ধর্ষণ ও বিচারহীনতার বিরুদ্ধে লংমার্চ

Posted: 18 অক্টোবর, 2020

একতা প্রতিবেদক : ধর্ষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী গণজাগরণ তৈরির লক্ষ্যে ঢাকা থেকে নোয়াখালী পর্যন্ত লংমার্চ করেছে ‘ধর্ষণ ও বিচারহীনতার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ’। বামপন্থি ছাত্র-যুব সংগঠনের নেতৃত্বে বিভিন্ন সংগঠনের সদস্যদের নিয়ে ১৬ অক্টোবর সকাল সাড়ে দশটার দিকে রাজধানীর জাতীয় জাদুঘরের সামনে থেকে লংমার্চ শুরু হয়। লংমার্চের আগে শাহবাগে সমাবেশে বক্তারা বলেন, সারা দেশে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় যে ধর্ষণের অভয়ারণ্য তৈরি হয়েছে, যে বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে, তা জনগণ কোনোভাবেই মেনে নেবে না। এর বিরুদ্ধে গণজাগরণ তৈরির লক্ষ্যে এই লংমার্চ। সমাবেশে সিপিবি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য লুনা নূর বলেন, ‘বিচারহীনতার যে পরিবেশ তৈরি হয়েছে তা দূর করার দাবিতে লড়াই-সংগ্রামকে সমন্বিত করতে, দেশবাসীর চেতনা ও অবস্থানকে সমন্বিত করতে আমাদের আহ্বান থাকবে এই লংমার্চ।’ সমাবেশে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি মেহেদী হাসান নোবেল বলেন, ‘সরকার এখন ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করেছে। কিন্তু এই করে সমাজ ও রাষ্ট্রে ধর্ষণ বন্ধ করা যাবে না। মৃত্যুদণ্ড থেকেও যেটি বেশি প্রয়োজন সেটি হল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ। সিলেটে ধর্ষণকাণ্ডের পরে তার যে বক্তব্য, তা নারী নিপীড়কদের প্রশ্রয় দেয়।’ লংমার্চটি শাহবাগ, গুলিস্তান হয়ে যায় নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ায়। চাষাঢ়া কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে অনুষ্ঠিত সমাবেশ থেকে ধর্ষণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। ১৬ অক্টোবর বেলা পৌঁনে ১টার শুরু হওয়া এ সমাবেশে বক্তারা বলেন, আগামীর লড়াই হবে ধর্ষণের বিরুদ্ধে; ধর্ষণের পাহারাদার এই সরকারের বিরুদ্ধে। ছাত্র ইউনিয়নের নারায়ণগঞ্জ জেলার সভাপতি শুভ বনিকের সভাপতিত্বে ফারহানা মানিক মুনার সঞ্চালনায় সমাবেশে বাংলাদেশ যুব ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আসাদ্জ্জুামান মাসুম, উদীচী শিল্পী গোষ্ঠি কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক জামশেদ আনোয়ার, নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক শাহীন মাহমুদ, চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের নেতা নিখিল দাস, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি মেহেদী হাসান, সাধারণ সম্পাদক অনিক রায়, গণতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের দফতর সম্পাদক সালমান সিদ্দিকী, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন বক্তব্য রাখেন। সমাবেশে মাসুম বলেন, ‘সারাদেশে নারী নির্যাতন ও ধর্ষণ বেড়েছে; বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে ধর্ষণ বাড়ছে। ছাত্রলীগ, যুবলীগ দেশে ধর্ষণের রাজনীতি চালু করেছে।’ সিলেটে এমসি কলেজে ধর্ষণের ঘটনায় ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা জড়িত উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘গডফাদারে সারাদেশ সয়লাব হয়ে গেছে। রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে, চিবিয়ে দানবে পরিণত হয়েছে সরকার।’ তিনি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড আইন করে বাহবা নিতে চায়। ধর্ষণ বিরোধী আমাদের এই আন্দোলনে ধর্ষণের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও বিচার দেখতে চায় দেশের মানুষ। সকলের একটাই দাবি ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা। বাংলাদেশ থেকে সমূলে ধর্ষণ নিশ্চিহ্ন করতে হবে। লংমার্চে কোথাও বাধা দেওয়ার চেষ্টা হলে সরকারের পতনের আন্দোলন শুরু হবে বলেও সমাবেশ থেকে অন্য বক্তারা হুঁশিয়ারি দেন। তারা বলেন, দেশের আইনের শাসন নেই, গণতন্ত্র নেই। শোষণহীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য ৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু নারী-পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়নি, শোষণহীন রাষ্ট্র ব্যবস্থা চালু হয়নি। এই লড়াই জেলায় জেলায়, থানায় থানায় প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। ধর্ষণ ও বিচারহীনতার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের এ লংমার্চে পূর্ব ঘোষিত নয় দফা বাস্তবায়নের আহ্বান জানানো হয়। এ নয় দফা দাবি হল- সারাদেশে অব্যাহত ধর্ষণ-নারীর প্রতি সহিংসতার সাথে যুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। ধর্ষণ, নিপীড়ন বন্ধ ও বিচারে ব্যর্থ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে অবিলম্বে অপসারণ করতে হবে; পাহাড়-সমতলে আদিবাসী নারীদের ওপর সামরিক-বেসামরিক সকল প্রকার যৌন ও সামাজিক নিপীড়ন বন্ধ করতে হবে; হাই কোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সরকারি, বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠানে নারী নির্যাতন বিরোধী সেল কার্যকর করতে হবে। সিডও সনদে বাংলাদেশকে স্বাক্ষর ও তার পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে। নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক সকল আইন ও প্রথা বিলোপ করতে হবে; ধর্মীয়সহ সকল ধরনের সভা-সমাবেশে নারী বিরোধী বক্তব্য শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে হবে। সাহিত্য, নাটক, সিনেমা, বিজ্ঞাপনে নারীকে পণ্য হিসেবে উপস্থাপন বন্ধ করতে হবে। পর্নগ্রাফি নিয়ন্ত্রণে বিটিসিএলকে কার্যকরী ভূমিকা নিতে হবে। সুস্থ ধারার সাংস্কৃতিক চর্চায় সরকারিভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করতে হবে; তদন্তকালীন সময়ে ভিকটিমকে মানসিক নিপীড়ন-হয়রানি বন্ধ করতে হবে। ভিকটিমের আইনগত ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে; অপরাধ বিজ্ঞান ও জেন্ডার বিশেষজ্ঞদের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা বাড়িয়ে অনিষ্পন্ন সকল মামলা দ্রুত নিষ্পন্ন করতে হবে; ধর্ষণ মামলার ক্ষেত্রে সাক্ষ্য আইন ১৮৭২-১৫৫(৪) ধারাকে বিলোপ করতে হবে এবং ডিএনএ আইনকে সাক্ষ্য প্রমাণের ক্ষেত্রে কার্যকর করতে হবে; পাঠ্যপুস্তকে নারীর প্রতি অবমাননা ও বৈষম্যমূলক যে কোনো প্রবন্ধ, নিবন্ধ, পরিচ্ছেদ, ছবি, নির্দেশনা ও শব্দ চয়ন পরিহার করতে হবে; গ্রাম্য সালিশের মাধ্যমে ধর্ষণের অভিযোগ ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে হবে। নারায়ণগঞ্জ থেকে সোনারগাঁও হয়ে লংমার্চ যায় কুমিল্লায়। পরদিন ফেনী, নোয়াখালীর চৌমুহনী হয়ে যায় বেগমগঞ্জের একলাসপুর। সেখান থেকে মাইজদী কোর্টে। সেখানে সমাবেশের মধ্যে দিয়ে শেষ হয় দুইদিনের এই লংমার্চ। দায়সারার আইনের পরিবর্তন দিয়ে ধর্ষণ বন্ধ হবে না: সারাদেশে ধর্ষণ এবং নারী নিপীড়নের বিরুদ্ধে চলমান ‘ধর্ষণ ও বিচারহীনতার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ’-এর পক্ষ থেকে গত ১৩ অক্টোবর বিকেল ৪টায় শাহবাগে সাংবাদিক সম্মেলন হয়। মন্ত্রিসভায় “ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যদণ্ড” এমন দায়সারা আইন পাশের প্রতিক্রিয়ায় সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় সংসদের সাধারণ সম্পাদক অনিক রায়। উপস্থিত ছিলেন সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক নাসিরউদ্দিন প্রিন্স, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সভাপতি মাসুদ রানা, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক জাহিদ সুজন, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর কেন্দ্রীয় নেতা রহমান মফিজ, আরিফ নূর। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন যখন তুঙ্গে ঠিক সেই সময়ে প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রীসভায় দাঁড়িয়ে জনগণের সামনে ‘ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যদণ্ড’ এমন দায়সারা সিদ্ধান্ত নিয়ে এসে আন্দোলন দমানোর চেষ্টা করছে। ধর্ষকের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড– এটা কোনো সমাধান না, বরং অনেক ক্ষেত্রে এই আইন ভুক্তভোগীর জীবনের জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে। এই আইন কার্যকর হলে নিজের জীবন বাঁচানোর জন্য ধর্ষক ধর্ষণের আলামত মুছে ফেলতে চাইবে; এ কারণে সে ভুক্তভোগীকে মেরেও ফেলতে পারে। শাস্তির মাত্রা বাড়ানোর চাইতে অপরাধ প্রমাণ করার জন্য যেসব বাধা আছে আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত সেগুলো দূর করা। ভুক্তভোগী যেন ন্যায়বিচার পান, সে পথটিই সুগম করা। আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত প্রতিটি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত নিশ্চিত করা এবং অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার পর শাস্তি কার্যকর করা। বিচারহীনতার সংস্কৃতি ভাঙা না হলে শাস্তির মাত্রা যাই হোক না কেন ভুক্তভোগী বিচার পাবেন কিনা সেটা অনিশ্চিতই থেকে যায়। লিখিত বক্তব্যে আরও বলা হয়, আমাদের দেশে ১০০টা ধর্ষণের ঘটনার মধ্যে মাত্র তিনটা ঘটনার বিচার হয়। অধিকাংশ ঘটনা বিচার প্রক্রিয়া পর্যন্ত পৌঁছাতেই পারে না। এই বিচারহীনতার সংস্কৃতি এবং আইনি ও বিচারিক প্রক্রিয়ায় যে অসংখ্য অসঙ্গতি ও জটিলতা আছে তা দূর করার পথে না হেঁটে সরকার যে মূলা ঝুলানোর রাজনীতির আশ্রয় নিচ্ছে, সেটা কোনোভাবেই ধর্ষণের সংস্কৃতি দমাতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে না। সরকারের বিভিন্ন অঙ্গ এবং সরকারি দলের অঙ্গসংগঠনসমূহের নেতাকর্মীরা দেশের সব জায়গায় যে অপরিসীম ক্ষমতার চর্চা করে, তার সামনে দাঁড়িয়ে একজন ভুক্তভোগীর পক্ষে বিচার চাওয়া কঠিন। এই সাহস যদি কোনো ভুক্তভোগী করেও ফেলে, তারপর শুরু হয় পুলিশ বাহিনীর অসহযোগিতা ও খারাপ আচরণ। এই সবকিছু পার করে যদি কোনো ভুক্তভোগী আদালত পর্যন্ত পৌঁছায়ও সেখানে তার নিজের চারিত্রিক পবিত্রতা প্রমাণ করতে হয়। গ্রামীণ সালিশে যেভাবে ভুক্তভোগীকে দোররা মারা হয়, সেই একই কায়দায় আমাদের দেশের আদালতেও ভুক্তভোগীকেই দোষী সাব্যস্ত করা হয়। এই ধরনের কাঠামোতে একজন ভিক্টিমকে একবার না, বারবার নীপিড়িত হতে হয়। আইন ও বিচারিক প্রক্রিয়ার এই সমস্ত অসঙ্গতি পরিবর্তন না করে শুধুমাত্র মৃত্যুদণ্ডের বুলি আওড়ায়ে এই আন্দোলন বন্ধ করা যাবে না। এইবারের আন্দোলন শুধু একটা, দুইটা কিংবা তিনটা ঘটনার বিচার আদায়ের জন্য নয়, এইবারের আন্দোলন দেশ থেকে ধর্ষণের সংস্কৃতিকে সমূলে উৎপাটনের আন্দোলন। বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বর্তমান দৃশ্য আমাদের সবার সামনেই পরিষ্কার। আমরা দেখছি, যখন ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন চলছে, তখনও ধর্ষণের ঘটনা বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘটছে এবং একইসঙ্গে আমরা দেখলাম সিলেটে ১০ হাজার টাকা ঘুষ না দেয়ায় বাংলাদেশের একজন নাগরিককে পুলিশ ফাঁড়িতে পিটিয়ে হত্যা করা হলো। বাংলাদেশের মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কথা ছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কিন্তু আমাদের এই মন্ত্রণালয় এবং এর মন্ত্রী উভয়েই ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। আমরা চাই, জনগণের সম্মুখে সরকার এই ব্যর্থতার দায় স্বীকার করবে এবং ব্যর্থ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে অবিলম্বে অপসারণ করা হবে।