ইয়েমেনে সৌদি জোটের আগ্রাসনের শেষ কোথায়

Posted: 28 জুন, 2020

তাহসীন মল্লিক : চলতি বছরের ছয় মাসে ১২ দফায় ইয়েমেনে প্রায় ১১০০ বার বিমান হামলা চালিয়েছে সৌদি আরব নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট। ২৬ জুন ২৪ ঘণ্টায় রাজধানী সানায় ৩৪ বার বিমান হামলা চালিয়েছে সৌদি জোট। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে গড়ে ৪২ বার করে চালানো হয় বিমান হামলা। যদিও ৮ এপ্রিল থেকে করোনা মাহামারীর দরুন সৌদি আরব ও তার মিত্ররা যুদ্ধবিরতি পালন করবে বলে ঘোষণা দিয়েছিল। জোটের পক্ষ থেকে বছরের শুরুতে কয়েক দফা ক্ষেপণাস্ত্র হামলাও চালানো হয় ইয়েমেনের মা’রিব শহরে। এসিএলিইডি (দ্যা আর্মড কনফ্লিক্ট লোকেশন এন্ড ইভেন্ট ডাটা) এর তথ্যমতে ইয়েমেনে সৌদি জোটের স্থল, বিমান, ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় এখন পর্যন্ত প্রায় ১ লক্ষ ইয়েমেনীর মৃত্যু হয়েছে। যাদের মধ্যে ১২ হাজার সাধারণ ইয়েমেনী নাগরিক। সৌদি জোটের বিমান হামলার পাশাপাশি চলছে নিষেধাজ্ঞা। যুদ্ধ এবং নিষেধাজ্ঞার ফলে সৃষ্টি হওয়া মর্মান্তিক দুর্ভিক্ষে মারা গেছে প্রায় ৮৫ হাজার মানুষ। বাস্তুচ্যুত কয়েক লাখ মানুষ মানবেতর জীবন যাপন করছেন। সংকটের শুরু ২০১৪ সাল থেকে ইয়েমেন সংঘাত শুরু হয়। ইরানের হুতি সমর্থিত বিদ্রোহীরা ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট মনসুর হাদিকে উচ্ছেদ করে রাজধানী সানা দখলে নেয়। রিয়াদে আশ্রয় নেন প্রেসিডেন্ট হাদি। মনসুর হাদি সৌদি জোটের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। এবং মধ্যপ্রাচ্যে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে সংঘাতে লিপ্ত রয়েছে সৌদি আরব এবং ইরান। এমতাবস্থায় প্রতিবেশি দেশ ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহীদের উত্থান মেনে নিতে পারেনি সৌদি আরব। ফলে ২০১৫ সালের মার্চ থেকে সৌদি সামরিক জোটের মিত্রদের নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় ‘অপারেশন ডিসাইসিভ স্টর্ম’ নামে সামরিক অভিযান শুরু করে রিয়াদ। ২৪ মার্চ ইয়েমেনের ঢালেতে অবস্থিত হুতি বিদ্রোহীদের দখলকৃত সরকারি দপ্তর থেকে মুখোমুখি সংঘাতের সূচনা হয়। হুতি-সৌদি জোটের সংঘাত সারা ইয়েমেন এবং ইয়েমেন-সৌদি সীমান্ত এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। ১৪ এপ্রিল ২০১৫ হুতি বিদ্রোহীদের উপর নিষেধাজ্ঞার প্রস্তাব পাশ হয় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে। প্রায় চার বছর ধরে চলমান সংঘাতে পর্যদুস্ত হয়ে পড়ে ইয়েমেন। শুরু হয় দুর্ভিক্ষ। ইয়েমেনের দক্ষিণাংশের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় রিয়াদ এবং আবুধাবির কাছে। আর হুতি বিদ্রোহীদের সমর্থিত ইয়েমেনের ন্যাশনাল সালভেশন সরকারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বাকি অংশ। গত বছর জুলাইয়ে সৌদি জোটের মিত্র সংযুক্ত আরব-আমিরাতের সৈন্যদল ইয়েমেন ত্যাগ করে। কিন্তু তারপরও অব্যাহতভাবেই চলছে পাল্টাপাল্টি হামলা এবং সংঘাত। ভৌগলিক ভাবে ইয়েমেন আরব সাগরের একটি ব-দ্বীপ। তার গাঁ ঘেষে প্রবাহিত হওয়া লোহিত সাগর ইসরাইল, মিশর এবং জর্ডানের আরব সাগরে মিলিত হওয়ার একমাত্র মাধ্যম। ফলে এডেন কিংবা জানজিবার বন্দরে ইরানের মত শত্রু দেশের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা এই তিন দেশের জন্য হুমকিই বটে। আর সৌদি আরবের জন্য ইয়েমেন কর্তৃক ইরানকে সমর্থন ভৌগলিক আধিপত্যের খেলায় চরম পরাজয়। আর সংযুক্ত আরব আমিরাতের এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ শুধুই ইয়েমেনের প্রাকৃতিক সম্পদ লুটের অভিপ্রায় থেকে। কারণ সৌদি আরব ও আমিরাত ঐক্যবদ্ধ হয়ে যুদ্ধ করলেও জায়গা দখল নিয়ে তাদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে চলে আসে। সংঘাতের শেষ কোথায়? আপাতত দৃষ্টিতে ইয়েমেনে চলমান সৌদি জোটের আগ্রাসনের কোনো ইতি নেই। ২০১৫ সাল থেকেই সৌদি জোট ইয়েমেনের ন্যাশনাল সালভেশন সরকারের প্রধানমন্ত্রী আব্দুল আজিজ হাবতুরকে উৎখাতের জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করেছে। বিপরীতে সর্বশক্তিতে প্রতিরোধ করছে হুতি বিদ্রোহীরা। সৌদি জোটে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন। আর হুতি বিদ্রোহীদের পক্ষে ইরান ব্যাতীত কোনো দেশের প্রত্যক্ষ সমর্থন নেই। এমনকি ২০১৫ সালে নিরাপত্তা পরিষদে হুতি বিদ্রোহীদের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের সময় ভোটদানে বিরত ছিল ইরানের মিত্র বলে পরিচিত রাশিয়া। ইয়েমেন ইস্যুতে জাতিসংঘ কয়েকদফা শান্তি আলোচনার চেষ্টা করলেও তাদের সমর্থন ঝুঁকে রয়েছে সৌদি জোটের দিকে। ফলে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় সংঘাতের অবসানের কোনো সুযোগ নেই। গত ২৩ জুন ২০২০ জাতিসংঘ তাদের কালো তালিকা থেকে সৌদি নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটকে শিশু হত্যাকারী হিসেবে অব্যাহতি দেয়। এমন ঘটনাকে ‘সৌদি জোটের পক্ষেই জাতিসংঘের স্পষ্ট অবস্থান’ বলে ক্ষোভও প্রকাশ করেছিল ইয়েমেন। আর গত বছরের সেপ্টেম্বরে হুতি বিদ্রোহীরা জাতিসংঘের কাছে শান্তি আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছিল তারও গুরুত্ব ফুরিয়ে আসছে দিন দিন।