বিপ্লবী চারুশীলা দেবী

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email
শেখ রফিক: ১৯০৮ সালের ১৮ এপ্রিল ক্ষুদিরাম বসু মেদিনীপুর শহরের উপকণ্ঠের বাড়ি থেকে শেষ বিদায় নিলেন। এই বাড়িতে অন্যান্যদের সাথে চারুশীলা দেবীও ছিলেন। চারুশীলা দেবীকে ক্ষুদিরাম নিজের বোনের মত জানতেন। তাঁর সাথে ক্ষুদিরামের নানা বিষয়ে কথা ও আলোচনা হত। দেশের মানুষের উপর ইংরেজদের অত্যাচার-জুলুমের কথা ক্ষুদিরাম প্রায়ই দিদিকে বলতেন। দিদিও ক্ষুদিরামকে আদর ¯েœহের সুরে বলতেন আমিও তোদের বিপ্লবী দলে যুক্ত হব এবং ভারত থেকে ইংরেজদের বিতাড়িত করব। দিদির কথা শুনে ক্ষুদিরাম হাসলেন, সত্যিই কি তুমি যুক্ত হবে? দিদি, বলল হ্যাঁ। সেইদিন ক্ষুদিরাম তাঁর দিদি চারুশীলা দেবীকে রক্ততিলক পরিয়ে স্বদেশমন্ত্রে দীক্ষিত করেন। কিংসফোর্ডকে হত্যা করতে যাবার আগে তাঁরই বাড়িতে ক্ষুদিরাম আত্মগোপন করেছিলেন। ক্ষুদিরামের ফাঁসিতে চারুশীলা দেবী প্রচণ্ড মর্মাহত হন। তখন থেকেই মূলত তিনি মনে প্রাণে ও চেতনায় বিপ্লবী হয়ে উঠতে শুরু করেন। কিন্তু কোনো সশস্ত্র বিপ্লবী দলের সংস্পর্শে আসতে পারেন নি তিনি। কারণ তখনও বিপ্লবী দলে নারীদের আনাগোনা ছিল না। তাই চারুশীলা দেবী মনে প্রাণে ইংরেজদের প্রতি তীব্র ঘৃণা প্রদর্শনের জন্য গ্রামের মানুষকে সচেতন করে তুলতেন। তাদেরকে জানাতেন ইংরেজদের শোষণ নিপীড়নের কাহিনী। চারুশীলা দেবীর জন্ম ১৮৮৩ সালে, মেদিনীপুরে। তার বাবার নাম রাখালচন্দ্র অধিকারী। তার স্বামী বীরেন্দ্রকুমার গোস্বামী। চারুশীলা দেবীর বয়স যখন ১২ বছর তখন তার বিবাহ হয়। অল্প বয়সে বিধবা হন তিনি। ১৯০৮-১৯২০ সাল পর্যন্ত তাঁর বিপ্লবী দলের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ততা না থাকলেও একসময় পরোক্ষভাবে তাদের সাথে যোগাযোগ শুরু হয়। জীবনের অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়ে ১৯২১ সালে তিনি মেদিনীপুরে মহিলা সমিতি গঠন করেন। ১৯২২ সালে তিনি কলিকাতায় ট্রেনিং স্কুলে পড়াশুনা করে স্বগ্রামে রাজনৈতিক ও সামাজিক গঠনমূলক কাজে যুক্ত হন। ১৯৩০ সালে চারুশীলা দেবী লবণ আইন অমান্য আন্দোলনে দুঃসাহসী ভূমিকা পালন করেন। তিনি এই আন্দোলনে জনসাধারণকে যোগদানের আহ্বান জানিয়ে নানা জায়গায় সভা-সমিতি করতে থাকেন। একটি সভায় বক্তৃতা প্রদানকালে পুলিশ লাঠি চার্জ করে। তিনি আন্দোলনকারীদের নিয়ে পুলিশি লাঠি চার্জ প্রতিহত করেন। ফলে তাঁর নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়। তারপর তিনি খড়গপুরে আত্মগোপন করেন। আত্মগোপন অবস্থায় শ্রমিক ইউনিয়নের এক সভা আহ্বান করেন সত্যাগ্রহীদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে। সেই সময় তিনি মেদিনীপুরে একটি শোভাযাত্রা পরিচালনা করেন। যে কারণে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁর ৬ মাসের কারাদণ্ড হয়। কারণ ওই শোভাযাত্রা করার কোনো আইনি অনুমতি ছিল না। শুরু হলো জেল জীবন। জেলখানায় রাজবন্দীসহ সাধারণ বন্দীদের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার মত কোনো পরিবেশ ছিল না। তিনি এ বিষয়গুলো নিয়ে জেল কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলেন। তাঁর কথায় কর্তৃপক্ষ কোনো সাড়া দেয়নি। ওই সময়ে জেলে বিধবাদের হস্তে রান্না করার অধিকার ছিল না। এই অধিকার আদায়ের জন্য তিনি অনশন শুরু করেন। অনশনের এক পর্যায়ে ব্রিটিশ সরকার তাঁর দাবি মানতে বাধ্য হয়। মুক্তি পেয়ে আবার ১৯৩২ আইন অমান্য আন্দোলনের কারণে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। এই সময়ে তার দেড় বছর কারাদণ্ড হয়। ১৯৩৩ সালে মেদিনীপুরের ম্যাজিস্ট্রেট বার্জ হত্যার পর ব্রিটিশ সরকার চারুশীলা দেবীকে আট বছরের জন্য মেদিনীপুর জেলায় বসবাসের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। কারণ ব্রিটিশ সরকার এই হত্যাকাণ্ডের সাথে তার সম্পৃক্ততা আছে বলে ধারণা করছিলেন। এরপর তিনি বাধ্য হয়ে পুরী চলে যান। বহিষ্কারের আদেশ প্রত্যাহৃত হলে তিনি ১৯৩৮ সালে কলকাতায় এসে পৌর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষিকা হন। কিছু দিন পর তিনি নিখোঁজ হয়ে যান। তাঁর পরবর্তী জীবন সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি। – সম্পাদক, বিপ্লবীদের কথা তথ্যসূত্র: ১। বিপ্লবী চরিতাভিধান, ডা. ননীগোপাল দেবদাস। ২। সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, সম্পাদনা: সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু। ৩। ক্ষুদিরামের জবানবন্দি, সম্পাদনা: শেখ রফিক।

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..