সাধারণের জীবন যন্ত্রণা

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email
রফিকুজ্জামান লায়েক চালের দামসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্যবৃদ্ধির কারণে মানুষের জীবনে আজ ত্রাহি অবস্থা। তার উপর আবার এবারের বিজয়ের মাস থেকে বিদ্যুতের অযৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধি করে মরার ওপরে খাড়ার ঘা দেয়া হচ্ছে। বিশ্লেষক ও বিশেষজ্ঞগণ হিসেব করে দিয়েছেন এবং গ্রহণযোগ্য যুক্তি দিয়ে বলেছেন, আমাদের দেশে এখন বিদ্যুতের দাম কমানো সম্ভব। কিন্তু সরকার সে কথা না শুনে ক্ষমতাশ্রয়ী আমলা ও বিদেশি প্রভুদের খুশি করার জন্য বিদ্যুতের দাম বাড়াল। এর ফলে সাধারণ মানুষ যে শুধু বাসাবাড়ি ও ছোট ছোট দোকান প্রতিষ্ঠানের জন্য বেশি বিল দেবে তা নয়, বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির কারণে নিত্য ব্যবহার্য জিনিসের দামও আরেক দফা বেড়ে যাবে। কেননা দৈনন্দিন জীবনে আমরা যা বাজার থেকে ক্রয় করে ব্যবহার করি তার অধিকাংশই তৈরি করতে জ্বালানি হিসেবে বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হয়। এ ধরনের জনবিরোধী সিদ্ধান্ত সমাজ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে। শিল্প-কৃষি, শিক্ষা-স্বাস্থ্যসহ সাধারণের জন্য যা সহজলভ্য করার কথা ছিল, তা আজ তার নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। কারণ কী? কারণ হল রাষ্ট্রের কর্তাদের ইচ্ছার অভাব। তার কারণ জবাবদিহিতার অভাব। তার কারণ গণতান্ত্রিক চর্চার মাধ্যমে নির্বাচিত সরকার না থাকার অভাব। এই অবস্থায় কার লাভ, কার ক্ষতি? ক্ষতি যাদের হচ্ছে তারা আমরা চিহ্নিত। কিন্তু যারা নানাভাবে লাভবান হচ্ছে তারা তো চিহ্নিত নয়। তবে তারাও এখন চিহ্নিত হচ্ছে। ক্ষমতার ব্যবহার করে নানা ধরনের ষড়যন্ত্র করে এই শ্রেণি আজ সমাজের সবকিছু গ্রাস করছে। আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে শত-শত বছর ধরে এ ভূখণ্ডের সাধারণের যা অর্জন, তা ওরা ধ্বংস করছে। কিন্তু কারা ওরা? ওরা হল- অসৎ ব্যবসায়ী, কালো টাকার মালিক, ক্ষমতাশ্রয়ী সামরিক-বেসামরিক আমলা, খারাপ রাজনীতিবিদ ও লুটপাটকারী শ্রেণিসহ অন্যরা। এরা কিন্তু সাধারণের তুলনায় সংখ্যায় খুবই নগন্য। সংখ্যাগরিষ্ট এই সাধারণ আসলে কারা– যারা কল-কারখানায় ও ক্ষেতে-খামারে উৎপাদন করে, গতর খাটিয়ে শ্রম দেয়, হাত ব্যবহার করে সমাজের চাকা সামনের দিকে ঘুরাতে থাকে- শুধু হাত কেন বলছি, তাদের শরীরের সবটুকু দিয়ে দেয় সমাজের জন্য। পায় শুধু কোনমতে বেঁচে থাকার মত সামান্য কিছু। সাধারণের মধ্যে আরও আছেন যারা নানা ধরনের কায়িক শ্রম বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন এবং বুদ্ধিবৃত্তিক পেশার সাথে সংশ্লিষ্ট। বর্তমান সমাজের নানা কারসাজি ও ষড়যন্ত্রের কারণে সাধারণ মানুষ আজ জীবন যন্ত্রণায় ভুগছেন। সাধারণ মানুষ যা করছেন ফল পাচ্ছেন তার উল্টোটা, যা ভাবছেন দেখছেন তার বিপরীতটা। সবখানেই তার জন্য অসংগতির ডালি সাজানো। আয়ের সাথে ব্যয়ের কোনও সংগতি করতে পারছেন না। এমনকি শ্রম বিক্রি করার মত উপযুক্ত ক্ষেত্র ও পরিবেশ ক্রমান্বয়ে তার জন্য দূরহ ও সঙ্কুচিত হয়ে উঠছে। কৃষক, শ্রমিক, ক্ষেতমজুরসহ নানা ধরনের পেশায় নিয়োজিত শ্রমজীবী মানুষ ও প্রান্তিক মধ্যবিত্ত আজ সার্বিকভাবে দিশেহারা। কৃষক যা উৎপাদন করছে, তার লাভজনক দাম থেকে সে বঞ্চিত। ক্ষেতমজুরদের সারা সময়ের জন্য কাজ নেই। শ্রমিক শ্রেণিসহ শ্রমজীবী মানুষ নানাভাবে নির্যাতিত ও নিপীড়িত। কোথায় নেই সাধারণের জীবন যন্ত্রণা। ঘরে-বাইরে শুধু যন্ত্রণা আর যন্ত্রণা। এই সাধারণের ঘরের সমস্যা ধীরে ধীরে প্রকট হচ্ছে। সন্তানের লেখাপড়ার ব্যয়ভার বহন করা তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। উন্নত বা ভাল চিকিৎসা তার নাগালের বাইরে। ভাল থাকা ও ভাল খাবার কথা তো সাধারণ মানুষ এখন আর কল্পনাও করে না। অথচ এই সমাজেরই একটি ক্ষুদ্র অংশ আজ যারা টাকার পাহাড় গড়ে তুলছে এরাই পালা-পার্বণে সময় কাটাতে কোটি টাকা খরচ করে দেশের বাইরে পাড়ি জমায়। সামান্য ব্যাধিতে তারা বিদেশের নামিদামি হাসপাতালগুলোতে ভীড় জমায়। বিত্ত ভৈবব, আরাম-আয়েম, দামি সবকিছু যেন তাদের জন্যই বরাদ্দ। ব্যাংকের টাকা মেরে দেয়া, রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে নানা ধরনের প্রজেক্ট করে পুরোটা আত্মসাত করা, ঘুষ-বাণিজ্য, মৌলিক অধিকার শিক্ষা ও স্বাস্থ্য নিয়ে বাণিজ্য করাসহ কোথায় নেই দুর্নীতি। ফলে আজ সমাজ জীবনের সর্বক্ষেত্রে পচন ধরেছে। যেনতেনভাবে টাকা কামাই করতে হবে–তাতে কার কী ক্ষতি হল– তা ভাববার কোন অবকাশ লুটপাটকারীদের নেই। ধান্দাবাজরা খুবই বেপরোয়া, তারা কোন কিছুর তোয়াক্কা করে না। আর এসব সম্ভব হচ্ছে কিন্তু রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের কারণে। কথা ছিল সকল অশুভের বিরুদ্ধে লড়াই করবে রাজনৈতিক শক্তি। অথচ হচ্ছে তার উল্টোটা। নেতা যখন রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে পাহাড়সম সম্পদের মালিক হচ্ছে, আর যাদের দ্বারা তারা তা করছে, তারাও আর বসে থাকে না। ফলে ভাগাভাগির এক অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে গোটা সমাজ জীবন। লুটপাট, ভাগাভাগি ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের যাতাকলের যন্ত্রণায় ভুগছে সাধারণ মানুষ। যন্ত্রণাকাতর সাধারণ মানুষ আজ যাবে কোথায়? আর করবেই বা কী? নানা পদের কালো টাকার মালিকরা দেশের টাকা বিদেশে পাঠিয়ে শান্তিতে থাকছে। তারা কানাডায় বেগম পাহাড় বানিয়েছে আর মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে সেকেন্ড হোম তৈরি করেছে। ওরা এই টাকা পেল কোথায়, কার সর্বনাশ করে এই টাকার পাহাড় তৈরি হয়েছে? সবক্ষেত্রে এই টাকার উৎস প্রকাশ্য নয়। ধাপ্পাবাজি, কালোবাজারি, ব্যাংক লুট, প্রজেক্ট চুরিসহ বহুবিধ উৎস থেকে এই টাকা এসেছে। অন্যদিকে এর ফলে জীবন যন্ত্রণা বেড়ে চলেছে সাধারণের। সাধারণের যন্ত্রণা শুধুই অর্থনৈতিক নয়। মানসিকভাবেও সে যন্ত্রনাকাতর। এই সাধারণ মানুষ দুইবার দেশ স্বাধীন হওয়া দেখে, দুইবার গণঅভ্যুত্থান প্রত্যক্ষ করে এবং ভাষার জন্য সংগ্রাম করে মাতৃভাষাকে রক্ষা করেছে। ব্রিটিশের নাগপাশ থেকে বের হয়ে স্বাধীন হতে চেয়েছিল, হয়েও ছিল। রাওয়ালপিন্ডি আর ইসলামাবাদের মুসলমান, বাংলার মুসলমানের সাথে এক হতে পারেনি। অর্থ, ভাষা, সংস্কৃতি ও রাজনীতিসহ জীবনের সকল ক্ষেত্রে বৈষ্যমের শিক্ষার হতে হয়েছিল বাংলার সাধারণ মানুষকে। ফলে যা সে চেয়েছিল ও ভেবেছিল তা না পেয়ে সাধারণের জীবন যন্ত্রণা বেড়েছিল। যন্ত্রণা কমাতে ২৩ বছর যাবৎ ধারাবাহিকভাবে পাকিদের রিরুদ্ধে লড়েছে সাধারণরাই। শেষ পর্যন্ত জীবনযন্ত্রণা মুছে ফেলতে তাকে চিরতরে বিদায় করতে জীবন বাজি রেখে অস্ত্র হাতে নিয়েছিলেন যারা, তাদের বেশিরভাগই শ্রেণিগতভাবে ছিলেন সাধারণ ঘরের। ৩০ লক্ষ তো চিরতরে জীবনযন্ত্রণা থেকে মুক্ত হয়ে শহীদ হয়েছেন। গরিব আর ধনী উভয় বাঙালি এক হয়ে পড়েছিল পাক দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে। ’৭১-এর সেই সাধারণদের আকাক্সক্ষা ৪৬ বছরেও পূরণ হয়নি। কারণ যুদ্ধের সময়ে এক হলেও স্বার্থ তো আর এক ছিল না। ফলে ধনী-গরিব বাঙালি এখন আর এক নয়। কেউ প্রাচুর্যে ভরপুর আর কেউ যন্ত্রণায় কাতর। গত ৭০ বছরে ঘটে যাওয়া ঐসব ঐতিহাসিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন এবং ঐতিহাসিক কালপর্বে যে সাধারণ বিবেকবান যুদ্ধে এবং অন্যান্য লড়াইয়ে অংশ নিয়েছিলেন তাদের মন আজ যন্ত্রণায় ভরে গেছে। ফলে অর্থকে কেন্দ্র করে বৈষয়িক যন্ত্রণার চাইতে মানসিক যন্ত্রণাও কম নয়। এ যন্ত্রণা সমাজ বিকাশে বুদ্ধিবৃত্তিক-সৃজনশীল ভূমিকা যারা রাখতে চান তাদেরও। সমাজের ভেতরে মানুষে-মানুষে অর্থের বৈষম্য যত বাড়ছে, অর্থাৎ ধনী আর সাধারণের জীবনমানের ফারাক যত দীর্ঘ হচ্ছে, ততই সমাজে সাম্প্রদায়িকতা বাড়ছে। কেননা সুযোগসন্ধানী সাম্প্রদায়িক শক্তি সাধারণ মানুষের এই জীবনযন্ত্রণাকে কাজে লাগাতে তৎপর রয়েছে। কিন্তু এই যন্ত্রণা কী মানুষের প্রাপ্য ছিল? এ কি মানুষের ভাবনার মধ্যে ছিল? না। তাহলে এমন হল কেন? এমন হওয়ার মধ্যে রাজনীতি আছে, আছে ষড়যন্ত্র। দেশের ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক শক্তিসমূহ দীর্ঘ সময় ধরে সাধারণের কথা আর ভাবছে না। ক্ষমতা দখল কর, জনগণের সম্পদ ও সম্পত্তি ভাগ কর আর দখল কর। ক্ষমতার পরিবর্তন হলেও এই সাধারণ নিয়মের কোন পরিবর্তন হচ্ছে না। শুধু লোক দেখানো কিছু হওয়া ছাড়া। সাধারণের জীবন যন্ত্রণা এক্ষেত্রে আরও বেশি হল যে, তার সামনে দৃশ্যমান রাজনৈতিক শক্তি দু’টি তার স্বার্থের নয়। তাকে খাটিয়ে মারছে, সময়মত মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে ব্যবহার করছে। মানুষ তার জীবন যন্ত্রণার জন্য যারা দায়ী, তাদের চিনেছে, কিন্তু কিছু করতে পারছে না। তাকে ঠকিয়েছে নানাভাবে, বারবার প্রতারণা করেছে তার সাথে। কিছু করতে না পেরে বীরের এই জাতির সাধারণের জীবন যন্ত্রণা আরও বাড়ছে। তবে ইতিহাস শিক্ষা দেয় যে এইভাবে চলাটা চিরস্থায়ী নয়। সাধারণ মানুষ আবার ঘুরে দাঁড়াবে ৫২, ৬৯, ৭১ ও ৯০-এর চেতনায়। কিন্তু সাধারণের সাথে অন্যদের মিলে লড়ার সময় শেষ। এখন লড়তে হবে শুধু সাধারণকে। সেই সাধারণ হল– কৃষক, শ্রমিক, ক্ষেতমজুর, নির্যাতিত নারী, ছাত্র ও নানান পেশার শ্রমজীবী খেটে খাওয়া মানুষ। তবে সাধারণের জীবন যন্ত্রণা ঘুচাবার লড়াইয়ের সাথে আরও একটি কাজ জোরের সাথে করা জরুরি। আর তা হল– ক্ষমতাশ্রয়ী, লুটপাটকারীদের স্বার্থ রক্ষাকারী জোট ও মহাজোটের বাইরে মুক্তিযুদ্ধের ধারা ও চেতনায় বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি সমাবেশ গড়ে তোলা। আর তার লক্ষ্য হবে সমাজতন্ত্র অভিমুখী। লেখক: প্রেসিডিয়াম সদস্য, সিপিবি

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..