বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থিদের ভূমিকা

Posted: 04 এপ্রিল, 2021

[পূর্ব প্রকাশের পর] মূলধারার মুক্তিসংগ্রামে নেতিবাচক ভূমিকা: ১৯৬৭ সালে আদি অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি থেকে চীনা লাইনের সমর্থকরা বের হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল) গঠন করেন। এ পার্টিরই একাংশ ছিল এ নেতিবাচক ধারার প্রতিনিধিত্বকারী। এ নেতিবাচক ধারার নেতৃত্বে ছিলেন সুখেন্দু দস্তিদার, আব্দুল হক এবং তোয়াহা। এরা ৬-দফা, ১১-দফাসহ সকল প্রকার নির্বাচনবিরোধী লাইন গ্রহণ করেন এবং এক ধাক্কায় (at one stroke) জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা কায়েমে বিশ্বাসী ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালে এদের বাহিনীগুলো প্রধানত যশোরসহ দেশের সমগ্র দক্ষিণাঞ্চল এবং নোয়াখালীর বিভিন্ন চরাঞ্চলে অবস্থান গ্রহণ করেছিল। তোয়াহা ও আব্দুল হকের লাইন অনুসারী নুর মোহাম্মদ ও বিমল বিশ্বাসের মুক্তিযুদ্ধ সময়কালীন স্মৃতিকথা থেকে তাদের অবস্থান সম্বন্ধে ধারণা পাওয়া যায়। বিমল বিশ্বাসের বর্ণনায়– ‘১ নভেম্বর রাতে আকরপুরের এক পরিত্যক্ত বাড়িতে রাত যাপন করি। ২ নভেম্বর রাতে বন খলিশাখালী গ্রামে অবস্থান করি। ৩ নভেম্বর বিকাল বেলা বাহিনীর সদস্যদের বুঝাবার চেষ্টা করি– এখন বাহিনীরূপে থাকার কোনো যুক্তি নেই। সেসময় ইব্রাহিম ও শাহজাহান বলেন, আপনারা যারা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, তারা আপনাদের আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় পাবেন, কিন্তু আমাদের মতো ভূমিহীন ও কৃষক কর্মীদের বুকে ইপিসিপি (এম-এল)’র পোস্টার লাগিয়ে নওয়াপাড়া রাজাকার ঘাঁটিতে যেয়ে হাজির হওয়া ছাড়া পথ নেই। যদিও ইব্রাহিম পাকা বাড়ি করে এখনও বহাল তবিয়তে বেঁচে আছেন, শ্রমিক নেতাও হয়েছেন, কিন্তু মার্কসবাদী রাজনীতিতে নেই। উল্লেখ্য, আহত কমরেড নাজিমকে কিছু টাকা দিয়ে কোলার ডাক্তার বৈদ্যনাথ বিশ্বাস-এর ওপর ছেড়ে দিয়ে বলেছিলাম ‘বেঁচে থাকলে দেখা হবে’। ৩ নভেম্বরেই আনুষ্ঠানিকভাবে বাহিনী ভেঙে দিয়ে এবং সকলকে কিছু কিছু টাকা দিয়ে আত্মরক্ষা করতে বলি। বেঁচে থাকলে দেখা হবে এটাই ছিল শেষ কথা।’ এই বিবরণ থেকে বোঝা যাচ্ছে যে মুক্তিযুদ্ধ যত স্বাধীনতার দিকে অগ্রসর হয়েছে, ততই “দুই কুকুর তত্ত্ব” দেউলিয়াত্বের মধ্যে পড়েছে, এই তত্ত্বের অনুসারীরা অনিচ্ছা সত্ত্বেও একটি কুকুরের (পাকিস্তানী বাহিনী) পক্ষে আবস্থান নিতে বাধ্য হয়েছেন। মূলধারার চীনাপন্থি বামেরা ছাড়াও আরো কয়েকটি শাখা-প্রশাখা বামপন্থি মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপের নাম উল্লেখ করা আবশ্যক। পূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে যে, চীনপন্থি ধারার অনেক সদস্যই গোপনে মূলধারার মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। রনো তাঁর লেখায় এরকম একটি মিশ্র বাহিনী হিসেবে ঢাকার বিখ্যাত ক্র্যাক প্লাটুন-এর কথা উল্লেখ করেছেন। এ প্লাটুনের অন্যতম সদস্য ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা সাদেক হোসেন খোকা (ইনি অবশ্য পরবর্তীতে জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপিতে যোগ দিয়েছিলেন)। তাঁর মতো আরো বেশকিছু চীনপন্থি মুক্তিযুদ্ধের মূলধারার সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ থেকে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। একই সময় সিরাজ শিকদারের নেতৃত্বে আরেকটি স্বতন্ত্র বামপন্থি বাহিনী পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি বরিশালের পেয়ারাবাগান অঞ্চলে থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। শুরুর দিকে তাঁরাও মূলধারার মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ থেকেই লড়াই চালিয়েছিলেন। পরে অবশ্য ঐ ঐক্য ভেঙে যায়। অপর এক বামপন্থি নেতা ওহিদুর রহমান রাজশাহীর আত্রাই অঞ্চলে মূলধারার মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে কখনো ঐক্য কখনো সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিলেন। তবে সাধারণভাবে ঐক্যবদ্ধভাবেই তাঁর বাহিনী মুক্তিযুদ্ধে শেষ পর্যন্ত অংশগ্রহণ করে। তাঁর স্মৃতিকথায় তিনি লিখেছেন– “আমরা পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি ত্যাগ করার পর প্রথমে ‘আত্রাই কমিউনিস্ট পাটি’ পরবর্তীতে রাজশাহী জেলার ‘আঞ্চলিক কমিউনিস্ট পার্টি’ গঠন করি, যার নেতৃত্বে একটি রাজনৈতিক কমিশন তৈরি করা হয়, যা আমাদের ফৌজকে রাজনৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে। এছাড়া চারজনের হাইকমান্ড (ওহিদুর রহমানকে কমান্ডার-ইন-চিফ নির্বাচিত করে আলমগীর কবির, আবদুল মজিদ ও এমদাদুর রহমানকে সদস্য করা হয়) ট্রেনিং ইন্সট্রাকশন, রেকি পার্টি, কোথ খাদ্যভাণ্ডার সিস্টেম চালু করা হয়েছেল। যদিও স্থায়ীভাবে আমাদের কোনো হেড কোয়ার্টার ছিল না। তবে মনছুর বিলের মতো বড় বিলের মধ্যে ছোট ছোট দ্বীপের মতো গ্রামগুলোই প্রায় হেড কোয়ার্টারের মতো ভূমিকা পালন করত। ভ্রাম্যমাণ অস্ত্রাগার ও খাদ্য ভাণ্ডার নৌকাতেই ছিল। ... আত্রাইয়ের ন্যাপ নেতা আফতাব মোল্লার নেতৃত্বে একটি টিমকে কিছু অর্থ দিয়ে অস্ত্র সংগ্রহ করার জন্য ভারতে পাঠাই। তিনি ৭নং সেক্টর কমান্ডার কর্নেল (অব.) কাজী নুরুজ্জামানের নিকট থেকে এক ট্রাক অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে বালুরঘাট হয়ে বর্ডারের দিকে রওয়ানা দেয়ার সময় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক তরুণ আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল জলিল [পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক; বর্তমানে প্রয়াত] খবর পেয়ে ওই ট্রাকটি ভারতীয় সেনাবাহিনীকে বলে আটকিয়ে দেন। আমরা অস্ত্রগুলো পেলে মুক্তিবাহিনীকে আরো ভালোভাবে গড়ে তুলতে পারতাম। জলিল সাহেব যদি জানতে পারতেন আমরা প্রকৃত অর্থে মুক্তিযুদ্ধে লিপ্ত তাহলে হয়তো তিনি আটকাতেন না। উনি পরে জেনেছেন আমরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি এবং সাফল্য অর্জন করেছি।’ সামগ্রিকভাবে বিচার করলে মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থিদের ভূমিকা বিশেষত মস্কোপন্থি বামদের ভূমিকা ছিল জাতীয়ভাবে ইতিবাচক ও আন্তর্জাতিকভাবে বিশেষ গুরুত্ববহ। তাদের এবং ভারতের সিপিআই এর যৌথ প্রচেষ্টার ফলে মুক্তিযুদ্ধের এক জটিল মুহূর্তে ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। তাতে বলা হয়েছিল যে, তৃতীয় কোন দেশ ভারতকে আক্রমণ করলে সোভিয়েত ইউনিয়ন মনে করবে যে তাকেও আক্রমণ করা হয়েছে! বস্তুতঃ এজন্যই তখন চীন বা আমেরিকা সরাসরি পাকিস্তানের পক্ষে কোনো যুদ্ধ উদ্যোগ নেয়ার সাহস পায়নি। আমেরিকাও শেষ মুহূর্তে বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর পাঠিয়ে হস্তক্ষেপ করতে ব্যর্থ হয়েছে। তবে চীনের লাইন অনুসারী বামপন্থিদের একটি ক্ষুদ্র অংশ মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধোত্তর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে চরম বিভ্রান্তির শিকার হয়েছিল-এ কথা অনস্বীকার্য। মিত্রকে শত্রু ভেবে শেষে গিয়ে শত্রুর (“আসলে মিত্র”!-লেখক) শত্রুকে (“আসলে শত্রু!”-লেখক) তারা মিত্র বানিয়েছিলেন। বামপন্থিদের জন্য শিক্ষা বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে চীনপন্থি বামদের যে বিচ্যুতি আমরা দেখি মার্কসীয় রাজনীতির পরিভাষায় তাকে “বাম বিচ্যুতি” বলা হয়। কমিউনিস্ট নেতৃত্বের বাম বিচ্যুতি কিভাবে ঘটে তা নিয়ে লেনিন তাঁর সুবিখ্যাত “বামপন্থি কমিউনিজমে শিশুদের রোগ” গ্রন্থে অনেক কিছু লিখেছেন। এই বামপন্থি শিশুরা রাজনীতিকে “আঁকা-বাঁকা বিহীন সিধা নিয়েভস্কী প্রসপেক্ট” রাস্তার মত করে দেখেন যেখানে আপস বা পশ্চাদপসারণের কোনো ব্যাপার নেই। তার ৯৭ পৃষ্ঠার এই মূল্যবান বইয়ের নীচের উদ্ধৃতিটি বেশ শিক্ষণীয় বলে মনে হয়– “The more powerful enemy can be vanquished only by exerting the utmost effort, and by the most thorough, careful, attentive, skilful and obligatory use of aû, even the smallest, rift between the enemies, aû conflict of interests among the bourgeoise of the various countries and among the various groups or types of bourgeoise within the various countries, and also by taking advantage of aû, even the smallest, opportunity of winning a mass ally, even though this ally is temporary, vascillating, unstable, unreliable and conditional. Those who do not understand this reveal a failure to understand even the smallest grain of Marxism, of modern scientific socialism in general. Those who have not proved in practice, over a fairly considerable period of time and in fairly varied political situations, their ability to apply this truth in practice have not yet learned to help the revolutionary class in its struggle to emancipate all toiling humanity from the exploiters. And this applies equally to the period before and after the proletariat has won power.” পাঠক ভাল করে মনোযোগ দিয়ে দেখুন যে লেনিন এখানে অধিকতর শক্তিশালী শত্রু বা বুর্জোয়া গোষ্ঠির মধ্যে বিরাজমান ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিভেদ ও ফাটলগুলিকে উস্কে দিয়ে নানাভাবে নানা সময়ে তা ব্যবহার করার আবশ্যিক প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছেন। সুযোগ থাকলে তাদের মধ্য থেকে কোনো একটি ক্ষুদ্র অংশকেও সাময়িক সময়ের জন্য শর্তসাপেক্ষভাবে হলেও “গণমিত্র” বানানোর সুযোগ পেলে তা করার জন্য বলেছেন। কিন্তু লক্ষ্যণীয় যে, তাদেরকে অবশ্যই সাধারণভাবে কোনো এক ধরনের “গণমিত্র” (Mass Ally) হতে হবে। কিন্তু কমিউনিস্টদের আন্দোলনের ইতিহাসে কখনো কখনো বাম বিচ্যুতি এড়াতে গিয়ে অনেক সময় ডান বিচ্যুতিও হয়। বুর্জোয়াদের বিভেদ নিয়ে তাদের সাথে খেলতে গিয়ে একাংশকে গণমিত্র তৈরির পরিবর্তে ঐ গণশত্রুদের পেটের ভেতরে ঢুকে পড়লে ব্যাপারটা তা-ই হবে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস একদিকে শিক্ষা দিচ্ছে যে, পাকিস্তানের পশ্চিম অংশের বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে পূর্বাংশের পেটি-বুর্জোয়া-বুর্জোয়াদের নেতৃত্বে পরিচালিত গণসংগ্রাম থেকে বিচ্ছিন্নতাই বুলিবাগীশ বামের বাম বিচ্যুতি ঘটিয়েছিল। তারা স্বকীয় বিপ্লবীপনা রক্ষার নামে গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। আবার এই বিচ্যুতি রোধ করতে গিয়ে দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যসমূহ ভুলে গিয়ে আপন স্বকীয়তা বিসর্জন দিয়ে পূর্বাংশের নতুন বিজয়ী শাসকদের সঙ্গে একাকার হয়ে যাওয়া থেকেই ডান বিচ্যুতি ও সুবিধাবাদের উদ্ভব হতে পারে যেমনটি পরবর্তীকালে বামপন্থিদের মূলধারার (মুক্তিযুদ্ধে যারা ভুল করেন নি!) হয়েছিল। তাঁরা নিজেরাই সেই আত্মসমালোচনা করেছেন। লেনিন প্রয়োজনে প্রতিক্রিয়াশীল ট্রেড ইউনিয়নের মধ্যেও কাজ করতে বলেছিলেন, কিন্তু তা শাসক বা প্রতিক্রিয়াশীলদের হাত শক্ত করার জন্য নয়, তাদেরকে বিভক্ত ও দুর্বল করে তাদের প্রভাব থেকে সম্ভাব্য গণমিত্রদের বের করে নিজেকে শক্তিশালী করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সকল প্রকৃত সম্ভাব্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মিত্রদের মূলধারার বামপন্থিরা প্রথমে সঠিকভাবেই চিহ্নিত করতে পেরেছিল এবং তাদের সঙ্গে সেই মূলধারার বাম যুক্ত থেকেছিল বলেই এত দ্রুত এবং সহজে আমরা সেদিন বিজয় অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলাম। পরবর্তীতে মূলধারার বামেরা স্বাধীন বাংলাদেশে সম্ভাব্য গণমিত্রদের নতুন শক্তি সমাবেশ তৈরি করতে পারেননি এবং নিজেরাই বুর্জোয়া জোটের মধ্যে কিছুটা দ্রবীভূত ও দুর্বল হয়ে গিয়েছিলেন, যার পরিণতিতে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রগতিশীল সম্ভাবনা আর সামনে এগোয়নি। তথ্যনির্দেশ: মণি সিংহ, জীবন সংগ্রাম, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী ১৯৯২; হায়দার আকবর খান রনো (সম্পাদিত), মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থীরা, ঢাকা তরফদার প্রকাশনী ২০১৮; এ টি এম আতিকুর রহমান, ‘মুক্তিযুদ্ধের রূপকল্প : পূর্ব বাংলার চীনপন্থী বাম রাজনীতি, ১৯৬৮-১৯৭১’, গবেষণা সন্দর্ভ (অপ্রকাশিত), জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ২০১৩; নূর মোহাম্মদ, একাত্তরের যুদ্ধ : যশোরে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (এম-এল)-এর বীরত্বপূর্ণ লড়াই এ জীবনদান, ঢাকা, সংহতি প্রকাশন ২০১৬; Talukder Maniryyuaman, Radical Politics and The Emergence of Bangladesh, Dhaka, Mowla Brothers 2003, Lenin, Left-Wing Communism and An Infantile Disorder, Collected Works, Vol-31 লেখক : সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, সিপিবি