‘জেরুজালেম ইসরাইলের রাজধানী’, স্বীকৃতি যুক্তরাষ্ট্রের

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email
একতা বিদেশ ডেস্ক : ইসরাইলের চাওয়া মেনে জেরুজালেম শহরকে দেশটির রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিল যুক্তরাষ্ট্র। ৫ ডিসেম্বর দেওয়া এক ঘোষণায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তেল আবিব থেকে জেরুজালেমে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস সরিয়ে নেওয়ারও নির্দেশ দেন। জাতিসংঘ, আরব দেশ ও মার্কিন মিত্রদের আপত্তি না মেনে যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা এ সিদ্ধান্তের প্রভাবে তাৎক্ষণিকভাবে ইসরাইল ফিলিস্তিন সংঘর্ষ শুরু হয়। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত সংঘর্ষে শতাধিক ফিলিস্তিনির আহত হওয়ার খবর দিয়েছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম। ইসরাইলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, ট্রাম্পের ঘোষণার পর ফিলিস্তিনের দিক থেকে দুটো রকেট তাদের সেনাবাহিনীর দিকে ছোড়া হয়েছে। সীমান্তে ফিলিস্তিনিদের ছোড়া পাথরের প্রতিদান টিয়ারশেল ও রাবার বুলেটে দিচ্ছে তেল আবিব। কোনো কোনো সময় তাজা গুলিবর্ষণও করা হচ্ছে। ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের কট্টর দক্ষিণপন্থি ইহুদি নেতারা শুরু থেকেই জেরুজালেমকে নিজেদের একচ্ছত্র রাজধানীর স্বীকৃতির দাবি করে আসছিল। ট্রাম্প তার নির্বাচনী প্রচারণায় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, নির্বাচিত হলে এই দাবি তিনি মেনে নেবেন। আপাতভাবে ট্রাম্প নিজের সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছেন, কিন্তু এই এক ঘটনার মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির প্রশ্নে নিরপেক্ষ মধ্যস্থতাকারী হিসেবে নিজের ভূমিকা তিনি নিজেই বাতিল করে দিলেন। ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস বলেছেন, ট্রাম্পের ঘোষণার ফলে শান্তিপ্রক্রিয়া ভেস্তে যাওয়ার ব্যবস্থা পাকাপাকি হলো। যুক্তরাষ্ট্র শান্তিপ্রক্রিয়ার নিরপেক্ষ মধ্যস্থতাকারী হিসেবে নিজেকে আর দাবি করতে পারে না বলেও মন্তব্য তার। অন্যদিকে ট্রাম্পকে সাহসী নেতা অ্যাখ্যা দিয়েছেন ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনজামিন নেতানিয়াহু। এর আগে হোয়াইট হাউজ থেকে দেওয়া ভাষণে ট্রাম্প সাফ জানিয়ে দেন, এখন থেকে যুক্তরাষ্ট্র জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে। এমন উদ্যোগকে মধ্যপ্রাচ্য শান্তিপ্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে ‘দীর্ঘদিন ধরে আটকে থাকা পদক্ষেপ’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি। ভাষণে ট্রাম্প আরও বলেন, ‘ইসরাইল ও ফিলিস্তিন উভয়ে মানলে’ দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানকে সমর্থন জানাবে যুক্তরাষ্ট্র। এ স্বীকৃতির নিন্দা জানিয়েছে জাতিসংঘ। মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ট্রাম্পের ঘোষণার সমালোচনা করেছেন। তিনি এই বলে সতর্ক করেছেন যে জেরুজালেমের কী হবে, তা কেবল ইসরাইল-ফিলিস্তিন আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান করতে হবে। তিনি বলেন, ‘জাতিসংঘের মহাসচিব হিসেবে আমি এখন থেকেই এ সিদ্ধান্তের বিপক্ষে আমার অবস্থানের কথা জানিয়ে যাব।’ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে বলেছেন, যুক্তরাজ্য সরকার মার্কিন প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করছে না। এটি মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি আলোচনার জন্যও সহায়ক নয়। ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ফ্রান্স; দেশটির প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রো বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের এ সিদ্ধান্তকে মানবে না ফ্রান্স। জার্মানির চ্যান্সেলর আঙ্গেলা মার্কেলের মুখপাত্র জানিয়েছেন, দশকের পর দশক ধরে ফিলিস্তিন-ইসরাইল বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি ভঙ্গ করে ট্রাম্প যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা সমর্থনযোগ্য নয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রধান কূটনীতিক ফিদেরিকা মোগেরিনি ট্রাম্পের জেরুজালেম ঘোষণায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এক কাতারে এসে দাঁড়িয়েছে সৌদি আরব, ইরান, সিরিয়া, লেবানন ও জর্ডান। সৌদি আরবের রাজকীয় আদালত এক বিবৃতিতে বলেছে, এটি ‘অযৌক্তিক ও দায়িত্বজ্ঞানহীন’। এমন সিদ্ধান্ত ফিলিস্তিনিদের ঐতিহাসিক ও মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি। ইরান ট্রাম্পের সমালোচনা করে বলেছে, এ সিদ্ধান্ত ইসরাইলের বিরুদ্ধে নতুন ইন্তিফাদা বা গণ-অভ্যুত্থানের সূচনা করতে পারে। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিজস্ব ওয়েবসাইটে বিবৃতি দিয়ে বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত মুসলমানদের নতুন ইন্তিফাদা, উগ্রবাদ, ক্ষুব্ধ ও সহিংস কর্মকাণ্ডের দিকে উস্কে দেবে। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের কার্যালয় থেকে ট্রাম্পের জেরুজালেম সিদ্ধান্তের নিন্দা জানানো হয়েছে। এক বিবৃতিতে তার কার্যালয় জানিয়েছে, ‘জেরুজালেমের ভবিষ্যৎ কোনো রাষ্ট্র বা প্রেসিডেন্টের দ্বারা নির্ধারিত হতে পারে না।’ লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরি স্বাধীন ফিলিস্তিন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ফিলিস্তিনিদের চাওয়া ও অধিকারের ব্যাপারে সর্বোচ্চ একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। একই সঙ্গে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, আরব বিশ্ব কখনোই ট্রাম্পের এমন সিদ্ধান্ত মেনে নেবে না। আর জর্ডান সরকারের মুখপাত্র মোহামেদ মোমানি এ ব্যাপারে রাষ্ট্রের অবস্থানের কথা জানিয়ে বলেন, ট্রাম্প জেরুজালেম ঘোষণার মাধ্যমে জাতিসংঘ সনদ ও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেছেন। কঠোর সমালোচনা করেছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। ট্রাম্পের ঘোষণা মধ্যপ্রাচ্যকে আগুনের মধ্যে ঠেলে দেবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। ‘হে ট্রাম্প, আপনি কী করতে চান? এটা কী ধরনের আচরণ। রাজনৈতিক নেতারা শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চান, তারা কোনো বিষয়কে অচল করেন না,’ বলেন ন্যাটো সদস্য তুরস্কের প্রেসিডেন্ট। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মিছিলের ডাক দিয়েছেন। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র গেং সুয়াং এক সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে দেবে বলে মন্তব্য করেছেন। মধ্যপ্রাচ্যের শান্তিপ্রক্রিয়া-বিষয়ক জাতিসংঘের দূত নিকোলে ম্লাদেনোভ সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, এ বিষয়টির সুরাহা করতে হবে ফিলিস্তিন ও ইসরাইলের মধ্যে সরাসরি আলোচনার মাধ্যমে। যুক্তরাজ্যের স্কাই নিউজ জানিয়েছে, ট্রাম্পের পরিকল্পনার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন পোপ ফ্রান্সিস। ‘সম্প্রতি যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে, তাতে আমি উদ্বেগ লুকিয়ে রাখতে পারছি না। জাতিসংঘের প্রস্তাবের আলোকে শহরটির (জেরুজালেম) বিদ্যমান অবস্থার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে সব পক্ষকে আহ্বান জানাচ্ছি,’ পোপ বলেন। স্বাভাবিকভাবেই এমন সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ ফিলিস্তিনের সরকার ও জনগণ। ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস এক ভাষণে বলেছেন, দুঃখজনক ও অগ্রহণযোগ্য এই সিদ্ধান্ত শান্তি আলোচনার সব ধরনের উদ্যোগ ভেস্তে দিয়েছে। ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থার (পিএলও) প্রধান সায়েব ইরেকাত বলেছেন, ট্রাম্প ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংকটের ‘পৃথক দুই রাষ্ট্র’ সমাধানের শেষ আশাটুকুও নষ্ট করে দিয়েছেন। হামাসের শীর্ষস্থানীয় নেতা ইসমাইল রেদোয়ান সাংবাদিকদের বলেন, এর মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিতে ‘নরকের দরজা’ খুলে গেল। ট্রাম্পের ঘোষণার পর গাজা ও অধিকৃত পশ্চিম তীরে ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়েছে। পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিরা রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ-ধর্মঘট করেছে। তাদের ঠেকাতে শত শত অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন করেছে ইসরাইল। বিক্ষোভকারীরা গাড়ির টায়ার জ্বালিয়ে দিচ্ছে ও ইসরাইলি সেনাদের দিকে পাথর ছুড়ে মারছে। জেরুজালেমসহ বেথলেহেম, রামাল্লাহ ও অন্যান্য শহরগুলোতেও বিক্ষোভ-সংঘর্ষ হয়েছে। নতুন নতুন এলাকায় আরও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ হচ্ছে। এই মাসেই যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সের ফিলিস্তিন সফর করার কথা; নতুন এই উত্তেজনায় ওই সফর হবে কি না, তা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘের যে প্রস্তাবের ভিত্তিতে ঐতিহাসিক ফিলিস্তিন ভেঙে একদিকে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল, অন্যদিকে আরব ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। ওই ঘোষণায় জেরুজালেমের জন্য স্বতন্ত্র আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধের পর ইসরাইল পূর্ব ও পশ্চিম জেরুজালেম দখল করে নেয় এবং এককভাবে তা নিজ দেশের অন্তর্ভুক্তির ঘোষণা দেয়। সেই অন্তর্ভুক্তি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কখনো মেনে নেয়নি। ১৯৯৫ সালে ইসরাইল ও পিএলও স্বাক্ষরিত অসলো শান্তিচুক্তিতে উভয় পক্ষ মেনে নেয় যে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে জেরুজালেমের প্রশ্নটি নির্ধারিত হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ২০০০ সালে হোয়াইট হাউসের লনে ইসরাইলি নেতা র্যাবিন ও ফিলিস্তিন নেতা আরাফাত যে শান্তি কাঠামো স্বাক্ষর করেন, তাতেও এই প্রশ্নে উভয় পক্ষের সম্মতি ছিল। ট্রাম্পের এই ঘটনার পর শান্তিচুক্তির ক্ষীণ শেষ সম্ভাবনাও নষ্ট হল বলে পর্যবেক্ষকরা বলছেন।

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..