করোনাকালে দ্রব্যমূল্যের যাঁতাকলে সাধারণ মানুষ

Posted: 04 এপ্রিল, 2021

করোনাকালে কর্মসংস্থান পরিস্থিতি নিয়ে কয়েক দিন আগে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)। এতে দেখা যায়, ২০২০ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত ১০ মাসে কাজ হারিয়েছেন ৭ দশমিক ৯ শতাংশ শ্রমজীবী মানুষ। সাময়িকভাবে কাজ হারিয়েছেন আরো ১ দশমিক ৭ শতাংশ। আর কাজ না থাকায় পেশা পরিবর্তনে বাধ্য হয়েছেন ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। এই প্রতিবেদন থেকে আরো জানা যাচ্ছে, বেতন বা মজুরির বিনিময়ে কাজ করেন এমন কর্মীদের মধ্যে ৬২ শতাংশের আয় ২০১৯ সালের তুলনায় কমে গেছে। স্বকর্মসংস্থানে নিয়োজিতদের মধ্যে আয় কমেছে ৮০ শতাংশের। এরমধ্যে ২ শতাংশের কাজ বা ব্যবসা একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। খোদ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপ বলছে, করোনাকালে ২০ শতাংশ হারে কমেছে সাধারণ মানুষের আয়। গত সেপ্টেম্বরে করা জরিপ অনুযায়ী, করোনার আগে ২০১৯ সালের মার্চে প্রতি পরিবারের মাসিক গড় আয় ছিল ১৯ হাজার ৪২৫ টাকা। করোনা পরিস্থিতিতে গত আগস্ট মাসে তা ১৫ হাজার ৪৯২ টাকায় নেমে এসেছে। বিবিএসের হিসাবে পরিবার প্রতি মাসিক গড় আয় কমেছে ৩ হাজার ৯৩৩ টাকা। এই যখন মানুষের কাজ ও আয়ের অবস্থা তখন নিত্যপণ্যের বাজারে বিরাজ করছে চরম অস্থিরতা। চাল, ডাল, তেল, মসলাসহ সাধারণ মানুষের প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় সব পণ্যের দাম ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। আয় কমে যাওয়ায় বা আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ডাল-ভাত খেয়ে কোনো রকমে দিন পার করার চেষ্টা করছে অনেক পরিবার। কিন্তু চালের দাম ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ায় আক্ষরিক অর্থেই তাদের এখন নাভিশ্বাস অবস্থা। ৫০ টাকার নিচে দেশে মোটা চালও পাওয়া যাচ্ছে না। সরু চালের দাম ছাড়িয়েছে ৬৫ টাকা। ভোজ্য তেলের দাম দফায় দফায় বাড়ছে আর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বৈঠক করে তা অনুমোদন করছে। সরকারের পক্ষ থেকে নানা সময়ে হাঁকডাক দেয়া হলেও বাজার নিয়ন্ত্রণে কার্যকর কিছুই করতে পারেনি। উল্টো একের পর এক পণ্যের বাজার অস্থির করে সরকারকে ব্যস্ত রেখে অন্যান্য পণ্যের দাম বাড়িয়ে নিচ্ছে ব্যবসায়ীরা। প্রতি বছর শেষে দেখা যাচ্ছে, প্রায় প্রতিটি পণ্যের দামই আগের বছরের চেয়ে বেড়ে গেছে। আয় না বাড়লেও জীবনযাত্রার ব্যয় ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ায় মানুষের জীবনযাত্রার মান হ্রাস পাচ্ছে। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সঙ্গতি না থাকায় প্রতিদিনের খাদ্য তালিকা থেকে বাদ দিতে হচ্ছে অনেক উপাদান। ফলে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় ক্যালরি গ্রহণ করতে পারছে না বেশিরভাগ মানুষ। বাজার পরিস্থিতির উন্নয়নে নানা প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হলেও এর মূলে হাত দিচ্ছে না সরকার। একদিকে মুক্তবাজার অর্থনীতি অন্যদিকে সাধারণ মানুষের স্বার্থ– এ দু’টি একসাথে রেখেই বাজার নিয়ন্ত্রণে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার। কিন্তু বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে ইতোমধ্যেই প্রমাণিত হয়েছে– মুক্তবাজার অর্থনীতি আর যাই হোক সাধারণ মানুষের স্বার্থরক্ষা করতে পারে না। ভোগ্যপণ্যেও বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সব উপাদান বিনাশর্তে ব্যবসায়ীদের হাতে ছেড়ে দিয়ে, আমদানিনির্ভর নীতি কার্যকর রেখে মানুষের দুর্দশা লাঘব করার চেষ্টা ব্যর্থ হবে– এটাই স্বাভাবিক। আর এ কারণেই দফায় দফায় শুল্ক কমিয়ে, এলসি খোলার প্রক্রিয়া সহজ করে আর খোলাবাজারে যৎসামান্য পণ্য বিক্রি করে দ্রব্যমূল্য কমাতে পারছে না সরকার। একথা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, মুক্তবাজারে কখনো ক্রেতাদের স্বার্থ রক্ষা হয়নি। যা হয় তা হলো– আমদানিকারক আর বড় ব্যবসায়ীদের মুনাফার অঙ্কবৃদ্ধি। দেশে গত এক দশকে চাল, ডাল, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, ভোজ্য তেল, গুঁড়ো দুধসহ প্রায় সব পণ্যের দাম বাড়তে বাড়তে অস্বাভাবিক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর মূল্য নিয়ন্ত্রণে বেশ কিছু পদক্ষেপের কথা বলা হলেও তাতে কোনো কাজ হয়নি। এর মূল কারণ সরকারের পরিচয় বদল হলেও বাজার নিয়ন্ত্রণে আগের সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছিল এ সরকারের প্রচেষ্টাও একই পথে চলছে। আর বুর্জোয়া রাজনৈতিক সরকারগুলো বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ-এর বাতলানো পথে যে মুক্তবাজার অর্থনীতি চালু করেছিল এখনো সেই ব্যবস্থাই বহাল আছে। যে নীতি অতীতে মানুষের দুঃখ-কষ্ট লাঘবে ব্যর্থ হয়েছে– সেই নীতি এখন সাফল্য বয়ে আনার কোনো কারণ নেই। বিশ্লেষকরা মনে করেন, নব্বই দশকের শুরু থেকে মুক্তবাজার অর্থনীতি চালুর নামে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের সকল চাবিকাঠি ব্যবসায়ীদের হাতে ছেড়ে দেয়ার পর থেকেই দেশে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রবণতা চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান টেড্রিং করপোরেশন অব বাংলাদেশকে (টিসিবি) অকার্যকর করে ব্যবসায়ীদের হাতে ভোগ্যপণ্য আমদানির একচেটিয়া ক্ষমতা তুলে দেয়ায় বাজার একচেটিয়াভাবে তাদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে। বিদেশি পণ্যের জন্য বাজার উন্মুক্ত করে দেয়ায় দেশে উৎপাদন ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। অধিকাংশ পণ্যের বাজার আমদানিনির্ভর হয়ে পড়ায় আমদানিকারক সিন্ডিকেটের হাতে চলে গেছে বাজারের নিয়ন্ত্রণ। এখন শুল্ক কমানোসহ যে ব্যবস্থাই নেয়া হচ্ছে তা কেবল ব্যবসায়ীদেরই লাভবান করছে। সরকারের প্রত্যক্ষ আমদানি ও বিপণন ব্যবস্থা শক্তিশালী থাকলে বাজারে অসাধু ব্যবসায়ীদের একচেটিয়া মুনাফার সুযোগ বন্ধ করা যেতো। ফলে দেশে মুক্তবাজার অর্থনীতি রাখা হবে কিনা তার ওপরই দ্রব্যমূল্য ও জনগণের স্বার্থের বিষয়টি নির্ভর করছে। ‘ব্যবসার ব্যাপারে নাক গলানো সরকারের কাজ নয়’ কিংবা ‘বাজার-ই বাজার নিয়ন্ত্রণ করবে’-এই নীতি অনুসরণ করে চললে দেশের মানুষকে মুনাফালোভী চক্রের কাছে জিম্মি হয়েই থাকতে হবে। এ ধরনের ক্ষতিকর নীতি পরিত্যাগ করে বাজারের ওপর জনগণের গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণই হবে ‘মূল্যবৃদ্ধি’ যন্ত্রণা থেকে মুক্ত হওয়ার প্রকৃত উপায়। ব্যবসায়ীদের ওপর খবরদারি, দেন-দরবার, মনিটরিং, হুমকি-ধামকি অথবা তোয়াজ-তদবির করে সাময়িকভাবে উপর-ভাসা কিছু ফল পাওয়া গেলেও– এর কোনোটিই দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে স্থায়ী সমাধান হিসেবে কাজ করবে না। পণ্য সরবরাহ ও বিপণনে বিকল্প ব্যবস্থার মাধ্যমেই কেবল ব্যবসায়ীদের ‘অসাধু নিয়ন্ত্রণ’ থেকে বাজারকে মুক্ত করা সম্ভব। বাজারে পণ্য সরবরাহের দু’টি পর্যায় বিবেচনায় নিয়ে সরকারী ব্যবস্থাপনা ঢেলে সাজাতে হবে। একটি উৎপাদন, আমদানি ও পাইকারি বিক্রয় কার্যক্রম। অন্যটি খুচরা বিক্রি বা ভোক্তা পর্যায়ে সরাসরি পণ্য পৌঁছানো। বাজার ব্যবস্থাপনার দু’টি পর্যায়েই রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে। ব্যক্তি খাতের পাশাপাশি পণ্য-বাণিজ্যের প্রতিটি পর্যায়ে সরকারি তৎপরতা থাকলেই কেবল ‘সুস্থ প্রতিযোগিতা’র মাধ্যমে ভোক্তাদের কাছে ‘সহনীয়’ মূল্যে ভোগ্যপণ্য পৌঁছানো সম্ভব। খুচরা বাজারকে ‘মুক্ত’ করে শুধু আমদানি ও পাইকারি ব্যবসার মাধ্যমে পণ্য সরবরাহ বাড়িয়ে সরকারের পক্ষে ‘নিয়ন্ত্রণ’ করা সম্ভব নয়। আবার ব্যক্তি খাত থেকে পণ্য কিনে ভোক্তা পর্যায়ে সরবরাহের চেষ্টাও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সাফল্য আনতে পারে না। দ্রব্যমূল্য সহনীয় রাখতে সরকারী প্রচেষ্টায় সফল হতে হলে প্রয়োজন পণ্য সরবরাহ ও বিপণনের জন্য শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো। স্বাধীনতার পর দীর্ঘকাল যে প্রতিষ্ঠানটি এই দায়িত্ব পালন করেছে তার নাম ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। মুক্তবাজারের নামে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ-এডিবির মতো ঋণদাতাদের পরামর্শে নব্বইয়ের দশক থেকে বাজার নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রের যেসব প্রথা-প্রতিষ্ঠান সক্রিয়া ছিল সেগুলোকে বিলুপ্ত কিংবা নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়। রাষ্ট্রীয় সংস্থা ‘মূল্য ও বাজার নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর’ বিলুপ্ত এবং টিসিবির কার্যক্রম একেবারে গুটিয়ে নেয়া হয়। বন্ধ হয়ে যায় আমদানি-রপ্তানি, পণ্য সরবরাহ ও বিপণনে টিসিবির কার্যক্রম। গত দুই যুগে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে বার বার টিসিবিকে কার্যকর করার কথা বলা হলেও তা ছিল শুধুই ফাঁকা বুলি। মুক্তবাজার নীতি বহাল রেখে বহুজাতিক কোম্পানি এবং মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষাই যদি মূল লক্ষ্য হয়– তাহলে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবনে দুর্ভোগ অব্যাহত থাকবে– এটাই স্বাভাবিক। লেখক : সাংবাদিক