কুখ্যাত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল কর

Posted: 07 মার্চ, 2021

গত কয়েক দিন ধরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের জুলুমের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছে বাংলাদেশ। নির্বতনমূলক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তারকৃত লেখক মুশতাক আহমেদের কারাভ্যন্তরে মৃত্যুতে বিক্ষুব্ধ দেশবাসী। ছয়বার জামিন নাকচ হওয়ার পর গত ৩ মার্চ ছয় মাসের জন্য জামিন পেয়েছে একই মামলায় গ্রেফতার হওয়া কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর। মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর প্রতিবাদ মিছিল থেকে গ্রেফতার করা হয় ছাত্র ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি নজির আমিন চৌধুরী জয়, ছাত্র ইউনিয়ন নেতা তামজীদ হায়দার চঞ্চল, জয়তী চক্রবর্তী, নাজিফা জান্নাত, তানজিম রাফি, আকিফ আহমেদ, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট নেতা আরাফাত সাদ’কে। দন্ডবিধির ১৪৩, ১৪৭, ১৪৯, ১৮৬, ৩৩২, ৩৩৩, ৩০৭, ৩৫৩, ৪২৭ মোট নয়টি ধারায় তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। আদালত জামিন নামঞ্জুর করে তাদের কারাগারে পাঠিয়ে দেয়। মুশতাকের মৃত্যুর প্রতিবাদ করে সামাজিক মাধ্যমে মন্তব্য করায় খুলনায় শ্রমিকনেতা রুহুল আমিনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জামিন নামঞ্জুর করে তাকেও কারাগারে পাঠানো হয়েছে। গত বছরের ৪ মে থেকে ৬ মে ঘোর করোনাকালে র্যাব রাজধানীর কাকরাইল, লালমাটিয়া, বাড্ডা ও বনানী এলাকা থেকে আহমেদ কবির কিশোর, মুশতাক আহমেদ, দিদারুল ভুঁইয়া ও মিনহাজ মান্নানকে গ্রেপ্তার করে। পরে র্যাব বাদী হয়ে রমনা থানায় তাদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়ের করে। ওই মামলায় এই চারজনসহ মোট ১১ জনকে আসামি করা হয়। বাকিরা হলেন প্রবাসী সাংবাদিক তাসনিম খলিল ও সাহেদ আলম, সায়ের জুলকারনাইন, আশিক ইমরান, ফিলিপ শুমাখার, স্বপন ওয়াহিদ, ব্লগার আসিফ মহিউদ্দীন। র্যাবের দায়ের করা মামলায় অভিযোগ করা হয়, কার্টুনিস্ট কিশোর তার ‘আমি কিশোর’ ফেসবুক অ্যাকাউন্টে দেশের করোনা ভাইরাস পরিস্থিতিতে সরকারের ভূমিকা নিয়ে বিভিন্ন সমালোচনামূলক কার্টুন-পোস্টার পোস্ট করতেন। মুশতাক তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে কিশোরের সেসব পোস্টের কয়েকটি শেয়ার করেছিলেন। অভিযুক্ত ১১ জন দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে জাতির জনক, বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ, মহামারি করোনা ভাইরাস সম্পর্কে গুজব, রাষ্ট্র ও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করতে অপপ্রচার ও বিভ্রান্তি ছড়ানোর অভিযোগ আনা হয়। গ্রেপ্তার হওয়া কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর, মুশতাক আহমেদসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে ‘আই অ্যাম বাংলাদেশি’ নামের একটি ফেসবুক পেজ থেকে রাষ্ট্রবিরোধী পোস্ট, মহামারি করোনা, সরকারদলীয় বিভিন্ন নেতার কার্টুন দিয়ে গুজব ছড়িয়ে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টির অভিযোগ আনা হয়। গত সেপ্টেম্বরে মিনহাজ মান্নান ও দিদারুল ভূঁইয়া জামিনে মুক্তি পান। গত ১১ জানুয়ারি রমনা থানা পুলিশ কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর, লেখক মুশতাক আহমেদ ও রাষ্ট্রচিন্তার ঢাকা কমিটির নেতা দিদারুল ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র জমা দেয়। নিম্ন ও উচ্চ আদালত মোট ছয়বার কার্টুনিস্ট কিশোর ও লেখক মুশতাকের জামিন আবেদন নাকচ করে দেয়। ২৫ ফেব্রুয়ারি মুশতাকের মৃত্যুর পর কার্টুনিস্ট কিশোর গত ৩ মার্চ জামিন পান ও ৪ মার্চ কারগার থেকে মুক্তি পান। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ ২০০৬ সালে ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন’ প্রণয়ন করা হয় এবং ২০০৯ ও ২০১৩ সালে এর কিছু সংশোধনও করা হয় । আইনটির ৫৭ ধারার প্রয়োগ নিয়ে জনমানসে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দিলে সরকার ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ নামে একটি নতুন আইন করে। পূর্বোক্ত আইনের ৫৭ ধারাকে ভেঙে নতুন আইনের ২১, ২৫, ২৯ এবং ৩১ এই ৪টি ধারায় ছড়িয়ে দেয়া হয়। আইনে অপরাধ হিসাবে আরো নতুন নতুন কিন্তু চরম অনির্দিষ্ট কতগুলি বিষয়কে যুক্ত করা হয়। তদন্তকারী পুলিশ অফিসারের কােেছ এ বিষয়গুলি ব্যখ্যা বিশ্লেষণ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা দেয়া হয়। আইনের মোট ১৩টি ধারার ক্ষেত্রে পুলিশের কাছে যে কোনো কিছুই আমলযোগ্য। অপরাধ প্রমাণের আগেই সেগুলো জামিন-অযোগ্য। শাস্তির মাত্রা অতি উচ্চ। এ আইনের ৪৩ ধারায় পুলিশকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার, জব্দ ও তল্লাশি করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। আর এই তল্লাশি হতে পারে, কোনো ব্যক্তি ডিজিটাল মাধ্যমে অপরাধমূলক কিছু করছে বা করতে পারে বলে মনে হলেই। এই আইন বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ ধারা এবং তথ্য অধিকার আইনের সঙ্গে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করতে হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বাতিল চেয়ে বলেন, ‘আমি মনে করি এই আইন বাতিল করতে হবে। বাতিল করে নতুন ব্যবস্থা নিতে হবে। এটা পর্যালোচনা করে সংশোধন করলে কোনো সমাধান হবে বলে মনে করি না। আমার আহ্বান থাকবে, এই আইন বাতিল করে ডিজিটাল সিকিউরিটির প্রভিশনগুলো প্যানাল কোডের মধ্যে অন্তর্গত করা। কেউ অপরাধ করলে সেই আইনে বিচার করতে হবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘এই আইন গণমাধ্যম, সাংবাদিক ও লেখকদের মত প্রকাশের স্বাধীনতায় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়াবে বলে আশঙ্কা করা হয়েছিল। যে অভিযোগগুলো আনা হলো, রাষ্ট্রের-সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন, এগুলো মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। একটা লেখার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের-সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে, তা কোনোমতে গ্রহণযোগ্য নয়। কাজেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে শুরুতেই যে আশঙ্কা করা হয়েছিল, সেটাই সত্য প্রমাণিত হয়েছে।’ আহমদ রফিক, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, আবুল কাসেম ফজলুল হক, আনোয়ারা সৈয়দ হক, দাউদ হায়দার, যতীন সরকার, মোরশেদ শফিউল হাসান, মামুনুর রশিদ, সলিমুল্লাহ খান, আনু মুহাম্মদ, মোহন রায়হান, শেখ বাতেন, সেলিম জাহান, আজফার হোসেন, শামীম আজাদ, জাকির তালুকদার, সেলিম রেজা নিউটনসহ ৬৬ জন লেখক-কবি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবি জানিয়ে এক বিবৃতিতে বলেন, ‘এতগুলো ধারা জামিন-অযোগ্য রাখা এবং শাস্তির মাত্রা দেখে আমরা ধারণা করতে পারি, এই আইনটি প্রবর্তন করাই হয়েছে লেখক, সাংবাদিক ও বিরোধী যে কারো রাজনৈতিক মতকে নিবর্তন করার জন্য। ক্ষমতায় চিরদিন থাকার বাসনা থেকেই এই আইন প্রবর্তন করা হয়েছে।’ তারা আরো বলেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন একটা চরম গণবিরোধী ও নিপীড়নমূলক আইন। তাই এর কোনো সংস্কার নয়, আমরা এই আইনের দ্রুত বিলোপ দাবি করছি।’ বিশিষ্ট আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তার জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কোনো প্রয়োজন নেই। এই আইন কারও নিরাপত্তা দিতে পারেনি। ২০০৬ সালের তথ্যপ্রযুক্তি (আইসিটি) আইন সংস্কার করে তথ্যপ্রযুক্তি অপরাধের বিপরীতে সুরক্ষা দিতে পারে। অনেকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিশেষ ধারা বাতিলের দাবি করছেন। আমি মনে করি, পুরো আইনই বাতিল করা উচিত।’ তিনি আরো বলেন, ‘আইনটির ব্যবহারই অপব্যবহার। আইনটি এমনভাবে তৈরিই করা হয়েছে, এখানে অভিযুক্ত ব্যক্তির ন্যায়বিচার পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এই আইনে যার বিরুদ্ধে মামলা হয়, প্রথমেই তাকে সামাজিকভাবে হেয় ও অসম্মান করা হয়। আইনটির বেশির ভাগধারা অজামিনযোগ্য। ফলে আসামি আইনি লড়াইয়ের স্বাভাবিক সুযোগ থেকেও বঞ্চিত। এই আইনের প্রায় সব ধারাই নিবর্তনমূলক। প্রয়োগ ও অপপ্রয়োগের বিতর্কে না গিয়ে আমি বলব, আইনটিই খারাপ।’ কমিউনিস্ট পার্টির সিপিবি সভাপতি কমরেড মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও সাধারণ সম্পাদক কমরেড মোহম্মদ শাহ আলম ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে দমন ও নিবর্তনমূলক ফ্যাসিবাদী আইন আখ্যা দিয়ে তার প্রয়োগ অবিলম্বে বন্ধ করার দাবি জানান। বাম গণতান্ত্রিক জোট মানুষের কন্ঠরোধকারী এ আইন বাতিলের দাবি জানিয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২১ ধারার সুযোগ নিয়ে সরকার এবং সরকারের সুবিধাভোগীরা বিরোধী মতের ব্যক্তিদের শায়েস্তা করার জন্য এর ব্যবহার করছে। যেমনটি মুশতাক, কিশোর, দিদারের ক্ষেত্রে ঘটেছে। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ২০১৫ সালে রায় দিয়েছে সরকার ও রাষ্ট্রবিরোধিতা এক নয়। জনগণের টাকায় যাদের বেতন হয়, জনগণ যাদের নির্বাচিত করেন, তাদের সমালোচনা করার অধিকার জনগণের রয়েছে। কোভিডের পরীক্ষা, স্বাস্থ্যসেবার অনিয়ম বা সরকারের অন্য কোন অব্যবস্থা, দুর্নীতি নিয়ে কার্টুন আঁকা ও প্রচার করা রাষ্ট্রদ্রোহ হতে পারে না। এটি নাগরিক অধিকার। ফলে ভোটারবিহীন বা মধ্যরাতের নির্বাচনের সরকারকে অবৈধ বলা বা তার পদত্যাগ দাবি করা রাষ্ট্রের বিরোধিতা নয়, রাষ্ট্রদ্রোহিতা নয়। সেই কারণে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মত বাক, ব্যক্তি স্বাধীনতা খর্বকারী কালো আইন বাতিলের জন্য গণআন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গণবিরোধী সরকারকে পরাভুত করে জনগণের ভাত ও ভোটের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে।