বিচ্ছিন্নতার মূলেই শ্রেণি বৈষম্য

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email
মযহারুল ইসলাম বাবলা : ছোটবেলায় পড়েছিলাম ঈশপের সারস এবং শিয়ালের বন্ধুত্বের গল্পটি। পশু এবং পাখি পৃথক দুই প্রাণির বন্ধুত্ব হয়েছিল বটে, তবে একে অপরের গৃহে নিমন্ত্রণ খেতে যেয়ে পরস্পর চরম বিড়ম্বনার মুখে পড়ে, কেউ কারো বাড়িতে নিমন্ত্রণের খাবার খেতে পর্যন্ত পারে নি। দু’জনের খাদ্য গ্রহণের সংস্কৃতিগত বৈপরীত্যে। পশু ও পাখির এই অসম সামঞ্জস্যহীন বন্ধুত্বের মূল সারবস্তু বয়স ও দৃষ্টিভঙ্গির অনভিজ্ঞতায় সেভাবে তখন উপলব্ধি করতে পারিনি। এখন বেশ সহজভাবে বুঝতে পারি। অসম সংস্কৃতির পশু-পাখিকে নিয়ে গল্পটি লেখা হলেও, সেটা মানুষ এবং মানুষের শ্রেণিগত পার্থক্যের উপমা সুলভ গল্প ছিল না, তা বলা যাবে না। কারণ আমরা জানি ঈশপের গল্প মাত্রই মানুষের সচেতনতা সৃষ্টিতে রচিত। তেল-জল যেমন মিশে একাকার হতে পারে না, তেমনি একটি শ্রেণিবিভক্ত সমাজে সকল মানুষের সম্পর্ক, সম্প্রীতি, হৃদ্যতা, অনাবিল আন্তরিকতার প্রকাশ ও বিকাশ ঘটা সম্ভব নয়। ঈশপের এই গল্পের দুই পৃথক প্রাণির ন্যায় মানুষে মানুষে দূরত্ব-ব্যবধান গড়ে ওঠে শ্রেণি ভিন্নতায়। এই শ্রেণি বৈষম্য একটি ব্যবস্থারই অনুদান। যে-ব্যবস্থাটি আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে রয়েছে। এবং ক্রমেই আরো বিস্তার লাভ করে চলেছে। সমাজের এই বৈষম্য পরিবারে পরিবারে পর্যন্ত বিস্তৃত, অপ্রতিরোধ্য গতিতে বিস্তার ঘটেছে যেমন বৈষম্য, তেমনি বিচ্ছিন্নতা। একান্নবর্তী পরিবারে ভাই-বোনেরা পরস্পর যেভাবে আন্তরিকতায় বেড়ে ওঠে, পরবর্তী জীবনে সেই ভালবাসায় ভাটির টান পড়ে পরস্পরের শ্রেণিগত অবস্থানের কারণে। কর্মকর্তা ভাইয়ের সঙ্গে কর্মচারী ভাইয়ের শ্রেণিগত দূরত্ব কেবল জীবীকার ক্ষেত্রেই নয়, ব্যক্তিগত-পারিবারিক জীবনেও প্রভাব ফেলে। একই বাবা-মায়ের সন্তানদের মধ্যে কেউ যদি অন্যদের তুলনায় বিত্তশালী-ক্ষমতাশালী এমনকি সেলিব্রেটি হয় তবে অন্য ভাই-বোনদের থেকে তার বিস্তর ব্যবধান সৃষ্টি হয়। শ্রেণি উত্তোরণে বদলে যায় তার দৃষ্টিভঙ্গি এবং আত্মীয়তার জগৎ পর্যন্ত। তার সমশ্রেণির অনাত্মীয় হয়ে পড়ে পরম নিকট আত্মীয় আর নিকট আত্মীয় হয়ে যায় পর। সেটা শ্রেণিগত অবস্থানের কারণে। পরিবারের মধ্যে দূরত্ব বা ব্যবধানের ক্ষেত্রেও শ্রেণিগত অবস্থানই প্রধান হয়ে দাঁড়ায়। শ্রেণি প্রশ্নেই অতীতের একান্নবর্তী জীবনের স্মৃতি ব্যতীত পরস্পরের সম্পর্ক বলে তেমন আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না। যেটুকু থাকে সেটা কেবলই সামাজিক লৌকিকতায় সীমাবদ্ধ। আমাদের সমাজে আত্মপরিচয়ের প্রশ্নে আমরা সাধারণত বিত্তবান-প্রভাবশালী নিকট বা দূর আত্মীয়দের সর্বাধিক পরিচয় দিয়ে থাকি, নিজের মর্যাদার তাগিদে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, যার পরিচয় দেয়া হয় তিনি কিন্তু শ্রেণিগত নিম্ন অবস্থানের নিকট বা দূর আত্মীয়ের পরিচয় দেয়া তো পরের কথা, তাদের স্মরণে রাখেন কিনা সন্দেহ! নিরুপায়ে বড় জোর প্রতিবেশী কিংবা পরিচিত পরিচয় দিয়ে নিজের শ্রেণি মর্যাদা-শ্রেণি অবস্থানকে সংহত করেন। একটি ঘটনা শুনেছিলাম। এক বিত্তবান ভাইয়ের বাড়ির ভেতরে প্রবেশের অনুমতি লাভের অপেক্ষায় মূল ফটকে দাঁড়িয়ে থাকা নিম্নবিত্ত ভাইটিকে জনৈক পথচারী বিশাল ওই বাড়িটির মালিক কে জানতে চাইলে ফটকে দাঁড়িয়ে থাকা বাড়ির মালিকের ভাইটি গর্বে বলে ওঠেন, ‘কেন, আমাদের বাড়ি।’ পথচারীটি তখন তাকে বলে, ‘ভাই বড্ড তেষ্টা পেয়েছে, এক গ্লাস পানি খাওয়াবেন।’ ভীষণ বিপদ-সংকোচে পড়ে যায় ভাইটি। অগত্যা মুখ ফস্কে সত্য কথাটি বেরিয়ে আসে তার মুখ থেকে। ‘ভাই দুঃখিত, অনুমতি ব্যতিরেকে আমার বাড়ির ভেতরে যাবার অনুমতি নেই। আমি সেই অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি।’ জানিনা যিনি আমাকে এই ঘটনাটি বলেছিলেন তা সত্য ঘটনা-না গল্প। তবে আমাদের সমাজ বাস্তবতার সঙ্গে ঘটনাটি অবিকল মিলে যায় বলেই সত্য ঘটনা বলেই মনে করেছি। ঢাকায় বসবাসরত এক উচ্চ মধ্যবিত্ত এবং প্রভাবশালী ব্যক্তির আত্মীয় (আপন চাচাতো ভাইয়ের বিএ পাস ছেলে) কে ঘনঘন চাকরি প্রদানের দাবির প্রেক্ষিতে বাধ্য হয়ে তাদের যৌথ মালিকানার অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানের একটিতে (চায়নিজ রেস্টুরেন্টে) হিসাবরক্ষকের চাকরি দেন। তবে ছেলেটির আত্মীয় পরিচয় গোপন করে অপরাপর অংশীদারদের নিকট পরিচয় দেন গ্রামের ছেলে বলে। আত্মীয় পরিচয় শ্রেণি হানি ঘটার আশঙ্কায় দেন নি। ছেলেটি ঢাকায় এসে আত্মীয়ের বাড়িতে ঠাঁই পায় নি। তাকে মেসে থেকে চাকরি করতে হয়েছে। এমন কি সেই আত্মীয়র বাড়িতে একদিনের জন্যও তার প্রবেশ ঘটেনি। নিকট আত্মীয়র পরিচয় আড়ালের এই প্রবণতা এখন সমাজের বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। শ্রেণি মর্যাদায় কিংবা শ্রেণি রক্ষায় শ্রেণির মান বাঁচাতে এই সংস্কৃতি এখন সমাজজুড়ে বিরাজ করছে। উল্টো দিকে দেখা যায় ঠিক এর বৈপরীত্য। অর্থাৎ গরিব আত্মীয়রা গর্ব করে বিত্তবান আত্মীয়র পরিচয় দেয়। আর বিত্তবানেরা গরিব আত্মীয়দের পরিচয় না দিয়ে অবজ্ঞায় এড়িয়ে চলে। না চেনার ভান করে। শ্রেণি বৈষম্য কতটা তীব্রতর হলে এমন ঘটনার উদ্ভব ঘটতে পারে, সেটা নিশ্চয় অনুমেয়। আমাদের সমাজে চিরকাল বৈষম্য ছিল সত্য, তবে এত নগ্নভাবে হয়ত ছিল না। সমাজে ক্রমাগত বৈষম্য সৃষ্টির ফলেই বৈষম্যগুলো মোটাদাগে দৃশ্যমান হয়ে পড়েছে। একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা প্রত্যক্ষ করেছিলাম। আজ থেকে বছর ছয় পূর্বে এক সংবাদ কর্মী বন্ধুর সঙ্গে গিয়েছিলাম ঢাকার বনেদী এলাকার এক বৃদ্ধাশ্রমে। বন্ধুটি ঈদ সংখ্যার জন্য পরিবার বিচ্ছিন্ন প্রবীণদের নিয়ে ফিচার লিখবেন। অথচ পত্রিকা প্রকাশের পর দেখলাম অনেক অতি সত্য কথা বন্ধুটি চেপে গিয়েছেন। বৃদ্ধাশ্রমের একজন প্রায় পঁচাত্তর বছরের সাবেক আমলার সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। সাক্ষাৎকারের ফাঁকে আমি ঐ বৃদ্ধার কাছ থেকে জেনেছিলাম পত্রিকার পাতায় অপ্রকাশিত তাঁর কথাগুলো। ভদ্রলোক কৃষকের সন্তান। কৃষক পিতা ও ভাইদের সহায়তায় মেধাবী ছাত্র হিসেবে প্রাইমারি, মাধ্যমিক কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করার পর জেলা শহরের কলেজে ভর্তি হন। উচ্চ মাধ্যমিকেও ভালো রেজাল্টের পর ঢাকায় এসে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সম্পূর্ণ অপরিচিত ঢাকায় এসে ওঠেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে। অনার্স-মাস্টার্সেও ভালো রেজাল্ট করে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে যোগ দেন সিভিল সার্ভিসে। জেলা শহরে এবং ঢাকায় পড়াশোনার সমস্ত খরচ পরিবার থেকে নিয়মিত জোগান দেয়া হত তাকে। তার ভরণ-পোষণসহ সমস্ত ব্যয়ভার বহন করেছে দরিদ্র কৃষক পরিবার। ঈদ-পার্বণে সেও পরিবারের কাছে ছুটে যেতেন। নিয়মিত পত্রালাপে যোগাযোগ ছিল। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের পর তার ঊর্ধ্বতন এক আমলার মেয়েকে বিয়ে করে পরিবার থেকে স্থায়ী বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। শুরুতে কৃষক ভাইয়েরা তার বাড়িতে এলে সবার অলক্ষ্যে কিছু অর্থ প্রদান করে মূল ফটক থেকেই বিদায় করতেন। এতে ভাইয়েরাও তীব্র অভিমানে তাকে ভুলে যায়। তিনিও আর গ্রামে কিংবা পরিবারে ফিরে না গিয়ে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে পৃথক ভুবন গড়ে তোলেন। এক ছেলে এক মেয়ের পিতা তিনি। ছেলে বউসহ অস্ট্রেলিয়ায়। আর ডাক্তার মেয়ে স্বামীর সঙ্গে কানাডায়। স্ত্রী মারা যাবার পর অস্ট্রেলিয়া এবং কানাডা দুই দেশেই সন্তানদের আশ্রয়ে থাকার অভিপ্রায়ে দেশত্যাগ করেছিলেন। কিন্তু ছেলে-মেয়ে কেউ তাকে বেশিদিন বহন না করে দেশে পাঠিয়ে দেয়। এবং পিতার প্রতি সন্তানের কতর্ব্যরে তাগিদে এই বৃদ্ধাশ্রমে ভর্তি করে দেন। ভদ্রলোক পেনশন পেতেন। কিন্তু পেনশনের টাকা উঠানোর ঝামেলায় সন্তানদের পরামর্শে এককালীন পেনশন বিক্রি করে দেন। ঐ টাকা ব্যাংকে গচ্ছিত। ব্যাংকের সুদের টাকায়ই এই বৃদ্ধাশ্রমের ব্যয় মেটানো হয়। ছেলে-মেয়েরা তাদের সময় সুযোগে ফোনে খোঁজ নেয়। তবে মাসে একবারের অধিক নয়। গ্রামের ভাই-বোন আত্মীয় স্বজনদের সংবাদ কি? জানতে চাইলে ভদ্রলোক অত্যন্ত নির্লিপ্ত ভাবে বলেছিলেন, ‘ওদের সংবাদ নেবার মুখ যে আমার নেই। নয়তো এই দুঃসময়ে ওরাই হতে পারতো আমার অবলম্বন। আমি ভুল করেছি। ভুল নয়, মহাভুল করেছি।’ ভদ্রলোকের স্বীকারোক্তিতে অনুশোচনা থাকলেও এখন তাকে জীবনের অবশিষ্ট সময় এখানেই একাকী কাটাতে হবে। শ্রেণি উত্তোরণে নিজ পরিবার পিতা, মাতা, ভাই, বোনদের পরিত্যাগ করতে দ্বিধা করেননি। সমশ্রেণির পরিমণ্ডলে বৈবাহিক সূত্রের নতুন আত্মীয় এবং অনাত্মীয়রা পরম আত্মীয় হয়ে উঠেছিল। আজ এই বৃদ্ধ বয়সে তিনি অনুশোচনা করেছেন বটে তবে যে কৃষক পিতা ও ভাইদের কষ্টার্জিত অর্থে তার শিক্ষালাভ এবং সমাজে মর্যাদাকর প্রতিষ্ঠা লাভ ঘটেছে। শ্রেণি পরিবর্তনে তিনি ১৮০ ডিগ্রি পাল্টে গিয়েছিলেন। তার প্রতি আমার কিন্তু সামান্য সহানুভূতি কেন যেন হয়নি। বরং ধিক্কার এসেছিল। আমার সংবাদকর্মী বন্ধু পুরো ঘটনা শুনলেও তার প্রতিবেদনে এসকল কথা উল্লেখ না করে বৃদ্ধাশ্রমে থাকাদের একাকীত্বের কষ্টের কথাই লিখেছিলেন। অথচ শ্রেণিগত কারণে এরা স্বজ্ঞানে পরিবার-নিকটআত্মীয় স্বজন থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে সমশ্রেণিতে জীবনভর মেতে ছিলেন। তাদের পরিণতির দায় যে প্রকারান্তরে তাঁদের কৃতকর্মের ওপরই বর্তায়। বন্ধুটির রচনায় তার বিন্দু-বিসর্গও ছিল না। একটি বৈষম্যপূর্ণ সমাজের এ সমস্ত চিত্র বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা বলা যাবে না। বৈষম্যই বিচ্ছিন্নতার ক্রমাগত জন্ম দিচ্ছে। সমাজে-পরিবারে এই যে অবিরাম বিচ্ছিন্নতা ঘটছে। তার প্রধান কারণ বৈষম্য। অবিরাম এই বৈষম্যে ব্যক্তি-পরিবার আরো বিচ্ছিন্ন হবে। শ্রেণি সমতা ব্যতীত বৈষম্যপূর্ণ সমাজে সকল সম্পর্কই তার আবেগ-আবেদন হারিয়ে চলেছে। এমন কি আমাদের সমাজ বাস্তবতায় ব্যক্তিপ্রেম-ভালবাসাও শ্রেণি ঊর্ধ্বে নয়। অসম শ্রেণি অবস্থানের কারণে ব্যক্তিপ্রেমও সফল হয় না। আমাদের সাহিত্যে– রূপকথায় বিত্তবান ও বিত্তহীনের প্রেম-ভালোবাসার শুভ পরিণতির নানা কাহিনী থাকলেও বাস্তবে তেমনটি ঘটে না। অতি নগণ্য অমন ঘটনা ঘটলেও সেটা কাকতালীয় বিচ্ছিন্ন ঘটনা মাত্র। প্রত্যেক মানুষই শ্রেণি সচেতন। শ্রেণিস্বার্থ ত্যাগ করা কারো পক্ষে সম্ভব হয় না। সাহিত্যে, গল্প, উপন্যাসে শ্রেণি ত্যাগের ঘটনা থাকলেও, বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিহীন। শ্রেণি বৈষম্যই মানুষে মানুষে বিচ্ছিন্নতার সৃষ্টি করে আছে যুগ-যুগান্তর ধরে। এখন সেটা ক্রমেই আরো তীব্রতর হয়ে পড়েছে। একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, প্রতিবেশী প্রায় সমশ্রেণির এক পরিবারের সঙ্গে আমাদের পারিবারিক সখ্য ছিল। ঐ পরিবারের মেয়েরা সবাই বড় এবং ছেলে দু’জন খুবই ছোট। তারা আমার বোনদের সঙ্গে একই স্কুলে-কলেজে পড়তো। তাদের পিতার পক্ষে অফিস কামাই করে দীর্ঘ লাইন ধরে রেশন তোলা, কেরোসিন তেল আনা, ন্যায্যমূল্যের দোকান থেকে সওদা আনা সম্ভব ছিল না। সদ্য স্বাধীন দেশে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য-সামগ্রীর চরম আকাল তখন। কাকভোরে লাইনে দাঁড়িয়ে ছয়-সাত ঘণ্টা পর রেশন নিয়ে ফিরতে পারতাম। আমার বোনের অনুরোধে ঐ পরিবারের সাপ্তাহিক রেশন, কেরোসিন তেল, ন্যায্যমূল্যের দোকানের সওদা আমাদের সঙ্গে একত্রে আনার অনুরোধে রাজি হয়ে যাই। সপ্তাহের রেশন একত্রে তুলে কুলি দিয়ে তাদেরগুলো তাদের বাসায় এবং আমাদেরগুলো সঙ্গে নিয়ে বাসায় ফিরতাম। এভাবে কেটে গেছে বেশ ক’বছর। বিনিময়ে তাদের ভালোবাসা যে পাইনি তা নয়। যথেষ্ট স্নেহ করতেন। উৎসব পার্বণে, এমন কি বাড়িতে ভালো রান্না হলে ডেকে নিয়েও খাওয়াতেন। পরবর্তীতে তারা নতুন ঢাকায় চলে যায় এবং আমাদের সঙ্গে ক্রমেই দূরত্ব বেড়ে যায়। ওই পরিবারের মেয়েদের প্রত্যেকের খুবই প্রতিষ্ঠিত পাত্রের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে। অনেকদিন পর তাদের বাড়িতে গেলে প্রায় সব বোন ও বোনের স্বামীসহ দেখা। আমাকে দেখামাত্র বোনেরা প্রত্যেকে স্বামীর উদ্দেশে বলে ওঠেন– বলেছিলাম না আমাদের রেশনসহ আনুষাঙ্গিক অনেক কাজ করে দিত। সেই ব্যক্তিই ইনি। আমি লজ্জায় চমকে উঠি তাদের কথায়। বৈবাহিক সূত্রে তাদের শ্রেণি উত্তোরণ ঘটেছে সন্দেহ নেই। তাই বলে পূর্বেকার সমশ্রেণির আমাকে জমিদার বাড়ির বাজার সরকার রূপে পরিচয় করিয়ে দেয়া কেন? হাসি পাচ্ছিল এবং দুঃখও হচ্ছিল। কিছুটা সময় ভদ্রতায় কাটিয়ে এক ফাঁকে উঠে পড়ি। নিজেদের সম্ভ্রান্ত শ্রেণি মর্যাদা প্রকাশের হাস্যকর বিষয়টি ফেরার পথে আমাকে বিস্মিত না করলেও, হাসিয়ে ছিল। সমাজের শ্রেণি বৈষম্য অবসানের একমাত্র উপায়টি হচ্ছে সমাজে শ্রেণি সমতা প্রতিষ্ঠা। যেটি একমাত্র সমাজ বদলেই সম্ভব। অন্য কোনো ভাবে সম্ভব নয়। আমাদের রাষ্ট্র, সমাজ পুঁজিতান্ত্রিক পথ অনুসরণে দ্বিধাহীনভাবে ছুটছে। পুঁজিবাদ মানুষে মানুষে বৈষম্য এবং বিচ্ছিন্নতার জন্ম ও বিস্তার ঘটিয়ে চলেছে। কাজেই পুঁজিবাদকে চিহ্নিত করা অসহজ নয়। এই পুঁজিবাদী অপব্যবস্থা নির্মূলে একমাত্র পথটি হচ্ছে বিদ্যমান ব্যবস্থা পরিবর্তনে সমাজ বিপ্লব সংঘটিত করা। সেটা যতদিন সম্ভব না হবে অবস্থার আরো অবনতি ঘটবে। পুঁজির শোষণের যাঁতাকলে আমরা আরো পিষ্ট হবো। সমষ্টির বিপরীতে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার যে তীব্র জোয়ার লক্ষ্য করা যাচ্ছে। একে এখনই রোখা সম্ভব না হলে আমাদের সমাজে সামাজিক সম্পর্ক, বিধি-ব্যবস্থা, আচার কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। বৈষম্য আরো তীব্রতর হবে। বৃদ্ধি পাবে বিচ্ছিন্নতা। বৈষম্য এবং বিচ্ছিন্নতা একে অপরের কেবল নিকটবর্তী নয়, বাহুলগ্নও বটে। লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..