কমরেড আবদুর রহমান

Posted: 18 অক্টোবর, 2020

২ অক্টোবর ২০২০ কমরেড আবদুর রহমানের ২৫তম মৃত্যুবার্ষিকী। যেই দিনটিকে আমরা চাঁদপুরবাসী গভীর শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও নিষ্ঠার সাথে পালন করে আসছি। ঠিক এই দিনটিতেই ২০১৭ সালে আমরা আমাদের আর একজন প্রাণপুরুষ সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের পথিকৃৎ কমরেড জসিম উদ্দীন মন্ডলকে হারিয়েছি। তাঁর স্মরণে শ্রদ্ধাবনত চিত্তে জানাই লাল সালাম। কমরেড আবদুর রহমান ভাইয়ের সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয় ঊনসত্তরের ১৭ সেপ্টেম্বর একটি ছাত্র সমাজের জঙ্গি মিছিলে। সেই মিছিলটিও ছিল আমার জীবনের প্রথম রাজপথে মিছিল। ১৬ সেপ্টেম্বর রাতে পার্থ আমাকে জানালো ছাত্রনেতা আবদুর রহমানের নির্দেশে ১৭ তারিখ সকাল ১০টায় মহিলা কলেজের ছাত্রীদের মিছিল নিয়ে যেন অবশ্যই হাসান আলী স্কুলের মাঠে চলে আসি, চাঁদপুর কলেজ থেকে ছাত্রদের মিছিলটিও সেখানে এসে যোগদান করবে। আমি মনে মনে নিজেকে প্রস্তুত করলাম। ঠিক সকাল সাড়ে ৯টার দিকে কলেজে প্রবেশ করলাম। সব রুমে রুমে ছাত্রীদের ক্লাস চলছে। আমি সাহস নিয়ে ক্লাসে ক্লাসে ঢুকে ছাত্রীদের রাজপথে মিছিলে অংশগ্রহণ করার আহ্বান জানাতেই সব হুড়মুড় করে বেরিয়ে পড়লো। এ যেন হ্যামিলনের বংশীবাদকের বাঁশির সুর। স্যারেরা মিটমিট করে হাসছেন, কোনও বাধা দিলেন না। আমার মনটা আনন্দে নেচে উঠলো। স্লোগান দিতে দিতে ছাত্রীদের নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এলাম। মাইক ছিল না, খালি গলায় মেয়েদের স্লোগান। পিছন ফিরে দেখলাম পার্থও স্লোগান দিতে দিতে আমাদের দিকে দৌড়ে আসছে। কিছুদূর এগোতেই দেখি নীল পাতাকার ব্যানারে সাদা-কাপড়ে লেখা ‘ঐক্য শিক্ষা শান্তি প্রগতি’র মিছিলটি আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। সামনের সারিতে সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরিহিত ব্যক্তিটি রহমান ভাই বলেই ধারণা করলাম। ছাত্র-ছাত্রীদের মিছিল তখন মাঠের মাঝখানে। রহমান ভাই হাত তুলে সকলকে অভিনন্দন জানিয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা দিলেন। তখন সময়টা ছিল গণবিস্ফোরণের। শুধু অপেক্ষা ছিল একটা সাহসী আহ্বানের, তাই ডাক দেয়ার সাথে সাথেই সকলে মিছিলে নেমে এসেছিলো। এটা কারো কৃতিত্ব নয়। এটাই বাস্তব সত্য। স্বাধীনতার আগে ও পরে রহমান ভাইকে যতই দেখেছি ততই অবাক হয়েছি। যিনি শুধুমাত্র শয়নে স্বপনে যাপিত জীবনে শোষণবিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই অবিচল নিষ্ঠাবান ছিলেন। বাম ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্বে থেকে যেমন ধারাবাহিকভাবে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে গেছেন স্বাধীনতার পরবর্তী রাজনৈতিক জীবনেও তেমনি দায়িত্বশীল থেকেছেন। তার সাথে সাথে আমাদেরও সেইভাবে তৈরি করতে চেয়েছেন। সত্তরের নির্বাচনে অধ্যাপক সাত্তার স্যারকে প্রার্থী দাঁড় করিয়ে সকল বাধা উপেক্ষা করে নেমেছেন, আমাদেরও নামিয়েছেন। মার্কা ছিল ‘কুঁড়েঘর’। পরাজয়ে আমরা হার মানি না, কারণ নতুন বার্তা দিয়ে জনগণকে কাছে টানতে পেয়েছি। পঁচিশে মার্চের পরে প্রতিরোধ আন্দোলন করতে নিয়ে বোমা তৈরি করার মতো একটি সাহসী পদক্ষেপে আবদুর রহমান এগিয়ে এসেছিলেন। যদিও শেষ পর্যন্ত সেই বোমা বিস্ফোরণে ৩ এপ্রিল আমাদের চার তরুণ ছাত্র নেতা ঘটনাস্থলে মায়া বাস, আহত হন দু’জন। সার্থকতা, ব্যর্থতা সবই আমাদের পুঁজি। তাই বলে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ থেমে থাকেনি। সেখানেও রহমান দেশমাতৃকার স্বাধিকার আন্দোলনে সশস্ত্র সংগ্রামে যোগদান করেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ছাত্র জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। প্রয়োজন হয় রাজনৈতিক জীবনে পদার্পণ। রহমান ভাই মার্কসবাদ লেলিনবাদের আদর্শে অনুপ্রানিত হয়ে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পদ প্রার্থীর ফরমে স্বাক্ষর করেন। তখন ১৯৭৪ তার সময়ে যে দুজন প্রার্থী ফরম পূরণ করে তার মধ্যে প্রয়াত অধ্যাপক সৈয়দ আবদুস সাত্তার স্যার অন্যজন আমি। চাঁদপুরের আকাশে তখন সরকারি দল আওয়ামী লীগ বৃহত্তর বিরোধী দল ন্যাপের (মোজাফর) পাশাপাশি কমিউনিস্ট পার্টি কাস্তে হাতুড়ি মার্কা লাল ঝান্ডা উড়তে দেখা যায়। ছাত্র ইউনিয়ন থেকে কিছু সংখ্যক ছাত্র বেড়িয়ে গিয়ে ছাত্র সমিতি গঠন করে থাকে। সেই সময়টাতে যেন বামধারার রাজনীতির একটি শক্তিশালী জোয়ার বইছিল। সমাজতন্ত্রের শব্দে শুধু শহরেই নয় গ্রাম-বাংলায়ও মুখরিত ছিল। প্রত্যেক উপজেলায় বাম ধারার ছাত্র-কৃষক ক্ষেত মজুর সমিতির গ্রুপ বৈঠক চলছিল। ঐ সময়ে কমরেড আবদুর রহমান উচ্ছ্বসিত কমরেডদের পার্টির সংযত করার লক্ষ্যে পার্টির গঠনতন্ত্রের নিয়মাবলির ওপর যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছিলেন। প্রত্যেক কমরেডের গ্রুপ গঠনের দায়িত্ব পার্টির মুখপত্র একতা পাঠ করা, বিক্রি করা, কাজের হিসাবের জন্য ডাইরি লেখা, পরিচিত বন্ধু বান্ধবের সাথে পার্টির বিষয়ে আলোচনা করাও তাদের ঠিকানা রাখা। পার্টিকে এজেন্ডা রেখে সমালোচনা আত্ম সমালোচনা করা দোষ ত্রুটি ভালোমন্দ সব। গঠনমূলক আলোচনা, সমালোচনার ক্ষেত্রে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য মধ্যবিত্তসুলভ আচরণ না করা বরং নিজেকে শোধরানো প্রকৃত আয়ের উৎস ও পরিমাণ গোপন রেখে আয়কর ফাঁকি দেয়ার মত মধ্যবিত্ত সুলভ দুর্বলতা পরিত্যাগ করা। নারী সমাজের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা ইত্যাদি। আচরণবিধি পালনের মধ্য দিয়ে পার্টির ভিত শক্ত ও মজবুত হচ্ছিল। জনগণের বৃহৎ অংশ নারীসমাজ যারা অবহেলিত নির্যাতিত পশ্চাৎপদ মহিলা পরিষদের মাধ্যমে তাদের মধ্যে পার্টিকে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত করা হয়। প্রতি মাসে এ সকল কর্মকাণ্ডের রিপোর্ট করা। উপর হতে নিচ, নিচ হতে উপরে সকল বিষয়ে তৎপর থাকা। এভাবে একটা সুশৃঙ্খল কর্মপদ্ধতি চালু হল। আমাদের জীবনে অন্যান্য ধারার সাথে পার্টি। আমরা মূলত পার্টিকে জীবনে প্রধান করতে পারছি না যা করেছেন কমরেড আবদুর রহমান। পার্টিই তার জীবন তারপর অন্যসব। তার দাম্পত্য জীবনেও একজন বিদূষী মহিলা অধ্যাপিকা পার্টি কমরেডকে জীবন সঙ্গিনী করেন। শামছুন নাহার শান্তি ভাবী নিঃসন্তান। কমরেড রহমান আইন পেশার সাথে যুক্ত হয়েও দু’হাতে পয়সা উপার্জন করতে পারেন নাই। গরিব মক্কেলদের ঠকিয়ে দিনের পর দিন উপার্জন তাঁর পক্ষে সম্ভব হয় নাই। তার বিচার, বিবেক, আদর্শ, সত্যাশ্রয়ী মানসিকতা পরিত্যাগ করা সম্ভব হয় নাই। এমনই নির্লোভ নিরহংকার সংবেদনশীল মানবদরদি কমরেড তার বৃহত্তর রাজনৈতিক জীবনে বার দু’য়েক প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছেন। প্রথমত দেশি ও বিদেশি চক্রান্তে পঁচাত্তরে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড যা সমগ্র জাতির জীবনে এক চরম বেদনাদায়ক অধ্যায়। সেই ঘোর কাটিয়ে দেশ আবারও যখন কর্মচঞ্চল হয়ে উঠলো। আবারও শুরু গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়া সভা সমিতি, হরতাল, অবরোধ, মিছিল বিক্ষোভে। রক্ত ভেজা স্বাধীনতার ফসলগুলিকে একে একে ধূলিস্যাৎ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত স্বৈরাচারি সরকারকে উৎখাত করার জন্য জনগণ যখন সংগঠিত হচ্ছিল ঠিক সেই সময়ে দুনিয়াব্যাপী আরও একটি দুঃস্বপ্নের মতো ঘটনা ঘটলো। সমাজতান্ত্রিক সমাজে এক মহা পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা দেখা গেল। যার প্রভাব বাংলাদেশের বাম দলগুলির ওপর ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হলো। বাইরে থেকে যখন আক্রমণ আসে তখন ঘরের মানুষ একত্র হয়ে প্রতিরোধ কওে, কিন্তু ঘরে যখন ভাঙন দেখা দেয় সেই বিপদ হতে রক্ষা করবে কে? বা কারা। বাস্তব অবস্থাটা ঠিক এমনই ছিল। অনেক নিবেদিত প্রান কমরেড হয় দল ছেড়ে দিয়েছেন আবার কেউ রাজনীতির থেকেই বিদায় নিয়েছেন একান্তই যারা ধৈর্য্য ধারণ করতে পেরেছেন তারা সেই পঁচাত্তরের মতো ছিলেন- দেখো এবং অপেক্ষা করো। পার্টিই যার জীবন সেই কমরেড আবদুর রহমান নব্বইয়ের দশকে সমাজতান্ত্রিক শিবিরের এই মহা প্রলয়ের দিন কেমন ছিলেন। তিনি দর্শকের ভূমিকায় ছিলেন না। নেতৃত্বের ভূমিকায় থেকেই সকলকে বুঝাতে চেয়েছেন যে এই অবস্থারও পরিবর্তন হবে। আবার সব স্বাভাবিক হয়ে আসবেই। যারা বিশ্বাস করেছেন তারা রয়ে গেছেন বাকিরা ছিটকে পরে গেছেন। এত বড় দুঃসহ আঘাতে তার সংবেদনশীল বুকের মাঝে যে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছিল দিনে দিনে পলে পলে তার থেকে বিন্দু বিন্দু রক্ত ক্ষরণ হচ্ছিল বাইরে থেকে তা বুঝতে পারা যায়নি। একদিনেই সবটুকু যখন একেবারেই নিঃশেষ হয়ে গেলো সেটাই ছিল ২ অক্টোবর ১৯৯৫ তাঁর জীবনের শেষ সূর্যোদয়। আজ তাই ঐ গানের কলিতে আবারও সুর ধরবো– তোমার সমাধি ফুলে ফুলে ঢাকা কে বলে তুমি নাই– তুমি আছ– তারপর না মন বলেনা। বলে তোমার কালজয়ী বিজ্ঞানভিত্তিক সাম্যবাদের আদর্শ। তুমি ছিলে, তুমি আছ, তুমি থাকবে। বাংলার মাটি সংগ্রামের এক উর্বর ঘাঁটি। এখানে অন্যায় অত্যাচার, শোষণ, লুটপাট যতই থাক তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রতিরোধও রয়েছে। এখনো ইতিহাসের পাতায় পাতায় অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের নাম উচ্চারণে এই প্রজন্মের দেহ মন রোমাঞ্চিত হয়– হৃদয়ে শিহরণ জাগে। তাদের বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তাধারা, উদ্ভাবনী শক্তি এক বিশাল সম্ভাবনার দ্বারা উন্মোচিত করেছে। ওরা কখনও শূন্য হাতে ফিরে যাবে না যেতে পারে না। তারাই আজকে লড়াইয়ের প্রথম কাতারে এগিয়ে আসছে। এই সেই তরুণ প্রজন্ম যারা অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে মৃত্যুর সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়াবার প্রচণ্ড সাহস রাখে। আবার সর্বনাশায় উদ্যত হাতে সৃষ্টিকে ল-ভ- ছিন্ন বিছিন্ন করতে পারে। ওরা ছুটছে গ্রহ হতে গ্রহান্তরে। কোথায় মঙ্গল? কোথায় শুক্র? মানুষ বাঁচবে কোথায়? থাকবে কোথায়? মনে হয় এই বিশাল বিশ্বটাকে ওরা খেলনা লাটিমের মত হাতের তালুতে রেখে দোলাচ্ছে। এটাই ওদের যৌবনের অহংকার এখন তাদের নিয়ন্ত্রণেই এই কল্যাণময় পৃথিবীর ভবিষ্যত নির্ভর করছে। এখন সময় বলে দিচ্ছে ঐ রহমানদের স্বপ্ন সফল করতে হলে এই তরুণ সমাজকে ভালোবেসে কাছে টানতে হবে। তাদের মনোজগতে সেই বিপ্লবী সমাজের চিত্র ভেসে বেড়াচ্ছে এক আহ্বানের প্রতীক্ষায়। এই আহ্বান আকাশ হতে নয়, এই আহ্বান এ দেশের কৃষক শ্রমিক মেহনতি জনতার কণ্ঠ হতেই। যা বিশ্বাস করতেন কমরেড আবদুর রহমান। আজ তাকেই জানাই হাজারো সালাম। লেখক : সভাপতি, সিপিবি, চাঁদপুর জেলা কমিটি