‘একুশের’ অমরত্ব ও বিশ্বজনীনতা

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম : ইতিহাস কখনো শুধু একটি মাত্র একরৈখিক পথ ধরে অগ্রসর হয় না। তার অগ্রগতির পথে থাকে বিপ্লবী উল্লম্ফনের অধ্যায়। কালের যাত্রাপথে এমন কিছু দিনের আগমন ঘটে যা ‘চলতি হাওয়ার’ মোড় ঘুরিয়ে দিতে স্বক্ষম হয়। ক্যালেন্ডারের পাতার গতানুগতিক সরল সময়ের হিসেবকে অতিক্রম করে সেসব দিন তখন অর্জন করে ‘ঐতিহাসিক’ তাৎপর্য। এসব ‘ঐতিহাসিক দিনের’ অস্তিত্ব তার ২৪ ঘণ্টার আয়ুষ্কালের মধ্যেই নিঃশেষ হয়ে যায় না। দিন-মাস-বছর পরিক্রমায় যুগ যুগ ধরে তা জীবন্ত রূপে অস্তিত্বমান থাকে। পরবর্তী ইতিহাস রচনায় প্রেরণা ও দিক নির্দেশনার উৎস রূপে তা বিরাজ করতে থাকে। তেমনই একটি দিন ছিল ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি। ক্যালেন্ডারের পাতার ২৪ ঘণ্টার গণ্ডিকে অতিক্রম করে বাঙালির ইতিহাসে যা যুক্ত হয়েছে কালজয়ী ‘অমর একুশে’ রূপে। একথা জানা প্রয়োজন যে, ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে কী এমন ঘটেছিল যা তাকে এরূপ ঐতিহাসিক অমরত্ব প্রদান করেছে? বায়ান্নর একুশের ফেব্রুয়ারি দিনটিকে আমরা ‘শহীদ দিবস’ বলে আক্ষায়িত করে থাকি। সেদিন পাকিস্তানের পুলিশ বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ চত্ত্বরে সংগ্রামরত ছাত্র সমাজের ওপর নির্বিচার হামলা, গ্রেফতার, লাঠিচার্জ ও গুলি চালিয়েছিল। ছাত্রদের বুকের রক্তে ঢাকার রাজপথ সেদিন রঞ্জিত হয়েছিল। গুলিতে ছাত্রদের মাথার খুলি উড়ে গিয়েছিল, বুক ঝাঝড়া হয়েছিল। পুলিশের গুলি মায়ের বুককে খালি করে হাহাকার জাগিয়ে তুলেছিল। সে হাহাকার প্রতিধ্বনিত হয়েছিল বাঙালির ঘরে ঘরে। শহীদ হয়েছিল সালাম, রফিক, জব্বর, বরকত, শফিউর। সেদিনের সেসব চিরঞ্জীব শহীদদেরকে জাতি আজও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে চলেছে। আরো যুগ-যুগ ধরে জাতি তাঁদেরকে স্মরণ করে চলবে। একুশে হয়ে উঠেছে ‘অমর একুশে’। তবে কথা হলো, শুধু ‘ছেলে হারা কতো মায়ের অশ্রু’ দিয়ে রাঙ্গানো হওয়ার কারণেই ‘একুশে’ অমর হয়নি। বায়ান্নর আগে-পরে এবং এখনো, ছোট-বড় সংগ্রামে অগণিত শহীদ জীবন বিলিয়ে দিয়েছে ও দিচ্ছে। সব শহীদের মৃত্যুই শোকের, বেদনার। সব শহীদদের প্রতিই জাতির শ্রদ্ধা-সম্মান সুগভীর। তাহলে নিশ্চয়ই একুশে ফেব্রুয়ারির অমরত্বের উৎস শুধু সেদিনের ঘটনাবলীর শোকের মধ্যে নিহিত নেই। ‘একুশের’ সেই অমরত্বের উৎস হলো সেদিনের সেই সংগ্রামের ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণ ও তার দাবির অন্তর্নিহিত তাৎপর্যে। একুশে ফেব্রুয়ারি ছিল, বায়ান্নরও চার বছর আগে আটচল্লিশে সূচীত, ভাষা আন্দোলনের একটি অনন্য সাড়া- জাগানিয়া উপাখ্যান। যে কোনো আন্দোলনের প্রবাহিত কালপর্বে গ্রথিত থাকে অসংখ্য খণ্ড খণ্ড সংগ্রামের উপাখ্যান। সেই সব সংগ্রামের উপাখ্যানগুলোর মধ্যে কোনো একটি অনন্যতা অর্জন করে তার ‘মোড় ঘুরিয়ে দেয়ার স্বক্ষমতার’ কারণে। সংগ্রামের সেই ঐতিহাসিক উপাখ্যানটি তখন সমগ্র আন্দোলনের প্রতিনিধিত্বশীল প্রতীকের স্থান করে নেয়। সে ভাবেই ‘একুশে’ হয়ে উঠতে পেরেছে, বেশ কিছু বছর ধরে চলা, বাঙালির ‘ভাষা আন্দোলনের’ প্রতীকী উপাখ্যানের দিন। সে কারণেই তা ‘শহীদ দিবস’ হিসেবে ‘অমরত্ব’ লাভ করেছে। ‘ভাষা আন্দোলন’ বাঙালির ভাষার দাবিতে পরিচালিত হলেও সেদিনের ‘ভাষা আন্দোলন’ সংগঠিত হয়েছিল বাংলাকে ‘মাতৃভাষা’ করার দাবিতে নয়, তা হয়েছিল বাংলা ভাষাকে ‘রাষ্ট্রভাষা‘ করার দাবিতে। সেটি ‘মাতৃভাষা’ আন্দোলন ছিল না, ছিল ‘রাষ্ট্রভাষা’ আন্দোলন। সেদিনের সে সংগ্রাম মোটেও বাংলা ও উর্দুর মধ্যে কোনো ভাষা দাঙ্গার ঘটনা ছিল না। সেটি ‘রাষ্ট্রভাষা’ আন্দোলনের সুস্পষ্ট দাবি ছিল– বহুজাতিক রাষ্ট্র পাকিস্তনের ‘অন্যতম’ রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষাকে আইনগত স্বীকৃতি দিতে হবে। কারণ, বাংলা হলো সেই বাঙালি জাতির মাতৃভাষা, যে বাঙালিরা হলো পাকিস্তানের নাগরিকদের বৃহত্তম অংশ। এই দাবির মধ্যে মিশে ছিল গণতান্ত্রিক চেতনা ও অধিকারবোধের প্রকাশ। উগ্র জাত্যাভিমান ও সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী ফ্যাসিসূলভ চিন্তা নিয়ে সেদিনের সে সংগ্রাম পরিচালিত হয়নি। তা যদি হতো তাহলে দাবি করা হতো, বাংলাকে পাকিস্তানের ‘একমাত্র’ রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। কিন্তু বাংলাকে ‘একমাত্র’-এর বদলে ‘অন্যতম’ রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করা হয়েছিল। এ কারণে আন্দোলনটি পেয়েছিল বিশ্বজনীন ও সার্বজনীন গণতান্ত্রিক চরিত্র। ‘অন্যতম’ ও ‘একমাত্র’– এ দুয়ের মাঝে পার্থক্যের বিষয়টি মোটেও হালকা কোনো বিষয় নয়। বাংলাকে ‘একমাত্রে’র বদলে ‘অন্যতম’ রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তোলার মাধ্যমে ভাষা আন্দোলনকে সংকীর্ণ ও উগ্র জাতীয়তাবাদের চোরাবালিতে ডুবে যাওয়ার বিপদ থেকে রক্ষা করা সম্ভব হয়েছিল। এর ফলে তাতে সন্বিবেশিত করা সম্ভব হয়েছিল গভীর গণতান্ত্রিক ও প্রগতিবাদী চরিত্র। প্রতিটি জাতির জাতীয় স্বকীয়তা, আত্মমর্যাদা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের নিশ্চয়তা বিধানের গণতান্ত্রিক নীতি-আদর্শের ওপর দাঁড়িয়েই ভাষা আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিল। এভাবে, ভাষা আন্দোলনের গতিমুখ স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রবাহমান হয়েছিল বিশ্বব্যাপী চলতে থাকা সাম্রাজ্যবাদ-উপনিবেশবাদ বিরোধী ‘জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের’ ধারায়। ফলে, পরবর্তী গণসংগ্রামের ধারাকেও ভাষা আন্দোলনের সেই গতিমুখীনতার পথে প্রবাহিত করা সম্ভব হয়েছিল। মাত্র ১৯ বছরের মাথায় সেই পথনির্দেশনা অনুসরণ করেই আমরা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের পর্বে উপনীত হয়েছিলাম। এবং এভাবেই একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে ‘জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের’ গতিমুখীনতা আরো গভীরভাবে প্রবিষ্ট থাকার পথ করে নিতে পেরেছিল। গোড়া থেকেই বাঙালির ভাষা আন্দোলনের গভীরে প্রোথিত ছিল একটি সর্বজাতির অধিকার বোধ। সেই আন্দোলনে প্রবিষ্ট ছিল প্রত্যেক জাতিসত্ত্বার স্বাধীন আত্মপ্রতিষ্ঠার গণতান্ত্রিক অধিকার ও বৈচিত্রপূর্ণ বহুমাত্রিকতায় মানব সভ্যতাকে বিকশিত করার স্পষ্ট প্রত্যয়। ‘একুশের’ এই বিশ্বজনীন গণতান্ত্রিক মর্মবাণীর কারণেই আজ একুশে ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ রূপে বিশ্ব সভায় মর্যাদা লাভ করেছে। বাঙালির রক্তে রাঙ্গানো ‘একুশে’ এভাবেই বাঙালির একান্ত নিজস্ব জাতীয়তার গণ্ডি অতিক্রম করে বিশ্ব সভ্যতার সম্পদ হয়ে উঠতে পেরেছে। সাংস্কৃতিক, সামাজিক, মতাদর্শিক ইত্যাদি ক্ষেত্রে বাঙালি জাতির জন্য ভাষা আন্দোলন ছিল মোড় ঘুরিয়ে দেয়ার মতো ঐতিহাসিক ঘটনা। বায়ান্নর মাত্র কয়েক বছর আগে পূর্ব বাংলার ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ ও পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল দ্বিজাতিতত্ত্বের দ্বারা বিভ্রান্ত হয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে তা নিয়ে সেই ‘সাধের পাকিস্তানের’ অন্যায়, আধিপত্যমূলক ও চরম বৈরী একগুয়ে অবস্থানের ঘটনা বাঙালির মনোজগতে সৃষ্টি হওয়া ‘পাকিস্তানি কালোমেঘের’ সাময়িক বিভ্রান্তি দ্রুত কাটতে শুরু করেছিল। সাম্প্রদায়িকতার যে বিষবাষ্প দ্বারা তারা প্রায় পরিপূর্ণ আচ্ছাদিত হয়ে পড়েছিল, সেই ভুল তাদের ভাঙ্গতে শুরু করেছিল। ধর্মভিত্তিক জাতির পরিচয়ের প্রতিক্রিয়াশীল ও সাম্প্রদায়িক চিন্তার চোরাবালি থেকে বেরিয়ে এসে বাঙালি জাতি ফিরে আসতে শুরু করেছিল ভাষাভিত্তিক জাতি পরিচয়ের চিন্তায়। নতুন করে পুনর্জাগরিত হয়েছিল বাঙালির জাতীয় চেতনা। ‘একুশে’ একাধারে ছিল সেই জাগরণের ফসল এবং একই সাথে ছিল তার মূল কর্ষক-ও। বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর যে আঘাত এসেছিল তার প্রতিবাদ করতে করতে এদেশের মানুষ নতুন করে বাঙালি স্বজাত্যবোধের প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়েছিল। ‘একুশেতে’ যে চেতনার উন্মেষ, সেটিই পরিণতি লাভ করেছিল ‘একাত্তরের’ মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে। সে কারণেই ‘একুশের’ আবেদন ও তাৎপর্য অনন্য। ‘একুশের’ বা ‘ভাষা আন্দোলনের’ সাথে ভাষা, সংস্কৃতি, চেতনা, আদর্শের বিষয়গুলো সরাসরি জড়িত ছিল। কিন্তু তার পেছনের চালিকা রূপে ছিল অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রশ্ন। একথা ইতিহাস দ্বারা প্রমাণিত যে ‘রাজনীতি হলো অর্থনীতির ঘনিভূত প্রকাশ’। একথাও প্রমাণিত সত্য যে, সমাজে বিদ্যমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ভিত্তির উপরেই রচিত হয় সেই সমাজের শিল্প, সাহিত্য, ভাষা, সংস্কৃতি, মতাদর্শ, রাজনীতি ইত্যাদি যাবতীয় উপরিকাঠামোর সৌধ। পাকিস্তানী শাসকরা শুরু থেকেই পূর্ববাংলাকে শোষণের লীলাক্ষেত্র বানিয়ে তার উপর ঔপনিবেশিক ধরনের শোষণ চাপিয়ে দেয়ার পথ গ্রহণ করেছিল। কোনো জাতির ওপর অর্থনৈতিক শোষণ চালাতে হলে তার ওপর রাজনৈতিক আধিপত্য নিশ্চিত করাটি একটি আবশ্যিক শর্ত। এবং সেরূপ রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা সবচেয়ে সহজ হয় যদি পদানত জাতির জাতিগত আত্মপরিচয় ও সত্ত্বাকে বিলুপ্ত করা বা তাকে অন্ততঃ প্রশ্নবিদ্ধ, খর্বিত ও বিকৃত করে দুর্বল করে রাখা যায়। সে কারণে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রথম দিন থেকেই বাঙালির জাতিগত আত্মপরিচয় ও অস্তিত্বের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি শাসকরা আঘাত হানার পথ গ্রহণ করেছিল। একটি জাতির আত্মপরিচয় ও অস্তিত্বের একটি প্রধান স্তম্ভ যেহেতু তার নিজস্ব ভাষা, তাই বাঙালির ভাষার ওপর আঘাত হানার জন্য তারা সবচেয়ে আগে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। পাকিস্তানি শাসকরা উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিয়েছিল। এর মাধ্যমে তারা এক ঢিলে দুই পাখি মারার কৌশল কার্যকর করতে চেয়েছিল। তারা একদিকে চেয়েছিল উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার মাধ্যমে বাঙালির জাতীয় আত্মপরিচয়কে ধ্বংস করে দিতে। অন্যদিকে তারা চেয়েছিল সরকারি পদে ও রাষ্ট্র সমাজের নিয়ন্ত্রণমূলক জায়গাগুলোতে বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য অনতিক্রমযোগ্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে। তাদের পরিকল্পনা ছিল, বাংলা, বাঙালি ও পূর্ব বাংলাকে পদানত রেখে এভাবে তার ওপর অর্থনৈতিকভাবে জাতিগত শোষণ বহাল রাখা। তাদের পক্ষে এই পথ গ্রহণ করা সহজ হয়েছিল এ কারণে যে, পাকিস্তান আন্দোলন ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভিত্তি ছিল ‘মুসলমানরা একটি জাতির’ প্রতিক্রিয়াশীল তত্ত্ব। এই তত্ত্বের আলোকে যুক্তি দেয়া হয়েছিল যে, পাকিস্তানের সব ভাষাভাষী মানুষই যদি মুসলমান হিসেবে এক জাতি হয় তাহলে সে ক্ষেত্রে বাঙালি জাতি বা বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রশ্ন তোলাটি অবান্তর। আর, মুসলমান হিসাবে সব পাকিস্তানিই যদি এক জাতি হয়, তাহলে তাদের ভাষাও একই হওয়া বাঞ্চনীয়। কোন্টা হতে পারে সেই সাধারণ ভাষা? নিশ্চয়ই তা বাংলা নয়। কারণ হিন্দুদের ব্যবহৃত সংস্কৃত ভাষা থেকে বাংলা ভাষার উদ্ভব হয়েছে। বাংলা বর্ণমালার উদ্ভবও ঘটেছে সেই সূত্র থেকেই। অন্যদিকে, উর্দুর উদ্ভবের পেছনে রয়েছে আরবী ভাষার উপাদান। উর্দু বর্ণমালার প্রায় সমপ্রকারের হলো আরবী বর্ণমালা। তাই, উর্দুই কেবল ‘পাকিস্তানের মুসলিম জাতির’ জন্য গ্রহণযোগ্য ভাষা হওয়ার যোগ্যতা রাখে। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করা হলে দু-চার প্রজন্মের মধ্যে বাঙালিরাও উর্দু শিখে নিতে বাধ্য হবে। বাংলা ভুলে গিয়ে তখন উর্দুই তাদের মাতৃভাষায় পরিণত হবে! একদিকে অর্থনৈতিক শোষণ-আধিপত্বের খড়গ ও অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রতিক্রিয়াশীলতা,– বাঙালির ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, জাতীয় আত্মপরিচয় ও অস্তিত্ব, জাতীয় অর্থনীতি, জীবনযাত্রার উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক স্বার্থ– সবকিছুর বিরুদ্ধে পাকিস্তানি শাসকরা এই উভয় পথ ধরে মরণ আঘাত হানতে শুরু করেছিল। ভাষা অন্দোলন ছিল এই আঘাতের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের মশাল। একুশে ছিল সেই প্রতিরোধ সংগ্রামের দূর্জয় বিস্ফোরণের এক মহান দিন। একুশ কি তবে কেবল ইতিহাসের একাট গৌরবদীপ্ত অধ্যায় মাত্র? তার কি কোনো সমসাময়িক প্রাসঙ্গিকতা নেই? আছে, এখন আরো বেশি করে আছে! কারণ, বাঙালির ‘জাতীয় মুক্তি’ অর্জনের কাজ আজও পূর্ণ হয়নি। সাম্রাজ্যবাদ-আধিপত্যবাদ আমাদের উপর আরো শক্ত করে চেপে বসেছে। অর্থনৈতিক শোষণের নিগড়ে দেশ ও জাতিকে বেঁধে ফেলা হয়েছে। সেই সূত্রে বাঙালির ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতি ইত্যাদির উপরেও চলছে আগ্রাসন-আঘাত-হামলা। ‘একুশের’ প্রাসঙ্গিকতা আজও তাই শেষ হয়নি। তা আজও জীবন্ত। এবং তা শুধুমাত্র আমাদের দেশে নয়। বিশ্বজনীনভাবে তার প্রাসঙ্গিকতা বরঞ্চ এখন একদিক থেকে বিবেচনা করলে আরো বেড়েছে। সব ধরণের শোষণ-আধিপত্যহীন ‘মুক্ত মানুষের মুক্ত বিশ্ব’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যের মাঝে একুশের মর্মবাণী আজও উৎকীর্ণ রয়েছে। তাই বলতে হয়–‘একুশে’ শুধু অমরই নয়, তা প্রবিষ্ট রয়েছে বিশ্বজনীন আন্দোলনের মাঝেও।

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..