স্বয়ম মজুমদার :
গত কয়েক বছর ধরেই সারা বিশ্বে শরণার্থী সংকট এক নতুন মাত্রায় উঠেছে। এ শরণার্থী সংকট আপাত দৃষ্টিতে মূলত সহিংসতা ও যুদ্ধ থেকে জন্ম নিলেও এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। সিরিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় ইসলামিক স্টেটসহ বিভিন্ন কট্টরবাদী সংগঠনের জন্য পশ্চিমামুখী যে শরণার্থী ¯্রােত তৈরি হয়েছিল তা এখন কিছুটা মন্থর হয়ে এসেছে। সে সময় নৌকায় করে সমুদ্র পাড়ির মতো ঘটনা এবং এর অবশ্যম্ভাবি ফল হিসেবে প্রচুর মৃত্যু পৃথিবীবাসী দেখেছে। যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে অভিবাসী অভিধায় শুরু হয়েছে আরেক সংকট। নাম ভিন্ন হলেও সন্দেহ নেই এও আরেক শরণার্থী বাস্তবতারই জন্ম দিচ্ছে। এখন পর্যন্ত এর ভুক্তভোগী যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেশী দেশ কানাডা। আর সর্বশেষ ও সবচেয়ে বড় শরণার্থী সংকটটির মুখে না চাইতেই এসে পড়েছে বাংলাদেশ। এর পেছনেও রয়েছে সহিংসতাই। কিন্তু সহিংসতার মধ্য দিয়ে জন্ম নেওয়া বাস্তবতা আবার বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলকে ঠেলে দিচ্ছে আরেক চরম বিপর্যয়ের দিকে, যা অবধারিতভাবে আরেক শরণার্থী সংকটের জন্ম দিচ্ছে ও দেবে।
গত ২৫ আগস্ট থেকে মিয়ানমারের রাখাইনে শুরু হওয়া রোহিঙ্গা নিধনে এরই মধ্যে উদ্বাস্তু হয়েছে প্রায় ৪ লাখ মানুষ। উদ্বাস্তু এ বিপুল সংখ্যক মানুষ এখন বাংলাদেশের আশ্রয়ে রয়েছে। চলতি জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে সারা বিশ্বের নেতারা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে এ মহানুভবতার জন্য প্রশংসা করেছেন। এ প্রশংসা তার এবং বাংলাদেশের মানুষের অবশ্যই প্রাপ্য। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় বাংলাদেশের শরণার্থী মোকাবিলার সক্ষমতা ও দক্ষতা নিয়ে।
শুরু থেকেই শরণার্থী বিষয়ে যথেষ্ট অদক্ষতার প্রমাণ দিয়েছে বাংলাদেশ। আশ্রিত রোহিঙ্গাদের নিবন্ধন কার্যক্রম শুরু হয়েছে সংকট শুরুর দুই সপ্তাহ পর। ফলে এর মধ্যেই সুযোগ সন্ধানী অনেকেই এর সদ্ব্যাবহার করবে তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। অনেক ক্ষেত্রে হয়েছেও তাই। বহু অভিযোগ শোনা যাচ্ছে। কিন্তু যে বিষয়টি একেবারে অনুচ্চারিত রয়ে যাচ্ছে তা হলো পরিবেশ প্রসঙ্গটি। হঠাৎ করে আসা মানুষেরা কক্সবাজারসহ সংশ্লিষ্ট অঞ্চলগুলোর অধিবাসীদের জন্য যেমন চাপ হয়ে উঠেছে, একইভাবে তারা সেখানকার পরিবেশের জন্যও চাপ তৈরি করছে। নতুন আসা সব হারানো এসব মানুষকে আশ্রয় দিতে অনেক ছাড় দিতে হচ্ছে সেখানকার সাধারণ মানুষকে। কিন্তু সবচেয়ে বড় ত্যাগ স্বীকার করতে হচ্ছে সেখানকার প্রকৃতিকে। এ বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসন একেবারে নির্বিকার বলা যায়। মানবতাবাদের আড়াল নিয়ে বিষয়টি এড়িয়ে যেতে চাইছেন তারা!
এরই মধ্যে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে গিয়ে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের পাহাড় ও সংরক্ষিত বন উজাড় হয়ে যাচ্ছে। এ দুই উপজেলায় বন বিভাগের হিসাবেই প্রায় ৪ হাজার একর পাহাড় কেটে নতুন বসতি স্থাপন করা হয়েছে। আর স্থানীয় পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠনের হিসাবে সব মিলিয়ে আক্রান্ত এলাকার পরিমাণ প্রায় ১০ হাজার একর। বিপদটির মাত্রা বুঝতে হলে খুব বেশি পেছনে তাকাতে হবে না। মাত্র কয়েক মাস আগেই রাঙামাটিতে ঘটেছে ভয়াবহ পাহাড়ধসের ঘটনা, যেখানে সরকারি হিসাবেই নিহত হন ১২১ জন। পরে সিলেটসহ আরো কয়েকটি এলাকায় এ পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটে। তবে হতাহতের বিচারে সেগুলো ততটা ভয়াবহ ছিল না। সে সময় এর কারণ হিসেবে পাহাড়ের গায়ে বনাঞ্চল উজাড় হওয়াকে দায়ী করেছিলেন বিশেষজ্ঞরা। এ ক্ষেত্রে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে আরো ভয়াবহ বিপর্যয় হতে পারে বলে তখনই সতর্ক করেছিলেন তারা।
কিন্তু তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। এর মধ্যেই রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকটটি এক রকম হঠাৎ করেই বাংলাদেশের ওপর চেপে বসে, যা এখনো চলমান। কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা না থাকায় এ সংকট মোকাবিলায় গৃহীত পদক্ষেপগুলো ভবিষ্যত সংকটের আঁতুড়ঘর হয়ে উঠছে। এটা মনে রাখতে হবে যে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য প্রাথমিকভাবে যে জায়গাটুকু ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, তা ব্যতিক্রমহীনভাবেই আরো সম্প্রসারিত হবে এমনকি আর একজনও রোহিঙ্গা না এলেও। ইতিহাস ঘাটলেই এর সত্যতা পাওয়া যাবে। গত বছর বালুখালী পাহাড়ে গড়ে ওঠা রোহিঙ্গা বস্তিতে শুরুতে ৩২ হাজার মানুষ থাকলেও বর্তমানে এটি অনেক সম্প্রসারিত হয়েছে। সেখানে এখন প্রায় ২ লাখ মানুষের বাস। ১৯৯১ সালে উখিয়ার কুতুপালং পাহাড়ের ৭৭ একর জমিতে রোহিঙ্গাদের জন্য সরকারি ব্যবস্থাপনায় আশ্রয়কেন্দ্র করা হয়। কিন্তু বর্তমানে পুরো পাহাড়টিই আশ্রয়শিবিরে পরিণত হয়েছে, যেখানে প্রায় ৩ লাখ রোহিঙ্গার বাস। একই অবস্থা টেকনাফ উপজেলায়ও। এখানকার নেচার পার্ক, বাহারছড়া, শাহপরীর দ্বীপ, মোচনী, দমদমিয়া, জাদিমুরা, মেরিন ড্রাইভ এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে ঝুপড়ি তুলে বসতি স্থাপন করছে রোহিঙ্গারা। এই মুহূর্তে রোহিঙ্গাদের কাছে পরিবেশের জন্য ভাবার কোনো সময় নেই। ভবিষ্যৎ শঙ্কার চেয়ে বর্তমান বাস্তবতাই তাদের কাছে বেশি দৃশ্যমান। যেকোনো শরণার্থীর জন্যই বিষয়টি সত্য। এ ক্ষেত্রে দায়িত্বের জায়গাটি আশ্রয়দাতা দেশের। সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও পরিকল্পনা এখানে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। না হলে যে পরিবেশ বিপর্যয় চোখ রাঙাচ্ছে তাতে আশ্রয়ের নামে আরেক বড় বিপর্যয়ের দিকেই ঠেলে দেওয়া হবে রোহিঙ্গা ও সেখানকার অধিবাসীদের। এ বিপর্যয় আসতে পারে পাহাড় ধসের নামে। আবার ডায়রিয়ার মতো রোগ-বালাইও তাৎক্ষণিক বিপর্যয় হিসেবে দেখা দিতে পারে।
এর আগে শরণার্থী সংকটের ভুক্তভোগী বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এমন সমস্যার মুখোমুখী হয়েছে। ২০১৪ সালে সিরিয়া সংকট শুরুর পর বহু মানুষ পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নেয়। এতে সেসব অঞ্চলের পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ে বলে জানিয়েছে খোদ জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর। সংস্থাটির তথ্যমতে, সিরিয়া সংকটের সময় এক সপ্তাহের ব্যবধানে লেবাননে মোট ১১-১৫ হাজার সিরীয় শরণার্থী প্রবেশ করে। আর গত বছরের মার্চ নাগাদ এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ১০ লাখে। দেশটির পরিবেশ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, শুধু শরণার্থীদের কারণেই ২০১৪ সালে লেবাননে কঠিন বর্জ্যরে পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ১৫ দশমকি ৭ শতাংশ। এর সঙ্গে ভূমিক্ষয় ও পানিদূষণ তো রয়েছেই। আর এর হাত ধরে এসেছে ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত বহু রোগ, যা বহু শিশুর প্রাণহানীর কারণ হয়েছে। একই সঙ্গে পানি দূষণের কারণে পুরো খাদ্য চক্রেই বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। ফলে আরেক ধরনের মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে।
ইউএনএইচসিআরের মতে, শরণার্থী সংকটের প্রথম আঘাতটিই যায় বনভূমির ওপর দিয়ে। সাধারণত আশ্রয়দাতা দেশগুলো শরণার্থীদের জন্য বিস্তীর্ণ এলাকা একসঙ্গে ছেড়ে দিতে চায়। এতে প্রশাসনিক সুবিধা হয় সত্য, কিন্তু সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয় প্রাকৃতিক পরিবেশের। কারণ এর ফলে ভূমিক্ষয় বেড়ে যায় ভীষণভাবে। সঙ্গে পানি দূষণ। এখানেই শেষ নয়। পরিবেশের ওপর শরণার্থীদের এ নেতিবাচক প্রভাবের উত্তর পরিবেশও দেয় মারাত্মকভাবে। এ ক্ষেত্রে ডায়রিয়া ও অপুষ্টিজনিত সংকট একেবারে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া। সবচেয়ে বড় প্রতিক্রিয়াটি অপেক্ষা করে ভবিষ্যতের জন্য। আর তাতে শুধু শরণার্থীরাই আক্রান্ত হয় না। আক্রান্ত হয় পুরো দেশ এমনকি গোটা প্রাকৃতিক পরিবেশ।
সর্বশেষ জলাবয়ু সম্মেলনে জলবায়ু উদ্বাস্তুর বিষয়টি বেশ জোরালোভাবে উপস্থাপিত হয়েছিল। বিশ্বজুড়ে সহিংসতার কারণ হিসেবে এ জলবায়ু সংকটকে পরোক্ষ কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন অনেক নেতা। বিষয়টি এখন বৈজ্ঞানিকভাবেও প্রমাণিত। ফলে এটা একটা চক্রের মতো কাজ করতে থাকে বলা যায়। শরণার্থী সংকট দীর্ঘমেয়াদে বড় ধরনের পরিবেশ বিপর্যয় ও জলবায়ু সংকটের ভিত্তি। এ সংকট যত দীর্ঘস্থায়ী হয় সংকটের ব্যাপ্তি ও প্রকরণ তত বাড়তে থাকে। আর এর শেষ পরিণতি হচ্ছে আরেকটি শরণার্থী সংকট। সরাসরি শরণার্থী আশ্রয়কেন্দ্রের এলাকায় হয়তো নয়, অন্য কোনোখানে। পাহাড় কেটে আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের মধ্য দিয়ে আমরা তাই আরেকটি উপকূলীয় দুর্যোগকেই ডেকে আনছি, অথবা আরেকটি পাহাড়ধস। এ অবস্থায় সঠিক পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে শরণার্থীদের অন্য কোথাও, বিশেষত চরাঞ্চলে বা এমন কোনো স্থানে স্থানান্তর করা প্রয়োজন যেখানে পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব সহনীয় হয়। সবচেয়ে বড় কথা হলো, বাড়তি এ জনসংখ্যাকে যেখানেই রাখা হোক না কেন, পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বেই। তাই একই সঙ্গে এসব শরণার্থীকে নিজ দেশে পাঠানোর কূটনৈতিক তৎপরতার পাশাপাশি পরিবেশের ওপর পড়া প্রভাব মোকাবিলায় কার্যকর পরিকল্পনাও করা উচিত।