
গত কয়েক দশকে দক্ষিণ এশিয়ার সাহিত্যে বহু জোরালো নারীবাদী কন্ঠস্বর উঠে এসেছে, তবু ইসমত চুঘতাই (১৯১১-১৯৯১)-এর সাহিত্য আজও একইরকম মুগ্ধ করে, তার একটা অন্যতম কারণ তাঁর অকপট ও তীব্র ভাষা যা পাঠকদের অস্বস্তিতে ফেলে আর ভাবায়ও। উর্দু ভাষার কথাসাহিত্যিক ইসমত চুঘতাই-এর লেখা বহুল পঠিত, চর্চিত এবং প্রশংসিত। ভারতের প্রথম সারির প্রগতিশীল সাহিত্যিকদের মধ্যেও ইসমত উজ্জ্বল একটা স্থান দখল করে আছেন। তিনি লিখেছেন উপন্যাস, নাটক, চলচ্চিত্রের স্ক্রিপ্ট, আরও অনেক কিছুই, তবে প্রায় নিঃসংকোচে বলা যায়, তাঁর লেখা ছোট গল্পগুলো বুকে ধারণ করে আছে সবচেয়ে বেশি উষ্ণতা, কথোপকথনের হাতছানি আর একটা গভীর, নিমগ্ন দেখা। তাঁর গল্পের চরিত্রগুলোতে রয়েছে অনেক সূক্ষ্ম-জটিল বৈশিষ্ট্য। আর নারী চরিত্রগুলোতে, পড়ে মনে হয়, রয়েছে বাড়তি একটু যত্নের ছাপ। তাদের পায়ের গোছ, হাতের মেহেন্দি থেকে রাস্তায় কিতকিত খেলার সময়ে আলুথালু বুকের আঁচল, সবই মনে হয় আসলে নিজেকেই দেখা। অথবা অনেকের ভেতর নিজেকে দেখা। নিজের অনেকখানি অন্যের থেকে ধার করা। আসলে সকলে মিলে একটাই চরিত্র– নারী আর তার আকাঙ্ক্ষা।
ইসমতের লেখায় আমরা এমন কিছু নারী চরিত্রকে দেখি যারা সমাজের ঠিক করে দেওয়া এসব বিধি-নিষেধের খুব একটা তোয়াক্কা করে না। ‘ঘরওয়ালি’ নামের গল্পটিতে লাজো অথবা লাজবন্তী মধ্যবয়সী মির্জা সাহেবের বাড়িতে ঘর গেরস্থালির কাজে বহাল হয়, অথচ তার নিজের পরিবার, বাবা-মা অথবা আত্মীয় পরিজনের খোঁজ তার কাছে ছিল না, এমনকি নিজের ধর্মটাও জানত না সে। সে কেবলই জানত তার শরীরটা মূল্যবান, যার আকর্ষণে মানুষ তার কাছে আসে। সে মির্জা সাহেবের পুরোনো বাড়িটাকে ভালোবেসে ফেলে মাথার উপর একটা স্থায়ী ছাদ পাবার আশায়, অথচ যখন মির্জা তাকে বিয়ে করে সেই বাড়ির গৃহিণী করেন, তখন সে হাঁফিয়ে ওঠে। অবিবাহিত মির্জা হুসনা জাহানের কাছে মধ্যরাতে গান শুনতে গেলে সে ঈর্ষান্বিত হয় অথচ মির্জার সাথে বিয়ের পর মিঠুয়ার লুকিয়ে থাকা চোখকে দেখিয়ে দেখিয়ে স্নান করতে তার ইচ্ছা যায়। এর কোনোটাই তৎকালীন সমাজের বেঁধে দেওয়া ‘ভালো মেয়ে’-র চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নয়। আর লাজো ভালো মেয়ে হতে চায়ওনি কোনোদিন। আবার ‘চৌথী কা জোড়া’ গল্পে আমরা পড়ি দুই বোন হামিদা ও কুবড়া এবং তাদের মায়ের কথা, যাদের লক্ষ্যই ছিল রাহাত নামের ছেলেটিকে নিজেদের কানের গয়না, পায়ের পায়জোড় বিক্রি করে হলেও তোয়াজ করতে হবে, তাকে খাইয়েদাইয়ে সন্তুষ্ট করতে হবে যাতে সে কুবড়াকে স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করার মহানুভবতা দেখায়। আর হামিদার চোখে একদিন ধরা পড়ে যায় যে কীভাবে তার দিদি কুবড়ার “ওই হাত সেতারের গত বাজাতে পারবে না। মণিপুরি আর ভরতনাট্যমের মুদ্রা দেখাতে পারবে না, ওই হাত দু-টিকে পিয়ানোর সুরে নাচতে শেখানো হয়নি, ফুল নিয়ে খেলার সৌভাগ্য ও দু-টি হাতের হয়নি, তবে ওই হাত তোমার শরীরে চর্বি চড়ানোর জন্য সকাল থেকে সন্ধ্যা সেলাই করবে, সাবান আর সোডার মধ্যে ডুবে থাকবে, উনুনের আঁচ সহ্য করবে। তোমার নোংরাময়লা ধুয়ে দেবে, যাতে তুমি ফিটফাট ফুলবাবুর মতো বুক ফুলিয়ে গটগট করে হেঁটে যেতে পারো।”
তাতে যেমন কোনো এক অলীক স্বপ্নের মতো এক সম্ভ্রান্ত সচ্ছ্বল স্বামী লাভের প্রত্যাশায় একটি মেয়ের জীবন নিঙড়ে দেওয়া অসম্মানের শ্রমের ভার হামিদার কাছে বড্ড ভারি হয়ে ওঠে, তেমনই মির্জা সাহেবের সাথে বিয়ের পর লাজোর জীবন লেহেঙ্গার স্বাচ্ছন্দ্য থেকে হিজাব-ওড়না-পায়জামার ভারে চাপা পড়ে লাজো থেকে কানীজ ফতিমা বেগম হয়ে ওঠার জন্য পালটে যেতে থাকে অনিচ্ছায়, তার যে শরীর নিয়ে তার কোনো ছুঁতমার্গ ছিল না, ছিল না জেনেই মির্জাও তার প্রতি আকর্ষিত হয়েছিলেন, তারই উপর হঠাৎই চেপে বসতে থাকে বেআব্রু, বেশরম জাতের ভারি ভারি অপবাদ। কুবড়া আর লাজো, সমাজের দুই আলাদা স্তরের দুই নারীর জীবনে যা কিছু পরিবর্তন, তা শুধুমাত্র অন্য কারো স্ত্রী হতে চাওয়ার অথবা না চাওয়ার মাসুল, যাতে তাদের নিজস্ব ইচ্ছার মূল্য ছিল সামান্যই।
আর শেষ অবধি কুবড়া আর লাজো, দুজনেরই গল্পের শেষ হয় একটি আলিঙ্গনে। কুবড়ার ক্ষেত্রে তার আলিঙ্গন লাভ করে মৃত্যু আর লাজোর ক্ষেত্রে সে শেষ পর্যন্ত তালাক পায়, ঘরের বৌয়ের অভিনয় করার ভার থেকে মুক্তি হয় তার আর আবারও মির্জা সাহেব তাকে রান্নাঘরের মেঝে থেকে তুলে নিজের ঘরে নিয়ে যাওয়ার সঠিক অধিকার লাভ করেন, যখন লাজোর একটি হাত তার গলা জড়িয়ে ধরে। এর থেকে বেশি কিছু লাজো কখনো তাঁকে দেবে বলে প্রতিশ্রুতিও দেয়নি, বরং এর চেয়ে কমেই সে নিজেকে সমর্পণ করেছিল, শুধু সে একনিষ্ঠ প্রেমিক বা ‘ঘরেলু ঔরত’ হতে পারেনি, কারণ সে তা হতে চায়নি। ইসমত লিখেছেন সেই জোরালো ‘না চাওয়ার’ কথাই।
১৯৪২ সালে লাহোরের একটি লিটল ম্যাগাজিন ‘আদাব-ই-লতিফ’-এ ইসমতের একটি ছোট গল্প প্রকাশিত হয় যার নাম ‘লিহাফ’, পরবর্তীতে বাংলায় ‘লেপ’ নামে অনুদিত হয়েছে এই বিখ্যাত গল্পটি। এই গল্পটির জন্য ইসমতের নামে মামলা দায়ের হয় আদালতে, অপরাধ স্বাধীনতা পূর্ববর্তী ভারতে প্রথম নারীর সমকামিতার বিষয়ে কথা বলা। পরবর্তীতে নিজের আত্মজীবনী ‘ইসমত: হার লাইফ, হার টাইমস’ বইতে তিনি গল্পের বেগমজানের সঙ্গে বাস্তবে সাক্ষাতের কথা বর্ণনা করেন। তিনি বলেন- এই গল্প সত্য ঘটনার থেকে অনুপ্রাণিত, নাহলে তিনি এই গল্প লিখতে পারতেন না। গল্পটিতে স্বামীর শরীর ও প্রেমবর্জিত বেগমজান কেমন করে বিকল্প জীবন ও যৌনতা খুঁজে নেন, তার কথাই রয়েছে। অল্পবয়সী বেগমজানকে বিয়ে করে এনে তার কথা ভুলেই গেলেন নওয়াব সাহেব। কারণ তিনি ছিলেন বয়স্ক হাজি মানুষ। বেগমজানের বহু তাবিজ কবচ টোটকাতেও যখন তাঁর মন ঘুরল না তার দিকে, তখন নিজের চাহিদা, বাসনা নিয়ে একাকীত্বে মরতে মরতে বেগমজানের দিন কাটতে লাগল পর্দার আড়াল থেকে কমবয়সী ছেলেদের সুঠাম দেহ দেখে দেখে। ইসমতের বিভিন্ন গল্পে আমরা পড়ি যে অনায়াসেই কোনো একটি মেয়ে আকর্ষিত হয় অন্য পুরুষের দিকে, আর সেটা নিয়ে তেমন সঙ্কোচও থাকে না তাদের। বেগমজান কিন্তু তা করেননি, বরং তাঁর জীবনে আনন্দ আবার ফিরে আসে পরিচারিকা রব্বুর সাহচর্যে। আর এখানেই এই গল্পটা এক আলাদা মাত্রা পায়, এ কারণেই এই গল্প নিয়ে ওঠে এত ঝড়। শুধুমাত্র বেগমজান আর রব্বুর দৈহিক বর্ণনার বৈপরীত্যের মধ্যেই ইসমত তাদের সম্পর্কের যে তীক্ষ্ণ সাহসী ইঙ্গিত দেন, তা তৎকালীন রক্ষণশীল সমাজের পক্ষে যথেষ্ট বড় ধাক্কা ছিল। আর এদের দুজনকে আমরা দেখি এক কিশোরীর চোখে, যে বেগমজানের কাছে কয়েকদিনের জন্য থাকতে গিয়েছিল। এর মধ্যেই বেগমজান আর রব্বুর মধ্যে অদ্ভুত এক সম্পর্ক সে লক্ষ্য করে, যে সম্পর্কের ইঙ্গিত আমরা কেবলই পাই দেওয়ালে পড়া লেপের ছায়ায়, যে লেপের মধ্যে নাকি হাতি আটকা পড়েছে মনে হয়। কখনো কখনো বেগমজান আর রব্বুর মধ্যে বনিবনা হয়ও না, আর তখনই মেয়েটিকে বেগমজানের আলিঙ্গনে ধরা দিতে হয়, বদলে সে পায় মিষ্টি, পুতুল, খেলনার আশ্বাসও। তার হাত বেগমজান রাখে নিজের শরীরের গোপন জায়গায়, যেসব জায়গায় রব্বু ছাড়া আর কারো হাত অনায়াসে পৌঁছে যেত না। তাকে নিয়ে সে ইচ্ছামতো খেলা করতে থাকে, এসবই ঘটতে থাকে মেয়েটির অনিচ্ছায়। এরপর থেকেই মেয়েটি এড়িয়ে চলতে থাকে বেগমজানকে। এমনকি, “এখন তার কাপড়চোপড় ছাড়া দেখে আমার বমি আসতে লাগল।”
অথচ এই মেয়েটিও অল্পদিন আগেই লুকিয়ে লুকিয়ে দেখত বেগমজানের উন্মুক্ত ঊরু, তাতে নিষিদ্ধতার স্বাদ পেতে ভালোই লাগত তারও। আবার মেয়েটি এও বলে যে তার মা তাকে ছেলেদের সাথে খেলতে দিতে চায় না, অথচ দেখা যায় এই বেগমজানের মতো মানুষেরা, আসলে যাদের কেউ সন্দেহ করে না, যারা কাছের মানুষ, তারাই একটি শিশুকে অথবা কিশোরকে বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে, ঘনিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে হেনস্থা করে, এই মেয়েটির মতোই ভিক্টিমরা সে-কথা কাউকে জানাতে পারে না—
“বেগমজানকে আমার এতটাই ভয় করতে লাগল যে সারাদিন চাকরানিদের পাশে পাশে ঘুরঘুর করতে থাকলাম। কিন্তু তাদের ঘরে পা রাখতেই দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়। কাকেই বা বলব, কী বলব। বেগমজানকে ভয় পাই, তওবা। বেগমজান তো আমার জন্য জান দিতে প্রস্তুত।”
এই গল্পটা তৎকালীন সমাজের মাপকাঠিতে অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত হয়েছিল সমকামিতার জন্য, সময়ের সাথে সাথে অশ্লীলতার সংজ্ঞা বদলায় তাই আজ এই গল্পটাকে আমরা ‘সাহসী’ আখ্যা দিই। বেগমজান এই গল্পে সামাজিক নিয়মের শিকার হয়ে অবদমিত যৌনতার ভারে চাপা পড়তে পড়তে বেছে নেন নিজের যৌনতার স্বাধীনতা, কিন্তু অন্যদিকে একইরকম গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রাসঙ্গিক যে কথা এই গল্পের কেন্দ্রে রয়েছে তা হল তাঁর হাতে ঐ কিশোরীর যৌন-নিপীড়নের কথা। গল্পের শেষে ঘরের আলোর স্যুইচটা টিপে দেওয়ার মধ্যে সেই কিশোরীর সঞ্চয় করা কিছুটা সাহসের আভাসও আমরা পাই। আজও ভারতবর্ষের সমস্ত বয়সের মেয়েরাই অনেক ক্ষেত্রে যার শিকার, ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের দ্বারা হেনস্থার। ভাবতে অবাক লাগে যে প্রায় আট দশক আগেও ইসমত সেই একই অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন।
আবার ‘পেশা’ গল্পটিতে আমরা পড়ি এক শিক্ষিকার গল্প, যিনি বারাঙ্গনাদের মনেপ্রাণে ঘৃণা করতেন, এমনকি গায়ের গন্ধেই তাদের চিনে নিতে পারতেন। ছোটবেলায় তাঁর মায়ের বয়সী এক বারাঙ্গনার স্নেহস্পর্শ তাঁর একটা ঘৃণ্য স্মৃতি হিসাবে মনে আছে, আর এই ঘৃণার চেতনা যে তৎকালীন সমাজের এবং তার বেড়াজালে থাকা পরিবারের মস্তিষ্কে গেঁথে দেওয়া, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। এই শিক্ষিকার বাড়ির উপরতলাতেই থাকেন এক নারী, যাকে তাঁর বারাঙ্গনাই মনে হয়। ঘৃণা করা সত্ত্বেও তিনি একদিন তার বাড়িতে যান, তার বাড়ির মজলিসে যোগ দেন। অবশ্যই নিজেকে বাঁচিয়ে জড়োসড়ো হয়ে ঘরের এক কোণে তিনি ছিলেন বসে, কিন্তু ওই জগতটার সাথে পরিচিত হওয়ার কিছুটা কৌতূহলও কি তাঁর ভেতরে ছিল না কোনো নিষিদ্ধ জিনিস চেখে দেখার মতোই? তারপর সেখান থেকে তিনি বেরিয়ে আসেন, আবার ঢুকে পড়েন নিজের জগতে, যেখানে ছাত্রদের পরীক্ষার খাতা দেখতে দেখতে বারেবারে তিনি নিজেকেই মনে করিয়ে দেন তাঁর মহান পেশার মাহাত্ম্য। অথচ তারই মধ্যে তাঁর মনে জাগে মমত্বও, মনে হয় হয়তো বারাঙ্গনারা নিজের ইচ্ছায় এই পেশায় আসে না, তাদের কেউ বাধ্য করে, হয়তো পেটের দায়ে তাদের এই পেশা চালিয়ে যেতে হয়। কখনো তাঁর নিজেকে মনে হয় হেরে যাওয়া, জৌলুসহীন এক মানুষ উপরতলার সেঠানীর সামনে। কখনো তাঁর নিজেকেই ভয় হয় যে এই সেঠানীদের সংস্পর্শে থাকলে হয়তো তাঁর ‘বিশুদ্ধতা’ আর বেশিদিন বজায় রাখা সম্ভব হবে না। এমনকি এক সময় এই সম্ভ্রান্ত, শিক্ষিত মেয়েটির, যে শরীরের পবিত্রতা সম্পর্কে অতি সচেতন, তাঁর জবানিতে ইসমত লেখেন, “সম্ভ্রান্ততা, সতীত্ব কিংবা পবিত্রতার ডিমগুলি যদি তুমি তোমার ডানার তলায় রেখে দাও তাহলে কী তারা একদিন ময়ূর হয়ে ফুটে বেরোবে? কিন্তু বিধির বিড়ম্বনা হল এই ডিমে তা দিয়ে ফুটিয়ে তোলার জন্য কেউ তোমাকে কোনও কৃতিত্ব দেবে না। কোনও রমণী আমৃত্যু পবিত্র থাকলে রাষ্ট্র তার জন্য কাঁচকলা করবে।”
ভাবতে অবাক লাগে যে কী সহজে অথচ তীক্ষ্ণতার সাথে ইসমত আক্রমণ করেছেন সমাজ-নির্মিত সতীত্বের ধারণাকে যার দায় নাকি নারীর একারই। আর এই সীমারেখার দুই পারে দাঁড়িয়ে থাকে সমাজের ‘ভালো’ এবং ‘খারাপ মেয়েরা’। যাদের কাছে প্রত্যাশিত যে তারা পরস্পরের সম্পর্কে সহমর্মী না হয়ে শত্রু হয়ে উঠবে। গল্পটার নাম ‘পেশা’-ও এ কারণেই তাৎপর্যপূর্ণ যে গণিকাবৃত্তি আসলে পৃথিবীর আদিমতম পেশা, বাকি সমস্ত পেশার মতোই, অথচ যাকে নিয়ে সমাজ চিরকাল ফতোয়া দিয়েছে, নিদান দিয়েছে বিভিন্ন, অথচ মেয়েগুলিকে সুরক্ষা দিতে পারেনি। এই গল্পের শেষ দিকে তাই শিক্ষিকা সেঠানীর সাথে নিজের মিলগুলোই বেশি করে লক্ষ্য করতে থাকেন। আর শেষে যখন জানতে পারেন সেঠানী আসলে এক অভিজাত সম্ভ্রান্ত পরিবারের নারী, তখন নিজের ভ্রান্ত ধারণা, অহেতুক সন্দেহ ও ঘৃণায় ভরা রূপটা তাঁর নিজের কাছেই পরিস্কার হয়ে ওঠে, আর তাঁর মনে হয়–
“আর এর প্রায়শ্চিত্ত করা যেন সম্ভবই নয় আমার দ্বারা”।
তখনই আমরা দেখি কীভাবে সমাজ মেয়েদেরকে কিছু নর্ম তৈরি করে দেয়, যা তাদের একজোট হতে বাধা দেয়। যা তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী করে তোলার চেষ্টা করে, সেও নিজেদেরই স্বার্থে।
আবার ‘তিল’ গল্পটিতে রাণি নামক মেয়েটি ছবি-আঁকিয়ে চৌধুরিকে গর্বের সাথে দেখায় তার বুকের কাছের সুন্দর তিলটি, আর নিঃসংকোচে বর্ণনা করে কেমন করে সে পুকুরে ডুবে যাওয়ার নাটক করেছিল কেবল রতনকে তিলটি দেখানোর জন্যই, আর কেমন করে তাকে চুনান গুড়ধানী খাওয়ানোর লোভ দেখিয়ে ডাকলেই সে সেখানে যায় আর ভরা আদালতে দাঁড়িয়েও সে জোর গলায় স্বীকার করে তার সন্তানের বাবা কে- রতন না চুনান, সে জানে না। ইসমতের বিভিন্ন লেখায় এভাবেই যৌনতা ব্যবহার হয়েছে একটা অস্ত্র হিসাবে, যা নিয়ে সাধারণত মেয়েদের বেশি কথা বলাকে কখনোই ভালো চোখে দেখা হয়নি।
ইসমত প্রগতিশীল লেখক সঙ্ঘে যুক্ত হন ১৯৪০ সালের কাছাকাছি সময়ে, তার বেশ কিছুদিন আগেই প্রকাশিত হয়েছে ‘অঙ্গারে’ নামক বইটি, যা এলোমেলো করে দিয়েছে সাহিত্য রচনার বহু সমীকরণ এবং গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে ইসমতকে। আপশোষ যে, ইসমত চুঘতাইয়ের কয়েকটি গল্প নিয়েই বারেবারে গবেষণাভিত্তিক কাজ হয়েছে বা সেইগুলোর সঙ্গেই আমরা বেশি পরিচিত। তাঁর অন্যান্য গল্পে আছে দেশভাগের কথা অথবা ‘কাফের’-এর মতো গল্পে আছে দুই ভিন্ন ধর্মের মানুষের মধ্যে এক নিখাদ প্রেমের গল্প, যার সুর তাঁর বেশিরভাগ গল্পের থেকে একটু আলাদা, এ কথা বলতেই হয়। আমি আশা করি, তাঁর কম পঠিত লেখাগুলোও আমরা আরো বেশি করে পড়ব, আলোচনা করব এবং তাঁর নারী চরিত্রদের রাজনীতিকে যতটা সম্ভব আত্মীকরণ করব, যার মূল সুরে আছে নারীর পরস্পরের প্রতি সহমর্মিতা, সহযোদ্ধা হিসেবে একে অপরের কাছে অঙ্গীকার আর বন্ধুত্ব, যা আমাদের নিজেদের চাহিদার, আকাঙ্ক্ষার ও লড়াইয়ের, ক্ষতের কথা জোর গলায় বলতে ও গর্বের সাথে ধারণ করতে উৎসাহ দেয়, কারণ তাঁর সময়ের থেকে প্রায় আশি বছরেরও বেশি পরে এসেও আজও আমরা একই প্রতিপক্ষদের সাথে লড়ে চলেছি, হাতে হাতিয়ার হয়তো কয়েকটা বেড়েছে, কিন্তু পায়ের নিচের রাস্তা এখনো রয়েছে একইরকম রুক্ষ।