আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গ

‘ছাত্র রাজনীতি’ ও ‘সমাজ বিপ্লবের’ জয় হোক

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম : ‘একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি, একটি মুখের হাসির জন্য অস্ত্র ধরি...’ একাত্তরের রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে এই গানটি ছিল বিশেষভাবে প্রিয়। হানাদার বাহিনীকে হটিয়ে একের পর এক যেসব ‘মুক্ত এলাকা’ আমরা স্থাপন করেছিলাম সেখানে এ গানটি আমরা গাইতাম। সমবেতভাবে স্বপ্ন দেখতাম মুক্ত স্বদেশকে আমরা ‘মুখের হাসিতে’ ভরপুর ও অনিন্দ সুন্দর এক ‘ফুলের’ বাগানের মতো করে গড়ে তুলবো। সে স্বপ্ন আজ চুরমার হয়ে গেছে। ‘ফুলের’ বাগানের বদলে আজ দেখতে হচ্ছে বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদের বর্বরভাবে থেতলে দেয়া দেহ। ‘মুখের হাসির’ বদলে শুনতে হচ্ছে আবরারের মায়ের করুন উচ্চারণ ‘ছেলেকে আমি মেডিকেলে পড়তে বলেছিলাম। হায়! সে এখন লাশ হয়ে মেডিকেলের মর্গে পরে আছে।’ হিটলারের ফ্যাসিস্ট শাসনামলে লক্ষ লক্ষ নারী-পুরুষ-শিশুকে গ্যাস চেম্বারে পাইকারী নিধনের জন্য যেসব ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্প’ নির্মিত হয়েছিল সেগুলোতে– কতোক্ষণ শ্বাস বন্ধ করে রাখা পর্যন্ত, শরীরে কি মাত্রায় বিদ্যুৎ প্রবাহিত হওয়া পর্যন্ত, তাপমাত্রা কতোটুকু বাড়ানো এবং কমানো পর্যন্ত, যতোটা যন্ত্রণা দেয়া পযৃন্ত একজন মানুষ বেঁচে থাকতে পারে সেসব বিষয়ে জীবন্ত মানুষদেরকে নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করা হতো। আবরারের হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি ছিল সেরকমই বর্বর। অনেকে বলার চেষ্টা করছেন যে, পিটুনিটা ‘একটু বেশি’ হয়ে যাওয়াতে ‘একসিডেন্টালি’ তার মৃত্যু হয়েছে। এসব কথার কোন যুক্তি নেই। বলা যায় যে বুয়েটে ‘ফ্যাসিস্ট দলখদারিত্বের’ মাধ্যমে যে ভয়ার্ত বর্বরতার রাজত্ব স্থাপিত ছিল সেখানে আবরার হত্যার মতো ঘটনা ‘ঘটার অপেক্ষায় ছিল’ অর্থাৎ ‘it was waiting to happen’। দীর্ঘ ৬ ঘণ্টা ধরে স্ট্যাম্প-লাঠির আঘাতে, সাপ পিটিয়ে মারার মতো করে, ‘স্যাডিস্টিক’ হিংস্রতায় আবরারকে হত্যা করা হয়েছিল। এই ঘটনা দেশবাসীকে প্রচ-ভাবে স্তম্ভিত, বেদনাহত, ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। তারা বুঝতে চাচ্ছে– মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে এমন ঘটনা ঘটতে পারার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো কিভাবে? কে তা সৃষ্টি করলো? এর দায়ভার কার? একটি মহল এর সম্পূর্ণ দায় চাপিয়ে দিচ্ছে ‘ছাত্র রাজনীতির’ ওপর। বলছে যে ‘ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে।’ এভাবে ‘সব দোষ নন্দ ঘোষের’ ওপর চাপিয়ে দিয়ে ‘বিরাজনীতিকরণের’ অন্য এক ষড়যন্ত্রের চেষ্টা হচ্ছে। এরই ধারাবহিকতায় বুয়েট কর্তৃপক্ষ গত ১১ অক্টোবর ‘ছাত্র রাজনীতি’ নিষিদ্ধ করার ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু তাদের চোখের সামনে ‘দুর্বৃত্তায়িত ফ্যাসিস্ট দখলদারদেরকে’ বিনা বাধায় ‘টর্চার সেল’ প্রতিষ্ঠাসহ যাবতীয় দুষ্কর্ম চালাতে দেয়ার চরম অপরাধের দায় নিয়ে বুয়েটের ভিসি, প্রভোস্ট, প্রক্টারগণ পদত্যাগ করেনি। তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেয়া হয়নি। একথা কারো অজানা নয় যে বুয়েটে (এবং দেশের প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে) ‘ছাত্র রাজনীতি’ অনেক দিন ধরেই কার্যতঃ নিষিদ্ধ রয়েছে। ছাত্র ইউনিয়নসহ অন্যান্য বামপন্থি ও আদর্শবাদী সংগঠনকে কোথাও কাজ করতে দেয়া হয় না। প্রায় সর্বত্রই ক্ষমতাসীনদের ছাত্র সংগঠনের একচ্ছত্র ফ্যাসিস্ট দখলদারিত্ব কায়েম রয়েছে। প্রশ্ন হলো–যেখানে ‘ছাত্র রাজনীতিকে’ এভাবে একরকম ‘নিষিদ্ধ’ করে রেখে ‘দুর্বৃত্ত-রাজত্ব’ চলছে, সেখানে আবরার হত্যাকাণ্ডের জন্য ‘ছাত্র রাজনীতিকে’ দায়ী করার বিন্দুমাত্র যৌক্তিকতা থাকতে পারে কি? অথচ একটি বিশেষ মহল এই সুযোগে তাদের পুরানো ও ‘বিরাজনীতিকরণের’ ফর্মুলা আবার সামনে আনার চেষ্টা করছে। এরকম প্রচারণা চালিয়ে ইতোপূর্বে এদেশে ওয়ান-ইলেভেন, সামরিক শাসন ইত্যাদি চাপিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্রের কথা দেশবাসীর জানা আছে। একথা প্রমাণিত যে, বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি ‘না থাকার’ পরিস্থিতির মধ্যেই ক্ষমতাসীনদের ফ্যাসিস্ট দখলদাররা দিনের পর দিন ‘টর্চার সেলগুলোতে’ যে নির্যাতন চালাতে পেরেছে, আবরার হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা ঘটতে পেরেছে। ‘হলি আর্টিজানের’ জঙ্গী হামলায় যেসব ছাত্র জড়িত ছিল তারা সবাই এমন সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র ছিল যার সবগুলোতেই ‘ছাত্র রাজনীতি’ নিষিদ্ধ ছিল। সুস্থ ধারার ‘ছাত্র রাজনীতি’ অবারিত ও মুক্ত থাকলে এসব দুষ্কর্মের বিরুদ্ধে অনেক আগেই প্রতিরোধ গড়ে উঠতো। আবরার হত্যার প্রতিবাদে গড়ে ওঠা বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীদের এবারের সংগ্রাম সে সত্যেরই। ‘ছাত্র রাজনীতি’ সবসময় হয়ে থেকেছে বুর্জোয়া শাসক-শোষকদের একটি চক্ষুশুল, তাদের একটি প্রধান ‘টার্গেট’। ‘ছাত্র রাজনীতির’ বিরুদ্ধে তাদের আক্রমণের গতানুগতিক অস্ত্র হলো ‘দুর্বৃত্তায়িত ফ্যাসিস্ট দখলদারিত্ব’। এক্ষেত্রে তাদের অপর একটি অস্ত্র হলো ‘ছাত্র রাজনীতি’ নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে ‘বিরাজনীতিকরণের’ ষড়যন্ত্র ও ফাঁদ। ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করার প্রস্তাবনার ভালো কাটতি থাকার কারণ আছে। দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে ‘ছাত্র রাজনীতির’ নামে খোলামেলাভাবে যা চলছে তা হলো কুৎসিত দলবাজী, চর দখলের কায়দায় দখলদারি, সন্ত্রাসী-মাস্তানি, ক্যাডার বাহিনীর নামে দুর্বৃত্ত লালন, ক্রিমিনালদের আশ্রয়দান, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, পার্সেন্টেজ-বাণিজ্য, ভর্তি-বাণিজ্য, তদবির-বাণিজ্য ইত্যাদি। রাষ্ট্র ক্ষমতার ও রাজনীতির ‘প্রটেকশন’ পাওয়ার জন্য এসব কাজের সাথে নেতা-নেত্রী ভজন, দলীয় শ্লোগানের জজবা উঠানো, জোর-জবরদস্তি করে অথবা নানা সুবিধার উচ্ছিষ্ট বিতরণ করে হল-হোস্টেল ও পাড়া মহল্লার ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে দলীয় শো-ডাউন করা, মুরুব্বি-দলের ‘বড় ভাইদের’ পক্ষ হয়ে উপদলীয় তৎপরতায় শক্তি যোগানো, দল-উপদলের প্রয়োজনে পেশী শক্তি হিসেবে ভূমিকা পালন করা ইত্যাদি যুক্ত করা হয়েছে। ভ্রষ্ট ‘ছাত্র নেতা’ নামধারীরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে পরিণত করছে কোটি কোটি টাকার অবৈধ উপার্জনের একটি স্বতন্ত্র উৎসে। কন্ট্রাক্টরদের কাছ থেকে কমিশন খাওয়া, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, ভর্তি বাণিজ্য, সিট বাণিজ্য, অপরাধীদের নিরাপদ আশ্রয় প্রদান (sanctuary for criminals), হাইজ্যাকার লালন, তদবির বাণিজ্য– কোনো অপরাধমূলক দুষ্কর্মই বাদ থাকছে না। এসব থেকে কামাই হচ্ছে কোটি কোটি টাকার লুটের মাল। সেই লুটের ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে অনেক সময়ই সৃষ্টি হচ্ছে দ্বন্দ্ব। কখনো দুই দলের মধ্যে। কখনো আবার একই দলের দুই বা অধিক গ্রুপের মধ্যে। তা থেকে শুরু হচ্ছে গোলাগুলি, সংঘাত, সংঘর্ষ। এক সময় বুর্জোয়া ধারার সংগঠনকে ছাত্র সংগঠনগুলোকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হতো ছাত্র ইউনিয়নের মতো বামপন্থি ও আদর্শবাদী সংগঠনের সাথে। তখন প্রতিযোগিতা হতো আদর্শবাদিতা ও দেশপ্রেমের ক্ষেত্রে, রাজনৈতিক চেতনা ও উন্নত সাংস্কৃতিক-মানবিক মূল্যবোধের ক্ষেত্রে। সুন্দরের কম্পিটিশনে টিকে থাকার জন্য তাদেরকেও সুন্দর হওয়ার চেষ্টা করতে হতো। পর্যায়ক্রমিকভাবে রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকতে পারার সুযোগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এখন গায়ের জোরে ‘বড় দল’ হয়ে উঠেছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র অনুসারী ছাত্রলীগ ও ছাত্রদল। এদের মধ্যে এখন প্রতিযোগিতার বিষয়গুলোও দুষ্কর্ম ভিত্তিক হয়ে উঠেছে। এখন কম্পিটিশন হয়ে উঠেছে নেতা-নেত্রী ভজন, অপরাধমূলক দুষ্কর্ম পরিচালনা, মাস্তান বাহিনী লালন ইত্যাদি ক্ষেত্রে দক্ষতা ও পরদর্শিতা নিয়ে। ছাত্র শিবিরের অবস্থা আরো ভয়ঙ্কর। হত্যা, খুন, জবাই, রগ কাটা, হাত-পা ছেদন, হামলা, অগ্নিসংযোগ–হেন দুষ্কর্ম নেই যাতে তারা লিপ্ত নয়। এসবই এখন ‘ছাত্র রাজনীতির’ দৃশ্যমান চেহারা। ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, ছাত্র শিবির প্রভৃতি সংগঠনগুলো এখন গায়ের জোরে ‘ছাত্র রাজনীতির’ দৃশ্যমান বাহক হয়ে উঠেছে। কিন্তু এরা যেসব বীভৎস কাণ্ডকারখানা ঘটিয়ে চলেছে তার সাথে ‘ছাত্র রাজনীতির’ কোনো সম্পর্কই আসলে নেই। বিজ্ঞানে যেমন ‘ম্যাটার’-এর বিপরীতধর্মী ‘এ্যান্টি-ম্যাটার’ রয়েছে– এদের কাজকর্মের ধারাকে অনুরূপভাবে ‘ছাত্র রাজনীতি’-এর বদলে ‘এ্যান্টি ছাত্র রাজনীতি’ বলে আখ্যায়িত ও বিবেচনা করাটিই যুক্তিযুক্ত। এদের এসব ঘৃণ্য দুষ্কর্ম যেহেতু ‘ছাত্র রাজনীতির’ গৌরবমণ্ডিত নামটি দখল করে নিতে পেরেছে তাই, এসবের অবসানের আকাঙ্ক্ষা থেকেই অনেক সাধারণ ছাত্র ও সাধারণ মানুষ ‘ছাত্র রাজনীতি’ নিষিদ্ধ করাকেই এক্ষেত্রে সহজ সমাধান বলে ভাবছে। ‘ছাত্র রাজনীতির’ অদৌ কোনো প্রয়োজন আছে কি? তার প্রকৃত স্বরূপই বা তাহলে কি? একথা মনে রাখতে হবে যে, ছাত্ররা সমাজেরই একটি অংশ। সমাজের অন্যান্য অংশের মতো ছাত্র সমাজেরও আছে সাধারণ অনেক আশা-আকাক্সক্ষা, চাওয়া-পাওয়ার বিষয়। এসব বিষয়কে অবলম্বন করেই ছাত্রদের নিজস্ব আন্দোলন ও সংগঠন পরিচালিত হওয়া স্বাভাবিক ও প্রয়োজন। ক্লাসরুমের ভাঙা বেঞ্চ-ব্ল্যাকবোর্ড মেরামত, বই-কাগজ-কলমের দাম কমানো, পর্যাপ্ত সংখ্যক শিক্ষকের ব্যবস্থা ইত্যাদি খুঁটিনাটি বিষয়সহ গণমুখী প্রগতিশীল শিক্ষানীতি, শিক্ষাখাতে পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ প্রভৃতি ছাত্র সমাজের প্রত্যক্ষ স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোকে ভিত্তি করে ছাত্রসমাজের একতা ও ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম গড়ে উঠবে- এটিই স্বাভাবিক ও প্রত্যাশিত। এসব ছাড়াও ছাত্র সমাজের পরোক্ষ (অথবা প্রচ্ছন্নভাবে প্রত্যক্ষ) নানা স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ও আছে। যেমন পড়াশুনায় পূর্ণ মনোনিবেশের পরিবেশ নিশ্চিত করা, গরিব বন্ধুকে অব্যাহতভাবে সহপাঠী হিসেবে পাওয়ার প্রয়োজনে সমাজকে দারিদ্র্য ও বৈষম্য থেকে মুক্ত করা, জ্ঞান অন্বেষণের জন্য মুক্তচিন্তার পরিবেশ নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র ব্যবস্থায় গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িকতা নিশ্চিত করা ইত্যাদি বিষয়। তাছাড়া শুধু বইয়ের পোকা হয়ে থাকাই নয়, প্রকৃত দেশপ্রেম, মানবিক মূল্যবোধ, মননশীলতা ও সৃজনশীল প্রতিভার জাগরণ ঘটিয়ে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে দেশ ও মানব সভ্যতা নির্মাণের কারিগর রূপে গড়ে তোলাই যে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য, সে কথাও মনে রাখা বাঞ্চনীয়। তাই গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা, শোষণমুক্তি, সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যের অবসান, দেশপ্রেম, উদার মানবিকতা, প্রগতিমুখীনতা, বিজ্ঞানমনস্কতা– ইত্যাদি বিষয়গুলোও ছাত্রসমাজের সাধারণ স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়। এসব বিষয়ের সাথে দেশের অর্থনৈতিক-সামাজিক নীতি, রাষ্ট্র-ব্যবস্থা, সরকারি নীতি ইত্যাদি জড়িত। ছাত্রসমাজের শিক্ষা জীবনের নানাবিধ মৌলিক চাহিদাই এসব বিষয়ের সাথে ছাত্র সমাজকে সরাসরি সম্পৃক্ত করে তোলে। এগুলোই ছাত্রসমাজের নিজস্ব আশা-আকাক্সক্ষা ও চাওয়া-পাওয়ার সাথে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ও স্বাভাবিকভাবে উত্থিত বিষয়। এগুলোই হলো ‘ছাত্র রাজনীতির’ প্রকৃত স্বরূপ। যারা ‘ছাত্র রাজনীতি’ বন্ধ করার কথা বলছেন তাদের কাছে প্রশ্ন হলো– ছাত্র সমাজের কি দেশপ্রেমিক হওয়া অত্যাবশ্যক নয়? এবং দেশপ্রেম কি রাজনীতি নয়? তাহলে ছাত্রসমাজকে ‘রাজনীতিমুক্ত’ করার চেষ্টা করা হলে তা কি তাদের মাঝে ও সমাজে দেশপ্রেম সৃজনের ক্ষেত্রে শূন্যতা সৃষ্টির প্রবণতার জন্ম দিবে না? এবং সেটিই কি ‘ব্যক্তিস্বার্থ-অন্ধ দুর্বৃত্তায়িত-লালসা ও দানবীয়-প্রবণতা’ বিস্তারের সুযোগ করে দিবে না? সেটি কি কোনোভাবে কাম্য হতে পারে? অনেকের মতে ছাত্র রাজনীতির নামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এখন যেহেতু ঘৃণ্য অপরাধমূলক অপতৎপরতা চলছে সে কারণে ‘ছাত্র রাজনীতি’ নিষিদ্ধ করা উচিৎ। এ যুক্তি হলো অনেকটা মাথা ব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলার প্রেসক্রিপশনের মতো ব্যাপার। এক্ষেত্রে পাল্টা প্রশ্ন করা যায় যে, জাতীয় রাজনীতিতে আরো বড় ও ঘৃণ্য অপরাধমূলক অপকর্ম চলছে বলে একই যুক্তিতে কি এদেশে ‘রাজনীতি’-ও তাহলে নিষিদ্ধ করতে হবে? এসব যুক্তি যে সামরিক শাসকদের যুক্তি(!) সেটি তো পাকিস্তানের জামানা থেকে দেশবাসী দেখে এসেছে। তাছাড়া আরো একটি মৌলিক প্রশ্ন এ বিষয়টির সাথে জড়িত। দেশের সংবিধানে ‘রাজনীতি’ করার অধিকারটি একটি মৌলিক অধিকার বলে সংবিধানে স্বীকৃত। ছাত্ররা একাধারে ছাত্র এবং একই সাথে তারা দেশের নাগরিকও বটে। তাদের ক্ষেত্রে ঢালাওভাবে ‘রাজনীতি’ নিষিদ্ধ করাটি হবে মৌলিক অধিকার হরণ ও সংবিধান লঙ্ঘনের মতো অপরাধ। এক্ষেত্রে অবশ্য একটি ভ্রান্তি সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে যে ‘রাজনীতি’ করা আর ‘দলবাজি’ করা এক জিনিস নয়। এই দু’য়ের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। ছাত্রদের মধ্যে সাধারণভাবে এবং বিশেষত: রাষ্ট্রক্ষমতা কেন্দ্রিকভাবে দলীয় লেজুড়বৃত্তি বা ‘দলবাজি’, যা বর্তমানে চরম রুগ্নতা ও অধঃপতনের উৎস হয়ে উঠেছে, সেটি বন্ধ করা উচিত। কিন্তু সমান্তরালভাবে তাদের ‘রাজনীতি’ করা, যা অতীতের ঐতিহ্যের ধারায় তাদেরকে দেশপ্রেম ও আদর্শবোধে উদ্বুদ্ধ করার মধ্য দিয়ে শিক্ষার প্রকৃত পরিবেশ ও সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করবে, তাকে উৎসাহিত করা উচিত। কুৎসিত দলবাজীর দৃষ্টান্ত তুলে ধরে কিন্তু মানুষ বলতে শুরু করেছেন যে ‘ছাত্র রাজনীতি’ থাকতে দিলেও ‘সংগঠিত ছাত্র রাজনীতি’ নিষিদ্ধ করা উচিত। এক্ষেত্রেও বুঝতে হবে যে ছাত্র সমাজ ‘সংগঠিত’ হওয়া আর তাদের নিয়ে ‘দলবাজী’ করা– এ দু’টি এক কথা নয়। সুস্থ ছাত্র রাজনীতি ও সুস্থ ছাত্র আন্দোলনের জন্য ধারাবাহিক কাজ দরকার। সেজন্য সুস্থ ধারার ছাত্র সংগঠন অপরিহার্য। ‘ছাত্র রাজনীতির’ প্রকৃত ও সুস্থ ধারা ফিরিয়ে আনতে হলে বিশেষভাবে প্রয়োজন হলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়মিতভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করে ছাত্র সংসদের কার্যকলাপ পরিচালনার ধারা ফিরিয়ে আনা। ছাত্র সংসদের মাধ্যমে যে সব কাজ হওয়া সম্ভব, সেগুলো প্রকৃত জ্ঞান অর্জন ও শিক্ষা লাভ এবং মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার প্রশিক্ষণের জন্য অপরিহার্য। তাই সেগুলো শিক্ষা কার্যক্রমেরই একটি আবশ্যিক উপাদান। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেমন একাডেমিক ক্যালেণ্ডার থাকে এবং যথাসময়ে পরীক্ষা অনুষ্ঠানসহ তার অনুসরণ বাধ্যতামূলক, তেমনি ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দিন-তারিখ ও বাধ্যবাধকতার বিষয়টিও বাৎসরিক ক্যালেন্ডারের বিষয়বস্তু করা বাঞ্চনীয়। ছাত্ররা বয়সে তরুণ। ছাত্র বয়সের স্বাভাবিক প্রবণতা হলো নিজের ব্যক্তিত্বের বিকাশ ও ‘জগৎ মাঝে’ প্রদর্শনের প্রবল আকাক্সক্ষা। ব্যক্তিত্বের আত্মপ্রকাশ ঘটানোর ক্ষেত্রে তা ‘সুস্থ’ অথবা ‘রুগ্ন’–এই দুটোর মধ্যে যেকোনো একটি পথে ঘটতে পারে। ‘রাজনীতির’ দরজা অবধারিত রাখতে পারলেই সুস্থ ধারায় ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ও প্রদর্শনের পথ তৈরি করা যাবে। সেই পথ রুদ্ধ করলেই আবির্ভাব ঘটবে অনাচার ও অপরাধমূলক প্রবণতার। তাই বলতে হয় যে, কেবল শুদ্ধ ‘রাজনীতির’ প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারলেই সম্ভব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর বর্তমান কলুষতা ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করা। সে কারণেই, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে আজ যা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তা হলো, আরো কম ‘রাজনীতি’ নয়– বরঞ্চ আরো বেশি ‘রাজনীতি’। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো আজ জোর করে জবরদখল করে রেখেছে ‘ফ্যাসিস্ট দখলদারিত্বের দুবৃর্ত্ত শক্তি’। এই অপশক্তির অবসান ঘটাতে পারে কেবল সুস্থ, সবল প্রগতিশীল ধারার ‘ছাত্র আন্দোলন’ ও ‘ছাত্র রাজনীতি’। সেই সুযোগটি কেড়ে নিতে এখন ‘বিরাজনীতিকরণের’ ভিন্ন লেবাসে যুক্ত হয়েছে সুশীল সমাজ বলে পরিচয়দানকারী মহল বিশেষের ‘ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করার’ দুর্ভিসন্ধিমূলক তৎপরতা। বুয়েটের আবরার ফাহাদের হত্যার ঘটনাটি মোটেও কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। গত সপ্তাহে সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে ৫ বছরের শিশু তুহীন তার বাবা ও চাচার হাতে খুন হওয়া এবং তার ক্ষত-বিক্ষত ঝুলন্ত লাশের আৎকে ওঠার মতো ছবি জাতিকে হতচকিত করেছে। এ ধরনের এবং আরো অন্যান্য ধরনের অসংখ্য ঘৃণ্য অপরাধ কাণ্ড আজ দেশময় ক্রমবর্ধমানভাবে ঘটে চলেছে। একটি ‘systemic’ অর্থাৎ ‘ব্যবস্থা প্রসূত’ উৎস থেকেই এসব উৎসারিত হচ্ছে। আবরার হত্যাকাণ্ড ও অন্যান্য ঘটনাগুলো দেশের বর্তমান পচে যাওয়া অর্থনৈতিক-সামাজিক ‘ব্যবস্থারই’ উপসর্গ মাত্র। আবরারের হত্যাকারীদের গ্রেফতার করা হয়েছে। অন্যান্য কিছু ঘটনায় অপরাধীদের ধরপাকড় শুরু হয়েছে। ‘শুদ্ধি অভিযান’ চলছে বলে বলা হচ্ছে। এ অভিযানকে কঠোরতা ও দৃঢ়তার সাথে শেষ অবধি এগিয়ে নিতে হবে। কিন্তু শুধু মাঝে মধ্যে দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে ‘কঠোর’ অভিযান চালিয়ে ‘শক্ত সিগনাল’ দিলেই ‘দুর্বৃত্ত রাজত্বের’ অবাসান ঘটানো যাবে না। এক ‘দুর্বৃত্ত, গোষ্ঠীর’ বদলে ‘অপর দুর্বৃত্ত গোষ্ঠীকে’ ক্ষমতায় আনলেই কাজ হবে না। তাই দুর্বৃত্ত দমনের পাশাপাশি, দুর্বৃত্তায়নের উৎসকে উৎপাটিত করতে হবে। শুদ্ধি অভিযান শক্তভাবে এগিয়ে নিতে হবে। একই সাথে দুর্বৃত্তয়িত ‘ব্যক্তির’ পাশাপাশি ‘প্রতিষ্ঠান’ এবং ‘ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের’ পাশাপাশি দুবৃত্তায়িত ‘সমাজ-ব্যবস্থার’ ক্ষেত্রেও শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করা আজ অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। সমাজ দেহের রক্ত আজ দূষিত হয়ে পরেছে। সমাজ দেহকে রোগমুক্ত করতে হলে সেই দূষিত রক্ত বদলে দিয়ে বিশুদ্ধ রক্তের সঞ্চালন ঘটাতে হবে। সেজন্য আজ প্রয়োজন হয়ে পরেছে মুক্তিযুদ্ধের ধারায় দেশকে ফিরিয়ে আনা। সেজন্য প্রয়োজন মুক্তিযুদ্ধের মতোই একটি বিপ্লবী গণজাগরণ সংগঠিত করা। সমাজ ব্যবস্থার একটি সমাজতন্ত্র অভিমুখীন সর্বাঙ্গীন বিপ্লবী রূপান্তর সাধন করা। জয় হোক ‘ছাত্র রাজনীতির’! জয় হোক ‘সমাজ বিপ্লবের’!

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..