জলবায়ু পরিবর্তন

পুঁজি, বাণিজ্য ও তন্ত্রমন্ত্রে বন্দী বিশ্ব

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email

নেলসনঃ ‘শূন্যগর্ভ শব্দ দিয়ে তোমরা আমাদের স্বপ্ন ও শৈশব চুরি করেছ।’ সদ্য সমাপ্ত জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ১৬ বছর বয়সী গ্রেটা থানবার্গ বিশ্ব নেতৃবৃন্দের উদ্দেশে এ কথা বলেছে। বিশ্বনেতাদের চোখে চোখ রেখে সে বলে এসেছে যে, তারা যা বলছে ও করছে, তার সবই ভাঁওতা। প্রশ্ন হচ্ছে একটি শিশু যেখানে বুঝতে পারছে, বছর বছর বিপুল অর্থ ব্যয়ে একেকটি অধিবেশন বা সম্মেলন করে নেতৃবৃন্দ শব্দের মায়ায় আদতে গোটা বিশ্বকে বোকা বানাচ্ছে, সেখানে পোড় খাওয়া অভিজ্ঞ নেতারা কি তা বুঝতে পারছেন না? উত্তর হচ্ছে, অবশ্যই পারছেন। কিন্তু তারপরও তাঁরা চুপ। পরস্পরের সঙ্গে তাঁরা আলোচনার অভিনয় করে যাচ্ছেন। দিয়ে যাচ্ছেন জলবায়ু পরিবর্তনরোধে একের পর এক তথাকথিত ঘোষণা। কিন্তু কাজের বেলায় লবডঙ্কা। বছরের পর বছর এটি চলছে কী করে, যখন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের বহু দেশ সংকটাপন্ন। এই সংকটগ্রস্ত দেশগুলোর তো অন্যদের ওপর কার্যকর চাপ প্রয়োগের কথা। কিন্তু তাঁরা তা করছেন না বা করতে পারছেন না। করতে পারছেন না কারণ, শক্তির সমীকরণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো পিছিয়ে। আর করছেন না কারণ, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে পুঁজি, বাণিজ্য ইত্যাদি, যা এই দেশগুলোর নেতাদেরও পকেটপূর্তিতে যথেষ্ট সহায়ক। একেকটি বছর যায়, আর আমাদের পৃথিবী হয়ে ওঠে আরও বেশি উত্তপ্ত। তাপমাত্রার এই ঊর্ধ্বগামীতায় কোনো ছেদ পড়ে না। উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে এখন পর্যন্ত প্রতি বছরই বিশ্বের তাপমাত্রা বেড়েছে। কোনো পরিবর্তন বা ছেদ নেই। বিশ্বের ইতিহাসের দিকে তাকালে অনেক ধরনের চড়াই উৎরাইয়ের দেখা মিলবে। দেখা মিলবে দুটি বিশ্বযুদ্ধ, প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও অভাবিত উন্নয়ন, কল্পনাতীত বাণিজ্য ও সম্পদের পাহাড় তৈরির হাজারটা গল্পের সঙ্গে। দেখা মিলবে স্নায়ুযুদ্ধসহ নানা ধরনের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের। এগুলোর একটি আরেকটি থেকে আলাদা। কিন্তু এই পুরো যাত্রায় একটি অভিন্ন সঙ্গী কিন্তু রয়ে যাচ্ছে। আর তা হলো উষ্ণায়ন এবং সেই সূত্রে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন। পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি ও প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস যেমন একসঙ্গে চলেছে, সম্পদ বৃদ্ধি ও গুটিকয়ের হাতে তার পুঞ্জিভবন যেমন একসঙ্গে বেড়েছে, ঠিক তেমনি বেড়েছে পৃথিবীর তাপমাত্রা। কারণ, এইসব সম্পদ ও বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে বিদ্যুৎ, শিল্পায়ন, পরিবহনসহ নানা কারণে নানাভাবে শত শত কোটি জীবাষ্ম জ্বালানি পোড়ানোর মাধ্যমে। সম্পদ সৃষ্টি প্রক্রিয়াতেই বৈষম্যের জন্ম দেওয়াটা পুঁজির অবধারিত স্বভাব। এছাড়া তার আর কোনো উপায় নেই। ফলে পুঁজি যখন উন্নয়ন সাধন করে, তখন তা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ওপর, প্রকৃতির ওপর নিপীড়নে রূপ নেয়। নেয় যে, তার প্রমাণ তো আমাদের সুন্দরবনই বহন করছে। এ প্রমাণ বহন করছে আমাদের প্রতিটি শহর, প্রতিটি নদী, প্রতিটি পাহাড়। এ নিপীড়নের পথ ধরেই সামনে এসে হাজির হয় আজকের বাস্তবতা, যখন জলবায়ু পরিবর্তন এক বিরাট জিজ্ঞাসা হয়ে জাজ্বল্যমান। মোটাদাগে জলবায়ুর যেহেতু কোনো সীমানা নেই, সেহেতু এর ভুক্তভোগী এ বিশ্বের সবাই। কিন্তু সত্য হচ্ছে, এ ক্ষেত্রেও রয়েছে বৈষম্য। কারণ এ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সংকটের মুখে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় দরিদ্ররা। কারণ, তাদের হাতে এ থেকে বাঁচার মতো তেমন কোনো হাতিয়ার থাকে না। ফলে এ ক্ষেত্রেও সংকটের মুখে তারাই থাকে, অগণিত হলেও যাদের কণ্ঠের জোর ঠিক বেশি নয়। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে এ বাস্তবতা ক্রিয়া করে বলেই বিশ্ব নেতৃবৃন্দ বছরের পর বছর ধরে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে নির্লিপ্তভাবে খেলে যেতে পারছে। এ ক্ষেত্রে আরেকটি সংকট রয়েছে-বর্তমান বিশ্বকাঠামো যেহেতু জলবায়ু পরিবর্তনের দামেই গঠিত হয়েছে, সেহেতু এর পরিবর্তন মানে পুরো অর্থনৈতিক ও উৎপাদন কাঠামোয় বদল আনা। একটি অর্থনীতিকে পরিবেশবান্ধব করা মানে এর কিছু উপাদান বাদ দেওয়া নয়, বরং পুরো পদ্ধতির আগা-পাশতলা বদলে ফেলা। যে ভিতটির ওপর দাঁড়িয়ে আজকের বিশ্ব চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে প্রবেশ করে গর্বিত, তার পুরোটাই দাঁড়িয়ে আছে জীবাষ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভর করে। ফলে এখানে পরিবর্তন আনতে গেলে বাজার অর্থনীতি নামের ফ্রাঙ্কেনস্টাইনটিকে নিয়ে ভাবতে হবে আগে। এর মীমাংসা না হলে, কোনো কিছুতেই কিছু হবে না। কারণ, ১৯৯০ সালে বিশ্বের সরকারগুলো যখন জলবায়ু পরিবর্তনকে স্বীকার করে, এর নিরসনে কিছু করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করল, তারপর থেকে এখন পর্যন্ত যে পরিমাণ বাড়তি কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ হয়েছে, তা মোট নিঃসরণের প্রায় অর্ধেক। ফলে, ব্যবস্থা টিকিয়ে রেখে এর মীমাংসা সম্ভব নয়। এ মীমাংসা পেতে হলে পুঁজির পায়েই বেড়ি পরাতে হবে যে। কিন্তু পুঁজি এ বেড়ি পরতে রাজি নয়। সে বরং জলবায়ু পরিবর্তনকেই পুঁজি করছে। জলবায়ু বিনিয়োগের আকর্ষণীয় খাত জলবায়ু নিয়ে বিশ্বব্যাপী আলোচনার প্রেক্ষাপটে এর ব্যবসায়িক সম্ভাবনাও ভীষণভাবে বেড়েছে। চলতি দশককে ক্লিন এনার্জির দশক বললেও ভুল হবে না। এই দশকে জীবাষ্ম জ্বালানিনির্ভর অর্থনীতির গতি রোধের বদলে টেকসই জ্বালানি ও এ সম্পর্কিত পণ্যের উৎপাদন ও বিপণনকে নতুন ব্যবসায়িক সম্ভাবনা হিসেবে সামনে নিয়ে এসেছে ক্ষমতাধর দেশগুলো। গবেষণা প্রতিষ্ঠান ব্লুমবার্গ এনইএফের তথ্যমতে, ২০১০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত কম কার্বন নিঃসরণকারী জ্বালানি খাতেই বিনিয়োগ হয়েছে ২ লাখ ৬০ হাজার কোটি ডলার। এই বিনিয়োগ যতটা সুফল বয়ে আনতে পারত, তাও আনতে পারছে না পুঁজি কাঠামোর অনীহার কারণেই আবার। কারণ, প্রাথমিক পর্যায়ে এর জন্য ভর্তুকির প্রয়োজন হয়। প্রবৃদ্ধির পেছনে উন্মত্তের মতো ছোটা বিশ্বের কোনো নেতৃত্ব এ ভর্তুকি দিতে রাজি হবে? ফলে এখন আবার এ বিনিয়োগে কিছুটা ভাটার টান লেগেছে। টেকসই জ্বালানির সমাধান হিসেবে হাজির হতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন জীবাষ্ম জ্বালানি থেকে উৎপাদন কাঠামোকে এ নতুন জ্বালানির দিকে স্থানান্তর। এই স্থানান্তর সম্ভব না হলে, তা শুধু অলঙ্কার হিসেবেই থেকে যাবে। হচ্ছেও তাই। বড় বড় দেশগুলো টেকসই জ্বালানির কথা মুখে বললেও, তারা এ দিয়ে জীবাষ্ম জ্বালানিকে প্রতিস্থাপন করছে না। হ্যাঁ, এক ধরনের প্রতিস্থাপন অবশ্য হচ্ছে। তবে তা শুধু ব্যবহারিক পর্যায়ে। মূল কারণের জায়গাতে তেমন একটা নড়চড় হচ্ছে না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় বৈদ্যুতিক গাড়ির কথা। এলোন মাস্ক, বিল গেটস থেকে শুরু করে অনেক বড় বড় উদ্যোক্তাই এ ধরনের পরিবহনের দিকে ঝোঁকার কথা বলছেন এবং করছেনও। কিন্তু এই যে বিদ্যুৎ, যা এসব পরিবহনের চালিকাশক্তি, তার উৎপাদনের কাঁচামালটি মুখ্যত জীবাষ্ম জ্বালানিই থেকে যাচ্ছে। ফলে, এই উদ্যোগগুলোও আদতে টেকসই প্রযুক্তির নামে পৃথিবীকে গিলে খাওয়ারই নামান্তর হয়ে উঠছে। শুধু ভোক্তা পর্যায়ে এটি এক ধরনের বিভ্রম তৈরি ছাড়া আর কিছু করছে না। বিল গেটস অবশ্য বায়ুমণ্ডলের অতিরিক্ত কার্বন ডাই অক্সাইডকে জ্বালানিতে রূপান্তর করে নতুন জ্বালানি তৈরির একটি প্রকল্পে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করেছেন। প্রতিষ্ঠানটির নাম টেরাপাওয়ার। বিনিয়োগের পরিমাণ? ১০ হাজার ৫০০ কোটি ডলার। এ প্রকল্প শেষ পর্যন্ত কী ফল নিয়ে আসে, তা এখনই জানা সম্ভব নয়। বৈদ্যুতিক গাড়ির পাশাপাশি এলোন মাস্ক কাজ করছেন ব্যাটারি নিয়েও। তাঁর সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন রবার্ট ফ্রিডল্যান্ডের মতো খনি ব্যবসায়ী, পৃথিবীকে বিষাক্ত করার দায়ে গণমাধ্যমের কাছ থেকে ‘বিষাক্ত বব’ অভিধা জুটেছিল যার। পুঁজির খেলায় সেই রবার্ট ফ্রিডল্যান্ডই এখন আবির্ভূত হচ্ছেন একজন পরিবেশবান্ধব খনি ব্যবসায়ী হিসেবে। আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়ায় তিনি কোবাল্ট, নিকেল ও কপার খনি নিয়ে কাজ করছেন। পরিবেশবান্ধব লিথিয়াম আয়ন সেল নিয়েও কাজ করছেন তিনি। এটি আবার যুক্ত করেছে চীনের ব্যবসায়ী ওয়াং চুয়ানফুকে। এলোন মাস্কের আরেক অংশীদার ওয়াং চুয়ানফুর ব্যবসা রিচার্জেবল ব্যাটারি নিয়ে। এখানে আবার বিনিয়োগ রয়েছে ওয়ারেন বাফেটেরও। গত বছর তাঁদের প্রতিষ্ঠান বিওয়াইডি ১ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের ব্যাটারি ও বৈদ্যুতিক গাড়ি বিক্রি করেছে। মজার বিষয় হলো, তাদের সবাই ‘গ্রিন ইনভেস্টর’ তকমা গায়ে সেঁটে নিলেও, কেউই আদতে সবুজ বিনিয়োগটি করছেন না। যে ধাতু ও এর উপজাতের ওপর তাদের টেকসই ব্যবসায়িক ধারণাটি দাঁড়িয়ে, তার খনিগুলো কিন্তু টেকসই নয়। সেখানে সর্বোচ্চ উৎপাদনের নীতিতেই পরিবেশ ও প্রকৃতিকে কাঁচকলা দেখিয়ে খনিজ উৎপাদন করা হচ্ছে। টেকসই জ্বালানি ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে কাজ যে হচ্ছে না, তা নয়। কিন্তু এই সব কাজই অর্থহীন হয়ে পড়বে, যদি না প্রকৃতি ধ্বংসের মূল উৎসটিকে চিহ্নিত ও তা মোকাবিলায় ব্যবস্থা না নেওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে কিছু ব্যতিক্রম বলা যায় যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার ফিলিপ আনশুটজকে। বায়ুশক্তি কাজে লাগিয়ে ৩ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে তিনি এখন পর্যন্ত ৩০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছেন। লক্ষ্য ক্যালিফোর্নিয়াকে টেকসই করে তোলা। তাঁর এ প্রকল্প কতটা আশা জাগাতে পারে তা ২০২০ সালের আগে অন্তত দেখা যাবে না। এ ক্ষেত্রে এমনকি বিল জয়ের মতো লোকেদের কথাও বলতে হয়। সান মাইক্রোসিস্টেমসের এ সহউদ্যোক্তা প্রাণিজ আমিষহীন বার্গার তৈরিতে বিনিয়োগ করেছিলেন। এখন এটি মোটামোটি জনপ্রিয়তাও পেয়েছে। ২০১৪ সালে তিনি সিমেন্ট উৎপাদনে টেকসই প্রযুক্তি নিয়ে আসেন, যা কার্বন নিঃসরণ কমিয়েছে ৭০ শতাংশের মতো। একইভাবে মাইকেল ব্লুমবার্গ, জ্যাক মা, জেফ বেজোসের মতো ব্যবসায়ীরাও বিনিয়োগ করছেন। এই সবই আশার কথা। কিন্তু গোটা বিশ্বের পরিস্থিতি বিবেচনায় এ আশার আলো এখনো মিটমিট করেই জ্বলছে বলতে হয়। এ ধরনের বিনিয়োগ ও (উৎপাদন উপায় ও উৎসসহ) এর সফল প্রয়োগ যত বাড়বে, তত এ আলো শক্তি পাবে। দুঃখের বিষয় হচ্ছে বড় উদ্যোক্তারা ঠিক এভাবে এগোতে চাইছেন না। তাঁদের লক্ষ্য বিনিয়োগ, চাহিদা সৃষ্টি ও চটজলদি মুনাফাতেই সীমাবদ্ধ থেকে যাচ্ছে। এশিয়া ও দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর বিপদ পৃথিবীর ফুসফুস খ্যাত আমাজনের আগুন সবাইকে এতটাই আচ্ছন্ন করেছিল যে, একই সময়ে ইন্দোনেশিয়ার বনাঞ্চলও যে পুড়ছিল, তা অনেকটাই অনালোচিত থেকে গেছে। ইন্দোনেশিয়ার বনাঞ্চলে আগুন পুরো দুক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জন্য একটি সতর্কবার্তা ছিল। এ সতর্কবার্তা বাংলাদেশ ও ভারতের জন্যও প্রযোজ্য। ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা ও বোর্নিওর ৩ হাজার ৩০০ বর্গকিলোমিটারেরও বেশি এলাকা এ আগুনের শিকার হয়েছিল, যা নেভাতে দেশটির সরকারের ৯ হাজার কর্মী ও ৫২টি উড়োজাহাজ নিযুক্ত করতে হয়েছিল। আগুনের এত ব্যপ্তি কেন হলো? কারণ খরা। ভয়াবহ খরা। আর এই খরার কারণের পেছনেও রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন। ঠিক যেমন বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসের পেছনে। এই ভয়াবহ খরা ও এর কারণে ছড়িয়ে পড়া আগুনের কারণে ইন্দোনেশিয়া একা নয়, মালয়েশিয়াকেও ক্ষতির শিকার হতে হয়েছে। ২ লাখের বেশি মানুষ শ্বাসকষ্টজনিত রোগে ভুগেছে। শুধু মালয়েশিয়াতেই বন্ধ করতে হয়েছে দেড় হাজার স্কুল। এটি যখন ঘটছে, ঠিক তখনই অস্বাভাবিক বর্ষণে বন্যার শিকার হতে হচ্ছে ভারত ও বাংলাদেশকে। এক সময়ের উচ্চাভিলাষি বাঁধ ভেঙে দেওয়ার প্রস্তাব আসছে বিহার থেকে। নিজের প্রদেশের কাছ থেকেই অভিযোগের দায় নিতে হচ্ছে ভারতের কেন্দ্র সরকারকে। আর বাংলাদেশ তখন আরও একবারের মতো ফারাক্কাকে ‘মরণবাঁধ’ হিসেবে শনাক্ত করতে পারছে। এশিয়া আক্রান্ত হচ্ছে পর্যায়ক্রমিক খরা ও বন্যায়। এশিয়ার শহরগুলো অকাল বন্যার শিকার হচ্ছে বেশি। ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তার কথা বলা যায়। বন্যা সেখানে স্বাভাবিক হলেও, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এটি ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। প্রতি বছরের বন্যা তার আগের রেকর্ড ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ঢাকার কথা বললে, বলতে হয়, বৃষ্টি মানেই বন্যা। এই কিছু দিন আগে মাত্র এক ঘণ্টার বৃষ্টিতে সারা শহর জলমগ্ন হয়েছে। চট্টগ্রামে বন্যা এখন নিত্যকার যন্ত্রণা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতি বছর এ দুই শহরে ঢুকে পড়ছে মৃত নদীদের প্রেতাত্মা। পূর্ব জুরাইনের জন্য ডুবে থাকাটাই যেন ভবিতব্য। এই সবই হয়েছে প্রবৃদ্ধিময় প্রকৃতিধ্বংসী উন্নয়ন চিন্তা ও এর বাস্তবায়নের কারণে। অথচ যে দেশগুলোর কথা বলা হলো, এরা সবাই কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনরোধে শিল্পোন্নত দেশগুলোকে চাপ দিয়ে আসছে। মূলত জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় তহবিল সংগ্রহের লক্ষ্যেই তারা তাদের যাবতীয় কূটনৈতিক তৎপরতা জারি রেখেছে। কিন্তু এ মোকাবিলার জন্য যে ব্যবস্থা নিজ দেশে করা প্রয়োজন, তার কিছুই তারা করছে না। বরং এ নিয়ে সাধারণ মানুষ প্রশ্ন তুললেই বলা হচ্ছে, ‘খামোশ’। যে জাকার্তার কথা বলা হলো, তার কর্তৃপক্ষ বন্যার হাত থেকে শহরটিকে বাঁচাতে দ্বীপের চারপাশে উপসাগর আড়াল করে একটি দেয়াল তৈরি করতে চাইছে। বাজেট ৬ হাজার কোটি ডলার। আফসোস, পরিবেশ বিপর্যয় থামাতে তারা আরেকটি বিপর্যয় ডেকে আনছে। কারণ, এই দেয়াল সামুদ্রিক বাস্তুসংস্থানকে ভয়াবহভাবে বিপর্যস্ত করবে। আর এ বিপর্যয় করা হবে জনগণের অর্থেই। এ এক দারুণ বাণিজ্য। এক হিসাবে দেখা গেছে, এশিয়ার বড় ২০টি শহর ২০২৫০ সালের মধ্যে বন্যার কারণে প্রতি বছর বিরাট অঙ্কের আর্থিক ক্ষতির শিকার হবে। আর এটি হবে, অপরিকল্পিত ও একদেশদর্শী নগর পরিকল্পনার কারণেই। অথচ এই শহরগুলোর কর্তারাই পরিবেশ প্রশ্নে আন্তর্জাতিক পরিসরে ব্যাপক সোচ্চার হিসেবে পরিচিত। নগর পুড়লে দেবালয় বাঁচে না এ তো অনেক পুরোনো কথা। কিন্তু বিশ্বের শাসকেরা বরাবরই এই সত্য ভুলে থাকতে চায়। তাদের মনে হয়, আগেরবারের মতো হবে না। কিন্তু হয়। এটাই স্বাভাবিক এবং অবধারিত। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে শুধু সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ভাবলে বড় ধরনের ভুল হবে। যে বাণিজ্যের মোহে এ খেলা পুঁজি খেলে চলেছে, সেই বাণিজ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দীর্ঘসূত্রে। এখনো এই ক্ষতি হয়তো বড়ভাবে দেখা দেয়নি। করপোরেট বিশ্ব এখনো এর ঝাঁঝ পুরোপুরি অনুধাবন করতে পারেনি। কিন্তু প্রকৃতির অন্য সব কিছুর মতোই, সব ক্রিয়ার মতোই ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। এখনো পুঁজির ব্যবসায়িক ও রাষ্ট্র কাঠামো বিনিয়োগ, বাজার ও মুনাফাকেন্দ্রিক যে চিন্তা করছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ইস্যুকেও বাণিজ্যের আরেক প্রকরণ ও সম্ভাব্যতা হিসেবে কাজে লাগানোর যে চিন্তা করছে, তা বুমেরাং হচ্ছে অলক্ষ্যেই। সাধারণভাবে ব্যবসায়িক মুনাফায় এখনো টান পড়েনি মনে হলেও, আদতে এর ক্ষেত্রটি তৈরি হয়ে গেছে। ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, কিছু কিছু করপোরেট প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে সংকটের আঁচ অনুভব করতে শুরু করেছে। কোনোটির উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি, কোনোটির ভোক্তা পর্যায়ের সংকোচনসহ নানাভাবে এ প্রভাব পড়ছে। আর যারা এখনো এর নেতিবাচক প্রভাব দেখেনি, তারাও খুব শিগগিরই এর মুখোমুখি হবে। বৈশ্বিক নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিন্যান্সিয়াল স্টেবিলিটি বোর্ড (এফএসবি) জানাচ্ছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, অত্যধিক তাপমাত্রা, খরা, বন্যা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাসে শুধু সাধারণ মানুষ ও তাদের ঘরবাড়িই আক্রান্ত হচ্ছে না। এসবের সরাসরি প্রভাব পড়ছে, উৎপাদন, সরবরাহ ও অবকাঠামোর ওপর। বহু কারখানার ওপর এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে। ফলে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে, যা ভোক্তাদের বিভাজিত করে দিচ্ছে। বিশ্বের সামনের সারির ১১ হাজার করপোরেট প্রতিষ্ঠানের ওপর পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, এসব প্রতিষ্ঠানের বাজার নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ২ থেকে ৩ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। টাকার অঙ্কে এর পরিমাণ অনেক বেশি। এ ক্ষতি এমনকি ২০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। এই ক্ষতি শুধু প্রত্যক্ষ বিপর্যয় বিবেচনায়। পরোক্ষ হিসাব টানলে এ পরিমাণ আরও অনেক বাড়বে। সব মিলিয়ে পুঁজিকেন্দ্রিক বিশ্বকাঠামো তার বাজার অর্থনীতির ধাঁচে ফেলে জলবায়ু পরিবর্তনের মতো সংকটকে যেভাবে চিহ্নিত করছে এবং একেই যেভাবে পুঁজিতে রূপান্তিরত করছে, তা এক ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনতে যাচ্ছে। প্রকৃতিকে বিচ্ছিন্ন সত্তা হিসেবে বিবেচনা করে এ সংকটের কোনো সমাধান মিলবে না জেনেও যারা চোখ বন্ধ করে রাখতে চাইছে, যারা ভাবছে নিজের চারপাশে একটা নিরাপত্তা দেয়াল তুলে রাখলে কিচ্ছুটি হবে না, তারা বোকার স্বর্গে বাস করছে। যে পুঁজি শুধু কড়ি বোঝে, সে যদি এরই মধ্যে এ সংকটের কারণে কতটা অর্থক্ষতি হলো, তার হিসাব নেয়, তাহলেই এ ফাঁকিটা সে বুঝতে পারবে। আমাদের মতো চরম সংকটের মুখে দাঁড়ানো দেশগুলোও এ ফাঁকি নিয়ে খেলছে। প্রতি বছরই বন্যা, খরাসহ নানা ধরনের দুর্যোগ দেখলেও তারা নিজেদের উন্নয়ন নীতিতে কোনো পরিবর্তন আনছে না। এ নিজেকেই নিজে ভাঁওতা দেওয়ার শামিল, যা দিয়ে তারা উত্তর প্রজন্মের স্বপ্ন ও শৈশব চুরি করছে। চুরি করে ভাবছে বেশ সম্পদ গড়া গেল। কিন্তু এই সম্পদ যে অলক্ষ্যে তারও পিঠে ছুরি বসাতে শান দিচ্ছে, তা সে টের পাচ্ছে না। পিঠে ছুরির শিরশির অনুভূতি নিয়ে এমন আত্মধ্বংসী কাজ এক মাত্র ‘দুঃসাহসীই’ করতে পারে। তাই গ্রেটা থানবার্গ ‘হাউ ডেয়ার ইউ’ বলে প্রশ্নটি যথার্থই ছুড়েছে। এ প্রশ্ন রাষ্ট্রনায়ক ও ব্যবসায়ীরা, বাণিজ্যের মধুপায়ীরা না বুঝুক, সাধারণ মানুষের বুঝতে হবে। পুঁজি, বাণিজ্য ও তন্ত্রমন্ত্রে বন্দী বিশ্বের আগলটি তবেই খোলা যাবে।

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..