কমরেড দ্বিজেশ চক্রবর্তী বাচ্চু

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email

শ্যামল চৌধুরী : মানুষ আসে মানুষ যায়। আসা যাওয়ার ঘূর্ণাবর্তে মানবজীবন আবর্তিত হয়। পৃথিবীতে মানুষ জন্ম নেয়, পৃথিবীতেই মানুষের জীবনপাত হয়। কর্মমুখর পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষকেই কোনো না কোনো কর্মে নিয়োজিত হতে হয়। কারণ কর্মই জীবন। কর্মহীন জীবন, জীবন নয়। কর্মময় দুনিয়ায় মানুষ কর্মের অধীন। প্রকৃত কর্মই একজন মানুষকে প্রকৃত মানুষে পরিণত করে। পৃথিবীতে এমন সব ক্ষণজন্মা মানুষের আবির্ভাব ঘটে, যাদের স্বপ্নই হয়ে ওঠে মানুষ আর মানুষের কল্যাণে। পরহিতে এসব মানুষ জীবন উৎসর্গ করতেও কুণ্ঠাবোধ করেন না। আপন সুখ-শান্তি বিসর্জন দিয়ে মানব কল্যাণের চিন্তায় সদ্য চিন্তিত থাকেন। নিজ ভোগ বিলাস চরিতার্থ নয়, অন্যের সুখ তথা মানবতার মুক্তির জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেন। সুস্থ-সুন্দর আলোকিত সমাজের জন্য কাজ করে যান এসব মানুষ। মানুষ আর মানুষের মঙ্গল চিন্তাই তাদের জীবনে ব্রত করে নেন। তাঁদের মননে চলনে শুধুই শোষিত বঞ্চিত মানুষের কথা স্থান পায়। জীবনসংগ্রামে তাঁরা থাকেন অবিচল অনড়। কোনো লোভ লালসা তাদের আদর্শ থেকে বিচ্যুত করতে পারে না। এসব মানুষের কাছে নিজ স্বার্থ নয়। ভুখা-নাঙ্গা-শোষিত-বঞ্চিতদের স্বার্থই বড় বলে বিবেচিত হয়। এমন সব মানুষের ভীড়ে একটি নাম কমরেড দ্বিজেশ চক্রবর্তী বাচ্চু, আমাদের সকলের বাচ্চু দা। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) নেত্রকোনা জেলার সাবেক সদস্য ও মোহনগঞ্জ উপজেলা কমিটির সাবেক সভাপতি, প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতা, একনিষ্ঠ সমাজসেবক, উদীচী-ময়মনসিংহ জেলা সংসদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, চিরকুমার কমরেড দ্বিজেশ চক্রবর্তী বাচ্চু ২০১০ সালের ৩ ডিসেম্বর পৌর শহরে মিরারগাতী (দেওয়ান) নিজ বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন। স্কুলজীবন থেকেই তিনি মার্কসবাদী দর্শনে দীক্ষিত হন এবং বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সম্ভবত ১৯৮৬ সনে সিপিবি’র সদস্যপদ লাভ করেন। পিতা মৃত দীনেশ চক্রবর্তী ও মাতা হেম প্রভা চক্রবর্তী পাঁচ ছেলের মধ্যে জ্যৈষ্ঠ সন্তান কমরেড দ্বিজেশ। শোষিত বঞ্চিত নিপীড়িত মানুষের মুক্তির জন্য তিনি আজীবন লড়াই করে গেছেন। কোনো লোভ-লালসা-মোহ তাঁকে তার আদর্শ থেকে এক চুল নাড়াতে পারেনি। খুব কাছে থেকে দেখেছি তাঁর কর্মগাঁথা, শুনেছি আদর্শমালা। জীবনে তাঁর কোনো চাওয়া পাওয়া ছিল না। সমাজতান্ত্রিক আদর্শে দীক্ষিত ছিলেন তিনি। স্বপ্ন দেখেছিলেন একটি শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার। তাই তিনি ক্ষেতমজুর আন্দোলন থেকে শুরু করে হাওরবাসীর দুঃখ যন্ত্রণা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতেন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ ক্ষেতমজুর সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যতম সদস্য। ‘জাল যার জলা তার’ ও ভাসান পানিতে মাছ ধরার আন্দোলনকে নেতৃত্ব দেন। গরিব-দুঃখী-মেহনতী মানুষের কাছের মানুষ কমরেড দ্বিজেশ চক্রবর্তী গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে চষে বেড়িয়েছেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি সিপিবি মোহনগঞ্জ উপজেলার দায়িত্ব পালন করে গেছেন। কঠিন শ্বাসকষ্ট রোগও তাঁকে তার কর্তব্যনিষ্ঠা থেকে দমাতে পারেনি। মিটিং-মিছিল জমায়েত করে মানুষকে শিখিয়ে গেছেন মুক্তির মূলমন্ত্র। জনমেও মানবতা মরণেও দেখিয়ে গেলেন মানবতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। জীবদ্দশায় তিনি তাঁর মরদেহ ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ছাত্র-ছাত্রীদের গবেষণা কাজে দান করে যান। স্থাপন করে গেলেন, আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেলেন আদর্শ ও মানবতার অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। স্বামী বিবেকানন্দের কথায়, ‘এসেছিস যখন, একটি দাগ রেখে যা’। কমরেড দ্বিজেশ চক্রবর্তী মানবতা ও আদর্শের একজন অকুতোভয় সৈনিক। ভোগে নয়, ত্যাগেই সুখ– এর উজ্জ্বল স্বাক্ষর হয়ে রইলেন কমরেড দ্বিজেশ। জীবনপথের বাঁকে বাঁকে অর্জন করে গেছেন বিচিত্র অভিজ্ঞতা। আজীবন লালন করে গেছেন মানুষের মুক্তির কথা। জীবনেও দিলেন, মরণেও দিলেন। সবটুকুই দিয়ে দিলেন মানবতার উদ্দেশ্যে। দ্বিজেশ চক্রবর্তীরা শুধু দিতেই জানে নিতে চায় না। মহাকালের অতলে হারিয়ে গেলেন গণমানুষের নেতা কমরেড দ্বিজেশ চক্রবর্তী, কিন্তু তাঁর আদর্শ চিন্তা কর্ম বেঁচে থাকবে অনন্তকাল। তাঁর স্বপ্নের সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবেই। অকৃত্রিম শ্রদ্ধাঞ্জলি কমরেড তোমায়। কমরেড দ্বিজেশ চক্রবর্তী লাল সালাম, লাল সালাম।

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..