পুঁজিবাদ বর্তমান নৈরাজ্যের হোতা
মোহাম্মদ শাহ্ আলম :
পুঁজিবাদী অস্থিরতা প্রতিদিন প্রতিক্ষণে দেশে দেশে ভয়ংকর নৈরাজ্যের জন্ম দিয়ে চলেছে। তারা মধ্যাপ্রাচ্য-উত্তর আফ্রিকার হস্তক্ষেপের মাধ্যমে ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া-ইয়ামেনকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। সমাজকে বিচ্ছিন্ন বিভক্ত এবং মানুষকে করেছে বাস্তুচূত। প্রতিনিয়ত সাধারণ মানুষ মরছে। আমেরিকা জন্ম দিয়েছে তালেবান, আল-কায়দা আইএসকে। তাদের এই কর্মকাণ্ড যুদ্ধাপরাধ ছাড়া কিছু নয়। ২১ শতকে পুঁজিবাদের এই অস্থিরতা যে কোনো সময়ের চেয়ে প্রকাশ্য ও গভীর। কেন অস্থিরতা? উন্নত পুঁজিবাদী সমাজ মন্দা উন্নয়ন-প্রবৃদ্ধি ও বিনিয়োগের নিম্নজাতি, বেকারত্ব শ্রেণি ও ধনবৈষম্য অস্থিরতা ও সংকটের জন্ম দিয়েছে, এই সংকট থেকে বের হওয়ার জন্য তারা রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে হিংস্র ও বাক-বিচারহীনভাবে আগ্রাসী তৎপরতা চালাচ্ছে। সারা দুনিয়ায় বর্ণ-গোষ্ঠি-জাতি-ধর্ম কাষ্ঠে কাষ্ঠে দ্বন্দ্ব সংঘাত উস্কে দিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য হয়েছে গোরস্থান, সন্ত্রাস ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে। জঙ্গি সাম্প্রদায়িকতা ও উগ্র জাতীয়তা বর্তমানে এদের বাহন।
পুঁজিবাদ মানব সভ্যতায় প্রধানতঃ তিনটি যুগান্তরকারী অবদান রেখেছে, রাষ্ট্রকে ধর্ম থেকে আলাদা করেছে। সমাজ চেতনায় ধর্মের জায়গায় বিজ্ঞানমনস্কতাকে প্রধান বিষয় রাজনীতিতে গণতন্ত্রের চর্চা চালু করেছে। তারা অদ্য এর থেকে সরে গেছে। বর্তমানে ধর্মনিরপেক্ষতা, বিজ্ঞানমনস্কতা বুর্জোয়া গণতন্ত্র ও বুর্জোয়া বিশ্ব মানবিকতা সাম্রাজ্যবাদী কর্পোরেট পুঁজিস্বার্থের সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই তারা এই মূল্যবোধগুলিকে ঝেড়ে ফেলে মধ্যযুগীয় ধর্মীয় জঙ্গি মৌলবাদী শক্তিকে ব্যবহার করছে, সমাজের ধনবৈষম্য ও শ্রেণি বৈষম্যের লড়াইকে আড়াল করার জন্য। যদিও সব ধর্মান্ধ-মৌলবাদী জঙ্গি শক্তি এদের নিয়ন্ত্রণে থাকতে চাইছে না। এতেও তাদের ক্ষতি নেই। জঙ্গি-সন্ত্রাস ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বব্যাপী যা আমরা আজো বলেছি। ইউরোপে ইসলামী জঙ্গিদের অন্তঃসাত উদ্ধার ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রকে করছে বিপর্যস্ত। এই প্রতিক্রিয়ায় মুসলিম বিদ্বেষ, অভিবাসী বিদ্বেষ-নন বিদ্বেষ বাড়ছে আমেরিকা ইউরোপে, সৃষ্টি হচ্ছে খ্রিষ্টান মৌলবাদী ও উগ্র সাম্প্রদায়িকতা, জন্ম হচ্ছে লিলেন, মোরাসা মে ও ডেনাল ট্রাম্পদের, জন্ম হচ্ছে বর্ণশ্রিত উগ্র জাতীয়তাবাদের। জঙ্গি সাম্প্রদায়িক শক্তি প্রগতি ও প্রগতিশীল শক্তির জন্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। জঙ্গি মৌলবাদ মুসলিম হউক, খ্রিষ্টান হউক, হিন্দু হউক পুঁজির স্বার্থকে ক্ষতিগ্রস্ত করে না। এদের পুঁজিবাদের বিকল্প কোনো আর্থ-সামাজিক কর্মসূচি নেই। যতই তারা মানবতা বিধ্বংসী হউক না কেন এরা সাম্রাজ্যবাদী করপোরেট পুঁজির জন্য হুমকি নয়। আমরা দেখি পুঁজির জন্য হুমকি নয়। আমরা দেখি ভারতে করপোরেট পুঁজি স্বার্থরক্ষা করছে বিজেপি আর এসএস হিন্দু জাতীয়তাবাদী শক্তি আমেরিকা-ইউরোপে ইসলামী জঙ্গিদের আন্তঃঘাত মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও আইনের শাসনকে সংকুচিত করে দিচ্ছে। জঙ্গি আক্রমণ রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়াশীল হাতিয়ারগুলি শক্তিশালী করতে সাহায্য করছে। মানবাধিকার, গণতন্ত্র, আইনের শাসন সংকুচিত করতে পারলে করপোরেট পুঁজির বিরুদ্ধে শ্রমিক ও মেহনতী মানুষের অধিকার ও লড়াইকে কর্তন ও দমন করা যায়। করা যায় যথেচ্ছা শাসন-শোষণও। যা থেরেসা মে ট্রাম্প ও দক্ষিণপন্থিরা চাই। থেরেসা মে বলেছেন মানবাধিকার কর্তন না করে জঙ্গি সন্ত্রাসী আক্রমণ দমন ও বন্ধ করা সম্ভব নয়।
উগ্র জাতীয়তাবাদের দেশে দেশে উত্থান, যুক্তরাজ্যের ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগ একা চলার উদ্যোগ। মুক্তবাজারের ব্যর্থতা-ট্রাম্পের রক্ষণশীল অর্থনৈতিক পন্থা অবলম্বন ‘আমেরিকা প্রথম’ আওয়াজ বর্ণ, অভিবাসী, ইসলাম বিদ্বেষ। ট্রাম্পের উগ্র জাতীয়তাবাদ বিশ্ব অর্থনীতির জাতিধারাকে উল্টোপাল্টা করে দিচ্ছে। আমেরিকায় করপোরেট পুঁজির স্বার্থ প্রাধান্য বিস্তার করেছে শত জাতির জলবায়ু চুক্তির উপর। পৃথিবীর পরিবেশ ঝুঁকি আবারও করেছে বৃদ্ধি। ট্রাম্পের রক্ষণশীল অর্থনৈতিক নীতি চীন, রাশিয়া, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সাথে দ্বন্দ্ব ও বিরোধ রয়েছে। যুদ্ধ, বাণিজ্য যুদ্ধের দিকে পৃথিবীকে ঠেলে দিচ্ছে। বৃদ্ধি পাচ্ছে দেশে দেশে উগ্র জাতীয়তাবাদী প্রবণতা। ভারতে হিন্দুত্ববাদ, রাশিয়ায় শ্লাভ জাতীয়তার উত্থান, আমেরিকার চীন ঘেরাও প্রতিক্রিয়ায় হ্যাংক জাতীয়তার উত্থানের লক্ষণ পৃথিবীকে বিপদগ্রস্ত করেছে।
এইসব কিছুই পুঁজিবাদের সংকটের থেকে উৎসারিত। ধর্ম, বর্ণ, জাতি গোষ্ঠী দ্বন্দ্বেকে সামনে এনে যারা অদৃশ্যপূর্ণ ধনবৈষম্য ও শ্রেণি বৈষম্যের লড়াইকে আড়াল করে পৃথিবীতে অস্থিরতা ও নৈরাজ্যের সৃষ্টি করেছে ও করছে। ট্রাম্পের সৌদি ও ইসরাইল সফর সৌদির সাথে বড় অস্ত্রচুক্তি বাণিজ্যের লড়াইকে সামনে এনেছে। ট্রাম্পের ইরান বিরোধিতা মধ্যপ্রাচ্যের মানবতা বিধ্বংসী যুদ্ধ উন্মাদনায় ঘি ঢেলেছে। মধ্যপ্রাচ্যের তেল-গ্যাস আত্মসাৎ করার ও অস্ত্র বিক্রি করার জন্য ট্রাম্প আমেরিকা-সৌদি ও ইসরাইলের বন্ধুত্বকে নতুন মাত্রায় উন্নীত করেছে।
কিন্তু আমেরিকা ও যুক্তরাজ্যের এই সামরিক ও রাজনৈতিক রণকৌশলের বিরুদ্ধে লড়াই অব্যাহত আছে চীন-রাশিয়া-ইরান-সিরিয়ায়। এর বিরুদ্ধে ইউরোপ আমেরিকায় প্রতিরোধও চলবে। বর্ণবাদ, অভিবাসী ও ইসলাম বিদ্বেষের বিরুদ্ধে ইউরোপের পুরানো ঐতিহ্যবাহী সামাজিক গণতন্ত্রী, খ্রিষ্টান গণতন্ত্রী, বামদলগুলো ও পরিবেশবাদী দলগুলো নিজেদের মতপার্থক্য পাশে রেখে একযোগে এই সংকট মোকাবিলায় প্রচেষ্টা জোরদার করেছে।
আমেরিকায় বার্নি স্টান্ডার্স, যুক্তরাজ্যে করবিনের নেতৃত্বে যুদ্ধ বৈষম্য শোষণ আর জাতি-ধর্ম-বর্ণ বিদ্বেষের বিরুদ্ধে লড়াই তরুণ প্রজন্মকে আকৃষ্ট করছে। তারা বুঝতে শুরু করেছে তাদের বঞ্চনার কারণ। পুঁিজ ও শ্রমের দ্বন্দ্বই মূলদ্বন্দ্ব, এটা আবার সামনে এসেছে। অন্য দ্বন্দ্বগুলি কিছু সফল কিছু আপেক্ষিক। পৃথিবীব্যাপী আবার সঞ্চার করেছে শান্তি-প্রগতির শক্তির নব উত্থানের।
লেখক : সাধারণ সম্পাদক, সিপিবি
Login to comment..