা প্রয়োজন:
“জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও সমতার প্রতি শ্রদ্ধা, শান্তিকামী ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী রাষ্ট্রসমূহ ও সমাজতান্ত্রিক শিবিরের রাষ্ট্রগুলির সাথে মৈত্রী ও সহযোগিতা, সাম্রাজ্যবাদী জোটসমূহে যোগ না দেওয়া, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, আন্তর্জাতিক বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং আন্তর্জাতিক আইনের ও জাতিসংঘের সনদে বর্ণিত নীতিসমূহের প্রতি শ্রদ্ধা- এই সকল নীতি হইবে রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভিত্তি...।”
মৌলিক অধিকার বিষয়ক
৫. সংবিধানের তৃতীয়ভাগে মৌলিক অধিকারের মধ্যে জনজীবনের নিম্নতম অধিকারগুলিরও কোন উল্লেখ নাই। একথা সত্য যে সকলের জন্য উপযুক্ত কাজের অধিকারের নিশ্চয়তা বিধান কিছুটা সময় সাপেক্ষ, কিন্তু খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য প্রভৃতিকেও যদি মৌলিক অধিকারের অন্তর্ভুক্ত করা না হয় তাহা হইলে গণতন্ত্র শুধু মৌখিক গণতন্ত্রই থাকিয়া যাইবে। তাই সংবিধানের তৃতীয় ভাগে মৌলিক অধিকারসমূহের মধ্যে প্রথমেই নিম্নোক্ত ধারাটি সন্নিবেশ করা একান্ত প্রয়োজন:
“প্রত্যেক নাগরিকের অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, নিঃখরচায় ৭ বছর হইতে শুরু করিয়া ১৪ বছর পর্যন্ত শিক্ষালাভ, নিঃখরচায় চিকিৎসা লাভ, কাজের জন্য যুক্তিসঙ্গত মজুরী, সামাজিক নিরাপত্তা এবং যুক্তিসঙ্গত বিশ্রাম ও অবকাশের অধিকার থাকিবে।”
৬. ধর্মঘটের অধিকার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত শ্রমিক শ্রেণীর একটি গণতান্ত্রিক অধিকার। এই অধিকারকে অস্বীকার করিয়া দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভবপর নয়। উহার ফলে বরং দেশে আমলাতন্ত্রের যথেচ্ছাচার এবং ধনিক শ্রেণীর অবাধ শোষণ ও জাতীয় অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ধ্বংসাত্মক ভূমিকা অবলম্বনের আশঙ্কা দেখা দিবে। তাই ৩৭ নং ধারাটিকে সংশোধন করিয়া নিম্নরূপে লেখা দরকার:
“জনশৃঙ্খলা ও জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধানিষেধ সাপেক্ষ শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হইবার, জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করিবার এবং ধর্মঘট করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।”
৭. ৪৭ নং ধারায় সম্পত্তি রাষ্ট্রায়ত্তকরণের বিধান রহিয়াছে। কিন্তু আমাদের সংবিধান একটি লিখিত সংবিধান বিধায় ইহাতে ক্ষতিপূরণ সম্বন্ধে কোন উল্লেখ না থাকায় বিচারালয় এই সম্বন্ধে তাদের বিবেচনামত রায় প্রদান করিয়া সমগ্র ধারাটির উদ্দেশ্যই ব্যর্থ করিয়া দিতে পারেন। সুতরাং ৪৭ নং ধারাটির (১) (ক) উপধারা নিম্নরূপে সংশোধিত আকারে লিপিবদ্ধ করা দরকার:
“বিনা ক্ষতিপূরণে অথবা ক্ষতিপূরণ দিয়া কোন সম্পত্তি বাধ্যতামূলকভাবে গ্রহণ, রাষ্ট্রায়ত্তকরণ বা দখল কিংবা সাময়িকভাবে বা স্থায়ীভাবে কোন সম্পত্তির নিয়ন্ত্রণ বা ব্যবস্থাপনা;”
প্রধান মন্ত্রী ও মন্ত্রী সভা বিষয়ক
৮. সংবিধান বিলের চতুর্থ ভাগে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ এবং প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক আইন সভা ভাঙ্গিয়া দিবার যে বিধান রহিয়াছে সেইগুলি গণতন্ত্র বিরোধী বিধান। এই বিধানগুলির ফলে রাজনৈতিক দলগুলির গুরুত্ব লোপ পাইবে এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যকলাপ তাঁহার রাজনৈতিক দল কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত না হইয়া, তিনিই বরং তাঁহার রাজনৈতিক দলকে নিয়ন্ত্রণ করিবেন। সুতরাং ৫৬ ধারার (৩) উপধারা এবং ৫৭ধারার (২) উপধারা নিম্নোক্ত সংশোধিত আকারে লিপিবদ্ধ করা উচিত:
(ক) ৫৬ (৩)-“নির্বাচনে যে রাজনৈতিক দল সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করিবে সেই রাজনৈতিক দলের সংসদ সদস্যরা যাঁহাকে সংসদীয় নেতা নির্বাচন করিবেন, রাষ্ট্রপতি তাঁহাকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করিবেন।”
(খ) ৫৭ (২)- “সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের সমর্থন হারাইলে প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করিবেন। তখন সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদ সদস্যরা অন্য কোন সংসদ সদস্যকে সংসদীয় নেতা নির্বাচন করিলে রাষ্ট্রপতি তাঁহাকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করিবেন। কোন সংসদ সদস্য অধিকাংশ সংসদ সদস্যের সমর্থন না পাইলে রাষ্ট্রপতি সংসদ ভাঙ্গিয়া দিবেন।”
আইন সভা বিষয়ক
৯. সংবিধান বিলের ৬৫ নং ধারায় আগামী ১০ বৎসরের জন্য মহিলাদের জন্য ১৫টি সংসদ সদস্যের আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হইয়াছে। আমরা এই বিধানটিকে যুক্তিযুক্ত মনে করি। কিন্তু এই ধারায় নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের দ্বারা যে ভাবে মহিলা সংসদ সদস্যাদের নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হইয়াছে তাহা একটা অগণতান্ত্রিক পদ্ধতি। ইহা মহিলা সমাজের অধিকার সংরক্ষণের ব্যবস্থা না করিয়া শুধু শাসক রাজনৈতিক দলের সদস্য সংখ্যাই বৃদ্ধি করিবে। তাই সংরক্ষিত মহিলা আসনে নির্বাচনের জন্য আমরা নিম্নোক্ত সুপারিশ করিতেছি:
“মহিলাদের জন্য ১৫টি সংরক্ষিত আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচনের জন্য দেশকে ১৫টি নির্বাচন এলাকায় বিভক্ত করিতে হইবে এবং সেই সকল এলাকার মহিলা ভোটাররা সরাসরিভাবে তাঁহাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করিবেন।
দ্রুত নির্বাচন সমাধানের জন্য এই পদ্ধতি বিশেষ অসুবিধাজনক বিবেচিত হইলে সংসদের প্রথম বারের নির্বাচনের ১৫টি বিশেষ নির্বাচনী এলাকায় বিভক্ত পৌরসভাগুলির এলাকাভুক্ত মহিলা ভোটারদের দ্বারা উক্ত ১৫ জন মহিলা সংসদ সদস্যা নির্বাচিত হইতে পারেন।”
১০. সংবিধান বিলের ৭০ (১) ধারায় এইরূপ বিধান রহিয়াছে যে, কোন সংসদ সদস্য যে কোন কারণে তাঁহার রাজনৈতিক দল হইতে বহিষ্কৃত হইলে তাহাকে সংসদের আসনও হারাইতে হইবে। এই বিধান একান্ত অগণতান্ত্রিক। এই বিধান কার্যকর থাকিলে সংসদ-সদস্যরা তাঁহাদের বিবেক বুদ্ধি অনুযায়ী সংসদে কোন রকম বক্তব্য উপস্থিত করিতে এবং তাহার নির্বাচক মণ্ডলীদের নিকট নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করিতে ভয় পাইবেন। এই বিধান দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা না করিয়া, জনগণের শাসন কায়েম না করিয়া বরং এক ধরণের দলীয় শাসন কায়েম করিবে-জনগণের চেয়ে দলের স্বার্থই বড় হইয়া উঠিবে। অথচ আমাদের দেশে দলত্যাগ একটা বড় ব্যাধি এবং ব্যক্তিগত সুবিধার কারণেও অনেকে দলত্যাগ করেন। এই অবস্থায় আমাদের প্রস্তাব এই যে ৭০ (১) ধারাটি নিম্নোক্ত রূপে সংশোধন করা হউক:
“কোন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হইয়া কোন ব্যক্তি কোন নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হইবার পর তিনি যদি উক্ত দল হইতে পদত্যাগ করেন অথবা আইন সভায় উক্ত রাজনৈতিক দলের নির্দেশ অমান্য করিয়া ভোট প্রয়োগ করেন তাহা হইলে এই অনুচ্ছেদের (২) দফার বিধানাবলী অনুযায়ী তাঁহার আসন শূন্য হইবে।”
১১. সংবিধান বিলের ৭৬ (১) ধারায় সংসদ সদস্যদের নিয়া কয়েকটি স্থায়ী কমিটি গঠনের বিধান রহিয়াছে। এইগুলির মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত সরকারী খাতের জন্য একটি স্থায়ী কমিটির উল্লেখ করিতে হইবে। এই কমিটি রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের শিল্প প্রভৃতি তদারক করিবেন এবং ঐ গুলির পরিচালনা ও উন্নতি বিধান সম্পর্কে বৎসরে অন্ততঃ একবার সংসদের নিকট রিপোর্ট পেশ করিবেন।
রাষ্ট্রায়ত্ত খাতকে লাভজনক ও গুরুত্বপূর্ণ খাতে পরিণত করিবার জন্য উহার উপর এই ধরণের গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ একান্ত জরুরী।
পরিশেষে, আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস এই যে, আমাদের দেশের সংবিধানকে একটি যথার্থ গণতান্ত্রিক ও জনকল্যাণকর, সংবিধান করিবার উদ্দেশ্যে আমরা উপরে যে সকল সংশোধন ও সংযোজনের প্রস্তাব দিয়াছি, গণপরিষদ সেইগুলি গ্রহণ করিয়া সংবিধান বিলটি সংশোধন করিয়া গ্রহণ করিলে উক্ত গণতান্ত্রিক সংবিধান আমাদের দেশের শ্রমিক কৃষক তথা সমগ্র মেহনতী মানুষের মনে দৃঢ় আস্থা ও উদ্দীপনার সৃষ্টি করিবে এবং জনগণের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে আমাদের দেশকে শান্তি, সমৃদ্ধি ও প্রগতির পথে তথা অবাধ পুঁজিবাদের পথ পরিহার করিয়া দেশকে সমাজতন্ত্রের পথে অগ্রসর করিয়া নিবার সুযোগও সম্ভাবনার সৃষ্টি হইবে।
***
সংবিধানের অসম্পূর্ণতা দূর করার লক্ষ্যে
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) বক্তব্য
৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ঢাকা
১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল গৃহীত “স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের” অঙ্গীকারকে অবলম্বন করে ১৯৭২-এ প্রণীত সংবিধানের মূলভিত্তি অর্থাৎ চার মূলনীতি ঠিক রেখে প্রয়োজনীয় সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ত্রুটি, দুর্বলতা ও অসম্পূর্ণতা দূর করে সংবিধানের পূর্ণতা আনার জন্য সিপিবির কতিপয় প্রস্তাবনা।
ভূমিকা
এই দেশের জনগণের দীর্ঘ দিনের ধারাবাহিক গণ-সংগ্রামের পরিণতিতে ১৯৭১ সালে সশস্ত্র জনযুদ্ধে হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। এসব গণ-সংগ্রামের মাধ্যমে জনগণের মাঝে রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক নীতিমালার ক্ষেত্রে এক অনন্য ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সেসব নীতিমালাকে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিবৃন্দ গণপরিষদ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন এবং ঐতিহাসিক ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ জারি করেছিল। এই ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ দেশবাসীকে ইস্পাতদৃঢ় ঐক্যে আবদ্ধ করে মরণপণ সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেছিল। সেই ভিত্তিতেই ৯ মাস জুড়ে সশস্ত্র জনযুদ্ধ সংগঠিত করে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধে এক অনন্য বিজয় অর্জিত হয়েছিল।
সেই ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে’ বলা হয়েছিল যে “বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করণার্থে, সার্বভৌম, গণপ্রজাতন্ত্র রূপে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করিলাম।”
দেশ হানাদার বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত হওয়ার পর গণপরিষদ দেশের সংবিধান প্রণয়ন করেছিল। তাতে সাধারণভাবে ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে’র অঙ্গীকারের প্রতিফলন থাকলেও, কিছু ত্রুটি, ঘাটতি ও ব্যত্যয় ছিল। উপযুক্ত সংশোধণীর মাধ্যমে সেসব দুর্বলতা দূর করার বদলে, সামরিক ফরমান জারি, কর্তৃত্ববাদী হুকুমদারী ইত্যাদির মাধ্যমে সেই সংবিধানকে এমনভাবে ক্ষত-বিক্ষত করা হয়েছে যে সেটি এখন গণতন্ত্রের বাহক না হয়ে স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট শাসন এবং লুটপাট-শোষণ-বৈষম্যের লালনকারী ও হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। এর প্রতিবিধানকল্পে উচ্চ আদালত একাধিকবার এসব বিকৃতিকে অবৈধ ঘোষণা করলেও লুটেরা শোষকরা সংবিধানকে আবারো ক্ষতবিক্ষেত করেছে।
এমতাবস্থায় উপযুক্ত সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ত্রুটিগুলো দূর করে একে তার ক্ষতবিক্ষত হাল থেকে উদ্ধার করা প্রয়োজন।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণপত্র ও তার আলোকে ১৯৭২ সালে গৃহীত সংবিধানের চার ‘মূলনীতিকে’ ভিত্তি হিসাবে ঠিক রেখে আমরা কয়েকটি সংশোধনী প্রস্তাব উপস্থিত করছি।
জনগণের সম্মতি নিয়ে এসব সংশোধনী কার্যকর করতে হবে। অন্য কোনো পন্থায় তা স্থায়ী হবে না। এই বিষয়ে উদ্যোগ ও পদক্ষেপ নেওয়ার দায়িত্ব অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত জাতীয় সংসদেরই রয়েছে। কিন্তু এর পেছনে জনগণের সচেতন সমর্থন থাকতে হবে। তাই প্রয়োজন, সংবিধানের সংশোধনী প্রস্তাবগুলো নিয়ে সর্বস্তরের মানুষের মাঝে খোলামেলা আলোচনা হওয়া।
বর্তমান অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার সেক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে এবং এই বিষয়ে ঐক্যমত্য গড়ে তোলার কাজ অনেকটা পরিমাণে অগ্রসর করতে সহায়ক ভূমিকা নিতে পারে।
এসব বিষয়ে আলোচনা ও মত বিনিময়ের জন্য আমরা নিম্নোক্ত প্রস্তবনাগুলো হাজির করছি। এসব প্রস্তাবসহ অন্যান্য প্রস্তাবনা নিয়ে আমরা খোলা মনে সব বিষয়ে আলোচনা করতে প্রস্তুত ও আগ্রহী।
প্রস্তাবিত সংশোধনীসমূহ
প্রস্তাবনায়
পঞ্চম প্যারায় ‘এতদ্বারা’ শব্দের পর “১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল তারিখের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে গঠিত” শব্দসমূহ যুক্ত করতে হবে।
প্রথম ভাগ : প্রজাতন্ত্র
২। ২ ক. এই ক্ষেত্রে সংবিধানের আদিপাঠ অনুসরণ করতে হবে, অর্থাৎ তা বাতিল হবে।
৩। ৪ ক. এই অনুচ্ছেদের ক্ষেত্রে সংবিধানের আদি পাঠ অনুসরণ করতে হবে, অর্থাৎ তা বাতিল হবে।
৪। ৬ ২. এই উপঅনুচ্ছেদটি নিম্নোক্তভাবে পুনরায় লিখিত হবে-
“বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে জাতি হিসাবে রহিয়াছে বাঙ্গালী এবং আদিবাসীসহ অপরাপর জাতিগোষ্ঠী এবং সকলেই সমমর্যাদাসম্পন্ন এবং রাষ্ট্রের সম্মুখে তাহারা সকলেই সমসত্ত্বাসম্পন্ন নাগরিক হিসাবে গণ্য হইবেন”
দ্বিতীয় ভাগ : রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি
আদি সংবিধানে যা ছিলো তা হুবহু বহাল থাকবে। তবে শুধু ২টি ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত সংশোধনী সম্পন্ন করতে হবে।
৫। ‘বাঙালি জাতি’ প্রথম বাক্যের এই শব্দগুলোর পর যুক্ত হবে “ও অন্যান্য জাতি গোষ্ঠী” এবং “সেই বাঙালি” শব্দগুলির পর “.....ও অপরাপর জাতি গোষ্ঠীর” শব্দগুলো যুক্ত হবে।
৬। ২৩ ক. এই অনুচ্ছেদটি নিম্নোক্তভাবে পুনঃলিখিত হবে-
“রাষ্ট্র বাঙ্গালীর পাশাপাশি আদিবাসী ও অপরাপর সকল ভাষাভাষী জাতিগোষ্ঠীর অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন”
তৃতীয় ভাগ : মৌলিক অধিকার
২৮. অনুচ্ছেদের পরে অথবা উপযুক্ত অন্য কোনো স্থানে নিম্নলিখিত অনুচ্ছেদটি যুক্ত হবে-
“প্রতিটি নাগরিকের জন্য অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরনের ব্যবস্থা করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের ওপর ন্যাস্ত থাকিবে”
৮। ৩৩. এই অনুচ্ছেদের (৩), (৪), (৫) এমনভাবে সংশোধন করে পুনঃলিখন করা হবে যাতে করে নিবর্তনমূলক আইনে আটক করার বিধানের কোন প্রকার অপব্যবহার না হতে পারে এবং তা যেন একটি নিবর্তনমূলক কালোকানুনে পরিগণিত না হয়।
৯। ৩৮. এই অনুচ্ছেদের দ্বিতীয় প্যারাতে সংবিধানের আদি পাঠে যা ছিলো এইখানে হুবহু তা নিম্নোক্ত রূপে পুনঃস্থাপিত হবে-
“তবে শর্ত থাকে যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সম্পন্ন বা লক্ষ্যানুসারী কোন সাম্প্রদায়িক সমিতি বা সঙ্ঘ কিম্বা অনুরূপ উদ্দেশ্য সম্পন্ন বা লক্ষ্যানুযায়ী ধর্মীয় নামযুক্ত বা ধর্মভিত্তিক অন্য কোনো সমিতি বা সংঘ গঠন করবার বা তার সদস্য হইবার অন্য বা কোনো প্রকারে তার তৎপরতায় অংশগ্রহণ করিবার কোনো অধিকার কোনো ব্যাক্তির থাকিবে না”
১০। ৩৯ খ. ‘নিশ্চয়তা’ শব্দের পরে ‘দান করা হইল’ স্থলে লেখা হবে “থাকিবে”।
১১। ৪৮ (৩) এই অনুচ্ছেদের এই ধারায় “...বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাতিত” শব্দগুলোর পরে যুক্ত হবে-“এবং ৮০(৩) দফা অনুসারে অর্থবিল ব্যাতিত অন্য কোন বিলের ক্ষেত্রে নিজস্ব বিবেচনা হইতে তাহা বা তাহার কোন সংশোধনী পুনর্বিবেচনার জন্য সংসদের কাছে ফেরত দেওয়া” শব্দগুলো যুক্ত করা হবে।
চতুর্থ ভাগ : নির্বাহী বিভাগ
১২। ৫৬. (৩ক) হিসাবে নিম্নোক্ত নতুন ধারাটি যুক্ত হবে-“তবে শর্ত থাকে যে তিনি ইতোপূর্বে দুই মেয়াদকাল প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন নাই।”
২. ক পরিচ্ছেদ : নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার
সংবিধানের ২. ক পরিষদ হিসাবে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধমে যে অনুচ্ছেদ সন্নিবেশিত হয়েছিল এর স্থলে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তদারকি সরকার লেখা ও তার কাজ সুনির্দিষ্ট করা সংশোধনীসহ পুনরায় স্থাপিত হইবে।
৩ .পরিচ্ছেদ : স্থানীয় শাসন
১৩। ৫৯ ১. “... স্থানীয় শাসনের” পরে ‘পরিপূর্ণ’ শব্দটি যুক্ত হবে। ‘স্থানীয় সরকার’ হতে পারে।
১৪। ৬০. এই অনুচ্ছেদে “স্থানীয় প্রয়োজনে” শব্দগুলোর পর “জাতীয় বাজেটের সংবিধিবদ্ধভাবে নির্দিষ্টকৃত একটি অংশ বরাদ্দ করিবে এবং এই সব সংস্থাকে স্থানীয়ভাবে অবস্থা অনুযায়ী”-এই শব্দগুলো যুক্ত হবে।
পঞ্চম ভাগ : আইনসভা
১৫। ৬৫ ২. সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হবে। এই বিষয়ে বিস্তারিত ধারা-উপধারা প্রস্তুত করতে হবে।
১৬। ৬৫ ৩. নারী আসনে প্রত্যক্ষ ভোটে ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হবে এবং সে বিষয়ে বিস্তারিত ধারা-উপধারা রচনা করে তা সন্নিবেশিত করতে হবে।
১৭। ৬৬. ৬৭. এই অনুচ্ছেদে বা অন্য কোনো উপযুক্ত স্থানে “সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি ব্যবস্থা প্রবর্তন” না হওয়া পর্যন্ত ‘না’ ভোট প্রদানের এবং ভোটারগণ কতৃক সংসদে তাদের প্রতিনিধিত্বকারী সদস্যকে প্রত্যাহার করার অধিকার (জরমযঃ ঃড় জবপধষষ) প্রদান এবং তার প্রয়োগের বিধানসমূহ সন্নিবেশিত করতে হবে।
১৮। ৭০ (খ) ‘সংসদে’ শব্দের পর “আস্থা ভোটের ক্ষেত্রে” শব্দগুলো যুক্ত হবে।
১৯। ৭২ ১. এই উপধারার শেষ প্যারা “তবে আরও শর্ত থাকে যে, ... কার্য করবেন” বাদ যাবে (কারণ এটি সব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, তা অন্যত্র ৪৮ ৩. ধারায় সাধারণভাবে বর্ণীত আছে।)
২০। ৭৫ ২. “ষাটের”এর স্থলে “একশত জন” প্রতিস্থাপিত হবে।
২১। ৭৭ ১. প্রথম বাক্যের শেষে “করতে পারবেন” শব্দগুলোর স্থলে “প্রণয়ন এবং সেই পদে ১ জন ব্যাক্তিকে নির্বাচন করিবেন” শব্দগুলো প্রতিস্থাপিত করা হবে।
২২। ৮০ ৩. “তহবিল ব্যাতিত অন্য কোনো বিলের ক্ষেত্রে” এর পরে নিম্নোক্ত শব্দগুলো যুক্ত হবে “প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ব্যতিরেকে নিজস্ব বিবেচনা হইতেও” শব্দগুলো যুক্ত হবে।
ষষ্ঠ ভাগ : বিচারভাগ
বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে পরিচালনার জন্য আলোচনা করে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনতে হবে।
[অন্যান্য ভাগে কোথায় কোথায় সংশোধনী দরকার বলে আমরা মনে করি,
তা পরবর্তীতে প্রয়োজন মতো জানানো হবে]
***
জাতীয় ঐকমত্য কমিটির প্রতি
৩ জুন ২০২৫-এ বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) চিঠি
প্রতি
জনাব অধ্যাপক আলী রিয়াজ
সহ-সভাপতি
জাতীয় ঐকমত্য কমিটি
প্রিয় মহোদয়
শুভেচ্ছা জানবেন।
আজকের আলোচ্য বিষয়ে আমাদের মতামত বিগত সভায় উল্লেখ করেছি। এখন লিখিতভাবে আমাদের মতামত আবারও জানাচ্ছি। আশা করি ঐকমত্যের ভিত্তিতে সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে।
আমাদের মতামত নিম্নরূপ :
নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে নির্বাচিত জাতীয় সংসদ বর্তমান সংবিধানের অসম্পূর্ণতা দূর করতে প্রয়োজনীয় সংশোধন সংযোজন করবে।
১. দলের বিপক্ষে ভোট দান : অনুচ্ছেদ ৭০
-আস্থা ভোট ও অর্থবিল ব্যতীত, ‘নিম্ন’ কথা লেখার প্রয়োজন নেই।
২. স্থায়ী কমিটিসমূহ
-সাধারণভাবে ঠিক আছে।
তবে সংসদীয় সব কমিটি না অধিকাংশ কমিটির কথা বলবেন, এটা আলোচনা করে ঠিক করা প্রয়োজন। আমরা অধিকাংশ কমিটির কথা বলতে চাই।
৩. নিম্নকক্ষের আলোচনার প্রয়োজন নেই।
-আমরা বর্তমান সংসদ ব্যবস্থা বহাল রেখে এগোতে চাই। উচ্চকক্ষ-নিম্নকক্ষের প্রয়োজন নেই বলে মনে করি।
-বর্তমান সংরক্ষিত নারী আসন ১০০-তে উন্নীত করা, যা নির্বাচিত সংসদ সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে করবে।
৪. তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা বলা এবং ওই সরকারের কার্যাবলি সুনির্দিষ্ট করা প্রয়োজন বলে মনে করি।
-মেয়াদ ৩ মাস। জাতীয় সংসদ নির্বাচন করবে। স্থানীয় সরকার নির্বাচন হবে নির্বাচন কমিশনের অধীনে।
নারী আসন :
-জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় সরকারের ঘূর্ণায়মান পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা হতে পারে। এ বিষয়ে আগামীতে নির্বাচিত সরকার রাজনৈতিক দলসহ নারীসমাজের প্রতিনিধি ও বিভিন্ন সংগঠন সঙ্গে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে
২৪ আগস্ট ২০২৫-এ দেওয়া চিঠি
বরাবর
সহ-সভাপতি
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন
এলইডি জাতীয় সংসদ ভবন
শেরে বাংলা নগর, ঢাকা
বিষয় : জুলাই জাতীয় সংসদ ২০২৫ এর পূর্ণাঙ্গ সমন্বিত খসড়া (সংশোধনী) প্রসঙ্গে।
প্রিয় মহোদয়
শুভেচ্ছা জানবেন।
উপরে উল্লেখিত বিষয়ে ইতোপূর্বে লিখিতভাবে ও আলোচনার মাধ্যমে আমাদের মতামত জানিয়েছি। তারপরও কিছু কথা জানতে চাই।
(১) ২০২৪ এর ৫ অক্টোবর মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ও জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশনের সভাপতির আমন্ত্রণে বাম গণতান্ত্রিক জোটের পক্ষ থেকে উপস্থিত হয়ে আমাদের লিখিত মতামত উত্থাপন করি। ঐ সময় আলোচনায় ও পরবর্তীতে ফেব্রুয়ারি ২০২৫ এ প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে চলমান সংস্কার নিয়ে এই আলোচনা হয় যে, সংস্কার প্রস্তাবে সব দল ও অংশীজন মিলে যে সব বিষয়ে একমত হওয়া যাবে এটুকুকে ঐক্যমত হিসেবে গ্রহণ করা হবে। এছাড়া কোন কোন বিষয়ে ঊনিশ/বিশ পার্থক্য হলে–ঐ সব ষিয়ে আলোচনা করে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হবে। ঐকমত্য না হেেল তা এসব দলের বক্তব্য হিসেবে তুলে ধরা হবে।
(২) এসব বিবেচনা থেকে আমরা আন্তরিকভাবে আলোচনায় অংশ নেই এবং আমাদের মতামত তুলে ধরি। কয়েকটি বিষয়ে জোরাজুরির প্রেক্ষিতে এসব আলোচনা হয় যে, এখানে আামরা ভিন্ন ভিন্ন দল তাই আদর্শিক বিষযে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা না করা ভালো (যেমন: সংবিধানে বর্ণিত চার মূলনীতি)। অন্যান্য সংস্কারে গুরুত্ব দিতে হবে।
(৩) আলোচনা এক পর্যায়ে চার মূলনীতি বিষয়ে আমাদের সুস্পষ্ট বক্তব্য তুলে ধরে ঘোষণা দিয়ে সভা চূড়ান্তভাবে বর্জন করি। আরো কয়েকটি দলও সভা বর্জন করে।
(৪) ঐ বর্জনের আগে অন্যান্য বিষয়ে, এমনি সনদ এর ভূমিকা, বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে আমরা আমাদের মতামত লিখিতভাবে জানাই।
(৫) আমরা আশা করেছিলাম, সনদ এর পূর্ণাঙ্গ সমন্বিত খসড়া (সংশোধিত) পাঠানোর পূর্বে উল্লেখিত বিষয়ে, বিশেষত সংবিধানের মূলনীতি প্রশ্নে আলোচনার বাইরে রেখে যে সব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, সেসব বিষয়ে বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে প্রস্তাব উত্থাপিত হবে।
এমনকি নোট অফ ডিসেন্ট দিয়ে যে ঐকমত্য বলা হলে, তা ভবিষ্যতে বাস্তবায়ন দূরূহ হয়ে পড়বে, সেসব বিষয়েও আমরা বলেছিলাম।
(৬) আমরা দেখলাম, আমাদের উল্লেখিত প্রস্তাবকে গুরুত্ব না দিয়ে এসব বিষয় পুনরায় উত্থাপিত হলো। এমনকি ইতোপূর্বে পাঠানো ভূমিকা ও বাস্তবায়ন বিষয়ে নতুন অনেক কথা সংযোজন করা হলো। যা সামগ্রিক ঐক্যমতের ক্ষেত্রে আরো সংকট তৈরি করবে বলে মনে করি।
(৭) এরপরও সর্বশেষ পাঠনো খসড়া সম্পর্কে কিছু বক্তব্য তুলে ধরছি।
ভূমিকার প্রথম প্যারার শেষ লাইনে ‘ঐকমত্যে উপনীত হয়েছি’, বলা হয়েছে, এটা যথাযথ নয়, বলা যায় ‘অনেক বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছি’।
(ক) পটভূমিতে পাকিস্তানের জন্ম, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তার অনেক কিছুই অসম্পূর্ণ, একপেশে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত সংবিধানের চার মূলনীতির কথা বলা হয়নি। অবৈজ্ঞানিক দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক ইতিহাস ১৯৫২, ১৯৫৮, ১৯৬৬, ১৯৬৯ ও ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ যথাযথভাবে লেখা প্রয়োজন।
(খ) সংকট তৈরি হয়েছে ৫৩ বছর ধরে, এগুলো না বলে শুধুমাত্র একটা সময়ের কথা বলা হয়েছে। কিছু বিশেষ সময়ের সংকটের কথা বলা হয়েছে, এটা একপেশে ও অগ্রহণযোগ্য। এটাকে গ্রহণযোগ্য করতে পুনর্লিখন করতে হবে।
পটভূমির শেষ প্যারায় দ্বিতীয় লাইনে ‘সংবিধানের মৌলিক সংস্কার’ এর স্থলে সংবিধানের অসম্পূর্ণতা দূর করে গণতান্ত্রিক সংস্কারের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার ... বল যথার্থ মরে করি।
(গ) ঐকমত্য কমিশন গঠন, কমিশন কার্যক্রম ... এত বিস্তারিত লেখা অপ্রয়োজনীয়। এছাড়া ঐকমত্য না বলে কোনো কোনো বিষয়ে ঐকমত্য বলা যথার্থ হবে।
(ঘ) ঐকমত্যে উপনীত বিষয়সমূহ হিসেবে ৮৪টি বিষয় বলা হয়েছে। এটা যথার্থ নয়। যথাযথভাবে আমাদের বক্তব্য লিপিবদ্ধ করা হয়নি। এছাড়া দেখতে পেলাম, সব বিষয়ে সব দলের ঐকমত্য নাই, তাই এসব বিষয় ঐকমত্য বলা মোটেই ঠিক না। আইন সভা, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন অধ্যায়ে বর্ণিত সব বক্তব্যের সাথে আমরা একমত নই। আলোচনায় আমাদের বক্তব্য তুলে ধরেছিলাম। দেখলাম আমাদের দ্বি-মতগুলো সুনির্দিষ্টভাবে তুলে ধরা হয়নি।
(ঙ) এগুলোর মধ্যে কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত সংবিধানের চার নীতি প্রশ্নে ঐক্যমত সম্ভব নয় বলে আমরা এগুলোকে আলোচনার বাইরে রাখার কথা বলেছিলাম। এজন্য আমরা সভা চূড়ান্ত বর্জন করেছিলাম। অথচ এরপরও আমাদের সাথে কথা না বলে প্রকারান্তরে ওই চার মূলনীতি পরিবর্তনের সম্মতি নেওয়ার কথাই বলা হয়েছে। যা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। এভাবে উল্লেখ থাকলে আমাদের পক্ষে এই সনদের পক্ষে থাকা অসম্ভব করে তোলা হয়েছে। মূলনীতি প্রশ্ন বাদ রাখা প্রয়োজন বলে মনে করছি।
(চ) সংবিধান সংশোধনে গণভোট, ৭(ক),৭(খ), ১৫০(২), ৬ষ্ঠ ও ৭ম তফসিল বিলুপ্তি ও সংবিধানে না রাখার সাথে আমরা একমত নই।
(ছ) নারী আসন বিষয়ক প্রস্তাবের সাথে আমরা একমত নই। এটাও আলোচনা থেকে বাদ রাখা দরকার বলে মনে করি।
(জ) এখন দ্বি-কথা বিশিষ্ট পার্লামেন্ট নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন নেই।
(ঝ) সংবিধানে আদিবাসীদের স্বীকৃতির বিষয়টি চূড়ান্ত করা প্রয়োজন।
(ঞ) মৌলিক অধিকারসমূহের তালিকা সম্প্রসারণের বিষয়ে তালিকা সংশোধন নয় সম্প্রসারণ করা এবং এসব বিষয় সুনির্দিষ্ট করার কথা আমরা বলেছি।
(ট) বলা হয়েছে, জাতীয় সনদ ২০২৫ ্এর বিধান প্রস্তাব ও সুপারিশ সাংবিধানিকভাবে আইনগতভাবে বলবৎ হিসেবে গণ্য হবে বিধায় এর বৈধতা প্রয়োজনীয়তা কিংবা জারির কর্তৃত্ব সম্পর্কে কোনো আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না। এটি একটি ভয়ঙ্কর বিষয়। সংবিধান পরিবর্তনের আগে সাংবিধানিক ও আইনগতভাবে বলবৎ হিসেবে গণ্য করার কথা বলা হচ্ছে এবং আদালতে কোনো প্রশ্ন তোলা যাবে না বলে হচ্ছে? এটি কি করে সম্ভব? এসব বক্তব্য সনদকেই অপ্রাসঙ্গিক করে তুলবে। এটা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য।
(ঠ) অঙ্গীকারে বলা হচ্ছে, এই সনদে যা আছে সেগুলো সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে বিদ্যমান সংবিধান অন্য কোনো আইেেন ভিন্নতর কিছু থাকলে সেক্ষেত্রে সনদের বিধান প্রাধান্য পাবে। সংবিধানের ঊর্ধ্বে এভাবে বিবেচনার কোনো সুযোগ থাকাটা গ্রহণযোগ্য নয়।
(ড) সংবিধান সংশোধন পরামর্শ আমরা দিতে পারি এর বেশি নয়। আমরা দেখলাম এখানে সংবিধান সংশোধনের সাথে সাথে পুনর্লিখনের কথাও বলা আছে। অনেকের সংবিধান পুনর্লিখন করতে চাই। তাদের সাথে আমরা নেই। এটা গ্রহণ করা যায় না। এখানে পুনর্লিখন শব্দ বাদ দিতে হবে।
(ঢ) প্রথমে আমাদের কাছে পাঠানো খসড়ায় দেখেছিলাম, সংবিধান সংশোধন বিষয়ক আমাদের পরামর্শ আগামী জাতীয় সংসদ দুই বছরের মধ্যে সম্পন্ন করবে। এবার দেখলাম এমনভাবে লেখা হয়েছে তাতে মনে হয় বর্তমান সরকারকে দিয়েই এসব কাজ সম্পন্ন করতে চান। এটা গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ সংবিধান সংশোধনের অধিকার একমাত্র নির্বাচিত সংসদের, যা সংবিধানে বর্ণিত আছে। আগামীতে নির্বাচিত সংসদ সে বিষয়ে ভূমিকা পালন করবে।
সবমিছিলিয়ে মনে হয়েছে এখানে কোনো কোনো গোষ্ঠীর বয়ানকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। যা ঐকমত্যকে বাধাগ্রস্ত করবে। শুরুর কথা পুনরাবৃত্তি করে বলতে চাই, ঐকমত্যের অর্থ হবে যে বিষয়ে আমরা শতভাগ একমত হয়েছি। আর এগুলো বাস্তবায়ন করবে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত পার্লামেন্ট। প্রস্তাবিত বক্তব্যে কমিশন অনড় থাকলে আমাদের পক্ষে এবং আমাদের ধারণা সব দলের পক্ষে এ বিষয়ে সম্মতি দেওয়া সম্ভব হবে না।
আমরা আশা করবো ঐকমত্য কমিশনের সদস্যবৃন্দের দীর্ঘ পরিশ্রম ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সংগঠন ও ব্যক্তিবর্গের সাথে আলোচনায় সর্বসম্মতিতে ঐকমত্যের বিষয়গুলো নিয়ে ‘সনদ’ তৈরি করা হবে এবং অন্যান্য বিষয় যার যার বক্তব্য হিসেবে তুলে ধরা হবে।
অঙ্গীকারপত্রে পূর্বেকার খসড়ার পাঠানো বক্তব্য ও আমাদের মতামত বিবেচনা করে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত সংসদে গঠিত সরকার আগামী ২ বছরের মধ্যে ঐকমত্যের প্রণীত সনদের সুপারিশ বাস্তবায়নে নিয়মানুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। এখানে বাস্তবায়নের সময়সীমা আলোচনা করে নির্ধারণ করা যেতে পারে।
এর বাইরে অন্য কোনো পদ্ধতি অনৈক্য তৈরি করবে এবং ঘোষিত সময়সীমায় আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকেও অনিশ্চিত করে তুলবে।
আশা করি, সনদে সকলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে কমিশন যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
***
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন
প্রসঙ্গে সিপিবি
(সিপিবির ত্রয়োদশ কংগ্রেসের কেন্দ্রীয়
কমিটির রিপোর্ট থেকে নেওয়া)
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ‘সংস্কার’ কার্যক্রমের কথা বলে ১১টি কমিশন গঠন করে। এসব কমিশনের প্রস্তাব সমূহ নিয়ে দেশের ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দল সমূহের মধ্যে সমঝোতা সৃষ্টির লক্ষ্যে সরকার সংস্কারের বিভিন্ন বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশন গঠন করে। এই কমিশন শুরু থেকেই তাদের বয়ানে সাম্রাজ্যবাদের পদলেহী শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থবিরোধী নীতি, মুক্তিযুদ্ধ এবং তার অর্জনকে নানা অপকৌশলে গুরুত্বহীন করে রাখার নীতি নিয়ে যাত্রা শুরু করে। ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র বাতিলের প্রস্তাবসহ সংবিধান সংক্রান্ত বিষয়ে দেওয়া নানা সংস্কার প্রস্তাবে তাদের সে নীতি স্পষ্ট। ফলে তারা বিতর্কে জড়িয়ে যায়। এই কারণে সমাধানের পথে সংকট বিরাজ করছে।
এর আগে অর্থনৈতিক দুর্নীতি বিষয়ে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি করা হয়। দুর্নীতি বিষয়ক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি যথাসময়ে রিপোর্ট দিলেও এসব নিয়ে আর আলোচনা হয়নি। ১১টি সংস্কার কমিশনের মধ্যে ৫টি কমিশনের কিছু প্রস্তাব নিয়ে দীর্ঘসময় ধরে আলোচনা চলতে থাকে। এখনো চলছে। ২০২৪-এর ৫ অক্টোবর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধানের সঙ্গে বাম গণতান্ত্রিক জোটের বৈঠকে আমরা লিখিতভাবে জানাই যে, সুষ্ঠু, অবাধ গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে।
সেইসঙ্গে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য জাতীয় সংসদে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি প্রবর্তন, স্থানীয় সরকার শক্তিশালী করা, ‘প্রার্থী হওয়া, ভোট দান ও প্রচার’-সব ক্ষেত্রে সমসুযোগ, ‘না’ ভোট প্রচলন, প্রতিনিধি প্রত্যাহার বিধান, নির্বাচনে টাকার খেলা, পেশীশক্তি, সাম্প্রদায়িক প্রচারণা, প্রশাসনিক কারসাজি বন্ধ করাসহ নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তদারকি/তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের সামনে আনার চেষ্টা করা হয়। সরকার সংস্কারের কতক প্রস্তাবকে মৌলিক সংস্কারের প্রস্তাব হিসেবে সামনে এনে আলোচনা শুরু করে। নির্বাচন ব্যবস্থার আমূল সংস্কার প্রস্তাব আড়ালে পড়ে যায়।
সরকারের ওইসব সংস্কার প্রস্তাবে বিশেষ গোষ্ঠীর কিছু বিশেষ প্রস্তাব যেমন, সংবিধানের চার মূলনীতি পরিবর্তন, মুক্তিযুদ্ধকে কৌশলে বিতর্কিত করার বিষয়ে সচেতন থেকে দৃঢ়তার সঙ্গে এর বিরোধিতা করা হয়। ওই সময় অপরাপর সমমনা শক্তিকে কাছে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়ানো এবং আমাদের বক্তব্য দৃশ্যমান করার প্রচেষ্টা নেওয়া হয়।
অন্যদিকে বুর্জোয়া ব্যবস্থার সংসদীয় গণতন্ত্রের ধারায় গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থা ও প্রতিষ্ঠাসমূহকে গড়ে তুলতে সংস্কারের কিছু প্রস্তাবে আলোচনার মধ্য দিয়ে আমাদের ইতিবাচক অবস্থান তুলে ধরি। যেমন: সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ, সংসদীয় কমিটির সভাপতি, বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রিকরণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা সংক্রান্ত বিধান, নির্বাচনী এলাকার সীমা নির্ধারণ, জরুরি অবস্থা ঘোষণা, প্রধান বিচারপতি নিয়োগ, প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার বিধান, মেয়াদ, নির্বাচন কমিশনসহ অন্যান্য সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ, সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব, তত্ত্বাবধায়ক সরকার, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, দায়িত্ব ও ক্ষমতা নাগরিকদের মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ। এসব বিষয়ে মতামত তুলে ধরে বলা হয়, মৌলিক এসব বিষয়সমূহে আগামীতে নির্বাচিত সংসদের জন্য রেখে দিতে হবে, যাতে তারা আইন অনুযায়ী সংস্কার বাস্তবায়ন করতে পারে।
এসব আলোচনায়ও জোর দেওয়া দ্রুততম সময়ে নির্বাচন ও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের। ধৈর্য ধরে আমরা আলোচনায় অংশ নিলেও সংবিধানের চার মূলনীতি নিয়ে নানা কারসাজির প্রভাবে বিরোধিতা করে সভা চূড়ান্তভাবে বর্জনের ঘোষণা দিয়ে বের হয়ে আসতে হয়।
এই পরিস্থিতিতে সরকার ৫ আগস্ট ২০২৫ ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ নামে একটি ঘোষণা পাঠ করে। ওই ঘোষণাপত্র সম্পর্কে সিপিবি বা অধিকাংশ দল আমরা অবহিত নই। তাই ওই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পেলেও আমরা অংশ নেই না। ওই ঘোষণাপত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকার সুযোগ নেই। ইতোমধ্যে পঠিত ওই পত্রে ইতিহাস বিকৃতি, একচোখা, বিশেষ উদ্দেশ্যে প্রণীত বলে বিভিন্ন মহল থেকে বলা হচ্ছে। যার ফলে এটি তার প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে।
সম্প্রতি ‘জুলাই সনদ’ নামে ৮৪টি প্রস্তাবের বিবরণী তুলে ধরা হয়েছে। তার মধ্যে অধিকাংশে সব দলের ঐকমত্য নেই। নোট অফ ডিসেন্ট অথবা চূড়ান্ত দ্বিমত আছে। ওই প্রস্তাবের আগে ভূমিকা ও বাস্তবায়ন পদ্ধতির কথা বলা হয়। আমরা এ বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে আমাদের মতামত তুলে ধরে বলি যে, ঐকমত্য বলতে, সব বিষয়ে আলোচনায় সকল দল যতটুকুতে সম্মত হয়েছে, ততটুকুকে ঐকমত্য করতে হবে। আর এগুলোর মধ্যে এখনকার আইনে বাস্তবায়নযোগ্যগুলো বাস্তবায়ন করা এবং সংবিধান সংশোধনের বিষয়গুলো আগামীতে নির্বাচিত সংসদের বিবেচনার জন্য রাখতে হবে। সব দল মিলে যেসব বিষয়ে সর্বসম্মতভাবে একমত হয়েছি, ওই বিষয়গুলো বাস্তবায়নে অঙ্গীকার ঘোষণা করতে পারি। এ ছাড়া অন্যান্য বিষয়ে যার যার দলীয় বক্তব্য হিসেবে তুলে ধরতে পারি।
আমরা উল্লেখিত সনদের ভূমিকা ও বাস্তবায়নে ভিন্ন পদ্ধতির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে জানাই যে, সব আলোচনায় ঐকমত্য সম্ভব না-ওইসব আলোচনা তুললে ঐক্যেরই ক্ষতি হবে। ফলে সনদে স্বাক্ষর করা সম্ভব হবে না। এ ছাড়া সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে অনেক মহলের আলোচিত, গণভোেট, গণপরিষদ নির্বাচন বা এলএফও (লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার), সাংবিধানিক আদেশ-এর মাধ্যমে উল্লেখিত প্রস্তাবসমূহ বাস্তবায়নকে অগ্রহণযোগ্য বলে নাকচ করা হয়। ইতিমধ্যে কমিশনের মেয়াদ বৃদ্ধি করে কমিশন তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচেছ। আমরা অন্যান্য বামপন্থী-প্রগতিশীল শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চার মূলনীতিসহ মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত করা ও গণবিরোধী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান অব্যাহত রেখেছি।