
সুবিধাবাদের বিরুদ্ধে কাল মার্কস
ও ফ্রেডরিক এঙ্গেলস
[শ্রমিক শ্রেণির মুক্তি আন্দোলন তথা কমিউনিস্ট আন্দোলনে সুবিধাবাদ, বিলোপবাদ ও সংস্কারবাদ নতুন কিছু নয়। আধুনা আমাদের দেশেও যেমন দেখা গেছে, তেমন অতীতেও এমনকি মার্কস-এঙ্গেলস্ যখন বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের বিপ্লবী মতবাদ নির্মাণ করছেন, তখনও তা দেখা গিয়েছিল। মার্কস-এঙ্গেলস্ তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলেন। জুরিখ থেকে হ্যেখবের্গে, বের্নস্তাইন ও শারাম তিনজন একটি প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন, যাতে শ্রমিকশ্রেণির বিপ্লবের মতবাদকে পরিত্যাগ করে একটি সংস্কারবাদী পার্টি করার প্রস্তাব ছিল। ইহাই জুরিখ ত্রয়ের ইস্তেহার নামে পরিচিত। সেখানে বলা হয়েছিল ‘চূড়ান্ত একপেশেভাবে শ্রমিক পার্টি’ করা চলবে না, বিপ্লবের কথা বলে বুর্জোয়াদের ভয় পাইয়ে দেয়া উচিত হবে না, ‘শিক্ষিত ও সম্পত্তিবান শ্রেণির মহল থেকেও বহু অনুগামী এসে যাবে... আন্দোলনকে সুস্পষ্ট সাফল্য লাভ করতে হলে... আগে এদেরই পক্ষে টেনে আনতে হবে।’ শ্রমিক শ্রেণির নতুন ধরনের বিপ্লবী পার্টির ভিত্তি, মতাদর্শ ও গঠন প্রণালী পরবর্তীতে লেনিন সুনির্দিষ্ট করলেও মার্কস-এঙ্গেলস সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে শ্রমিকশ্রেণির বিপ্লবী পার্টির রূপরেখা দিয়ে গিয়েছিলেন। জুরিখ ত্রয়ীর ইস্তেহারের সমালোচনা করে মার্কস-এঙ্গেলস আ. বেবেল, ড. লিবক্লেখত, ড. ব্রাক প্রমুখের কাছে যে পত্র লেখেন (লন্ডন থেকে ১৭-১৮ সেপ্টেম্বর ১৮৭৯ সাল) তা সার্কুলার পত্র নামে ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে রয়েছে। এই পত্রে মার্কস-এঙ্গেলস বিপ্লবী বিরোধী-সংস্কারবাদী ঐ সকল ভদ্রলোকদের (জুরিখ ত্রয়ী) কড়া সমালোচনা করে লিখেছিলেন তা এখনও বিপ্লবী পার্টি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক হতে পারে। তারা লিখেছিলেন–]
‘...এই ভদ্রলোকরা বুর্জোয়া পেটিবুর্জোয়া ভাবধারায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত। ...নিজেদের নিয়ে একটি সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পেটি-বুর্জোয়া পার্টি করার সম্পূর্ণ অধিকার এই ভদ্রলোকদের আছে। তখন তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করা যেতে পারে, অবস্থা অনুযায়ী জোট গঠন করাও যেতে পারে ইত্যাদি। কিন্তু শ্রমিকশ্রেণির পার্টিতে এরা হলেন ভেজাল বস্তু। ...এই প্রবন্ধের লেখকদের (অর্থাৎ জুরিখ ত্রয়ী) পার্টির অভ্যন্তরে থাকা পার্টি এখনও কিভাবে সহ্য করে যেতে পারে সেটা আমাদের বুদ্ধির অগম্য।...
আমাদের কথা বলতে গেলে বলতে হয়, আমাদের সমগ্র অতীত বিবেচনা করে আমাদের একটি পথই খোলা রয়েছে। প্রায় চল্লিশ বছর ধরে আমরা এই জোর দিয়ে আসছি যে, শ্রেণি সংগ্রামই ইতিহাসের আশু চালিকাশক্তি এবং বিশেষ করে বুর্জোয়া ও প্রলেতারিয়েতের মধ্যকার শ্রেণি সংগ্রাম আধুনিক সমাজ বিপ্লবের বিশাল চালক দণ্ডস্বরূপ। অতএব, যারা আন্দোলন থেকে শ্রেণি সংগ্রামকে বর্জন করতে চান, তাদের সঙ্গে সহযোগিতা করা আমাদের পক্ষে অসম্ভব। আন্তর্জাতিক যখন গঠিত হয়েছিল, তখন পরিষ্কার করেই আমরা এই রণধ্বনি সূত্রবন্ধ করেছিলাম, শ্রমিক শ্রেণির মুক্তি সাধন হওয়া চাই শ্রমিক শ্রেণির নিজের কাজ। অতএব, যারা খোলাখুলিই বলেন, নিজেদের মুক্ত করার মতো শিক্ষাদীক্ষা শ্রমিকদের নেই। উপর থেকে মানবদরদী বড় বুর্জোয়া ও পেটি বুর্জোয়াদের সাহায্যে তাদের মুক্ত করতে হবে, তাদের সঙ্গে আমরা সহযোগিতা করতে পারি না।’
রাষ্ট্র বিপ্লব প্রসঙ্গে ফ্রেডরিক এঙ্গেলস
[১৮৭১ সালের মহান প্যারী কমিউনের পতনের দুই দিন পর প্রথম আন্তর্জাতিক সাধারণ অধিবেশনে কার্ল মার্কস যে লিখিত ভাষণ দিয়েছিলেন, তা পরবর্তীতে ‘ফ্রান্সে গৃহযুদ্ধ’–এই শিরোনামে বই আকারে প্রকাশিত হয়েছিল। ১৮৯১ সালে প্যারি কমিউনের বিংশ বার্ষিকী দিবসে গ্রন্থটির পুনঃপ্রকাশের সময় ফ্রেডারিখ এঙ্গেলস যে ভূমিকা লেখেন (তার আগেই মার্কসের মৃত্যু হয়েছিল), সেখানে থেকে কিছু অংশ নিচে উদ্ধৃত হলো। দেখা যাবে এই বক্তব্য এখনও এবং বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও কত প্রাসঙ্গিক।]
‘শুরু থেকেই কমিউন মানতে বাধ্য হল যে, ক্ষমতায় একবার এসেই শ্রমিক শ্রেণি পুরানো শাসনযন্ত্র দিয়ে কাজ চালাতে পারবে না, যে আধিপত্য শ্রমিক শ্রেণি সদ্য জয় করে নিয়েছে, তাকে আবার হারাতে না হলে একদিকে যেমন উচ্ছেদ করে দিতে হবে সকল সাবেকী নিপীড়ন যন্ত্রকে, এতকাল যা তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবহৃত হয়েছে, আবার অন্যদিকে তেমনই তাদের আত্মরক্ষা করতে হবে নিজেদের প্রতিনিধি ও সরকারি পদাভিষিক্তদের হাত থেকেও... এইসব (রাষ্ট্রীয়) সংস্থা আর তার যা শীর্ষ স্থানীয় সেই রাষ্ট্র শক্তি কালক্রমে নিজেদের বিশেষ স্বার্থ অনুসরণ করতে গিয়ে সমাজের সেবক থেকে রূপান্তরিত হল সমাজের প্রভূতে। এটা দেখা যায়, দৃষ্টান্ত স্বরূপ শুধু বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রের বেলায় নয়, সমভাবেই দেখা যাবে গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের ক্ষেত্রেও। খাস উত্তর আমেরিকাতে ‘রাজনীতিকরা’ জাতির ভিতর যেমন স্বতন্ত্র ও শক্তিশালী গোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে, তেমনটি আর কোথাও নয়। সেখানে যে দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল পাল্টাপাল্টি করে ক্ষমতায় আসীন থাকে, তাদের উভয়কেই আবার চালিত করছে গুটি কতক লোক, রাজনীতি নিয়েই যারা ব্যবসা করে, যারা কেন্দ্র ও বিভিন্ন রাষ্ট্রের বিধান সভাগুলির আসন নিয়ে ফটকা খেলে, কিংবা নিজ নিজ দলের হয়ে প্রচার চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে, এবং নিজ দল জয়লাভ করলে যাদের পুরষ্কার জোটে বড় বড় পদ। সবাই জানে যে, অসহ্য হয়ে ওঠা এই জোয়াল কাঁধের উপর থেকে ঝেড়ে ফেলে দেবার জন্য আমেরিকানরা গত ত্রিশ বৎসর ধরে কত চেষ্টাই না করেছে, অথচ তা সত্ত্বেও কীভাবে তারা ক্রমান্বয়ে দুর্নীতির পঙ্কে ক্রমাগত নিচে নেমে যাচ্ছে। ...এখানে আমরা দেখি রাজনৈতিকভাবে ফটকাবাজির দুটি বিরাট দল, পাল্টাপাল্টি করে তারা শাসনক্ষমতা দখলে রাখছে, আর সেই রাষ্ট্রশক্তির অপব্যবহার করছে সবচেয়ে দুর্নীতিভরা পদ্ধতিতে সবচেয়ে দুর্নীতিপূর্ণ উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য– আর সমগ্র জাতি শক্তিহীন দাঁড়িয়ে আছে রাজনীতিকদের এই দুটি বিরাট জোটের সম্মুখে, যারা বাহ্যত তার সেবক অথচ প্রকৃতপক্ষে তার কর্তা ও লুণ্ঠনকারী।
‘...রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবকিছুর প্রতি এক সংস্কারাচ্ছন্ন ভক্তি সহজেই গেড়ে বসে, কারণ লোকে ছেলেবেলা থেকেই কল্পনা করতে অভ্যস্ত হয় যে, সমগ্র সমাজের সাধারণ ব্যাপার ও স্বার্থের দেখা-শোনা অতীতে যেভাবে হয়েছে, তাছাড়া অন্যভাবে হতে পারে না, অর্থাৎ সম্পন্ন হতে পারে একমাত্র রাষ্ট্রের মারফৎ আর তার মোটা পদে অধিষ্টিত কর্মচারীদের দ্বারা। তাই বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রের উপর বিশ্বাস মন থেকে দূর করে গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের নামে শপথ নিতে পারলেই লোকে ভাবে, খুব একটা সাহসিক অসাধারণ পদক্ষেপ গ্রহণ করল তারা। প্রকৃতপক্ষে কিন্তু রাষ্ট্র এক শ্রেণির হাতে অপর শ্রেণির নিপীড়ন যন্ত্রণা ছাড়া আর কিছুই না; বরং বস্তুত রাজতন্ত্রের বেলা যতটা গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের ক্ষেত্রে তার চাইতে কিছু কম না, ....।
জনগণ, পার্টি ও বিপ্লব প্রসঙ্গে লেনিন
[নিচে উদ্বৃত অংশটি লেনিনের একটি বক্তৃতা থেকে নেয়া হয়েছে। কমিউনিস্ট আর্ন্তজাতিকের তৃতীয় কংগ্রেসে ১৯২১ সালের ১ জুলাই ‘কমিউনিস্ট আর্ন্তজাতিকের রণকৌশল সমর্থনে’ লেনিন যে বক্তৃতা দেন, যা প্রাভদায় ১৯২১ সালের ৫ জুলাই এবং ‘কমিউনিস্ট আর্ন্তজাতিকের তৃতীয় কংগ্রেসের বুলেটিনে’ ৮ জুলাই প্রকাশিত হয়েছিল এবং পরে লেনিন রচনা সংকলনের ৪৪ শ খণ্ডে সংকলিত আছে (পৃষ্ঠা ২৩-৩৩), সেই বক্তৃতা থেকে অল্প কয়েকটি বাক্য নিয়ে উদ্বৃত হয়েছে। এই উদ্বৃত অংশের প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে বর্তমানেও, বাংলাদেশেও।]
‘জনগণ’ সংজ্ঞাটি সংগ্রামের চরিত্রের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তনশীল। সংগ্রামের গোড়ার দিকে কয়েক হাজার সত্যিকারের বিপ্লবী মজুর থাকলেই জনগণ বলা যেত। পার্টি যদি সংগ্রামে শুধু নিজ সভ্যদের নয়, পার্টি বহির্ভূত লোকদেরও নামাতে পারে, তাহলে সেটাই হল জণগণকে জয় করার সূত্রপাত। আমাদের বিপ্লবের ক্ষেত্রে এমন ঘটনা ঘটেছে যখন কয়েক হাজার শ্রমিককেই বলা যেত জনগণ। আমাদের আন্দোলনের ইতিহাসে, মেনশোভিকদের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রামের ইতিহাসে আপনারা এমন বহু দৃষ্টান্ত পাবেন যেখানে একটা শহরে কয়েক হাজার মজুরের যোগদানেই আন্দোলনের পরিষ্কার গণ চরিত্র দেখা দিত। সাধারণত একটা কূপমন্ডুক ধরনের দিন কাটানো, শোচনীয় একটা জীবন যাপন করা, রাজনীতির নাম না শোনা কয়েক হাজার পার্টি বহির্ভূত মজুর যদি বিপ্লবী কর্মে নামে, তবে সেই হল জনগণ। সে আন্দোলন যদি ছড়ায় ও বাড়তে থাকে, তবে সেটা সত্যিকার বিপ্লবেই ক্রমিক উত্তরণ। এটা আমরা দেখেছি ১৯০৫ ও ১৯১৭ সালে, তিনটি বিপ্লবের ক্ষেত্রে, এবং আপনাদেরও এ প্রত্যয়ে পৌঁছাতে হবে। বিপ্লব যখন যথেষ্ট রকমে প্রস্তুত করা হয়েছে, তখন ‘জনগণ’ অন্য ব্যাপার; কয়েক হাজার মজুর দিয়ে তখন আর জনগণ হয় না। কথাটায় তখন অন্য কিছু বোঝাতে শুরু করে। জনগণ সংজ্ঞাটি তখন বদলে যায় এই অর্থে যে তাতে বোঝায় অধিকাংশ এবং শুধু শ্রমিকদের অধিকাংশ নয়, সমস্ত শোষিতদের অধিকাংশ। বিপ্লবীদের পক্ষে একথার অন্য কোনরূপ অর্থ করা অমার্জনীয়, একথার অন্য যে কোনো অর্থই হয়ে দাঁড়ায় অবোধ্য। একটা ছোট পার্টিও, দৃষ্টান্ত স্বরূপ ব্রিটিশ কি আমেরিকান পার্টি রাজনৈতিক বিকাশধারা ভালো করে বিচার করে এবং পার্টি বহির্ভূত জনগণের জীবনধারা ও অভ্যাসের সঙ্গে পরিচিত হয়ে অনুকূল মুহূর্তে বিপ্লবী অন্দোলন জাগিয়ে তুলতে পারে, তা সম্ভব। ......... তেমন পার্টি যদি সেরকম মুহূর্তে নিজস্ব ধ্বনি নিয়ে উদিত হয় ও লক্ষ লক্ষ মজুরকে নিজের পেছনে টানতে পারে, তাহলে সেটা হল গণ আন্দোলন। বিপ্লব যে একেবারেই ছোট পার্টি দিয়ে শুরু হতে পারে ও বিজয়ে সমাপ্ত হতে পারে, একথা আমি আদৌ অস্বীকার করছি না। কিন্তু জানা চাই কী পদ্ধতিতে নিজের পক্ষে জনগণকে টানতে হবে। তার জন্য বিপ্লবের আমূল প্রস্তুতি দরকার। .... আমূল প্রস্তুতি ছাড়া আপনারা একটা দেশেও বিজয় অর্জন করবে। জনগণকে পেছনে টানার জন্য একেবারে ছোট সময়ে বৃহৎ সংগঠনের দরকার হয় না।
“কিন্তু বিজয় লাভের জন্য জনগণের সহানুভূতি চাই। অনপেক্ষ সংখ্যাধিক্য সব সময় দরকার হয় না। কিন্তু বিজয়ের জন্য, ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য দরকার শুধু শ্রমিকশ্রেণির অধিকাংশই নয় -‘শ্রমিক শ্রেণি’ কথাটি আমি এখানে পশ্চিম ইউরোপীয় অর্থে, অর্থাৎ শিল্প প্রলেতারিয়েত অর্থে ব্যবহার করছি- গ্রাম্য জনসংখ্যার শোষিত ও মেহনতিদের অধিকাংশও।....
“.... ফাকা কচকচানিতে আমাদের মেতে থাকা উচিত নয়, কী করে ভালো করে সংগ্রাম সংগঠিত করতে হয় সেটা অবিলম্বেই শিখতে শুরু করা দরকার এবং শেখা দরকার অনুষ্ঠিত ভুলগুলি থেকেই। শত্রুর সামনে আমাদের ভুল চেপে রাখা উচিত নয়। তাতে যে ভয় পায় সে বিপ্লবী নয়। বরং আমরা যদি খোলাখুলি শ্রমিকদের বলি ‘হ্যাঁ, আমরা ভুল করেছি’, তাহলে তার মানে; ভবিষ্যতে এ ভুলের পুনরাবৃত্তি হবে না, এবং সময় নির্বাচন করতে পারব ভালো করে। যদি সংগ্রামের সময় আমাদের পক্ষে এসে দাঁড়ায় মেহনতিদের অধিকাংশ- শুধু শ্রমিকদের অধিকাংশ নয়, সমস্ত শোষিত ও নিপীড়িতদের অধিকাংশ- তাহলে সত্যিই আমরা জিতব।”