কমরেড লেনিনের দর্শন ভাবনা

Posted: 20 এপ্রিল, 2025

২২ এপ্রিল ২০২৫ কমরেড লেনিনের ১৫৬ তম জন্মদিবস। দুনিয়া কাঁপানো প্রথম সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের নেতা লেনিন বিশ্বজুড়ে কমবেশি পরিচিত। কিন্তু দার্শনিক লেনিন সে তুলনায় ততটা পরিচিত নন। লেনিনের দার্শনিক ভাবনা নিয়ে এই নিবন্ধটি- প্লেটো সম্ভবত বলেছিলেন ‘কিং ফিলোসফার’ এর কথা। তাঁর মতে একজন শাসক ও রাষ্ট্রনায়ককে অবশ্যই দার্শনিক হতে হবে। বস্তুত যেকোনো রাষ্ট্রের কোনো না কোনো রাষ্ট্রনৈতিক দর্শন ভাবনা থাকে। মানব সভ্যতার ইতিহাসে লেনিন ছিলেন একজন অনন্য সাধারণ দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক যিনি প্রচলিত সব দর্শনের বিপরীতে নতুন এক দুনিয়া নির্মাণের রাজনৈতিক দর্শন নিয়ে অদৃষ্টপূর্ব কাজ শুরু করেন তাঁর দার্শনিক গুরু কার্ল মার্কসের ভাবনার অনির্বান আলোয়। মার্কসীয় চিন্তার সৃজনশীল প্রয়োগে এবং তাঁর বিচক্ষণ নেতৃত্বে ১৯১৭ সালে সংঘটিত অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব শুধু এক দুনিয়া কাঁপানো রাজনৈতিক অর্থনীতির সূচনা করেনি বস্তুত একজন দার্শনিক হিসাবে তিনি মানুষের চিন্তাজগতকে প্রবলভাবে আলোড়িত করেছেন। কার্ল মার্কসের সুযোগ্য দার্শনিক অনুসারী হিসাবে তিনি শুধু পৃথিবীকে ব্যাখ্যা করেননি প্রকৃত প্রস্তাবে পাল্টে দিয়েছেন যা বিদ্যমান সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ের পরে আজ একবিংশ শতাব্দীর প্রথম পাদেও সমান সত্য ও প্রাসঙ্গিক। উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে রাশিয়ায় নারোদনিকদের প্রচণ্ড প্রভাব ছিল। প্লেখানভ ছিলেন একজন নারোদনিক কিন্তু নির্বাসিত জীবনে মার্কসবাদী সাহিত্য গভীরভাবে পাঠ করে তিনি রাশিয়ার একজন অন্যতম প্রথম মার্কসবাদী হয়ে উঠেন। এ সময়ে তিনি নারোদনিকদের তিনটি ভুল ধরেন। প্রথমত রাশিয়াতে পুঁজিবাদের বিকাশকে নারোদনিরা বিবেচনায় নিতে পারেনি, দ্বিতীয়ত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে শ্রমিক শ্রেণির অগ্রণী ভূমিকা তারা অস্বীকার করে, তৃতীয়ত ব্যক্তিনির্ভর বিপ্লবী আন্দোলনে বিশ্বাস তথা ব্যক্তিপূজার চর্চা করে। নব্যকান্টীয় ভাববাদের বিরুদ্ধে মার্কসীয় চিন্তাধারা রক্ষা, এর বৈপ্লবিক চরিত্রকে অক্ষুণ্ন রাখার জন্য তিনি সংগ্রাম করেন। বার্নষ্টাইন প্রমুখের সংশোধনবাদী সমালোচনার জবাবে প্লেখানভ পরপর দুটি বই লিখেন যেগুলো হলো “ঊংংধুং ড়হ ঃযব যরংঃড়ৎু ড়ভ সধঃবৎরধষরংস” , “ঙহ ঃযব রহফরারফঁধষ ৎড়ষব ড়ভ ঐরংঃড়ৎু” লেনিন বলেছিলেন প্লেখানভের এই দুটি বই ‘রাশিয়ার মার্কসীয় চিন্তার অনুসারীদের একটি পুরো প্রজন্মকে শিক্ষিত করেছে। পরিহাস হল পরবর্তীতে এই যুগন্ধর রুশ মার্কসবাদীর সাথেই লেনিনের প্রত্যেকটি বিষয়ে মতান্তর শুরু হয়। ১৯০২ সালে নবগঠিত রুশ সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক লেবার পার্টির গঠনতান্ত্রিক বিধি ব্যবস্থা সর্ম্পকে লেনিনের মতামতের বিরোধিতা, ১৯০৫ সালের রুশ গণতান্ত্রিক বিপ্লবের ব্যর্থতা নিয়ে মতবিরোধ ও প্রত্যক্ষ বিচারবাদের বা ইম্পিরিও ক্রিটিসিজমের নামে ছদ্মবেশী ভাববাদকে পরোক্ষভাবে সমর্থন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র ও মূল কারণকে উপেক্ষা করে দ্বিতীয় আর্ন্তজাতিকের জার্মান নেতা কাউটস্কির অনুসরণে জাতীয়তাবাদী ভূমিকা গ্রহণসহ লেনিনের নেতৃত্বে আসন্ন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রত্যক্ষ বিরোধিতায় নামেন। লেনিন তাঁর এই অগ্রজ মার্কসবাদী বিপ্লবীর ও অন্যদের প্রত্যেকটি বৈরী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে শুধু রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক লড়াই নয় মার্কসবাদী সৃজনশীলতার দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রত্যেকটি বিষয়ের প্রেক্ষিতে লিখেছেন চমৎকার সব রাজনৈতিক দর্শনের বই। এ ক্ষেত্রে সব থেকে উল্লেখ করার মতো দুটি বই হল দর্শনের উপর ‘মেটেরিয়ালিজম অ্যান্ড ইম্পিরিও ক্রিটিসিজম’ এবং রাজনৈতিক অর্থনীতির উপর বিশ্ববিখ্যাত পুস্তুক ‘ইম্পিরিয়ালিজম ইজ দি হাইয়েস্ট স্টেজ অব ক্যাপিটেলিজম’। নারোদনিকবাদের প্রভাব ও সর্বহারা শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবী পার্টি গড়ার ক্ষেত্রে লেনিনকে মার্কসীয় ডায়ালেকটিক বস্তুবাদ বিরোধী মেনশেভিকদের সাথে নিরন্তর দার্শনিক লড়াই করতে হয়েছিল এমনকি অক্টোবর বিপ্লবের পূর্বাপর সময় থেকে আমৃত্যু বলশেভিকদের নেতৃত্বের একটি অংশের ত্রুটি বিচ্যুতির বিরুদ্ধেও তিনি আপসহীন লড়াই চালিয়েছেন। ১৯০৫ সালের রুশ গণতান্ত্রিক বিপ্লবে বলশেভিকদের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা এবং বিপ্লবের সাময়িক ব্যর্থতার প্রেক্ষাপটে মেনশেভিকদের ভাবাদর্শগত আক্রমণ তথা মার্কসীয় বস্তুবাদের ভিত্তির উপর আঘাতের প্রেক্ষিতে ১৯০৮ সালে লেখেন ‘মেটেরিয়ালিজম অ্যান্ড ইম্পিরিও ক্রিটিসিজম’ নামের দার্শনিক গ্রন্থটি। এ সময়ে বাজারভ, লুনাচারস্কি, বের্মান, য়কুকেভিচ প্রমুখ নিজেদের মার্কসবাদী দাবি করে মার্কসীয় ভাবনার মৌলিক বিষয়বস্তুকেই অস্বীকার করতে লাগলেন। এতে তাঁরা দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদকে আক্রমণ করে মার্কসীয় ভাবনা নিয়ে নিজেদের ব্যাখ্যা হাজির করেন। এর ফলে পার্টির ভিতরে বাইরে বিভ্রান্তি ও রাজনৈতিক হতাশার মুখে লেনিন শক্ত হাতে কলম ধরে প্রকৃতিবিজ্ঞানের সমসাময়িক নতুন নতুন আবিষ্কারের ঘটনা ব্যাখ্যা করে মার্কসীয় দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের যথার্থতা প্রতিপাদনের জন্য বাস্তবতাবাদের নামে প্রত্যক্ষ বিচারবাদের মূঢ়তাকে উন্মোচন করেন। ‘মেটেরিয়ালিজম এন্ড ইম্পিরিও ক্রিটিসিজম’ পুস্তকটি ছয় পরিচ্ছদে বিভক্ত। প্রথম তিনটি পরিচ্ছেদে লেনিন প্রধানত ভাববাদ ও বস্তুবাদের দার্শনিক বির্তকের পুনর্বিচার করেছেন এবং বস্তুবাদী জ্ঞানতত্বকে আলাদাভাবে বিচার করেছেন। পরবর্তী তিনটি পরিচ্ছেদে প্রত্যক্ষ বিচারবাদীদের প্রকৃতি বিজ্ঞানের নব আবিষ্কারসমূহের ভুল ব্যাখ্যা তুলে ধরে ঐতিহাসিক বস্তুবাদের যথার্থতা ও তাদের ভাববাদী চিন্তার অসারতা প্রতিপন্ন করেছেন। ১৮৯৫ সালে এঙ্গেলসের মৃত্যুর পর থেকে প্রকৃতি বিজ্ঞান তথা পদার্থবিদ্যার কিছু যুগান্তকারী আবিষ্কার চিরায়ত পদার্থবিদ্যার ভিত্তিমূলে আঘাত করে সজোরে। ১৮৯৫ সালে রন্টজেন আবিষ্কার করেন এক্স-রে, ১৮৯৬ সালে বেকেরেল আবিষ্কার করেন তেজষ্ক্রিয়তা, ১৮৯৭ সালে আবিষ্কৃত হয় বস্তুর ক্ষুদ্রতম কনা ইলেকট্রন, ১৮৯৮ সালে কুরি দম্পতি আবিস্কার করেন তেজস্ক্রীয় মৌল রেডিয়াম। একের পর এক এসব বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ফলে ভাববাদীরা বলতে শুরু করেন “সধঃঃবৎ যধং ফরংধঢ়ঢ়ধৎবফ” অর্থাৎ বস্তু অদৃশ্য হয়ে গেছে। কাজেই বস্তুই যদি না থাকে বস্তুবাদেরও আর অস্তিত্ব নেই। লেনিন এসব আবিস্কারের পটভূমি ও প্রকৃতি ব্যাখ্যা করে বললেন এসব আবিষ্কার বস্তুর অস্তিত্ব ও দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদকে আরো বিকশিত করেছে যা তিনি এই পুস্তকে ব্যাখ্যা করেছেন। আসলে পূর্বোল্লিখিত রুশ মেনশেভিকরা অস্ট্রীয় পদার্থবিজ্ঞানী ও কথিত বস্তুবাদী আর্নষ্ট মাখ এবং রিচার্ড আভেনারিয়াসকে গুরু মেনে নিয়ে ছদ্মবেশী মার্কসবাদী হিসাবে মূলত ভাববাদের পক্ষে কাজ করেন। আর্নস্ট মাখ মূলত পজিটিভিস্ট দর্শনের ভাববাদের খোলস পাল্টিয়ে নতুন করে উপস্থাপন করেন। তাঁদের চিন্তাকে বলা হয় ইম্পিরিও ক্রিটিসিজম বা প্রত্যক্ষ বিচারবাদ। ইম্পিরিও ক্রিটিসিজমের মতে সংবেদন হল জ্ঞানের উৎস। মানুষের জ্ঞাত বিষয় এই সংবেদনের সমাহার। এদের মতে বস্তু প্রত্যক্ষণের (ঢ়বৎপবঢ়ঃরড়হ) বিষয় নয়, প্রত্যক্ষণের বিষয় হলো সংবেদন সমষ্টি। আমরা যা দেখি তাকে আমরা বস্তু বলে মনে করি কিন্তু তা আসলে বস্তু নয়, তা সংবেদনের নানা মাত্রিক সমবায় মাত্র। অর্থাৎ সংবেদনই বস্তুর আদি রূপ এবং মনুষ্য নিরপেক্ষ বস্তুর স্বাধীন অস্তিত্ব নেই বলে মাখ অনুসারীরা মনে করেন। সেক্ষেত্রে লেনিন একজন প্রকৃত মার্কসবাদী হিসাবে বললেন আমরা কি বস্তু থেকে সংবেদন বা চেতনার পথে আগাব নাকি চেতনা বা সংবেদনের দিক থেকে বস্তুর দিকে আগাব। প্রথম পথ হলে বস্তুবাদী, দ্বিতীয় পথ হল মাখ ও মেনশেভিকদের ভাববাদী পথ, যা আদতে বিষয়ীগত ভাববাদ কেননা মাখ বলেছিলেন বি ংবহংব ড়হষু ড়ঁৎ ংবহংধঃরড়হং অর্থাৎ তাঁর মতে দুনিয়াতে আমি ছাড়া আর কিছুর অস্তিত্ব নেই। বস্তুত বস্তুবাদের সাথে প্রত্যক্ষ বিচারবাদের বা মাখের মতের পার্থক্য মৌলিক। বস্তুবাদ বলে বস্তুই প্রধান। চিন্তা, ভাব, সংবেদন, চেতনা এগুলো বস্তুর বিকাশের পরস্পরামাত্র। সংবেদন বস্তুর এক ইন্দ্রিয়জ উপলব্ধি। বাহ্যিক জগত আমাদের ইন্দ্রিয়ের উপর প্রতিনিয়ত যে আঘাত করে নানা জৈবিক প্রক্রিয়ায় তা চেতনায় রূপ নেয়। ফলে মাখ কথিত সংবেদন চেতনার উৎস নয় তা চেতনায় পৌঁছানোর মাধ্যম মাত্র। ইম্পিরিও ক্রিটিসিস্টদের ধারণা হল বস্তুর জন্ম মানব চেতনায়-বস্তু মানব চেতনার উপজাত মাত্র। লেনিন প্রত্যুত্তরে বললেন মানুষ নিরপেক্ষ বস্তুর ধারণা হলো ডায়ালেকটিক বস্তুবাদের মৌলিক প্রতিপাদ্য বিষয়। অন্য সব দার্শনিক ব্যাখ্যা এর সহযোগী মাত্র। কিন্তু ইম্পিরিও ক্রিটিসিস্টরা এর বিরোধী। তাদের বক্তব্য হল ইলেকট্রন, প্রোটন আবিষ্কারের ফলে বস্তুর চিরায়ত সংজ্ঞা পাল্টে গেছে ফলে বস্তুবাদীরা বস্তুর বিজ্ঞানসম্মত কোনো নতুন সংজ্ঞা দিতে অক্ষম। এখানেই লেনিন মার্কসপূর্ব বস্তুবাদ এবং মার্কসীয় বস্তুবাদের পার্থক্য নির্দেশ করলেন। মার্কস পূর্ব বস্তুবাদকে তিনি সবঃধঢ়যুংরপধষ বা অধিবিদ্যামূলক বললেন মার্কসীয় দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের বিপরীতে। মার্কস পূর্ব বস্তুবাদ বস্তুকে গতির সাপেক্ষে বিচার করে না। বস্তুকে বস্তুবিশ্বের সামগ্রিকতায় বুঝে না বরং মনে করে বস্তু অনড় ও স্থির সত্তা। দ্বন্দ্বমূলক বা মার্কসীয় বস্তুবাদ বস্তুকে গতিশীল এবং পারিপার্শ্বিকতার নিরিখে বিচার করে। লেনিন বললেন সড়ঃরড়হ রং ঃযব বীরংঃবহপব ড়ভ সধঃঃবৎ. গতির প্রবাহের মধ্যেই নতুন নতুন বস্তুর আর্বিভাব। ক্রমাগত গতি প্রবাহের মধ্যে মানুষের সংবেদন বা চেতনাও গতিশীল হয়ে থাকে। মানুষ এই গতিশীল বস্তু নিয়ে কাজ করে। ক্রমাগত বস্তুর নানা গুনাবলী মানুষের চেতনায় ধরা পড়ে, উন্নততর হতে থাকে বস্তু তথা বস্তুবিশ্ব নিয়ে ধারণা। এটা ঠিক বস্তুর সমস্ত গুণাবলী মানুষ এখনও জানতে পারেনি কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে তা কখনো জানতে পারবে না। কেননা মার্কসের মতে জগত জ্ঞেয়, জগতকে জানা যায়। গতির প্রবাহে ক্রমাগত পরিবর্তনশীল চেতনার আলোকেই মানুষ একদিন জানবে জগতের জ্ঞান ভা-র, বিজ্ঞান সমৃদ্ধ হবে। সমস্ত জ্ঞানই অভিজ্ঞতা সঞ্জাত আর সংবেদন হলো সেই অভিজ্ঞতার বিমূর্ত রূপ। মনুষ্য নিরপেক্ষ বাস্তব জগতে বিশ্বাসের কোনো স্থান নেই। বৈচিত্রপূর্ণ ও জীবন্ত বস্তুবিশ্বকে অভিজ্ঞতালব্ধ ব্যাখ্যার দ্বারা বিজ্ঞান তার অজানা রহস্যকে মানুষের জানার পরিধির মধ্যে নিয়ে আসে। কিন্তু এই বস্তু সত্যকে জানার উপায় কি। মার্কস বলছেন “ঞযব ফরংঢ়ঁঃব ড়াবৎ ঃযব ৎবধষরঃু ড়ৎ হড়হ ৎবধষরঃু ড়ভ ঃযরহশরহম যিরপয রং রংড়ষধঃবফ ভৎড়স ঢ়ৎধপঃরপব রং ঢ়ঁৎবষু ধ ংপযড়ষধংঃরপ য়ঁবংঃরড়হ. তাঁর মতে বস্তুবাদী জ্ঞানতত্বের ভিত্তি হল কর্ম বা ধপঃরড়হ. কর্মের সাফল্যই বিষয়গত অবস্থার ধরন নিয়ে আমাদের ধারণাকে সত্য প্রমাণ করে। সত্য উপলব্ধির আর কোনো পথ নেই। বইটির শেষ অধ্যায়ে ইম্পিরিও ক্রিটিসিস্টদের দাবি বাতিল করে লেনিন ঐতিহাসিক বস্তুবাদের মার্কসীয় ধারণাকে পোক্ত করেছেন। তিনি বলেন মার্কসের শিক্ষা এই যে সামাজিক চেতনা হল সামাজিক সত্তার প্রতিফলন। সামাজিক চেতনার ভিত্তি নিহিত আছে সম্পদের অর্থনৈতিক ভিত্তির মধ্যে। এই অর্থনৈতিক ভিত্তি বা সর্ম্পকের কি ধরনের পরিবর্তন হলে সমাজের বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে তা মার্কস দেখিয়ে গেছেন। মার্কসের আগে সমাজ পরিবর্তনের এই বিজ্ঞানসম্মত ধারণা মানুষের জানা ছিল না। এটা জেনে মানুষ কাঙ্খিত পরিবর্তনের জন্য কাজ করছে। প্লেখানভ ও মেনশেভিকদের মাখের চিন্তার সাথে মার্কসের চিন্তাকে মেশানোর অপতৎপরতার স্বরূপ লেনিন এই বইয়ের মাধ্যমে স্পষ্ট করে দেন। তাঁর মতে মার্কসবাদীদের কাজ হল জ্ঞানজগতের সমস্ত বুর্জোয়া ভাবধারা আত্মস্থ করা এবং মার্কসের চিন্তার আলোকে তা বিচার ও পরিশুদ্ধ করে মার্কসীয় জ্ঞানতত্বকে বিকশিত করা। এ লক্ষেই লেনিন প্লেখানভও মাখপন্থি মেনশেভিকদের বিরুদ্ধে লিখেন দর্শন চিন্তার উপর আলোচ্য অমূল্য গ্রন্থ ‘মেটেরিয়ালিজম অ্যান্ড ইম্পিরিও ক্রিটিসিজম’। লেনিনের মৃত্যু শতবার্ষিকীতে এই বইটি প্রাসঙ্গিক ও প্রগতিশীলদের অবশ্য পাঠ্য বিশেষ করে আমাদের মত ডান-বাম অন্ধ বিশ্বাসের মোহাচ্ছন্ন সামাজিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে। প্রাসঙ্গিকভাবেই এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে রাশিয়ার প্রথম প্রজন্মের কমিনিস্ট প্লেখানভ মার্কসীয় চিন্তার প্রসারে অসাধারণ ভূমিকা পালন করে কেন এত বিভ্রান্ত হয়েছিলেন পরবর্তী জীবনে। লেনিন যা পারলেন প্লেখানভ তা পারার কথা দূরে থাক একজন মেনশেভিক হিসাবে কেন প্রতিক্রিয়শীলতার পিচ্ছিল পথে হাঁটলেন? এক্ষেত্রে বলা যায় পার্টির ঐক্য, আদর্শ ও রাজনীতির কাছে ব্যক্তির পাণ্ডিত্যাভিমান, প্রখর অহংবোধ, নিজেকে কার্যত পার্টির ঊর্ধ্বে স্থাপন করার শ্রেণিগত প্রবণতার জন্য দায়ী। অন্যদিকে গোর্কি ‘লেনিনের সাথে’ স্মৃতিকথায় লিখেছেন ‘তাঁর অনুরাগের বিষয়বস্তুর পরিসর দেখে বিস্মিত না হয়ে পারি না। ..... সব বিষয়ে সবার অগ্রগন্য হয়েও অনুচ্চাভিলাষী, নিরহংকারী, নর নারীর সরল জীবনের অনুরাগী এমন দ্বিতীয় পুরুষ আমি কল্পনা করতে পারি না’। একজন যথার্থ মার্কসবাদী ব্যক্তিগত মিথ্যা মর্যাদা-অমর্যাদা নিয়ে নির্বিকার থাকেন। ব্যক্তিগত অহংবোধে, শ্রেষ্ঠত্ববোধে বিভ্রান্ত হয়ে মূল কর্তব্য ও বিচার্য কাজগুলো গোলমাল করে দিয়ে বিপ্লবী আন্দোলন ও পার্টিকে কোনো অবস্থাতেই দুর্বল করে দেন না। বড় পণ্ডিত হয়েও প্লেখানভ রুচি ও সাংস্কৃতিক মানের দিক থেকে উপরোল্লিখিত অবস্থায় পৌঁছাতে পারেননি বলে ইতিহাসের উপহাসের পাত্রে পরিণত হয়েছেন। লেনিনের সময় থেকে এই সংকট বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের এক বিষয়ীগত সাধারণ সংকট হিসাবে দৃশ্যমান। লেনিনের জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে নির্মোহ দৃষ্টিতে এ সংকট মোকাবিলা করতে হবে। লেখক : সভাপতি, চট্টগ্রাম দক্ষিণ, সিপিবি