নিরাপদ সড়ক-যানজটমুক্ত নগর প্রত্যাশা ও বাস্তবতা

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email
মৃণাল চৌধুরী : দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ভয়াবহভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু, পঙ্গুত্ব ও আহতের সংখ্যা ক্রমাগতভাবে বেড়েই চলেছে। মৃত্যু মানে স্বজন হারানোর কান্না, শোক ছাড়াও সড়ক দুর্ঘটনায় কখনো কখনো গোটা পরিবার ধ্বংসের মুখোমুখি হয়। সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা বর্তমানে জাতীয় কর্তব্য হিসাবে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু কি ভাবে? অনেকেই বলে থাকেন সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী চালকেরাই। চালকেরাই ঘাতক। অতি উৎসাহী কেউ কেউ পরিবহন শ্রমিকদের খান সেনার সঙ্গে তুলনা করেন। তারা দাবি করেন দুর্ঘটনার জন্য মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আইন করলেই সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধ হয়ে যাবে। তাদের একটি প্রশ্ন করা যায়- খুনের মামলায় আসামির ফাঁসির আইন আছে। ধর্ষণ, এসিড নিক্ষেপের জন্য অপরাধীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। তবু কেন খুন ধর্ষণ কমে না? বরং বেড়েই চলে। সুতরাং দুর্ঘটনার জন্য চালকের ফাঁসি অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আইন করলেই যে দুর্ঘটনা বন্ধ হয়ে যাবে তার কোনো গ্যারান্টি আছে কি? দেশ শাসন করছে লুটেরা পুঁজিবাদীরা। পুঁজির ক্রম বিকাশের মাধ্যমে পুঁজিবাদ যখন প্রতিষ্ঠা পায় তখন পুঁজিকে নিরাপদ রাখার জন্য প্রণীত হয় আইন কানুন ও নিয়ম নীতি। কিন্তু লুটেরা পুঁজিতো আইন কানুন, নিয়ম নীতির ধার ধারে না। লুটেরা পুঁজি বুঝে কেবল লুট কর। রাষ্ট্রের সব সেক্টরে অরাজকতা, নৈরাজ্য ও অমানবিকতা চলবে, পরিবহন সেক্টরে মানকিকতা খোঁজা হবে তা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত? সড়ক পরিবহন সেক্টরে চলছে লুটেরা পুঁজির দৌরাত্ম। সড়ক পরিবহন সেক্টর একটি দোজখ। চালক, মালিক, বি. আর. টি. এ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, আমদানিকারক, যাত্রী, পথচারী, মন্ত্রণালয় প্রভৃতি বহুপক্ষ নিয়ে সড়ক পরিবহন সেক্টর। বাংলাদেশের লক্ষ চালক মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে। বাংলাদেশে কেন চালকেরা ঘাতক বা খান সেনা হিসাবে আখ্যায়িত হয়? যেকোনো পক্ষের অব্যবস্থা, অবহেলা, লোভ-লালসা, ক্রটি, দুর্নীতি, দলীয়তার মারাত্মক প্রকাশ হলো সড়ক দুর্ঘটনা। তা যেহেতু শ্রমিকের হাতে ঘটে তাকে দায়ী করে, গরিবের কাঁধে পা রেখে অন্যরা পাড় পেতে চায়। সড়ক দুর্ঘটনা শ্রমিকের ইচ্ছাকৃত অপরাধ নয়। তারাও মানুষ। তাদেরও পরিবার-আত্মীয় স্বজন আছে। দুর্ঘটনায় তারাও প্রাণে বাঁচে না। দুর্ঘটনা কারো কাম্য নয়। সকল মৃত্যুই বেদনাদায়ক। ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট প্রখ্যাত চিত্র পরিচালক তারেক মাসুদ, বিশিষ্ট চিত্রগ্রাহক ও সাংবাদিক মিশুক মুনিরের মর্মান্তিক মৃত্যু জাতীয় ক্ষতি। কিন্তু উক্ত দুর্ঘটনায় চালকের মৃত্যুর জন্য ভুলেও কেউ সমবেদনা প্রকাশ করেন না। সড়ক পরিবহন সেক্টরে কোনো পরিকল্পিত উদ্যোগ, নিয়মনীতি নেই। তার উপর আছে হঠাৎ উন্নয়নের গর্ভ যন্ত্রনা। যে কোনো উন্নয়নের থাকবে ধারাবাহিকতা। প্রয়োজন উন্নয়নের খাপ খাওয়ানোর ক্ষমতা। সাংস্কৃতিক বিকাশ। প্রয়োজন নাগরিক প্রস্তুতি। পারিপার্শি¦ক উন্নয়নের পরিকল্পিত প্রস্তুতি ছাড়া ফরমালিন দিয়ে ফল পাকানোর কুফল ভোগ করছি আমরা। যেমন ধরুন-আন্তর্জাতিক মানের চট্টগ্রাম বন্দর হবে, বৃটিশ বা পাকিস্তান আমলের চট্টগ্রাম মহানগরী রেখে কি তা সম্ভব? হাজার হাজার বাস, কোচ, ট্রাক, প্রাইমোভার ট্রেইলার্সের জন্য কোনো টার্মিনাল নেই। বিগত ৫ বৎসরে চট্টগ্রাম বন্দরের মালামাল পরিবহন ক্ষমতা ৫ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২০ সালে বৃদ্ধি পাবে ২০ গুণ। ২০৪০ সালে কি হবে ? চট্টগ্রাম এয়ারর্পোট থেকে মহানগরীতে প্রবেশের একটি মাত্র রাস্তা। নৌবাহিনীর সদর দফতর, বিমান বাহিনীর দফতর ছাড়াও রয়েছে বহু শিল্প,কারাখানা। ই,পি, জেট যখন প্রতিষ্ঠা করা হয় তখন কারাখানা ছিল। ১০টি শ্রমিক ছিল ১০,০০০। এখন শ্রমিক সংখ্যা কয়েক লক্ষ। সড়ক বাড়ছে, গাড়ি বাড়ছে চালক তো বাড়ছে না। বি. আর. টি. এ’ র তথ্য হলো দেশে বর্তমানে অনুমোদিত গাড়ির সংখ্যা ৩৪ লাখ। লাইসেন্স প্রাপ্ত চালক আছে ১৭ লাখ। একটা গাড়ি দিন-রাত একজনে চালালেও ১৭ লাখ চালকের ঘাটতি আছে। প্রতি বৎসর চালকের চাহিদা রয়েছে ৩০-৩৫ হাজার। এখন পর্যন্ত বছরে নুতন চালক যুক্ত হচ্ছে ৩-৫ হাজার। আমাদের দেশে চালক সৃষ্টির কোনো পরিকল্পিত উদ্যোগ বা প্রতিষ্ঠান নেই। অনুমোদনহীন, অদক্ষ প্রশিক্ষক দ্বারা পরিচালিত কিছু ট্রেনিং স্কুল আছে। যা চালক সৃষ্টি হচ্ছে স্ব উদ্যোগেই সৃষ্টি হচ্ছে। গ্রাম থেকে উঠে আসা বেকার তরুণেরা টার্মিনালে, স্ট্যান্ডে ঘোরাঘুরি করে। ৫/১০ টাকার বিনিময়ে গাড়ি ধোয়ামোছা করে। কোন সময় গাড়ির সহকারীর অর্বতমানে যাত্রী ডাকে, গাড়িতে উঠে। শখ করে স্টিয়ারিং ধরে। দালালের মাধ্যমে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে লাইসেন্স পায়। যদিও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে জাল লাইসেন্স। হঠাৎ উন্নয়নের জরুরি চাহিদা মেটাতে যে যুবকেরা কয়দিন আগে গ্রামে মাটি কাটত আজকে তারা অটোরিকসা, অটো টেম্পো, ড্রাইভার এবং কয়দিন পরেই তারা বাস ট্রাকের ড্রাইভার হবে। জাল লাইসেন্স, অবৈধ গাড়ির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াও কতটুকু সম্ভব? তাহলে পরিবহন সেক্টরে নুতন সংকটের সৃষ্টি হবে। ব্যবস্থা নেবেই বা কে? যারা ব্যবস্থা নেবে তাদের পক্ষপাতিত্ব অবৈধ গাড়ির পক্ষে। বৈধ গাড়ি সরকারকে ট্যাক্স দেয়, যারা অবৈধ তারা দেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের। একটা কেস হিষ্ট্রি নিয়ে আলোচনা করা যায়। ২০১১ সালের ১১ জুলাই। চট্টগ্রাম জেলার মীরসরাই উপজেলায় বঙ্গবন্ধু-বঙ্গমাতা আন্তঃস্কুল ফুটবল প্রতিযোগিতায় বিজয়ী আবু তোরাব উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মিনি ট্রাকে করে ফেরার পথে ট্রাক দুর্ঘটনায় পতিত হয়। তাৎক্ষণিকভাবে ৩৯ জন শিক্ষার্থী নিহত হয়। পরবর্তীতে আহতদের মধ্য থেকে আরও ৫ জনের মৃত্যু হয়। এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী কে? দুর্ঘটনার কারণ কি? সকলের দৃষ্টিতে অদক্ষ চালকের কারণে দুর্ঘটনাটি সংগঠিত হয়। ‘এ’ টা অস্বীকার না করেও আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সকলের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। ১. সে দিনের চালক মফিজের কোনো ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিল না। ২.মফিজ ছিল একজন হেলপার ৩. ট্রাক মালিক কেন হেলপারকে ট্রাক চালানোর দায়িত্ব দিয়েছিল? ৪. যে ট্রাকটি দুর্ঘটনার শিকার হয় সেটির কোনো ফিটন্সে ছিল না। ৫. লাইসেন্স ছাড়া ফিটন্সেবিহীন গাড়িটি যে রাস্তায় চলছিল আইনশৃঙ্খলাবাহিনী কি করছিল? ৬. গ্রামের রাস্তায় আর একটি অবৈধ চাঁদের গাড়িকে সাইড দিতে গিয়ে দুর্ঘটনাটি হয়েছিল। ৭. সাইড নেওয়ার সময় রাস্তার একাংশ ধ্বসে গিয়েছিল। ৮. মিনি ট্রাকের ধারণ ক্ষমতা মাত্র ২০ থেকে ২২ জন। সেখানে ৬০-৬২ জন ছাত্রকে শিক্ষকেরা কেন তুলে দিয়েছিল? ফলে বিজয়ের আনন্দে ছাত্ররা নাচানাচি করার কারণে চালক মফিজ গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারায়। মফিজের ৫ বছরের সাজা হয়েছে। প্রশ্ন করা যায় সাতটি পক্ষের কেন কোনো শাস্তি হয় না? ফাঁসি, যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আইন কার্যকরী করা হলে শ্রমিকেরাও পেশা বদলের সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কারণ পেশা পরিবর্তনের অধিকার সকলেরই রয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনার জন্য পরিবহন শ্রমিকেরা যেমন একমাত্র দায়ী নয়, তেমনি দুর্ঘটনা প্রতিরোধে তাদের দায়িত্বও কম নয়। ওভার স্পিড, ওভার লোড, ঝুঁকিপূর্ণ ওভারটেক, গাড়ি চালনা অবস্থায় মোবাইলে কথা বলা, নেশাগ্রস্ত হয়ে গাড়ি চালনা, ঝুঁকিপূর্ণ বাঁকে গতি নিয়ন্ত্রণ না করা, নিজের সাইডে না থাকা, চালকের পরির্বতে হেলপার দিয়ে গাড়ি চালানো, প্রতিযোগিতামূলক গাড়ি চালানো ইত্যাদি যেকোনো একটার কারণে সড়ক দুর্ঘটনা হতে পারে। মালিক পক্ষের ক্রটির কারণেও সড়ক দুর্ঘটনা হতে পারে। যেমন ক্রটিপূর্ণ যানবাহন চালাতে শ্রমিকদের বাধ্য করা, লাইসেন্স পরীক্ষা না করে চালক নিয়োগ, শ্রমিকদের নিয়োগপত্র না দেওয়া, যোগ্য ও দক্ষ চালক নিয়োগ না দেওয়া, কোনো রকম বিশ্রামের সুযোগ না দিয়ে দিন-রাত গাড়ি চালাতে বাধ্য করা, শ্রমিকের বেকারত্বের সুযোগ নিয়ে দৈনিক নির্দিষ্ট অংকের টাকা মালিককে দিতে বাধ্য করা, আইন অনুযায়ী শ্রমিকদের ছুটি ভোগ করার সুযোগ না দেওয়া –ইত্যাদি। দুর্ঘটনা হতে পারে পথচারীর কারণে। অসর্তক ও অমনোযোগী অবস্থায় রাস্তা পাড় হওয়া, মোবাইলে কথা বলতে বলতে রাস্তা পাড় হওয়া, রাস্তা পাড়াপাড়ে জেব্রাক্রসিং/ওভার ব্রিজ ব্যবহার না করা, ফুটপাত দিয়ে না চলা ইত্যাদি। অনেক সময় গাড়ির যাত্রীরাও পরোক্ষভাবে চালককে প্ররোচিত করে। আস্তে চালালে বলে গরুর গাড়ি, জোরে চালালে বলে ড্রাইভার মদ খেয়েছে। কোনো কোনো যাত্রী নির্দিষ্ট স্টপিজের আগে পরে নামতে চায়। চলন্ত গাড়িতে লাফ দিয়ে ওঠে। নানা কথায় দায়িত্বহীনভাবে ড্রাইভারকে উত্তেজিত করে। আমাদের দেশে ক্রটিপূর্ণ সড়ক ব্যবস্থা দুর্ঘটনার অন্যতম প্রধান কারণ। সড়কের অপ্রস্থতা, ভাঙ্গা সড়ক, আকাঁবাঁকা সড়ক, সড়ক নির্মাণে নিন্মমানের বিটুমিন, পাথর ব্যবহার, ডিভাইডার না থাকা, রোড সাইন মার্কিং না থাকা ইত্যাদি কারণে সড়ক দুর্ঘটনা হয়। দুর্ঘটনা কমানোর জন্য সারাদেশে ঝুঁকিপূর্ণ মোড়গুলি চিহ্নিত করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। কার কথা কে শোনে? রাস্তার পাশের গাছের ডাল কাটার জন্যও পরিবহন ধর্মঘট করতে হয়। বাংলদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি হল সড়ক নিয়ন্ত্রণের মূল কর্তৃপক্ষ। বি. আর. টি. এ. নামক এ সংস্থাটি দিনকে রাত করতে পারে। যে গাড়ি চলার যোগ্য নয় সে গাড়ির ফিটন্সে দেওয়া, যে চালক গাড়ি চালানোর যোগ্য নয় সে চালককে লাইসেন্স দেওয়া, যে সড়ক গাড়ি চলার উপযুক্ত নয় সে সড়কের ধারণ ক্ষমতা বিবেচনা না করে গাড়ি চলার জন্য রুট পারমিট দেওয়া -সব কিছুই তারা করতে পারে। তারা থাকে দালালচক্র বেষ্টিত। দালালদের ডিঙ্গিয়ে কর্মকর্তাদের কাছে যাওয়া যায় না। সংস্থাটি হলো পরিবহন সেক্টরে লুটপাটের ফ্যাক্টরি। তাদের দুর্নীতি, হয়রানি, আমলাতন্ত্রিক জটিলতায় শ্রমিকেরা অতিষ্ট। বি. আর. টি. এ. এর উদ্যোগে সারাদেশে প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন। এমন নিয়মও করা যায় লাইসেন্স প্রাপ্তির শর্ত হবে প্রশিক্ষণ কোর্স। বি. আর. টি. এ. এর নিয়মনীতি কার্যকর করে আইন শৃংখলা বাহিনী বা পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ। তাছাড়া মহাসড়কে ডাকাতি প্রতিরোধ ও সন্ত্রাস দমনের জন্য পরিবহন শ্রমিকদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইওয়ে পুলিশ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। পরিবহন শ্রমিকেরা ঘোড়ায় চড়তে চেয়েছিল। ঘোড়া এখন শ্রমিকদের উপর চড়ছে। ট্রাফিক ও হাইওয়ে পুলিশের দায়িত্ব হল পরিবহন সেক্টরে চাঁদাবাজ ধরা। কিন্তু তারাই এখন শ্রেষ্ঠ চাঁদাবাজ হিসাবে চিহ্নিত । অবৈধ গাড়ির পক্ষেই থাকে তাদের পক্ষপাতিত্ব। তাদের সঙ্গে মাসিক চুক্তি হয়। উপর মহলের বিভিন্ন সভায় অবৈধ গাড়ি, নসিমন, করিমন, চাঁদের গাড়ি বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু পুলিশ তা হতে দেবে না। অনেক সময় নানা রাজনৈতিক চাপে পড়েও পুলিশের পক্ষে বন্ধ করা সম্ভব হয় না। মোটরসাইকেলে ৪-৫ জন যাত্রী চড়ে। বহু ফোরামে বলেও কোনো লাভ হয় না। ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্বপ্রাপ্তরা বহুক্ষেত্রে মোটর ভেইক্যাল এ্যাক্ট সম্পর্কে কিছুই জানে না। ব্যস্ততম সড়কে অবৈধ গাড়িকে সাইড দিতে গিয়েও মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা হয়। সড়ক পরিবহন সেক্টরে নীতি নির্ধারণ ও মৌলিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য একটি মন্ত্রণালয় রয়েছে। পূর্বে এরকম ছিল যোগযোগ মন্ত্রণালয়। এখন সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয়। তার অধীনে বি. আর. টি. এ. কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। বাংলাদেশে একটি যুগোপযোগী গণমুখী পরিবহন নীতি নেই সে ব্যাপারে কোনো প্রতিশ্রুতি বা আন্তরিকতাও নেই। নিয়োগদান হয় রাজনৈতিকভাবে। বাংলাদেশে পরিবহন বিষয়ে কিছু করতে হলে এখনই দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। জাল লাইসেন্স প্রদানকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ট্রাফিক আইন যুগোপযোগী ও ট্রাফিক পুলিশের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। দক্ষ চালক গড়ে তোলার জন্য দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে রাষ্ট্রকে। নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বড় গাড়ি ও ছোট গাড়ির জন্য আলাদা রাস্তা করতে হবে। দূরপাল্লা গাড়ির জন্য সড়ক মহাসড়কে টার্মিনাল এবং শ্রমিকদের নিয়োগ পত্র, কল্যাণ তহবিল প্রদানসহ প্রচলিত শ্রম আইনের সকল সুবিধা পরিবহন শ্রমিকেরা যাতে ভোগ করতে পারে তার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন মহানগরী ও মহাসড়কে নাগরিকেরা যানজটের কারণে ভোগ করছে নরক যন্ত্রনা। সড়ক দুর্ঘটনার যেমন বহু কারণ রয়েছে তেমনি যানজটেরও বহু কারণ আছে অন্যান্য কারণগুলি বিশ্লেষণ করার আগে বলা প্রয়োজন–‘মহানগরীতে মানবজট না কমলে যানজট কমানো যাবে না।’ জেলা শহর, উপজেলা শহরকে কেন্দ্র করে শিল্পায়নসহ নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করে গ্রাম থেকে উচ্ছেদকৃত প্রান্তিক মানুষদের ব্যবস্থা গ্রহণ করে নগরের চাপ কমাতে হবে। জাইকার রির্পোট অনুযায়ী ঢাকায় ট্রাফিক অব্যবস্থার কারণে দৈনিক ক্ষতি হয় ২০ হাজার কোটি টাকা। দৈনিক সময় অপচয় হয় ৩২ লাখ কর্ম ঘণ্টা। রাস্তার জন্য বাড়তি সময় নির্ধারণ না করে কোনো প্রোগ্রামে সঠিক সময়ে উপস্থিত হওয়া সম্ভব নয়। ‘এভাবে যানজট নগরবাসীর সময় কেড়ে নিচ্ছে, স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে। মহানগরীতে যানজট কিভাবে মানুষের সময় কেড়ে নিচ্ছে তার একটি রির্পোট দিয়েছে লন্ডনভিত্তিক ফিনানন্সিয়াল টাইমস। তারা বলছে- পিক আওয়ারে অফিস শুরু এবং ছুটির সময়ে ১৯৯৭ সনে পরিবহনের গতি ছিল ঘণ্টায় ২৫ কি.মি, ২০০৪ সনে গতি ছিল ঘণ্টায় ১৬ কি.মি, ২০১০ সনে হলো ১২ কি.মি, এবং ২০১৬ সনে ঘণ্টায় গতি হয়েছে ৬.৪ কি.মি। এক সময় হয়ত: এমনই পরিস্থিতি হবে যখন নগর জীবনের গতি থেমে যাবে। আমাদের দেশে গণ পরিবহন আমদানি হয় ৬-৮%। পক্ষান্তরে বিলাস বহুল গাড়ি আমদানী হয় ৮০%। মানুষ কেন বাসে চড়ে না? বাসে চড়ার পরিবেশ সৃষ্টি হলে, বাসের জন্য আলাদা সড়ক হলে এবং বাসকে যদি আরামদায়ক সার্ভিসে পরিণত করা যায় তাহলে মানুষ অবশ্যই বাসে চড়বে। এতে যানজট অনেকাংশে কমে আসবে। ঢাকা চট্টগ্রাম মহানগরীতে বাসে চড়ে মাত্র ৮-১১% মানুষ অন্যাদিকে রিক্সা চড়ে ৩৭%, টেক্সিতে চড়ে ৩৯%, কার’ এ চড়ে ১১-২০% মানুষ। যানজট নিরসনের জন্য বাস সার্ভিস কেন গুরুত্বপূর্ণ তা নি¤েœর তথ্য থেকে বুঝা যাবে। বাসে ৩৩ জনের জন্য জায়গা প্রয়োজন ৩৩ ফুট, টেম্পুতে ৩৩ জনের জন্য জায়গা প্রয়োজন ৬৬ ফুট, সিএনজিতে ৩৩ জনের জন্য জায়গা প্রয়োজন ৯৯ ফুট, রিক্সায় ৩৩ জনের জন্য জায়গা প্রয়োজন ১৩২ ফুট এবং কার ‘এ’ ৩৩ জনের জন্য জায়গা প্রয়োজন ৪৬২ ফুট যানজটের বিরুদ্ধে মুখে ফেনা তুললেও কোনো লাভ নেই। প্রয়োজন বাস্তবসম্মত গণমুখী পরিকল্পনা। নগর পরিকল্পনায় ত্রুটি এবং ধনিক শ্রেণি, দলীয় ক্যাডার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারলে যানজট কমানো সম্ভব নয়। আগেই বলা হয়েছে চালকেরা ঘাতক নয়। তাদের বিরুদ্ধে নেগেটিভ প্রপাগণ্ডা বন্ধ করে পত্র-পত্রিকা, মিডিয়ায় তাদেরকে পজিটিভভাবে উপস্থাপন করা প্রয়োজন। যে চালক সারা জীবনে কোনো দুর্ঘটনা করেনি তাদেরকে প্রশংসাপত্রসহ পুরষ্কৃত করে উৎসাহিত করতে হবে। পাঠ্য পুস্তকের সিলেবাসে সড়ক দুর্ঘটনার কারণ, প্রতিরোধ সংক্রান্ত সচেতনতামূলক প্রবন্ধ, গল্প অর্ন্তভুক্ত করতে হবে। বিভিন্ন সড়কের সুনির্দিষ্ট কারণ চিহ্নিত করে দুর্ঘটনাবিরোধী অভিযান চালাতে হবে। সড়ক মেরামত, সংস্কারের মত জরুরি কাজকে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। চালকদের সচেতনতা বৃদ্ধিসহ বি, আর, টি, এর উদ্যোগে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, ট্রাকে ওভারলোড বন্ধে প্রয়োজনীয় সংখ্যক (ওয়েয়িং) মেশিন চালু করা এবং ওভারলোডের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা চালু করতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধের জন্য ট্রেড ইউনিয়ন -এর ভূমিকা বিশাল। এ দায়িত্ব এড়িয়ে অন্যের উপর দোষ চাপানো দেশপ্রেমের লক্ষণ নয়। প্রত্যেকে প্রত্যেকের নিরাপত্তা দেওয়া ছাড়া দুর্ঘটনা হ্রাস করা সম্ভব নয়। ট্রেড ইউনিয়নের কর্তব্য হলো নিজেদের দোষ-ত্রুটির ব্যাপারে সংশোধন হবো, অন্যের ত্রুটিগুলোর ব্যাপারে আন্দোলন করবো। সরকারের উদ্দেশ্যে বলা প্রয়োজন অন্যান্য সড়কে যে চালক বা পথচারীরা চরমভাবে সভ্যতার পরিপন্থি আচরণ করে তারাই সেনা নিবাসের ভেতরের রাস্তায় পরিণত হয় সভ্য নাগরিক হিসাবে। এর কারণ কি? সব শেষে বলা প্রয়োজন লুটেরা পুঁজিকে নিরাপদ করে নিরাপদ সড়ক পাওয়া যাবে না। লেখক : সদস্য কেন্দ্রীয় কমিটি,সিপিবি

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..