শীতল হচ্ছে ইরান-সৌদি সম্পর্ক

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email

একতা বিদেশ ডেস্ক : শিয়া সুন্নি বিভেদের অবসান হবে বলে ধারণা করছেন আন্তঃর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা। যার অংশ হিসেবেই মক্কায় হজ পালনকালে প্রদেশটির গভর্নর যুবরাজ খালিদ আল-ফয়সাল ৮৬ হাজার ইরানিকে আলাদাভাবে স্বাগত জানান। মসজিদে নববীর প্রাঙ্গণে শিয়া মুসলমানদের প্রার্থনা করা, প্রখর তাপের মধ্যে সৌদি নিরাপত্তা প্রহরী দ্বারা তাদের বিশেষ আপ্যায়ন ইত্যাদি। সদ্য শেষ হওয়া পবিত্র হজে এসবই উল্লেখযোগ্যভাবে ব্যতিক্রমী ঘটনার ভিত্তিতে ধারণ করছেন দুই দেশের কর্মকর্তা এবং নেতারা। এসবই শিয়া মতাবলম্বী ও ইরানের নেতৃবৃন্দের প্রতি সৌদি আরবের বৈরি মনোভাব বদলের ইঙ্গিত, যা সৌদি আরবের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে বিশেষভাবে গুরুত্ববহ। কয়েক দশক ধরেই সৌদি আরবের সুন্নি রাজত্ব শিয়াদের প্রতি বৈরী মনোভাব পোষণ করে আসছে। এর আগে শিয়াদের ‘খারিজি’ আখ্যা দিয়ে তাদের কাছ থেকে প্রকৃত ইসলামকে রক্ষার ডাক দিয়ে বিভিন্ন প্রচার ছিল নিয়মিত একটি বিষয়। কিন্তু এবারের হজ ছিল এসব কিছু থেকে একেবারেই আলাদা। সমবেত হাজির সংখ্যা আগের বছর থেকে ২০ শতাংশ বৃদ্ধি ছাড়া কোনো বড় ধরনের কিছুও ঘটেনি। আর ইরানও সার্বিক ব্যবস্থাপনার জন্য সৌদি আরবকে ধন্যবাদ জানিয়েছে। ২০১৫ সালে সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আবদেল আজিজ এবং তাঁর ছেলে ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোহাম্মদ মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের আধিপত্য খর্বে শক্তি প্রয়োগের পথে হেঁটেছিলেন। ইয়েমেনে তাঁরা যুদ্ধে নেমেছিলেন ইরানের মিত্র হুতিদের বিরুদ্ধে, যারা দেশটির রাজধানী সানা দখল করেছিল। একই বছরে মক্কায় হজের সময় পদদলিত হয়ে নিহত ইরানিদের জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। পরের বছর সৌদি শিয়া নেতা নিমর আল-নিমরের শিরশ্ছেদ করা হয়। ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্নের পাশাপাশি সুন্নি অধ্যুষিত দেশগুলোকে নিয়ে করা হয় সামরিক জোট। আর সৌদি কর্তৃপক্ষ থেকে ঘোষিত হয়েছিল ‘নীরব রাজনীতির’ সমাপন। কিন্তু দুই বছরের মাথায় এ অবস্থার পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। যুবরাজ মোহাম্মদ এখন ক্রাউন প্রিন্স (পরবর্তী বাদশাহ)। গত জুনে এ পদে বসার পর থেকেই তার মনোভাবের পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। ইরানের স্যাটেলাইটগুলোর বিরোধিতা করার বদলে তিনি এখন এগুলো এবং অবধারিতভাবেই এর অধিকারী নেতার সমর্থন চাইছেন। ২৫ বছর পর তিনি ইরাকের সঙ্গে সম্পর্ক নবায়ন করেছেন। ১৯৯০ সালের পর এ মাসেই প্রথম দেশটির মানুষ ও পণ্যের জন্য সীমান্ত উন্মুক্ত করেছে সৌদি আরব। গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় সংক্রান্ত একটি চুক্তি করতে যুবরাজ মোহাম্মদ তাঁর চিফ অব স্টাফকে বাগদাদে পাঠিয়েছেন। একই সঙ্গে ইরাকের বাণিজ্য প্রতিনিধিদের আতিথ্য দিয়েছে রিয়াদ। গত জুনে ইরাকের শিয়া মতাবলম্বী প্রধানমন্ত্রী হায়দার আল আবাদিকে আতিথ্য দিয়েছেন মোহাম্মদ। আর জুলাইয়ে সৌদি আরবের বাণিজ্যিক রাজধানী জেদ্দায় তাঁকে দেখা গেছে ইরাকের কট্টর শিয়া নেতা মুকতাদা আল-সদরের সঙ্গে। আর তার এক মন্ত্রী টুইটার পোস্টে ‘শিয়া ও সুন্নি কট্টর মতবাদ দিয়ে জাতি কিংবা সমাজ গঠন সম্ভব নয়’ লিখে প্রকারান্তরে সম্মিলনের কথাই বলছেন। ইরাকের দক্ষিণাঞ্চলে শিয়াদের আধ্যাত্মিক রাজধানী খ্যাত নাজাফে কনস্যুলেট খোলার পরিকল্পনা রয়েছে সৌদি আরবের। একই সঙ্গে সৌদি শিয়া মতাবলম্বীরা যেন ইমাম হজরত আলীর মাজার পরিদর্শন করতে পারেন, সে জন্য সরাসরি ফ্লাইট পরিচালনারও পরিকল্পনা রয়েছে রিয়াদের। এ বিষয়ে সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদেল আল-জুবায়ের দ্য ইকোনমিস্টকে বলেন, ‘সাম্প্রদায়িক বিভেদের নিরসন হওয়া প্রয়োজন।’ সিরিয়া যুদ্ধের সমাপ্তি ও জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের পরাজয়ের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এ অঞ্চল শান্ত হয়ে আসছে।’ এমনকি সিরিয়া বিষয়েও মনোভাবের বদল হয়েছে সৌদি আরবের। সিরিয়ার বংশ পরম্পরায় ক্ষমতাসীন আলাউইত গোত্রের সঙ্গে ইরানের মৈত্রী রয়েছে। আর এ গোত্রের বিরুদ্ধে মুজাহিদীনদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ডাক দিচ্ছিলেন সৌদি ধর্মনেতারা। এখন তাদের কণ্ঠ নেমে এসেছে। না হলে তাদের বিরুদ্ধেই সন্ত্রাসবাদে মদদ দেওয়ার অভিযোগ উঠতে পারে। সিরিয়ার সুন্নি বিদ্রোহীদের ওপর থেকে সমর্থন তুলে নিয়েছেন সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ। একই সঙ্গে রিয়াদে আশ্রিত বিদ্রোহীদের নেতার প্রতি সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদ সরকারের সঙ্গে বিরোধ নিষ্পত্তির আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। এখনো ইয়েমেনে বোমা হামলা অব্যাহত রাখলেও একটি চুক্তিতে পৌঁছাতে সৌদি আরব আগ্রহী বলেই মনে হচ্ছে। ২৫ আগস্ট সানায় করা বোমা হামলায় ১৪ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হওয়ায় অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবেই দুঃখ প্রকাশ করেছে রিয়াদ। এমনকি জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সানার বিমানবন্দর ও ইয়েমেনের বৃহত্তম বন্দর হোদেইদা খুলে দেওয়ার কথাও বলেছেন এক সৌদি মুখপাত্র। কিছু সৌদি কর্মকর্তা বলছেন, গোত্র পরিচয়কে ধর্মের ঊর্ধ্বে বিবেচনা করে তারা ইরানের মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্ক নবায়ন করতে চান। ইরানের প্রভাব খর্বের জন্যই এটা প্রয়োজন। ইকোনমিস্টকে তারা বলেন, ‘ইরাকের সঙ্গে সম্পর্ক যত গাঢ় হবে, ইরানের প্রতিপত্তি তত কমবে। আর ইরাক আরব বিশ্বেরই অংশ।’ বিশ্লেষকদের মতে, মধ্যপ্রাচ্যের আধিপত্যের বিষয়ে ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে একটি বড় ধরনের আলোচনা হতে পারে। এতে সিরিয়াসহ উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোয় ইরানের কর্তৃত্ব স্বীকার করে নিয়ে ভূমধ্যসাগর ও আরব দেশগুলোয় নিজের কর্তৃত্ব পুনঃস্থাপনের প্রস্তাব তুলতে পারে সৌদি আরব। কিন্তু এমন কোনো আলোচনার সম্ভাবনাকে খারিজ করে দিয়েছেন সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এক সৌদি কর্মকর্তা বলেন, হাসান রুহানির সরকারের কাছ থেকে মধুর বাক্য শোনার সময়ই আপনি ইরানের বিপ্লবী রক্ষীদের আগ্রাসী কর্মকাণ্ড দেখবেন। এ সময় তিনি কুয়েত ও বাহরাইনে ইরানের মদদে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন। ফলে সার্বিকভাবে এ অগ্রগতি এতটা সহজ নয় বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। তাঁদের মতে, ইরানের বিষয়ে সৌদি আরবের অবস্থান ঐতিহাসিকভাবেই ‘সতর্ক’। এমনকি ইরাকের শিয়া নেতাদের পক্ষেও সৌদি আরবের সঙ্গে সব ভুলে মিলে যাওয়া কঠিন। সৌদি আরবে নিমর আল-নিমরের শির–েদের প্রতিবাদে একটি শিয়া অধ্যুষিত গ্রামে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানের সময়ই যুবরাজ মোহাম্মদের সঙ্গে আলোচনায় বসায় ইরাকে শিয়া নেতা মুকতাদা আল-সদরেরও তীব্র সমালোচনা হচ্ছে। ফলে শিগগিরই বড় কোনো পরিবর্তনের আশা করাটা ঠিক হবে না। তবে মশুল বিজয়ের জন্য ইরাকের প্রধানমন্ত্রীর যে প্রশংসা সৌদি আরব করেছে, তাতে পরিস্থিতির অগ্রগতি হয়েছে বলা যায় নিঃসন্দেহে।

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..