প্রবাসী নারী শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email
লক্ষ্মী চক্রবর্তী : ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাসের মধ্য দিয়ে আমাদের বাংলাদেশের জন্ম। সংগ্রাম ও ইতিহাস ঐতিহ্যের দেশ বাংলাদেশ। এদেশের নারীদের অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছে শোষণ-বৈষম্য ও নারী-পুরুষের সমতাপূর্ণ অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক মানবিক রাষ্ট্রের স্বপ্ন নিয়ে। বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত নানা সংকট বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী। বর্তমানে আমাদের দেশের নারীরা শিক্ষা প্রসারতা যেমন ঘটাতে পেরেছে, তেমনিভাবে নারীরা নিজেদের শুধু গৃহ-কর্ম-সন্তান প্রতিপালনের মধ্য দিয়ে পারিবারিক গণ্ডির মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ রাখছে না। বর্তমানে নারীরা কর্মসংস্থানের জন্য যেমন দেশে পোশাক শিল্পসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে কাজ করছে তেমনিভাবে নারীরা বেশিরভাগ শ্রমিক হিসেবে কর্মসংস্থানের জন্য বিদেশে– সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে কাজের সন্ধানে যাচ্ছে। এর ফলে বিদেশে যাবার পর নারী তাঁর জীবনযুদ্ধের মধ্যে অর্থনৈতিক মুক্তির পথ সুগম করে নেয়। কিন্তু নারীর মানবাধিকার ও নিরাপত্তার বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ থেকে যায়। বিদেশে কর্মসংস্থানের তথ্য বিদেশে নারীদের কর্মসংস্থানের বিষয়ে জানা যায়–জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) এর তথ্য অনুযায়ী। ১৯৯১ থেকে ২০১৯ সময়কালে অভিবাসী শ্রমিকের সংখ্যা অনেকটাই বেড়েছে। এর মধ্যে সংখ্যানুযায়ী কিছু শ্রমিক ২০১৮ সালে কমতির দিকেই ছিল। আমাদের দেশের কর্মরত নারী শ্রমিক মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশের তুলনায় সৌদি আরবেই বেশিরভাগ কাজ করে। অন্যান্য দেশের মধ্যে কুয়েত, ওমান, জর্ডান, লেবানন, মারিশাস, মলয়েশিয়াতেও নারীরা কাজ করে। ১৯৯১ সাল থেকে ২০১৯ এর এপ্রিল পর্যন্ত ৮, ২৪, ৯৮৫ জন নারী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অভিবাসন করছে। ২০০৪ সালের পর থেকে তা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। বিএমইটি’র তথ্য অনুযায়ী ২০১৭ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত ৮, ৬৭, ১২৮ জনের কর্মসংস্থান প্রাপ্তদের মধ্যে পুরুষকর্মী ৭, ৫৩, ২২১ জন ও নারী কর্মী ১, ১৩, ৯০৭ জন। নারীদের আয়ের সবচেয়ে বেশি এসেছে সৌদি আরব থেকে (১৮.১৪% রেমিট্যান্স)। আমাদের দেশে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দেশ যখন পুনর্গঠনের কাজে এগিয়ে চলছে তখন নারী অগ্রযাত্রাও সামনে চলে এসেছে। প্রবাসে নারীরা কর্মসংস্থানের জন্য দিনের পর দিন চলে যাচ্ছে। সেখানে নারীরা অকালে মৃত্যুবরণও করছে। প্রবাসে নারীরা কীভাবে মৃত্যুবরণ করছে তা স্পষ্টত জানার সুযোগ নেই। ‘প্রথম আলো’ পত্রিকার তথ্য অনুযায়ী ১০ বছরে ২৬ হাজার ৭৫২ জনের লাশ এসেছে বিদেশ থেকে। গত ৯ মাসে প্রায় তিন হাজার লাশ দেশে এসেছে। সেখানে নারীদের নির্যাতনের পর মেরে ফেলা হচ্ছে। স্বজনদের অভিযোগ, হত্যাকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই। ৩১ অক্টোবর সৌদি আরবে গৃহকর্মী পারভীনের লাশ দেশে আসে। তার মৃত্যু সনদে লেখা ছিল ‘আত্মহত্যা’। সংসারের অভাব দূর করতে ২০১৭ সালে সৌদি আরব যান গৃহকর্মী আবিরন। গত ২৪ মার্চ তিনি মারা গেলে তাঁর লাশ আসে মৃত্যুর ৭ মাস পর। মৃত্যু সনদে লেখা ছিল মার্ডার। এ বছর জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ১১৯ জনের মরদেহ দেশে এসেছে। আবিরন তাঁর মৃত্যুর আগে যৌন নির্যাতনের কথা জানিয়েছিল। যে বাসায় সে কাজ করতো সে বাসায় ৮ জন পুরুষ ছিল। তারা তাকে যৌন নির্যাতন করতো। সৌদি আরব নারী গৃহকর্মী নেওয়ার জন্য ২০১৫ সালে বাংলাদেশের সাথে এক চুক্তি করে। এর ফলে ৩ লক্ষ নারী চাকুরির জন্য সৌদিতে চলে যায়। ‘রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের’ তথ্য অনুযায়ী গত সাড়ে তিন বছরে মধ্যপ্রাচ্যে নারী গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতে গিয়ে ৩১১ জন লাশ হয়ে দেশে ফিরেছে। গ্রামের প্রান্তিক নারীরা অভাব-অনটন-নদীভাঙনে সহায় সম্বলহীন হয়ে পড়ার ফলে কোন কোন সংস্থার সহায়তা-দালালদের মাধ্যমে কিংবা বেসরকারিভাবে বিদেশে পাড়ি জমায়। মধ্যপ্রাচ্যে নারীরা নানা কষ্টে কাজ করছে। তাদের সমস্যাগুলো মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- ১. কাজের চাপ বেশি ২. পরিমিত খাবার না দেয়া ৩. বিশ্রামের সুযোগ না দেয়া ৪. মানসিক নির্যাতন ৫. যৌন নির্যাতন ৬. অধিক বেতনের প্রলোভন ৭. বেতন ঠিকমত না দেয়া ৮. পরিবারের সাথে যোগাযোগ করতে না দেয়া ৯. ওয়ার্ক পারমিট আটকে রাখা ১০. জেলে কারাবন্দি করে রাখা কৌশলগতভাবে গৃহকর্মীর কাজের বিষয় বলে তাদের বিদেশে নিয়ে দেহ ব্যবসা করানো হয়। নারীদের কর্মক্ষেত্রের গৃহকর্তা ও এদের পুত্র সন্তানেরা এদের নির্যাতন করে। অনেকে অন্তঃস্বত্ত্বা হয়ে দেশে ফিরে এলে পারিবারিকভাবেও সমস্যায় পড়তে হয়। অনেক নারীরা নানান নির্যাতনের ফলে প্রতিবন্ধীর মতো হয়ে যায়। কেউবা মানসিক রোগীতে পরিণত হয়। যে সমস্ত নারীরা বিদেশে কর্মসংস্থানের জন্য যায় তাদের কোনও সংগঠন নেই, ফলে ব্যক্তিগতভাবে তারা এর প্রতিবাদ করার মতো ক্ষমতা রাখে না। দেশে বিভিন্ন নারী সংগঠন নারী আন্দোলনকে সামনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। নারীর অর্থনৈতিক মুক্তির আন্দোলনের জন্য সংগঠনগুলো সোচ্চার হয়েছে। গৃহ থেকে রাষ্ট্র ব্যবস্থা পর্যন্ত নারীর ভূমিকা সক্রিয় হচ্ছে। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে সংগঠনগুলো সক্রিয় ভূমিকা রেখে চলেছে। নারী নির্যাতন প্রতিরোধের বিষয়গুলো জাতিসংঘ বা বিশ্ব নারী আন্দোলন গুরুত্বের সাথে দেখছে। আজ স্বাধীনতা পরবর্তী দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় আমাদের দেশকে উন্নত দেশ হিসেবে বারবার চিহ্নিত করা হয়। অথচ এ দেশের নারীরা জীবন বাজি রেখে দু’মুঠো অন্ন যোগানের প্রয়াসে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে চাকুরির সন্ধানে চলে যাচ্ছে এবং নানা কায়দায় নির্যাতিত হয়ে দেশে ফিরে আসছে। কেউবা পারভীন, নাজমা হয়ে দেশে ফিরছে। এর প্রতিকার অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। এর আশু প্রতিকার করতে গেলে যে বিষয়গুলোর দিকে নজর দিতে হবে সেগুলো হলো– ১ বিদেশে পাঠানোর এজেন্টগুলোকে সরকারি বৈধতা নিয়ে কাজ করতে হবে। ২. সঠিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করে তাদের পাঠাতে হবে। ৩. নির্যাতন এবং চাকুরিচ্যুত হয়ে আসা নারীদের সরকারি তত্ত্বাবধানে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। ৪. যে সকল এজেন্সির মাধ্যমে নারীরা বিদেশে গিয়ে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে সে এজেন্সিগুলোকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে এবং ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। ৫. অবৈধভাবে শ্রমিক নিয়োগকারী এজেন্সির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। ৬. বিদেশে কর্মসংস্থানে পাঠাতে গেলে কতগুলো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা গ্রহণ করতে হবে। ৭. এ বিষয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসকে সক্রিয় ও সচেষ্ট থাকতে হবে। ৮. সহায় সম্বলহীন নারীদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বর্তমানে দেশে-বিদেশে নারী নির্যাতন যে মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে সেদিকে সরকারকে অবশ্যই দৃষ্টি রাখতে হবে। নারী-পুরুষসহ জনজীবনের নিরাপত্তা দিতে হবে। বাহির্বিশ্বের যেকোনো দেশে নারী নির্যাতন এবং নির্যাতনের মাধ্যমে মৃত্যু হলে সে বিষয়গুলো দ্রুত মিমাংসা করতে হবে। কঠোর বিচারের আওতায় এনে বিচারকার্য চালাতে হবে। সৌদি আরবে চাকুরি করতে গিয়ে যে সকল বাংলাদেশি কর্মীরা মৃত্যুবরণ করেছে অবিলম্বে সে বিষয়গুলো দৃঢ়তার সাথে প্রতিকার করতে হবে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদকে। জাতিসংঘ ঘোষিত নারীর প্রতি বৈষম্য বিলোপের দলিলের (সিডও) বাস্তবায়ন পৃথিবীর সকল দেশে কার্যকর হওয়া প্রয়োজন। সৌদি আরবের এই বর্বোরোচিত বিষয় বারবার সামনের দিকে চলে আসছে। সৌদি গৃহকর্মীরা যেভাবে নির্যাতনের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করছে, একের পর এক লাশ দেশে আসছে- এই নির্মমতা আর আমাদের দেশে যেন না দেখতে হয়ে সেজন্য অবিলম্বে সৌদিতে এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কর্মসংস্থানে নারীদের ঠেলে দেয়া সরকারকে বন্ধ করতে হবে। দেশে সহায় সম্বলহীন নারীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা এখন অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। লেখক : সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, সিপিবি

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..