ময়মনসিংহের প্রথম শহীদ মিনার
Posted: 23 ফেব্রুয়ারী, 2020
রাশেদা কুদ্দুস রানু ঃ
ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে ময়মনসিংহের প্রথম শহীদ মিনার নির্মিত হয় পুরানো পৌরসভা ভবনের পাশে। কিভাবে, কখন, কার ডাকে, কার উদ্যোগে, কার হাতে এই শহীদ মিনারের স্তম্ভ তৈরি হলো। তা এখন অনেকেই জানেন না।
গত ৪ঠা ফেব্রুয়ারি, মঙ্গলবার কালের কণ্ঠে দেখতে পেলাম কবি ও গবেষক ফরিদ আহমদ দুলাল সাহেব লিখেছেন, ময়মনসিংহের এই প্রথম শহীদ মিনার সম্পর্কে। উনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি, লিখার জন্য। উনি যাদের নাম লিখেছেন, তা ছাড়াও আরো অনেক নাম আছে, এবং অজানাও আছে অনেক নাম।
তবে আমাদের জানা আছে এই শহীদ মিনারটি কমরেড আলতাব আলীর হাতেই হয়েছে। তখন সেই উত্থার সময়ে চারদিকে শুধু মিটিং মিছিল চলছে। রাষ্ট্রের ভাষার জন্য। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই– এই স্লোগান সারাদেশে চলছে। পত্র-পত্রিকায় শুধু ছবি আর ছবি সব মিছিলের এবং মিটিংয়ের। একই কথা ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। রাষ্ট্র ভাষা মায়ের ভাষা, মায়ের ভাষা বাংলা ভাষা, আমার ভাষা বাংলা ভাষা।
সেই সময় কমরেড আলতাব আলী ঢাকায় অবস্থান করছিলেন রাষ্ট্রভাষার আন্দোলনের কাজে পার্টির সাথে কাজ করতেন। ২১ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাত্রেই কমরেড আলতাব আলী ঢাকা থেকে ময়মনসিংহে ফিরে আসেন এবং রাত্রেই চুঙ্গা মেরে শহরের চারদিকে জানানো হলো ঢাকা শহরে রক্তের নদী হয়ে গেছে। রক্তের বন্যা হয়ে গেছে। পার্টির লোকজন সবাই চুঙ্গা নিয়ে বের হয়ে মাইকিং করছে। সাইকেলে লোকজন যে যেখানে পারছে যাচ্ছে এবং সবাইকে বলা হচ্ছে– সূর্য উঠার আগেই, অন্ধকার থাকতেই সবাই মিউনিসিপালটি অফিসের মোড়ে আসবেন। রাষ্ট্র ভাষা বাংলার জন্য যাদের প্রাণ গেল তাদের আমরা স্মরণ করব, প্রতিবাদ করব। যারা হত্যা করেছে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করব সংগ্রাম করব। যাদের বুকের রক্ত দিয়ে ঢাকায় বন্যা হলো, যাদের মায়ের বুক খালি হলো, তাদের আমরা ভুলবো না। তারা গিয়েছে আমরা আছি রাষ্ট্রভাষা বাংলাই হবে। আমাদের ভাষা কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। আরো রক্ত দিতে হলে আমরা ছাত্ররা দেশের সর্বস্তরের জনগণ আরো রক্ত দিবে। তবু বাংলাভাষা কেড়ে নিতে দিব না। আমরা এই ভাষা শহীদদের প্রতি সম্মান জানাতেই একত্রিত হবো এই মিউনিসিপালটি অফিসের পাশে।
কমরেড আলতাব আলীর নির্দেশে কাজ শুরু হলো। ফজরের আজানের পরপরেই লোকজন জড়ো হলো যথাস্থানে। টুকড়া কাটা হলো। চারপাশে চার বাঁশ পোঁতা হলো, উপরের দিকে চারটি বাঁশের মাথা একসাথে বাঁধা হলো।
আলতাব আলী সাহেব দুই, তিনটি ইট নিয়ে বসে পড়লেন এবং ইটের উপর মোম ধরালেন। শহীদ মিনারের ভিত্তিস্থাপন হলো। পুরো এলাকা লোকারণ্য। শ্লোগান আর শ্লোগান।
শহীদ মিনার তৈরি হবার পর হঠাৎ করেই পুলিশ আসলো। শহীদ মিনারটি ভেঙে ফেললো। শহীদ মিনারের বাঁশ দিয়েই সকলের উপর লাঠি চার্জ করতে থাকলো। ইটগুলো নিয়ে কারোর ওপর ছুঁড়ে ফেললো। মার খেয়ে অনেকেই আহত হলেন। অনেককেই আটক করে নিয়ে গেলো। আলতাব আলীর মাথা ফেটে গেল। আরো অনেকের এই অবস্থা হয়েছে। কারো হাত, কারো পা, মাথা, পিঠ। অনেক রক্ত ঝরলো।
এখানে অনেকের নাম আসেনি। এখানে কমরেড মজিরুন্ননেছার ভূমিকা ছিল সবচাইতে বেশি। নারী হিসাবে উনি উনার পরিবারের আত্মীয় স্বজন এবং শহরের অনেক নারীদের এই সমাবেশে নিয়ে গিয়েছিলেন। নারীর সংখ্যা মোটামুটি অনেক ছিলেন। মজিরুন্ননেছা ছিলেন আলতাব আলী সাহেবের স্ত্রী।
আমাদের জিয়া ভাই এবং আমি নিজে উপস্থিত ছিলাম কালের সাক্ষী হয়ে। আমরা এখনো বেঁচে আছি। জিয়া ভাই হলেন প্রিন্সিপাল মতিউর রহমানের ভাই। আমি ছোট ছিলাম, কিন্তু আমার মা মজিরুন্ননেছার সাথে সব মিছিলে গিয়েছে। ভাষা আন্দোলনের মিছিলে।
তাই ময়মনসিংহের প্রথম শহীদ মিনার ২২শে ফেব্রুয়ারি ভোর বেলায় আলতাব আলীর হাতে এই শহীদ মিনার তৈরি হয়।
কমরেড আলতাব আলী ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের একজন নেতা। উনার জন্ম ১ জানুয়ারি ১৯০৯ সালে। মৃত্যুবরণ করেন ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৮০ সালে।
উনার স্ত্রী কমরেড মজিরুন্ননেছাও ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের একজন কর্মী ছিলেন।
চারদিকে বাংলা ভাষার জন্য মিটিং মিছিল চলছে। কমরেড আলতাব আলী ঢাকায় অবস্থান করছে ভাষা আন্দোলন সফল করার জন্য। ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথে ছাত্রদের উপর, সাধারণ মানুষের উপর যখন গুলি চালানো হলো আলতাব আলী সেই মিছিলে ছিলেন। রক্তে ভেজে গেলো রাজপথ। কমরেড আলতাব আলী রাত্রেই ময়মনসিংহে চলে আসলেন। পার্টির কর্মীদের দিয়ে সারা শহরে চুঙ্গা মেরে জানানো হলো ঢাকায় ছাত্রদের ওপর গুলি চালানো হয়েছে, অনেকেই মারা গিয়েছে। রক্তে ভেসে গেছে ঢাকার রাজপথ। আপনারা সবাই আজানের পরেই ভোরে মিউনিসিপালটি অফিসের সামনে জড়ো হবেন। বাংলা ভাষার জন্য যারা প্রাণ দিয়েছে, তাদের জন্য দুঃখ প্রকাশ করা হবে। রাতভর মাইক মারা হলো। ভোর রাত থেকেই সর্বস্তরের লোকজন জমা হতে থাকলো। বিশাল সমাবেশ। নারী পুরুষ ছোট ছোট বাচ্চারাও এসেছে বাবা মায়ের সাথে। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই শ্লোগান চলছে। পাঁচ রাস্তার মোড়ে। আলতাব আলী বাঁশ আনতে বললেন। বাঁশ ফালি করে চার দিকে চারটা ফালি গাঁথা হলো। মিনার তৈরি হলো।
আলতাব আলী ৩টি ইট নিয়ে মিনারের সামনে মাটির উপর বসে পড়লেন এবং ইট বিছিয়ে তার উপর মোমবাতি ধরালেন। শ্লোগান দিলেন– রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। যাদের বুকে গুলি চালানো হয়েছে, যারা মৃত্যুবরণ করেছে, তাদের আমরা সম্মান জানাব। তাদের আমরা কখনো ভুব না। তারা শহীদ হয়েছেন, বাংলা ভাষার জন্য।
ময়মনসিংহের প্রথম শহীদ মিনার তৈরি হয়েছে ২২শে ফেব্রুয়ারির ভোরে। তখনো অন্ধকার ছিল। এই পাঁচ রাস্তার মোড়টিতে।
পুলিশ এসে মিনারটি ভেঙে ফেললো, মানুষের ওপর লাঠি চালালো, অনেকেই আহত হলেন, অনেকেই এরস্ট হলেন। আলতাব আলীকে প্রথমেই হাতকড়া পড়ানো হলো। কারণ আলতাব আলী এই শহীদ মিনার স্থাপন করার উদ্যোক্তা। জিয়া ভাই এবং আমি এর প্রত্যক্ষদর্শী। জিয়া ভাই অনেক কিছুই জানেন।
১৯৫২ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি, ময়মনসিংহ শহীদ মিনার প্রথম তৈরি হয়। পাঁচ রাস্তার মোড়ে আমরা সেখানেই ফুল দিতাম। সকলেই জামায়েত হতো মাদ্রাসা কোয়ার্টার কবরস্থানে এখানে, সেখানে থেকেই মিছিল করে যাওয়া হতো পুরাতন পৌরসভার পাঁচ রাস্তার মোড়ে এবং শহীদ মিনারে ফুল দেওয়া হতো।
পরবর্তীতে টাউন হল মাঠে নতুন শহীদ মিনার তৈরি হয়। বর্তমানে নতুন প্রজন্মরা টাউন হলের মাঠে তৈরি শহীদ মিনারে ফুল দেয়।
আসল এবং প্রথম শহীদ মিনার পুরাতন পৌরসভার পাঁচ রাস্তার মোড়ে। ভাষা শহীদদের প্রথম শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়েছিল এই পুরাতন শহীদ মিনারে। সেটাই আসল এবং প্রথম শহীদ মিনার। কমরেড আলতাব আলীর হাতে তৈরি এই শহীদ মিনার।
লেখক : সদস্য, নারী শাখা, ঢাকা কমিটি, সিপিবি