ব্রাজিলের নারীদের সংগ্রাম

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email
লাকী আক্তার : পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তেই সমাজবদলের সংগ্রামের সাথে সাথে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে নারীদের সংগ্রাম পরিচালনা করতে হয়। ব্রাজিলের নারীরাও এর ব্যতিক্রম নয়। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে ব্রাজিলে যাওয়ার সুবাদে সেখানকার নারীদের সংগ্রাম নিয়ে আমার জানার সুযোগ হয়। উপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই, নিজেদের ঐতিহ্যকে রক্ষার লড়াই, ব্রাজিলে কালো মানুষদের অধিকারের লড়াই, সাম্রাজ্যবাদ আর পুজিবাদের বিরুদ্ধে চিরন্তন লড়াইয়ের এক উর্বর ভূমি ল্যাটিন আমেরিকার এই দেশটি। এ সকল আন্দোলনের সাথে সাথে ব্রাজিলে নারী আন্দোলনেরও রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস। ব্রাজিলে পারিবারিক সহিংসতা এবং নারী নির্যাতনের হারও কম নয়। পরিসংখ্যান বলে ব্রাজিলে প্রতি ১১ মিনিটে একজন নারী ধর্ষিত হয়। কালো আর আদিবাসী নারীদের অবস্থা আরো নাজুক। শহরের নারীদের ক্ষেত্রেও এ সংকট তীব্র। পারিবারিক দায়িত্বের চাপে নারীরা প্রায়শই নিজেদের অবস্থান আরো দৃঢ় করতে সমর্থ হয় না। তাছাড়া ব্রাজিলের রাজনীতি কিংবা ব্যবসার ক্ষেত্রেও নারীরা পিছিয়ে আছে। পারিবারিক সহিংসতার বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধারাবাহিক আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে ব্রাজিলে বহুল প্রতীক্ষিত ‘মারিয়া দা পেনহা’ আইন প্রণীত হয়। এই আইনকে ব্রাজিলের নারী আন্দোলনের বিজয় হিসেবে গণ্য করা হয়। এই আইনের ফলে ব্যাপক আশাবাদী ছিল ব্রাজিলের নারীবাদী আন্দোলনকারীরা। কিন্তু এই আইন প্রণয়নের মধ্য দিয়ে তাদের সমাজ ব্যবস্থার অসংগতি আর পারিবারিক সহিংসতাও বন্ধ হয়নি। নারী নির্যাতনও থেমে থাকেনি। ব্রাজিলে যৌন নিপীড়নকারীদের জন্য ২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ভোগের আইন থাকলেও সেখানেও অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। ফলশ্রুতিতে সেখানেও নির্যাতন বন্ধ হচ্ছে না। পৃথিবীর বৃহৎ রোমান ক্যাথলিক দেশ ব্রাজিলে, নারীদের প্রতিটি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে ধর্মীয় প্রভাবও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গত শতকে ব্রাজিলে নারী আন্দোলনের অনেক অর্জন থাকা সত্ত্বেও জেন্ডার বৈষম্য রয়েই গেছে। ব্রাজিলের ১৯৮৮ সালের সংবিধানের ৫ম অধ্যাদেশে পরিষ্কারভাবেই ব্রাজিলে নারী পুরুষের সমানাধিকারের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত নারী-পুরুষের মজুরি বৈষম্য এবং রাজনৈতিক প্রভাবের ক্ষেত্রে নারীদের অবস্থান পেছনেই রয়ে গেছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম ২০০৫ সালে তাদের প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রবন্ধে উল্লেখ্য করেছে, ব্রাজিলে বিচারব্যবস্থায় মাত্র ৫ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণ রয়েছে। এমনকি ব্রাজিলের শ্রম এবং কর্মসংস্থাপন মন্ত্রণালয় বলছে, ব্রাজিলে নারীরা পুরুষের চেয়ে ৩০ শতাংশ কম মজুরি পেয়ে থাকেন। বর্তমানে অনেক ঘটনাকেই সহিংসতা বলে চালিয়ে দেয়া হয়। এ যেন রীতিতে পরিণত হয়েছে। উপনিবেশিক সংস্কৃতি রয়ে যাওয়ার দরুণ এখনো নারীদেরকে মনে করা হয়, তারা তাদের পুরুষদের সার্বক্ষণিক সহায়তা করবে তাদের ক্যারিয়ার গঠনের জন্য। এখনো নারীদের বিবেচনা করা হয়, তারা পরিবারের সমগ্র দায়িত্বভার নিজেদের হাতে তুলে নিবে, তাদের বাড়ির পুরুষেরা ক্যারিয়ারে পূর্ণ মনযোগ প্রদান করবে। বর্তমানে অনেকে নারী এ ধারণা থেকে বের হয়ে কর্মরত থাকলেও, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের একই সাথে পারিবারিক দায়িত্বও সমানতালে পালন করতে হয়। ব্রাজিলে উগ্রবাদী জাইর বলসানরো ক্ষমতায় আসার পর সবচেয়ে বেশি সংকটের মুখে পড়েছে নারী, এলজিবিটি কমিউনিটি এবং আদীবাসীরা। তার ঘৃণা মিশ্রিত কথা আর নারীদের সম্পর্কে অশ্রদ্ধামূলক কথাবার্তা শুধুমাত্র ব্রাজিল নয় পুরো লাতিন আমেরিকার জন্যই অশনিসংকেত। যদিও ব্রাজিলে নারী আন্দোলন অনেক বেশি সংগঠিত। জাইর বলসানরোর নির্বাচনকালেও লক্ষ লক্ষ নারী রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করেছিলেন। ব্রাজিলে নারী আন্দোলনের নানা মাত্রিক বৈচিত্র্যতা রয়েছে। স্থান ভেদে নারী আন্দোলনেরও তারতম্যও রয়েছে। রাজনৈতিক এবং ব্যবসায়িকভাবে এখনো ব্রাজিলের নারীরা পিছিয়ে আছে। ব্রাজিলের পার্লামেন্টে মাত্র ১০.৭ শতাংশ নারী সংসদে আছেন। ১৯৯৭ সালের প্রণীত আইন অনুযায়ী ব্রাজিলের পার্লামেন্টে ৩০ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণ করার কথা থাকলেও কার্যত পিছিয়েই আছে নারীরা। সাও পাওলো ক্যাথলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতির অধ্যাপক রোজমেরী সিগুয়ার্দো বলেছিলেন, ‘বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলে ৩০ শতাংশ নারী কোটা পূরণ করার জন্য নারীদের মনোনয়ন দেয়া হলেও দলগুলো নারীদের আসন পাকাপোক্ত করার জন্য পর্যাপ্ত গুরুত্ব কিংবা অর্থ ব্যয় করে না। যার ফলশ্রুতিতে সংসদে নারীদের হার আশানুরূপভাবে বাড়ছে না। কিন্তু প্রতিকূলতা থাকা সত্ত্বেও অনেক নারীই রাজনীতিতে নাম লেখানোর সাহস দেখাচ্ছেন। বর্তমান সময়ে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করা একজন রাজনীতিবিদ হচ্ছেন মারিয়েলা ফ্রাঙ্কো।’ ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিওর কাউন্সিলর, কালো এবং এলজিবিটি কম্যুনিটির নেতা এবং সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিবিদ মারিয়েলো ফ্রাঙ্কোকে পেশাদার খুনিরা প্রকাশে গুলি করে হত্যা করে ২০১৮ সালে। মারিয়েলো ফ্রাঙ্কোর হত্যাকে অনেকেই গণতন্ত্রকে হত্যার শামিল বলে ঘোষণা দেন। নারী অধিকার, সমকামিতা, সিঙ্গেল মায়ের অধিকার নিয়ে দীর্ঘদিন লড়াই করেছেন মারিয়েলো ফ্রাঙ্কো। তার মৃত্যুর পর লক্ষ লক্ষ জনতা রাজপথে নেমে আসে প্রতিবাদে। পুলিশের সহিংসতার বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন দৃঢ়চেতা একজন প্রতিবাদকারী। তার অসীম সাহসিকতার জন্যই রিও ফাভেলার জনগণ বিশেষ করে কালো মানুষেরা তাকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করে রিও’র কাউন্সিলর নির্বাচিত করে। উগ্র বর্ণবাদের শিকার ব্রাজিলের কালো মানুষেরা ধারাবাহিকভাবে সহিংসতার শিকার হন। উগ্র বর্ণবাদের বিরুদ্ধে ৩৮ বছর বয়সী মারিয়েলো ফ্রাঙ্কো বরাবরই ছিলেন খুব স্পষ্ট প্রতিবাদী। এমনকি তিনি যেদিন গুলিবিদ্ধ হন সেদিনও তিনি ৩০ জনের কালো নারীদের একটা গোলটেবিল বৈঠক করেন। সেই বৈঠকে তার শেষ কথা ছিল, ‘আমি ততক্ষণ পর্যন্ত মুক্ত নই যতক্ষণ না সকল নারী মুক্ত হচ্ছে। এমনকি যখন তাদের হাতের শেকল আমার চাইতে ভিন্ন।’ লেখক : নির্বাহী সদস্য, কৃষক সমিতি

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..