ধর্ষণ ও বুর্জোয়া গণমাধ্যম

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email
সজল অনিরুদ্ধ : নারীর প্রতি সবচে বড় যে নিপীড়ন সেটা হলো ধর্ষণ। বলা হয়ে থাকে ধর্ষণ খুনের চেয়ে ভয়াবহ। যদিও আমরা একটা অপরাধের সঙ্গে আরেকটা অপরাধের তুলনামূলক মানদণ্ড বিচারের পক্ষপাতি নই। শুধু আজকের দিনেই নয়, আমরা যদি পেছনে গিয়ে রামায়ণ-মহাভারতের যুগের দিকেও তাকাই, সেখানেও আমরা ধর্ষকামী সমাজের আলামত খুঁজে পাই। ভরা রাজসভায় যাজ্ঞসেনী দ্রৌপদীকে দুর্যোধনের উরু দেখিয়ে আহ্বানতো তারই একটি জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ। যদিও চতুর কৃষ্ণের কারিশমায় দ্রৌপদীর শেষ রক্ষা হয়েছিল, তবু কুরু রাজসভায় সেদিন যে নারীর সম্মান ভূলুণ্ঠিত হয়েছিল তাতো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আর সবচে অবাক করার মতো বিষয় হলো সেই সভায় ভীষ্ম, দ্রোণ ও কর্ণের মতো রথী-মহারথীরাও পাঞ্চালীর সম্মান রক্ষার জন্য কোনো ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। এমনকি কর্ণের মতো মহা দানবীর ধার্মিকও প্রতিশোধ স্পৃহায় উন্মত্ত হয়ে বলেছিলেন- ‘যে নারীর পাঁচ পাঁচজন স্বামী থাকে সে বেশ্যা হয়।’ স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যাচ্ছে নারীকে আমরা যতোই পুষ্প, চন্দন দিয়ে সাজাই না কেন, যুগ যুগ ধরেই নারী নিগৃহীত হয়েছে, নিপীড়িত হয়েছে। আজকের এই একবিংশ শতাব্দিতেও নারীর মুক্তি মেলেনি। গেল ছয় বছর ধরে বিভিন্ন অনলাইন পোর্টালের একজন সংবাদকর্মী হিসেবে কাজ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। আর ওখানে কাজ করতে গিয়ে ধর্ষকামী সমাজের চরিত্রটাকে আমি পরোক্ষভাবে হলেও প্রত্যক্ষ করেছি। একটি সংবাদের ময়নাতদন্ত করে বিষয়টি খোলাসা করার চেষ্টা করব। কিছুদিন আগে নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ উপজেলায় এক হিন্দু নববধূ ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন। সংবাদ সূত্রে জানা গিয়েছিল ওই গৃহবধূর স্বামী একজন বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। সেই বুদ্ধি প্রতিবন্ধী মানুষটাকে বাইরে ঘুমানোর নির্দেশ দিয়ে তার স্ত্রীকে সারারাত ধর্ষণ করে প্রতিবেশী এক পাষ-। আমি যখন সংবাদটি আমার পোর্টালে পরিবেশন করি, তখন এর শিরোনাম দিয়েছিলাম এরকম- ‘স্বামীকে বাইরে ঘুমানোর নির্দেশ দিয়ে নববধূকে রাতভর ধর্ষণ’। নিউজটি পোস্ট করার পর দেখলাম পাঠক এতে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। শেষ পর্যন্ত নিউজটি অর্ধ লাখের ওপর হিট হয়েছিল। এখন প্রশ্ন হলো– সেদিন আমার পোর্টালে আরো আরো অনেক জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ নিউজ থাকার পরেও কেন এই সামান্য একটি নিউজে পাঠক হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল? তার কারণ আমাদের অবচেতন মনে লুকিয়ে থাকা ধর্ষকামী মানসিকতা। আর এই ধর্ষকামী মানসিকতার কারণেই আমরা ধর্ষণের সংবাদ পড়েও এক ধরনের বিকৃত সুখ অনুভব করি। আর সেটাকেই পুঁজির হাতিয়ার বানায় আমাদের বুর্জোয়া গণমাধ্যম। বলতে গেলে আমাদের দেশের প্রায় সবগুলো অনলাইন পোর্টালেই ধর্ষণের সংবাদ চটকদার করে পরিবেশন করে থাকে। যেন একটা অদৃশ্য প্রতিযোগিতা চলছে– কে কার থেকে বেশি ট্যাবুর আবেশ এনে সংবাদটি পরিবেশন করবে। এতে করে আমরা যে ধর্ষিত হওয়া নারীকে ফের ধর্ষণ করে ফেলছি এটা মাথায় থাকে না। এমনটা কেন হয়? আমাদের রাষ্ট্রের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মতো সংবাদ প্রতিষ্ঠানও দিন দিন নষ্ট হয়ে পড়ছে। কাড়ি কাড়ি মুনাফা লাভের আশায় মালিকপক্ষ এ হেন কাজ নেই যা করতে পারে না। আর আমরা যারা সংবাদকর্মী আমাদেরও দুবেলা দুমুঠো অন্নের জন্য বিপ্লবী হয়ে ওঠা হয় না। অনেকটা সেই কবিতার মতো- ‘রাজার কথাই আমার কথা, আমি যখন রাজার লোক।’ অবশ্য রাজার ওপর দোষ চাপিয়ে দিয়েই আমাদের কর্তব্য-কর্ম শেষ হয়ে যায় না। সংবাদপত্রের এই ‘অন্ধকার যুগে’ আলো ফিরিয়ে আনতে একজন সংবাদকর্মী হিসেবে আমাদেরও কিছু একটা করার রয়েছে।

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..