পেঁয়াজ না খেলে কি জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়?

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email
এ. এন. রাশেদা : বাংলাদেশে জীবন ঝুঁকিপূর্ণ এমন বহু ক্ষেত্র আছে। বিদ্যালয় দিয়ে শুরু করা যাক। প্রায় প্রতিদিন যা খবর হয়ে প্রকাশিত হচ্ছে। প্রাইমারি থেকে স্কুল, কলেজ সবই। ছাদের পলেস্তারা খসে ঝুঁকিতে শিশুরা আছে, মাঠে পাঠদান চলছে, নদীর ভাঙনে বিলীন হয়ে যাচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইত্যাদি। ৩০ সেপ্টেম্বর দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত হয়েছে ‘৮০ ভাগ সরকারি প্রাইমারি স্কুলের শৌচালয় ব্যবহার অনুপযোগি’। প্রতিবেদনটি বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার এবং বিশুদ্ধ পানিরও অভাব সেখানে। পানির অপর নাম জীবন। শুধু সেখানে তো নয়, দক্ষিণাঞ্চলের অনেক স্থানে বিশুদ্ধ পানির অভাব আছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শৌচালয় ব্যবহার অনুপযোগি বা বিশুদ্ধ পানির অভাব– খবরগুলো বড়ই বেদনাদায়ক। কত জায়গায় কত কিছুর যে দরকার তা ভেবে হৃদয় ব্যাকুল হয়। ইনডেপেন্ডেট টেলিভিশনে সেদিন সচিত্র দেখানো হচ্ছিল মোমিনপুর রেল স্টেশনের প্রয়োজনীয়তা এবং দুরবস্থার কাহিনী। এর পূর্বে কুমিল্লার এক স্টেশনের এমনই অবস্থা দেখানো হয়েছিল। ২ অক্টোবর সিরাজগঞ্জের দুটি রেল সেতুতে ফাটল ধরার পরও ঝুঁকি নিয়ে ধীরগতিতে ট্রেন চলাচল করছে দিনে ২০ বারের বেশি। কোথাও আবার বাঁশ দিয়ে ঠেকা দিয়ে রাখা হয়েছে ইত্যাদি লোমহর্ষক বর্ণনা। আর সড়ক পথের কথা কে না জানে? প্রতিদিন সেখানে চলছে মৃত্যুর মিছিল। নিম্ন আয়ের মানুষ হলে তো তাদের পরিবারের দুঃখ দুর্দশা মোচনে সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়েও আসে না। বহু সংসার মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না, ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। এছাড়াও আছে বহু সমস্যা যা প্রতি মুহূর্তে মানুষের জীবনকে সংকটাপন্ন করে তুলছে। সেখানে পেঁয়াজের সমস্যা– কি ঠিক তেমন? লবণ হলে তা অবশ্যই হতো। চালের বেলায়ও তা সত্য। কিন্তু পেঁয়াজ না খেলে কি মানুষ মৃত্যুমুখে পতিত হয় কিংবা মস্তিস্কে রক্তক্ষরণ হয়, হাত পা অবশ বা অন্য কিছু হয়? অর্ধেক জনগোষ্ঠী তো মোটেও খায় না। অথচ এই পেঁয়াজের জন্য বিভিন্ন মিডিয়া তৎপর হয়েছে এবং ব্যবসায়ীরা নিজেদের স্বার্থেই তৎপরতা দেখাচ্ছে। জনগণের চিন্তায় তারা কতই না ব্যাকুল। ২ অক্টোবর সকালে Rtv চ্যানেলে যখন এমন বিতর্ক চলছিল তখন আমাদের সাহায্যকারী হাজেরা বেগম বলে উঠলেন– ‘পেঁয়াজের দাম যখন ১০০ টাকা তখন পেঁয়াজ খাওনের দরকার কি? না খাইলেই তো হয়’। আমি আগের দিন ফেসবুকে পেঁয়াজ ছাড়া বা অল্প দিয়ে রান্নার কথা লিখেছিলাম, অনেকে পছন্দ করেছেন। প্রশ্ন করেছিলাম কিভাবে তারা রান্না করেন? সোজা সাপ্টা উত্তর- “কড়াইতে তেল দিয়া সব ময়মশলা দিয়ে খানিক নাড়ানাড়া কইরা যা রান্না করতে চায় তা ঢাইলা দেয়।” এটাই বাস্তবতা। তা ছাড়াও ব্রাহ্মণরা যে মাছ ও শাক সব্জি রান্না করেন, তা তো পেঁয়াজ ছাড়াই। সে রান্না তো ঘ্রাণেই অর্ধ ভোজন হয়ে যায়। তারা সব্জিতে পাঁচফোড়ন এবং মাছে কালোজিরা বা মেথি ব্যবহার করেন। আর অন্যরা যখন গরুর মাংস রান্না করবেন, তখন তারা পেঁয়াজের পরিমাণে মিষ্টি কুমড়ার ছোট ছোট টুকরাসহ অন্যান্য সকল মসলা দিয়ে রান্না করলে পেঁয়াজের অভাব মনেই হবে না। খুব সামান্য পেঁয়াজ শেষে ভেজে উপরে দেয়া যেতে পারে। আর খাসী বা মুরগির মাংসে পেপের কুচি এবং শেষে লবণের চেয়ে কম পরিমাণে চিনি ব্যবহার করলে পেঁয়াজের প্রয়োজন কমে যাবে। মাংসের কোরমা করলে সামান্য ময়দা/আটা গুলিয়ে দিলে ঝোল ঘন হয়ে এলে দুধের গুড়া দিতে হবে। এতে স্বাদে কোনো ঘাটতি পড়বে না। অথবা এখানে বাদাম বা পোস্ত বাটাও হতে পারে। রান্না নিয়ে এত কথা বলার কারণ হলো এই যে, মাংস, মাছ– এসব কেনার ক্ষমতা শতকরা কতজন মানুষের আছে? যাদের দৈনন্দিন আয় ৩০০/- থেকে ৬০০/- টাকা বা আরও কম– তারা কি মাছ মাংস কেনার সামর্থ্য রাখেন? হয়ত ছোট ছোট মাছ কেনেন বা নিজেরাই ধরেন। আপত্তির বিষয় হলো এখানে যখন টেলিভিশনের আলাপের এক পর্যায়ে ব্যবসায়ী নেতা হেলাল সাহেবকে বলতে শুনি– টিসিবিকে পেঁয়াজ কেনায় ইনসেন্টিভ না দিয়ে ব্যবসায়ীদের আমদানিতে ইনসেন্টিভ দিলে পেঁয়াজের সংকট থাকবে না। এখানেই প্রশ্ন শতকরা কত ভাগ মানুষের জন্য ব্যবসায়ীদের ইনসেন্টিভ দিতে হবে? আর এই আমদানিতেই ব্যবসায়ী শ্রেণি এবং সরকারের আমলা ও মন্ত্রীরা আনন্দিত হয় সবচেয়ে বেশি। ধান যখন প্রচুর উৎপন্ন হয় কৃষক ধান নিয়ে বিপাকে থাকে ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার জন্য, তখন সরকার ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে চাল আমদানি করে। আবার পেঁয়াজ যখন উৎপন্ন হয়, তখন পেঁয়াজ আমদানি করে। সেই অনুষ্ঠানে সম্ভবত সিরাজগঞ্জ থেকে একজন দর্শক ফোনে বললেন, গত মৌসুমে তার এলাকায় তিনি ৩ টাকা কেজিতে পেঁয়াজ কিনেছেন। কৃষক সর্বস্বান্ত হয়েছে। তারা উৎপাদনে আগ্রহ হারিয়েছে। অথচ কৃষককে বাঁচবার চিন্তা না করে সরকার এবং ব্যবসায়ী শ্রেণি ‘হায় হায়’ মাতম করছে যেমন করে শিয়া সম্প্রদায় মহরমে ‘হায় হাসান, হায় হোসেন’ করে। কৃষি বিজ্ঞানীরা সারাবছর পেঁয়াজ চাষের ভ্যারাইটি আবিষ্কার করছেন। কৃষককে প্রণোদনা দিয়ে আগামী এক বছরের মধ্যেই পেঁয়াজ চাষে দেশকে স্বনির্ভর করা যায়। তাহলে ব্যবসায়ী শ্রেণির পেঁয়াজ নিয়ে এত পেরেশান হবার প্রয়োজন পড়বে না। দেশের শ্রমিকের, কৃষকের কষ্টার্জিত অর্থ দিয়ে পেঁয়াজ আমদানি না করে বিদ্যালয়ের শৌচাগার, পলেস্তারা খসে পড়া ছাদ ও জরাজীর্ণ ভবন মেরামত করা যাবে। খেলার মাঠ উদ্ধার ও যেসব জেলায় মানুষের পানির কষ্ট– তা দূর করতে হবে। রেলব্যবস্থার প্রকৃত উন্নয়ন করে লাখো মানুষকে মৃত্যুঝুঁকি থেকে উদ্ধার আর সড়কের প্রাণহানি বন্ধ করার দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। আর কৃষক যখন যে ফসল উৎপাদন করে তার লাভজনক দাম নিশ্চিত করে প্রতি উপজেলায় কষিপণ্যের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে হিমাগার তৈরি করতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একা মানুষ তিনি কতদিকে দৃষ্টি দেবেন। বাকীরা তো অন্ধ, বধির, দুর্নীতিবাজ ও তালিবাজ। তাই জনগণকে এমন ধোঁকার মধ্যে কতকাল থাকতে হবে, কে জানে? ভারতবর্ষে একসময়ে আমলাদের পক্ষ থেকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকে বলা হয়েছিল ‘ভাল ব্লেড না থাকায় দাঁড়ি কামানো যাচ্ছে না।’ প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমি বিয়ার্ডম্যান পছন্দ করি।’ তাই ভারতবর্ষকে ব্লেড আমদানি না করে উৎপাদন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল। একেই বলে দেশপ্রেম। তাই আমাদের দেশেও পর্যাপ্ত পেঁয়াজ উৎপন্ন না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলে ক্ষতি কি? এক সময় আলু অধিক উৎপন্ন হওয়ায় বিএডিসি আলুর নানারকম উপাদেয় খাদ্য তৈরি করে প্রদর্শনীর আয়োজন করত। এখনও হতে পারে পেঁয়াজ ছাড়া বা সামান্য ব্যবহার করে বা বিকল্প কিছু পথ উদ্ভাবন করে নানারকম উপাদেয় খাদ্য করা এবং প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা। আর বিভিন্ন চ্যানেলে শুধু বিদেশি রান্নার আয়োজন না করে পেঁয়াজ ছাড়া রান্নাও দেখানো যেতে পারে। জুয়া বা ক্যাসিনোকে ভালো না বেসে দেশকে ভালোবাসলে এ অসম্ভবের দেশে সবই সম্ভব বলে বিশ্বাস করা যায়। লেখক : সম্পাদক, সাপ্তাহিক একতা

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..