ধনীদের ঈদ আনন্দ গরিবের যন্ত্রণা

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email

কাজী মো. রুহুল আমিন : আসছে ঈদ। ঈদ মানে আনন্দ। ইতোমধ্যেই ঈদের আনন্দ শুরু হয়েছে। মধ্যবিত্তরা দেশে এবং উচ্চবিত্তরা বিদেশে কেনাকাটায় ব্যস্ত। নানারকম প্রচার। ব্যবসায়ীদের মুনাফা বৃদ্ধির নানা পাঁয়তারা নানা আয়োজন। অনেক ব্যবসায়ী বলছে এক মাসে লাভ করে সারা বছর চলতে হবে। এই লাভ আসে কোথা থেকে? জনগণের পকেট কাটাকে ব্যবসায়ীরা লাভ হিসেবে দেখছে। এই লাভের যাতাকলে শ্রমজীবী মেহনতি জনগণ দিশেহারা। যাদের পক্ষে খেয়ে পরে বেঁচে থাকাই দুষ্কর তারা এই চাপ সইবে কেমন করে। আর ঈদ কারো জন্য আনন্দ আর কারো জন্য বেদনাদায়ক। যেমন অর্থনৈতিক বৈষম্য, জীবনমানের বৈষম্য। আমরা জানি কোনো কোনো মানুষের গাড়ি বাড়ি বিলাসবহুল জীবনের কথা। নানা গল্প শুনি ও বলি যে, অমুক শিল্পপতির এতগুলো কারখানা, কোটি-কোটি টাকা আয়, যার শুধু দেশেই নয় বিদেশেও গাড়ি-বাড়ি। তারা এদেশের গরিব মানুষের মেহনতের ফসল বিদেশে পাচার করে। এদেশের টাকা দিয়ে বিদেশে মার্কেটিং করে। তারা অসুখ হলে এদেশে চিকিৎসা করে না, বিদেশে চিকিৎসা করেন। এমন আরো অনেক ঘটনা। এক মালিকের কথা শুনেছিলাম, বড় কারখানার মালিক। অথচ শ্রমিকদের চার মাস যাবত মজুরি দেন না। গত ২ মাস যাবত আন্দোলন চলছে। বার বার আন্দোলনে হামলা, অনাহারি শ্রমিকদের মারধর করা হচ্ছে। মালিক এবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নমিনেশন চেয়ে পান নাই। ঐ মালিকের পক্ষে অনেকেই সাফাই গেয়ে বলছিলেন তিনি খুব ভাল মানুষ কিন্তু ব্যবসায়িক সংকটে পড়ে গেছে। বাস্তবে তা নয়, ৬০ বছরের অধিক বয়সী (১ বার তাকে দেখেছি তাতে যা অনুভব হয়েছে) ঐ মালিক কিছুদিন আগে কানাডায় একটি বাড়ি বানিয়েছে এবং কানাডিয়ান এক লেডিকে বিয়ে করেছে। তিনি এদেশের সব নিয়ে এখন কানাডায় পাড়ি জমাচ্ছেন। মাঝখান থেকে মেরে দিতে চায় শ্রমিকের পাওনা। আর ঐ কারখানার শ্রমিকদের অনেককে ইতিমধ্যেই বাড়িওয়ালা বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। অর্থের অভাবে অনেক শ্রমিকের সন্তানের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে। সংসার ভাঙতে বসেছে অনেক শ্রমিকের। দুমুঠো চালের অভাবে না খেয়ে দিন কাটছে এই কারখানার হাজারো শ্রমিকের। কিছু দিন আগে এনটিকেসি নামক এক কারখানায়ও ৩ মাস বেতন বাকী রেখে কারখানা বন্ধ করে দেয়ায় আন্দোলনের এক পর্যায়ে শ্রম প্রতিমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে শ্রমিকদের পাওনা দেয়ার তারিখ নির্ধারিত হয়। শ্রমিকরা ভেবেছিল ঐদিন অবশ্যই টাকা পাবে, কিন্তু টাকা দেয়নি মালিক। কোনো ব্যবস্থা নেয়নি সরকার বা মন্ত্রী। ঐ কারখানার এক শ্রমিক আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন। কারণ টাকা পাবে বলে তার পরিবার গ্রামের বাড়িতে বিয়ে ঠিক করেছিল। পরের দিন টাকা নিয়ে বাড়ি যাওয়ার কথা। যেতে না পারায় পারিবারিক চাপ সইতে না পেরে লজ্জায়-ঘৃণায় বিয়ের পরিবর্তে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন। এ সকল খুনি মালিকরা ঈদের সময় শ্রমিকদের বেতন-বোনাস না দিয়ে বিদেশে ঈদ করে। তারা ভুলে যায় যে, এই শ্রমিকদের শ্রমে-ঘামের ন্যায্য মজুরি না দিয়ে তারা এত টাকার মালিক। তারা শ্রমিকদের না খাইয়ে রেখেই ক্ষ্যান্ত হয় না, শ্রমিকদের জীবনও কেড়ে নেয়। তাই স্লোগান উঠেছে “লাশের উপর দাঁড়িয়ে মুনাফা করা চলবে না, লাশের উপর দাঁড়িয়ে লুটপাট করা চলবে না”। এই পুঁজিপতিদের অধিক মুনাফার শিকারিরা কিভাবে ঈদের বেদনা সইবে? যেমনি করে প্রতিদিন বেঁচে থাকার তাগিদের জীবন যন্ত্রণা সয়ে যায়। অনেক পণ্ডিত ভদ্রলোকরা ২ জনের আয়ের হিসেব কষে মজুরি নির্ধারণের কথা বলেন। তারা খুঁজে দেখেছেন কি? স্বামী-স্ত্রী দুই জন কারখানায় কাজ করলে তাদের শিশু-কিশোর সন্তানেরা কেমন থাকেন? কোথায় থাকেন? শ্রম আইন অনুসারে থাকার কথা কারখানার শিশু যত্নকেন্দ্রে। কিন্তু মালিকরা আইন মানেন না, তাই কারখানায় কোনো শিশু যত্নকেন্দ্র নাই। ক্ষুধা নিবারণের জন্য দু’জনেই কারখানার শ্রমিক, শিশু সন্তানকে রেখে দেন গ্রামে নানি বা দাদির কাছে। মাস শেষে কিছু টাকা পাঠান। পিতা-মাতা ছাড়া শিশু বড় হতে গিয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে অনেকেই রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে। শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত এসকল শিশুর ভবিষ্যৎ কী? তা-কি একবারও ভেবেছেন? বোধ হয় না। যেমনটি এই শিশুর বাবা-মায়ের ক্ষেত্রেও কেউ ভাবেনি। কেউ দায়িত্ব নেয়নি। আমাদের সমাজে নারীরা সাধারণত: গৃহিণীই থাকতেন। নানা কারণে অসহায় নারীরা সমাজের বোঝা হয়ে যান। সেখান থেকে মুক্তি পেতে ছুটে আসেন গার্মেন্টস কারখানায়। নাম লেখান গার্মেন্টের হেলপারের খাতায়। প্রতিদিন ভোর থেকে আবার গভীর রাত পর্যন্ত চলতে থাকে জীবনযুদ্ধ। যে বাসায় মাথা গুজে ঠিকানা খুঁজে পায়, সেই বস্তি বা টিনসেড বাসায় ফজরের আযানের সময় হতে রান্না ঘরের সিরিয়াল যুদ্ধ। গোসলখানা-টয়লেটের সিরিয়াল। খাবার খাওয়া দুপুরের খাবারের বাটি গোছানো কোনোটারই সময় নেই। কারখানায় যেতে ৫ মিনিট দেরি হলেই হাজিরা কাটা, বোনাস কাটা যাবে। প্রতিবাদ করলেই নেমে আসবে নিষ্ঠুর নির্যাতন। মুখ বুজে সইতে হবে কারণ চাকুরি গেলে না খেয়ে থাকতে হবে। বাড়ি ভাড়া দেয়া না গেলে বাড়িওয়ালা বাড়ি থেকে বের করে দিলে মাথা গোজার ঠাঁই নাই। এই দারিদ্র্যতার যাতাকলে থেকেও মাস শেষে গ্রামের শিশু-সন্তান বা বৃদ্ধ পিতা-মাতা তাদেরকে কিছু টাকা পাঠাতে না পারলে তারাও না খেয়ে মরবে। ঠিকমত টাকা না দিতে পারলে আর বাছাধনকে লালন-পালন করার দায়িত্ব নেবে না কেউ। যার ফলে নীরবে কাঁদতে কাঁদতে দিনের পর দিন- মাসের পর মাস এমনকি বছরের পর বছর সব জ্বালা সইতেই থাকেন শ্রমিকেরা। আর স্বপ্ন দেখেন সন্তান লালন-পালন করে বড় করলে বুঝি তার দুঃখ-কষ্ট লাঘব হবে। সে কারণে কারখানায় অফিসার গালি দিলেও গায়ে হাত দিলেও কোনো কথা না বলে চুপ করে থাকে। ঈদের সময় হলে বাড়িতে সন্তান চেয়ে থাকে তার মা নতুন জামা-কাপড় নিয়ে যাবে। মাও আশায় বুক বেঁধে থাকেন- ঈদের ছুটিতে বাড়ি গিয়ে সন্তানকে দু-চার দিন লালন-পালন করবেন। মা তার সন্তানকে নিজের বুকে ঘুম পাড়াবে, নিজ হাতে খাইয়ে-নাইয়ে দেবে। কিন্তু তার কিছুই করতে দেয়া হয় না। সন্তানের মুখখানা দেখতেও যাওয়ার সুযোগ হয় না অসংখ্য মা-বাবার। আমরা দেখি অনেক কারখানায় ঈদ বোনাস দেয়া হয় না। যেসব কারখানায় বোনাস দেয়া হয় তাও নামমাত্র। অনেক কারখানায় বেতন দেয়া হয় না। তাদের আর বাড়ি যাওয়া হয় না। প্রতিদিনের নীরব কান্না সেদিন আর নীরব থাকে না। সেদিন সবাই দেখে এই কান্না, সবাই দেখে চিৎকার আর আর্তনাদ। কিন্তু কেউ তাদের পাশে থাকে না একটু সান্তনা দিতে। আমরা এর অবসান চাই। আমরা শিশুকে ভবিষ্যৎ সমাজের বোঝা বানাতে চাই না। মানবসম্পদে পরিণত করতে চাই। সে কারণে আমরা প্রতিবার দাবি তুলি ঈদের আগে বেতন-বোনাস পরিশোধ করতে হবে। এক মাসের বেতনের সমান ঈদ বোনাস দিতে হবে। এত উন্নয়নের গল্পই যদি হয় তাহলে গল্পের মধ্যে এ দাবি জানাতে হবে কেন? যেখানে দেশের মন্ত্রী, এমপি, সকল সরকারি ও বেসরকারি চাকরিজীবী এবং সরকারি খাতের শ্রমিক-কর্মচারীরা এক মাসের বেতনের সমান বোনাস পাবে। একই সমাজের মানুষ একই বাজারের ভোক্তা গার্মেন্ট ও অন্যান্য শ্রমিকরা কেন সে অনুযায়ী বোনাস পাবেন না। শুধু বোনাসের কথা দিয়েই শেষ করা যায় না। এবারের রানা প্লাজা দিবসে দেখলাম তানভীরকে এবং শুনলাম তানভীরের জীবন কাহিনী। তানভীরের জন্মের পর থেকেই তার মা অসুস্থ হয়ে সকল প্রকার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। এমনকি নিজের সন্তানকেও চেনেন না তিনি। এমন পরিস্থিতিতে তানভীরকে তার খালার কাছে রেখে বাবা এসে চাকরি করেন রানা প্লাজায়। রানা প্লাজা তানভীরের বাবার জীবন কেড়ে নেয়। আজও তার সন্ধান পাওয়া যায়নি। তানভীরের খালা এসেছিল শিশু তানভীরকে নিয়ে তার বাবার খোঁজে কোন কিন্তু সন্ধান না পেয়ে রানা প্লাজার সামনেই চিৎকার করছিল আর বলেছিল, কে আর খাওয়াবে তানভীরকে কে বাঁচাবে তানভীরকে? কোথায় ফেলে যাবো তানভীরকে? এক পর্যায়ে নীরবে রাস্তায় ফেলে রেখে যান পিতা-মাতা হারা তানভীরকে। রাস্তা থেকে কুড়িয়ে নেন মহিলা পরিষদ এর নেত্রী তমা আপা। তমা আপাই তাকে লালন-পালন করতে থাকে। তমা আপার আরো দুই সন্তান তারা মায়ের আদরে বড় হচ্ছে। মাকে মা বলে ডাকতে পারে। কিন্তু তানভীর শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে যে, মায়ের আদর কেমন? কিন্তু সে আর মা বলে ডাকতে পারে না। কখনো মায়ের আদর পান না। একদিন তমা আপা সোফায় বসে তার দুই সন্তানকে আদর করছে। তানভীর তার পায়ের কাছে বসে দেখছিল। এক পর্যায়ে পায়ের কাছ থেকে দাঁড়িয়ে বললেন, আমি একটু আপনাকে মা বলে ডাকি, তমা খন্দকার তাকে মা বলে ডাকার অনুমতি দিল। তানভীর জড়িয়ে ধরে মা বলে ডাক শুরু করলো আজও তাকেই মা বলে ডাকে আর প্রায়ই বাবার খোঁজে ছুটে যায় রানা প্লাজায়। কিন্তু আজও বাবার সন্ধান পায়নি। হয়তোবা আর কোনো দিন তানভীর তার বাবাকে ফিরে পাবে না। বাবা বলে ডাকতে পারবে না। পাবে না। মুনাফালোভী এসকল মালিকরা মানবতা-মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলেছে। আমরা শুধু পুঁজিপতিদের ঈদ আনন্দ দেখে ভুলে যেন না থাকি। আমরা তানভীরদের জীবনে ঈদের আনন্দ দেখতে চাই। ঈদ হোক সবার জন্য আনন্দের। ক্ষুধা-দারিদ্র্য যেন কারো জীবনের ঈদ আনন্দ কেড়ে না নেয়। সকল মানুষের প্রত্যেকটি ঈদ যেন হয় আনন্দের। তাহলে গরিবের ঈদ যন্ত্রণার লাঘব করতে পারবো। সেই সংগ্রাম জোরদার করাই আমাদের কর্তব্য। আসুন এ কর্তব্য সাধন করি। সে লক্ষ্যে পুঁজিবাদের কালো থাবার বিরুদ্ধে সকল মজদুরকে ঐক্যবদ্ধ করে লড়াই অগ্রসর করি। দুনিয়ার মজদুর এক হও! লেখক : কার্যকরী সভাপতি, গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..