কৃষকের লড়াই করতে হবে এখনই

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email
আবিদ হোসেন : বাংলাদেশে গত দশ বছরে শাসকশ্রেণির পক্ষ থেকে সবচেয়ে বহুল উচ্চারিত শব্দ হচ্ছে ‘উন্নয়ন’। এই উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ আয়াজনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নকে উদ্দীপনার উৎস হিসেবে জনগণের সামনে প্রচার করছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নের কথা বলে মূলতঃ মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা থেকে দ্রুতগতিতে দেশকে অনেক দূরে নিয়ে যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে অর্জিত আমাদের সংবিধানে রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্যের অঙ্গীকার নির্দিষ্ট করা আছে, ‘আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা– যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে;’ রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হবে, ‘মানুষের ওপর মানুষের শোষণ হইতে মুক্ত ন্যায়ানুগ ও সাম্যবাদী সমাজ লাভ নিশ্চিত করিবার উদ্দেশ্যে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা...।’ ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে’। এই অঙ্গীকার ও রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির সাংবিধানিক নির্দেশনা এবং সেই সাথে সরকারের ‘উন্নয়ন অভিযাত্রা’ বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট যে, মুখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বললেও আসলে বিপরীত ধারায় দেশকে অগ্রসর করে নিয়ে যাচ্ছে। সমাজে বৈষম্য আরো বেড়ে যাচ্ছে। ১ ভাগ ধনিক শ্রেণির হাতে ৯৯ ভাগ শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি গরিব মানুষের সম্পদ। অথচ মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ছিলো ‘রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব হইবে মেহনতি মানুষকে-কৃষক ও শ্রমিককে–এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তি দান করা। ‘রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বিকাশের মাধ্যমে উৎপাদনশক্তির ক্রমবৃদ্ধি সাধন এবং জনগণের জীবনযাত্রার বস্তুগত ও সংস্কৃতিগত মানের দৃঢ় উন্নতি সাধন’ কিন্তু সরকার তা না করে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য উন্নয়নের তকমা লাগিয়ে এক লুটপাটের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ভিত দৃঢ় করছে। প্রশাসনের সকল স্তরকে নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা দিয়ে এক প্রশাসনিক সমাজকাঠামো নির্মাণ করছে। যার প্রতিফলন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চূড়ান্তভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে। লুটপাটের এই অর্থনীতিতে নিষ্পেষিত হচ্ছে কৃষক-শ্রমিক গরিব মেহনতি মানুষ। গ্রামীণ কৃষি অর্থনৈতিক কাঠামো ক্রমশঃ ভেঙে যাচ্ছে। দেশের সকল মানুষের অন্ন উৎপাদন করে কৃষক। অথচ কৃষকের জীবনের কোনো ধরনের নিশ্চয়তা নেই। রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে মহাজন, এনজিও কিংবা ব্যাংক থেকে ঋণ করে ফসল ফলিয়ে লাভজনক দাম না পেয়ে নিঃস্ব হচ্ছে। সরকার ধানের দাম নির্ধারণ করে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান-গম ক্রয়ের ঘোষণা দিলেও প্রকৃত কৃষকের কাছ থেকে ধান-গম ক্রয় করা হচ্ছে না। মধ্যসত্ত্বভোগী ফড়িয়া-দালালের কাছে কৃষক কমদামে ধান-গম বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। প্রতিটি ইউনিয়নে সরকারি শস্য ক্রয় কেন্দ্র চালু হলে কৃষক কিছুটা লাভ করতে পারতো। ধান, গম, ভূট্টা, পাটসহ সকল প্রকার ফসলের বাজার ব্যবস্থাপনা মধ্যসত্ত্বভোগী সিন্ডিকেটের হাতে। ফলে কৃষক এই সিন্ডিকেটের নির্ধারিত দামে ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হয়। কৃষক ব্যাংক থেকে কৃষি ঋণ নিতে নানান হয়রানির মুখোমুখি হয়। খাজনা, পরচা, নামজারি, দলিল ইত্যাদি কাগজপত্র ঠিক করতে নাভিশ্বাস বের হয়ে যায়। ক্ষুদ্র কৃষক ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে সার্টিফিকেট মামলা ঘাড়ে নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। সারাদেশে প্রায় ১ লাখ ৬৮ হাজার সার্টিফিকেট মামলায় কৃষক হয়রানি হচ্ছে। এরমধ্যে ১১ হাজার ৭৭২ জন কৃষক গ্রেফতারি পরোয়ানা নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। শুধু কুমিল্লা জেলারই মাত্র ১২ কোটি ৪৮ লাখ ৭১ হাজার টাকার জন্য সাড়ে ৪ হাজার কৃষকের বিরুদ্ধে সার্টিফিকেট মামলায় চরম হয়রানি করা হচ্ছে। অথচ ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়ে যাচ্ছে। এই লুটপাটকারীরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে। গ্রামীণ কৃষি অর্থনীতির উন্নয়নের সবচেয়ে বড় বাধা ভূমি অফিস। ভূমি অফিসের অনিয়ম হয়রানি-দুর্নীতিতে মানুষ অতিষ্ঠ। দুর্নীতির খাতওয়ারি জরিপে ভূমি প্রশাসন শীর্ষে। এখানে ঘুষের পরিমাণ প্রায় ১ হাজার ৬০৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে খাস জমি বণ্টণে গড়ে ৪৮৫৭ টাকা। জমি জরিপে ও সীমানা নির্ধারণে ৩৮৫৭ টাকা জমি ক্রয়-বিক্রয়ে ১৮৪৭ টাকা, জমি খারিজে ৩৩১৩ টাকা, কর প্রদানে ১১৭০ টাকা, নথি উত্তোলনে ১৬৩৯ টাকা, অন্যান্য সেবায় ৪১৮১ টাকা ঘুষ দিতে হয়। এছাড়াও অকৃষি জমিতে ২৫ বিঘা পর্যন্ত খাজনার আওতায় না থাকলেও জোর জবরদস্তি করে কৃষকের কাছ থেকে খাজনা আদায় করে নেয়। পৌর এলাকা ঘোষিত হয় নাই এমন এলাকায় আবাসিক ও অন্যান্য কাজে বাৎসরিক ১০টাকা, শিল্প কাজে ৩০ টাকা, বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত ভূমির কর ৪০টাকা নির্ধারণ হলেও ভূমি অফিসে ইচ্ছে মতো নানান খাত দেখিয়ে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করে থাকে। ভূমি অফিস দ্বারা মানুষ কতোটুকু জিম্মি তা ভূমি অফিসের ৩১ আগস্ট ২০১৭, স্মারক নং ৩১,০০.০০০০.০৪৬.১৯.০৫৫.১৪.৬৬৮ পরিপত্রেই উল্লেখ আছে, ‘ইদানিং ভূমি মন্ত্রণালয় ও এর অধীনস্থ দপ্তরসমূহের বিশেষ করে উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের কার্যালয়সমূহের ভূমি সেবা বিষয়ে বিভিন্ন অভিযোগ শোনা যায়। জন প্রতিনিধি থেকে শুরু করে উচ্চ পদস্থ বিভিন্ন কর্মকর্তা/ব্যক্তিবর্গ/বিচারপ্রার্থী জনগণ সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তাদের বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ করে আসছেন। সহকারী কমিশনার (ভূমি) এবং ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তাদের হাতে মূলত জমির মালিকরা জিম্মি। তারা মানুষকে সীমাহীন ভোগন্তি দিয়ে থাকেন। তারা মানুষকে জিম্মি করে বিভিন্ন অপারাধে জড়িয়ে পড়ছে বলেও স্থায়ী কমিটি কার্যবিবরণীতে লিপিবদ্ধাকারে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও ভূমি আপিল বোর্ড কর্তৃক অধস্তন ভূমি ও ভূমি রাজস্ব আদালত/অফিস পরিদর্শনকালে আদালতসমূহের পরিচালনা, সিদ্ধান্ত, আদেশ, রায় ও ভূমি সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত ত্রুটি/সমস্যাদি দূরীকরণের জন্য আরও স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধিসহ গুণগত ও মানোন্নয়নের স্বার্থে যে বিষদ নির্দেশনা দিয়েছে তার কোনোটাই মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন করা সম্ভব না। উন্নয়নের জোয়ারে ধ্বংস হচ্ছে কৃষি জমি। নগরকেন্দ্রিক ও নগরায়নের উন্নয়নে গ্রাম উজাড় হচ্ছে শহরের দাপুটে ধনিক শ্রেণি, আর দলীয় সরকারো দলীয় চামুণ্ডাদের দখল-আধিপত্যে। গ্রামের অবকাঠামোর উন্নয়ন না করে উন্নয়নের নামে ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে গ্রামীণ সংস্কৃতি। সর্বস্তরে দলীয় আধিপত্যে সাধারণ মানুষ আজ দিশেহারা। তাদের দেখার যেন কেউ নেই। অথচ এই উন্নয়ন বৈষম্য দূর করে একটি সমতাভিত্তিক জনগণের রাষ্ট্র গড়ে তোলাই ছিলো মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীত ধারায় দেশকে নিয়ে যাচ্ছে ধনিক শ্রেণির প্রতিনিধিত্বকারী সরকার। মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ও অঙ্গীকার ফিরিয়ে আনতে শ্রমিক-কৃষক-ক্ষেতমজুর মেহনতি মানুষের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের কোনো বিকল্প নেই। ১ ভাগ ধনিক শ্রেণির বিরুদ্ধে ৯৯ ভাগ মানুষের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামেই মানুষকে মুক্তি দিবে। শ্রমিক-কৃষক-ক্ষেতমজুর মেহনতি মানুষের শ্রেণি পেশার অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে এগিয়ে নেয়ার এখনি সময়। তাই গ্রামে গ্রামে কৃষক-ক্ষেতমজুরদের সংগঠিত হয়ে ধারাবাহিকভাবে আন্দোলন-কর্মসূচি এগিয়ে নিতে হবে। বাংলাদেশ কৃষক সমিতি দীর্ঘদিন ধরে কৃষি-কৃষক-দেশ বাঁচাতে আন্দোলন সংগ্রাম করে আসছে। আগামী ২৬ ফেব্রুয়ারি সারাদেশে গ্রাম থেকে উপজেলা সদরে ‘পদযাত্রা’ অবস্থান ও সমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। এই কর্মসূচি সফল করতে ২৫ জানুয়ারি থেকে ১০ ফেব্রুয়ারি সারাদেশে ‘সাংগঠনিক পক্ষ’ ও ১১ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৫ ফেব্রুয়ারি ‘আন্দোলন ও প্রচার পক্ষ’ কর্মসূচি পালন করছে। ‘সাংগঠনিক পক্ষে’ সদস্য সংগ্রহ, গ্রাম কমিটি, ইউনিয়ন কমিটি গঠন, বিভিন্ন কমিটির সভা করা, জেলা নেতৃত্বের উপজেলা ও গ্রাম সফর, পরিকল্পনা গ্রহণ ইত্যাদি কর্মসূচি জেলা কমিটিসমূহ পালন করছে। ‘আন্দোলন ও প্রচার পক্ষে’ স্থানীয় দাবিসমূহ চিহ্নিত করে কৃষকদের সংগঠিত করে গ্রামে গ্রামে গ্রাম বৈঠক, উঠান বৈঠক, হাট সভা, মিছিল, সমাবেশ কর্মসূচি পালন করবে। ২৬ ফেব্রুয়ারি সর্বোচ্চ সংখ্যক কৃষকের অংশগ্রহণের মাধ্যমে গ্রাম থেকে উপজেলায় পতাকা, প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুনসহ মিছিল করে উপজেলা সদরে ‘পদযাত্রা ও অবস্থান’ সমাবেশ কর্মসূচি পালন করবে। এই কর্মসূচি সফল করতে অনেক জেলা নিজস্ব উদ্যোগে স্থানীয় দাবি ও জাতীয় দাবি সম্বলিত লিফলেট ছাপানোর উদ্যোগ নিয়েছে। ধান, গম, ভূট্টাসহ সকল প্রকার ফসলের লাভজনক দাম দিতে হবে। ইউনিয়ন পর্যায়ে সরকারি শস্য ক্রয় কেন্দ্র চালু করে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধানসহ অন্যান্য ফসল ক্রয় করতে হবে। অবিলম্বে কৃষি ঋণ বিতরণে অনিয়ম-হয়রানি-দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। কৃষকদের সার্টিফিকেট মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। ভূমি অফিস ও পল্লী বিদ্যুতের অনিয়ম-হয়রানি-দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। এই দাবিসমূহ সামনে রেখে স্থানীয় দাবি যুক্ত করে সারাদেশের কৃষকদের কৃষক সমিতিতে সম্পৃক্ত করে একটি কার্যকর আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এই দেশকে নির্মাণ করেছে কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি জনতা। মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনাকে সমুন্নত রাখতে মুক্তিযুদ্ধের ধারায় দেশকে ফিরিয়ে নিতে হবে। ৯৯ ভাগ মানুষের স্বপ্ন-সম্পদ লুটপাটকারী ১ ভাগ ধনিক শ্রেণির বিরুদ্ধে লড়াইটা করতে হবে এখনি। অধিকার সবসময় আদায় করেই নিতে হয় সংগঠিত লড়াইয়ের মাধ্যমে। ঐতিহাসিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের মতোই এই লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে কৃষক-শ্রমিক-ক্ষেতমজুর মেহনতি মানুষকেই। মহান মুক্তিযুদ্ধতো আমাদের এই প্রেরণাই দেয়। লেখক : সহ-সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ কৃষক সমিতি, কেন্দ্রীয় কমিটি

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..