সরকারের কৃষকবিরোধী নীতি ও কৃষকের নিঃস্বকরণ

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email
মোস্তাফিজুর রহমান মুকুল : আমার দাদা আমার বাবাকে মেট্রিক পাস করার পর কলেজে পড়তে যেতে দেন নাই। কারণ তার একটিই ছেলে। জমি ৮০ বিঘার উপরে। তখন এসএসসি পাস দিয়েই অনেকে চাকুরিতে যোগদান করেছে। আমার বাবারও চাকুরি হয়েছিল। তাতেও আমার দাদার আপত্তি। এত জমি থাকতে চাকুরি করতে হবে কেন? এত কিছু কে খাবে? আমি প্রাইমারিতে পড়ার সময়ই আমার দাদা মারা যান। ৮০ বিঘার উপর জমি নিয়ে আমার কৃষক বাবা সংসারের দায়িত্ব নেন। ছোটবেলায় দেখতাম ধান কাটার সময় বাড়িতে দাঁড়ানোর জায়গা থাকতো না। আবার পাটের সময়ে পাট দিয়ে বাড়ি ভর্তি হয়ে যেত। একটি ঘরে বিশাল আকৃতির মাচায় বড় বড় মাটির পাতিলে বিভিন্ন জাতের ধানের বীজ সংরক্ষণ করা হত। সব মিলিয়ে আমাদের পরিবারের মোটামুটি স্বচ্ছলতা ছিল। বাড়িতে মাঝেমাঝেই গণ খাইদাইয়ের আয়োজন হত। তবে জমির ফসলের উপরেই সংসারের সকল খরচ চলত। বাবার জমানো কোনো টাকা থাকতো না। আমার মনে পড়ে, ১৯৮৬ সালে বোরো চাষ শুরু হলে ঐ বছরেই আমার বাবা দুটি শ্যালো টিউবওয়েল ঋণে নেয়। সেবার ধানের পরিমাণ এত বেশি হয় যে বাড়িতে ধান রাখার জায়গা সংকুলান হচ্ছিল না। এরপর ৮৬, ৮৭’র বন্যায় বিশাল ক্ষতি আমার বাবা আর কাটিতে উঠতে পারলেন না। প্রায় প্রতি বছরেই বন্যায় আমন ফসল নষ্ট হয়েছে। একমাত্র বোরো ফসলের উপর ভরসা। বোরো ধান অনেক হলেও ফসল বিক্রি করে সার ডিজেল কীটনাশকের দোকানের বাকী টাকা পরিশোধ করে খুব বেশি যে টিকত না তা বোঝা গেল যখন পরবর্তী বছরে ফসল রোপনের সময় হলেই বাবা দুই এক বিঘা জমি বন্ধক রাখতেন। এরইমধ্যে আমাদের ভাইবোনদের লেখাপড়ার খরচও বাড়তে শুরু করেছে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে খুব সম্ভব ১০ বছরের মধ্যে বাবার অর্ধেকের বেশি জমি বন্ধক পড়ে গেল। এই প্রক্রিয়ায় আমার বাবাকে এক পর্যায়ে কিছু জমি বিক্রি করে দিতে হলো। এরইমধ্যে ব্যাংক থেকে নোটিশ আসতে শুরু করলো শ্যালো ঋণ শোধ করবার জন্য। বাবা কিছুতেই কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না। এভাবে বাবার বেশিরভাগ জমি বন্ধক পড়ে গেল। বাবার মাথায় বিশাল এক ঋণের বোঝা চেপে বসলো। কিছুতেই সমাধান হচ্ছিল না। এক পর্যায়ে পারিবারিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রায় ২০/২৫ বিঘা জমি বিক্রি করে দিতে হলো। তা দিয়ে কিছু জমি বন্ধক খুলে নেয়া হল আর বাকিটা আমার বোনের বিয়েতে খরচ করলেন। তারপরেও ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করা হলো না। আজকে সারা দেশে কৃষককে ধান নিয়ে মহা সংকটে দেখে আমার কৃষক বাবার সংগ্রামের কথা মনে পড়ে গেল। তখন না বুঝতে পারলেও এখন বুঝি এদেশের কৃষক কিভাবে সরকারের কৃষক বিরোধী নীতির কারণে নিঃস্ব হয়েছে। এই সময়ে কৃষক কিনতে ঠকেছে আর বেচতে ঠকেছে। কৃষক যখন তার ফসল উৎপাদনের জন্য কৃষি উপকরণ (সার, ডিজেল, কীটনাশক, বীজ) কিনতে গেছে তখন তাকে বেশি দামে কিনতে হয়েছে। আর যখন তার ঘামে শ্রমে উৎপাদিত ফসল বাজারে বিক্রি করতে গেছে তখন সে তার ন্যায্য দাম পায় নাই। এভাকে কিনতে ঠকা আর বেচতে ঠকার কারণে কৃষক তার জমি হারিয়েছে। অনেকে নিঃস্ব হয়েছে। কৃষকের জন্য ভর্তুকি কাগজে কলমে দেখা গেলেও সরকারের কাছ থেকে কোন রকম সহযোগিতা কৃষক পায় না। বিগত ৪০ বছরে আমার বাবাকে সরকারি কোনো সুযোগ সুবিধা পেতে বা সরকার নির্ধারিত রেটে সরকারি গুদামে ধান দিতে দেখি নাই। ৫০ বছর আগে আমার দাদা আমার বাবাকে পড়তে না দিয়ে, চাকরি করতে না দিয়ে যে কৃষির মত এক মহাসংগ্রামী পেশায় নিয়োগ করে দিয়েছিলেন সেই সংগ্রাম বাবার আজও শেষ হলো না। কমতে কমতে যে অল্প পরিমাণ জমি আছে তাতে উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য দাম বাবা আজও পাচ্ছেন না। উৎপাদিত ফসল বলতে ধান। আগে পাটসহ অন্যান্য ফসল ফলাতো। এখন কৃষক আর পাট বোনে না। পাটের দাম না পেয়ে হতাশ হয়ে এক সময় কৃষক পাটে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। পাট চাষ ছেড়ে দিয়েছে। এবারে আমরা দেখলাম ন্যায্য দাম না পেয়ে কৃষক ধানের ক্ষেতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। অনেকেই বলছে আর ধান চাষ করবো না। মুখে কৃষকবান্ধব বললেও আমাদের দেশের সরকার বরাবরেই কৃষক মারার সরকার হিসেবে কাজ করেছে, করছে। যখন দেখি হাজার হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ মওকুফ করার জন্য ব্যস্ত হয়ে যায় আমার দেশের সরকারের অর্থমন্ত্রী। আর মাত্র ৭৯২ কোটি টাকা কৃষি ঋণ মওকুফ করে না তখন এই সরকার কতটা কৃষকবান্ধব তা আর বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়। আজকে কৃষকের মনের ক্ষোভের আগুন ক্ষেতে জ্বলছে। এই আগুন কোথায় গিয়ে পড়বে তা কে জানে। গত ১৮ মে আমরা কমিউনিস্ট পার্টির উদ্যোগে গাইবান্ধা সদর উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ হাট দারিয়াপুরে ইউনিয়ন পর্যায়ে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে সরকার নির্ধারিত ১০৪০ টাকা মণ দরে ধান ক্রয়ের দাবিতে ধান ভর্তি বস্তা মহাসড়কে ফেলে অবরোধ করতে গিয়ে দেখলাম সিএনজি অটোরিকশা ভ্যানওয়ালারা আমাদের জায়গা নিজে থেকেই ফাঁকা করে দিচ্ছে। অনেক সাধারণ মানুষ এসে আমাদের অবস্থান কর্মসূচিতে সামিল হচ্ছেন। রাস্তায় আটকে থাকা যাত্রীরা কোনোরকম বিরক্ত হচ্ছে না। প্রায় দুই ঘণ্টা রাস্তা আটকে রেখে অবরোধ তুলে নিলে অনেকে বলেছেন আরও কিছুক্ষণ থাকতে পারলেন না। শুধু তাই নয়, বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই এলাকায় মানুষ ডেকে বলছিল- ‘ধানের দাম নাই আমরা মরে গেলাম, সরকার আমাদের জন্য কিছু করবে না। আপনার কিছু একটা করেন, কর্মসূচি দেন। আপনারা ছাড়া আমাদের পক্ষে বলার তো আর কেউ নাই’। এর থেকে একটা কিছু অনুমান অন্তত: করা যায় কৃষকের ক্ষোভের এই আগুন বিদ্রোহের আগুনে পরিণত হতে বেশি দেরি নাই। আর তার জন্য প্রয়োজন বাম গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক শক্তির ঐক্যবদ্ধ লড়াই। লেখক : সাধারণ সম্পাদক, সিপিবি, গাইবান্ধা জেলা কমিটি

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..