সহপাঠী রণজিত নিয়োগী

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email
আনোয়ার হোসেন : ব্রিটিশবিরোধী ও মানবমুক্তি আন্দোলনের যে মহামানব বিপ্লবের পথে নিজেকে আপসহীনভাবে নিয়োজিত রেখেছিলেন, ব্রিটিশের নির্যাতনে আন্দামানের সেলুলার জেলে চির নির্বাসনে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন, আন্দোলন করে ফিরে এসে পাকিস্তানে, বাংলাদেশের বিভিন্ন কারাগারে কাটিয়েছেন জীবনের ৩৬টি বছর সেই কমরেড রবি নিয়োগী এবং নারীমুক্তি আন্দোলনের জন্য ৮ বছর কারাবরণ করা তাঁর সহধর্মিনী জ্যোৎস্না নিয়োগী’র বড় ছেলে রণজিত নিয়োগী। ঢাকা আর্ট কলেজে আমার সহপাঠী ছিল, আমি গর্বিত, দীপ্তিত। রণজিতকে পেয়েছিলাম বলেই রবি-দা ও জ্যোৎস্না দিকে পেয়েছিলাম। আর সেকারণেই জীবনে সর্ব মানবিক মঙ্গলময় চেতনায় প্রদীপ্ত হয়েছি, হতে পেরেছি বোধহয়।ব্রিটিশের অত্যাচারিত আন্দামান ফেরত সেই কমরেড রবি নিয়োগী যাঁর কথা বড়দার কাছ থেকে অনেক আগে থেকেই শুনেছি সেই বিপ্লবীর সাথে সরাসরি দেখা হবে! এ স্বপ্নাতীত, শরীর শিউরে ওঠে। তিনি তখন গৃহবন্দি। প্রহরীদের ফাঁকি দিয়ে চলে এলেন একদিন, দেখা হলো, পরম শ্রদ্ধায় অভিবাদন জানিয়ে অতি সতর্কে আমি আর রণজিত তাঁকে নিয়ে গেলাম আবেদিন স্যারের কলেজ কক্ষে। রবি-দা বলে ওঠেন, তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। নইলে ঐ প্রহরীদের চাকুরি চলে যেতে পারে। যাওয়ার সময়ে দাদা বলে গেলেন- ‘তোমরা সফল হবে’। সেই থেকে সাহসী হলাম। সেই থেকে অন্যায় অমঙ্গল আমাকে স্পর্শ করতে পারে নি। স্বদেশের মঙ্গল জনগণের মঙ্গল-সুন্দরের জন্য অসুন্দরের বিরুদ্ধে আন্দোলনে জয়ের চেতনা হৃদয়ে লালিত হয়ে আসছে। কলেজ আন্দোলনে আমরা জয়ী হয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের সময় কাকাদের সাথে রণজিত কলকাতা চলে যায়। সেখানে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে নানা সাংস্কৃতিক সংঠনের সাথে চিত্রশিল্পী হিসেবে কাজ করেছে অনেক। হানাদার বাহিনীর জঘন্য অত্যাচার ও গণহত্যার ওপর বাংলাদেশের চিত্রশিল্পীদের আঁকা ছবি নিয়ে একটি চিত্র প্রদর্শনীর উদ্যোগের সাথেও রণজিত সংযুক্ত ছিলো বলেও আমি জেনেছি। ’৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ঐ প্রদর্শনী উদ্ধোধন করেন ভারতের খ্যাতনামা ভাস্কর দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী। উদ্ধোধন হয় বিরলা অ্যাকাডেমীতে। আমি গর্বিত। বন্ধু রণজিতের আঁকা ছবি ছিল ঐ প্রদর্শনীতে। এই প্রদর্শনী ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিলো বিশ্ব বিবেককে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বিশ্বজনমত গড়ে উঠেছিল ঐ প্রদর্শনীর চিত্রমালা দেখে। রণজিত ছিলো প্রচারবিমুখ, তাই ওর কাজের কথা আমরা বন্ধুরা অনেকে জানি না। কিন্তু গল্পে-গল্পে অনেক কাজের কথাই জেনেছি। দেশের জন্য, মানুষের জন্য ভালোবাসায় নিষ্ঠাবান ছিল রণজিত, ওর কবিতায় তার পরিচয় পাওয়া যায়। আধুনিক ছন্দে ওর বেশ কিছু কবিতা রয়েছে। পরিবারের বা প্রকাশক বা বন্ধু-বান্ধব কেউ যদি ওর কবিতার বই প্রকাশ করত তবে বইয়ের অঙ্গন একটি সুন্দর প্রকাশনা উপহার পেতো। এইতো! রণজিত আমার সামনে সুমিষ্ট মৃদু হাসি হাসছে। রণজিতকে আমি ‘রঞ্জু’ বলতাম। ছোট বোন মঞ্জুকে প্রকাশনার কথাটি চেতনায় রাখতে হবে। উদীচীর সম্মেলনে আমি শেরপুর গিয়েছিলাম। থেকে ছিলাম রণজিতদের বাড়িতে। রণজিতের মা জ্যোৎস্না দি তখন লাঠি ভর করে উবু হয়ে হাঁটতেন। তবুও পেয়েছি জ্যোৎস্না দি’র জোৎস্না ¯িœগ্ধ ¯েœহ। খাইয়েছেন, ছোট ছোট কথা বলেছেন। শুনিয়েছেন উদীচীর প্রতিষ্ঠাতা সত্যেন দা’র কথা। তাঁদের বাড়ির বড় পুকুরের দিকে হাত বাড়িয়ে দেখিয়ে বলেছেন ঐ পুকুর পাড় দিয়ে হেঁটে হেঁটে গুনগুনিয়ে গান গাওয়ার কথা। তাঁদের আজ শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি।সম্মেলনের ব্যাকগ্রাউন্ডের জন্য আমি যখন তিন রঙে সত্যেন দা’র প্রতিকৃতি আঁকছিলাম রণজিত তখন পাশে বসে রঙতুলি এগিয়ে দিচ্ছিল। রবিদা এলেন, দেখলেন, প্রশংসা করলেন, উৎফুল্ল মনে চলে গেলেন। সে উৎফুল্লের রেশ রয়ে গেল মনে। আর রণজিত-মাতার ¯িœগ্ধ-¯েœহে স্নাত হয়ে ক্লান্তি ধুয়ে সতেজ হলাম। রণজিত নিয়োগীর এক ছেলে। শুভজিত নিয়োগী। শুভজিতের শুভ হোক। সজীবতার সাথে দীর্ঘজীবী হোক। কলেজে আন্দোলন চালাতে গিয়ে আমি আমাকে প্রধান করে সঙ্গোপনে একটি ‘হার্টকোর’ গঠন করেছিলাম। রণজিত তার সদস্য ছিলো। সদস্য ছিলো প্রয়াত প্রফুল্ল রায়, আনোয়ার জাহান। এখান থেকে সিদ্ধান্ত নিয়েই আন্দোলন চালাতাম। রণজিত স্বপ্রণোদিত ভাবেই আমার প্রতি লক্ষ্য রাখত। আন্দোলনের নানা কাজে ব্যস্ত থাকতাম, রণজিত ক্লাসে আমার রঙ-তুলি-কাগজ-পেন্সিল, ইজেল ক্লাসে আঁকার জন্য যা যা দরকার সুন্দরভাবে গুছিয়ে রাখত। ওকে অভিনন্দন। তা ছাড়াও আমি খেয়েছি কি না, খাব কিনা? সিঙ্গরা ও পানির ব্যবস্থা করে রাখত ক্লাসে। যাতে করে খেতে খেতে ক্লাসে কাজ করতে পারি। এ আন্তরিকতা কোথায় পাবো? আন্দোলনের সফলতা ছিল ওর ¯িœগ্ধ হৃদয়ের কাম্য। আমরা আন্দোলনে রত থাকলেও ক্লাসের কাজে আন্তরিক ছিলাম। থাক সে কথা। রণজিতের কথায় আসা যাক। ও বলে, বাবা বলতেন- ‘দল করি কিন্তু দলবাজি করি না’। এই মহৎ কথা মনের গভীরে দাগ কেটে আছে। রণজিত ক্লাসে মাঝে মাঝে দু-একটি কবিতা শুনাতো। মনে হতো নিষ্পেষিত মানুষের আত্মা নিংড়ানো কষ্টের ধারা। গভীরভাবে শুনতাম। মাঝে মাঝে কলেজের গোল পুকুরের ধারে ঝোপের আড়ালে বসে জ্যোৎস্না দি’র ও রবিদার পুলিশী নির্যাতন ও তা থেকে বাঁচার কৌশল ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা হতো। একবার তাদের আস্তানায় পুলিশ হানা দেয়। রান্না-বান্না, কাপড়-চোপড় ফেলে শুধু পেটিকোট পরা অবস্থায় ছোট বোন, ছোট্ট মঞ্জুকে রঞ্জুর কাছে ফেলে রেখে দেছুট-দেছুট।তাদের আস্তানা স্থলে যে পথে পুলিশের আগমন হতে পারে সে পথে দু’ধারে দু’তিন স্তরে সারি বেঁধে তীর-ধনুক ‘ছিলা’ টেনে বসানো থাকতো, কিছু হলেই এক কোপে ঐ ছিলা কেটে দিলে সব তীর ছুটে যেত ঐ পথে। পুলিশের হামলা ব্যাহত হতো। ঐ ফাঁকে ওঁরা অন্যপথে চলে যেতেন বহুদূর। শেষ টেলিফোন, আমি রণজিত। হাসপাতালে আছি। নিঃশ্বাস ছাড়তে পারছি না। বললাম আমি আসি। না তুমি এসো না। তুমিও তো অসুস্থ। হ্যাঁ, ওষুধ খাচ্ছি! নিশ্বাস টানতে পারছিনা, কষ্ট হচ্ছে।বোধ হয় কিছুক্ষণ পরেই ও চলে গেছে। পরে জেনেছি। ও বোধ হয় বুঝতে পেরেছিল আমি গিয়ে লাভ নেই! দেখা হবে না। ওর কণ্ঠস্বরে আমারও মনের মধ্যে এমনি ধারণা লালিত হচ্ছিল। নীরবে অশ্রুধারা বয়ে গেলো বুক বেয়ে। ওর দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে শুভ্র-সমুজ্জ্বল নয়নের জলে ওকে স্মরণ করি।

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..