
ঐতিহাসিক কাল ধরে বিবর্তিত হয়ে আসা ইসলাম বঙ্গীয় ব-দ্বীপে এসে বহু চিন্তাকে সন্নিবেশিত করে যে চর্চায় রূপান্তরিত হয়েছে তার একটা দীর্ঘ সাংস্কৃতিক সিলসিলা বা পরম্পরা বাংলাদেশে শক্তিশালী ভাবেই বহমান আছে এখনো। দেহান্তরীত হওয়ার পর আধ্যাত্মিক সাধকদের সাধনার স্থানকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা কেন্দ্রগুলোর প্রত্যেকটিতেই অঞ্চল ও লোকাচার ভেদে স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য তৈরি হয়েছে বহু বছরের পরম্পরায়। একই সাথে আধ্যাত্মিক চর্চার ক্ষেত্র এবং খোদার দিদার লাভের আশায় মত্ত হওয়া মানুষদের আশ্রয়, খানা-দানার জায়গা হিসেবে অবলুপ্ত হয়ে যাওয়া মুসাফিরখানার মতোই নিরাপদ আশ্রয় এই মাজারগুলো। পাগল সাধকরা এক মাজার থেকে আরেক মাজারে পরিভ্রমণ করেন, কিছুদিন করে থেকে আবার অন্য কোনো মাজারে আশ্রয় নেন। জাতি-ধর্ম-বর্ণ ভেদে মাজারগুলোতে গড়ে উঠেছে একটা যৌথতার সংস্কৃতি, সাংস্কৃতিক সেতু হিসেবেও মাজারগুলোর ঐতিহাসিক ভূমিকা তমিজের সাথেই বিবেচনা করতে হবে।
খাদেম, মুতাওয়াল্লি, ভক্ত, আশেকানদের যৌথ চর্চার ধারাবাহিকতায় মাজারগুলোতে এক ধরনের ‘স্ব-শাসন’ বিরাজ করে এবং এই বর্গের মুসলিমরা ক্ষমতার প্রশ্নে রাজনৈতিকভাবে ততটা সক্রিয় থাকার চেয়ে আধ্যাত্মিক সাধনা, চিন্তা ও চর্চার স্বপক্ষে মশগুল থাকতেই আগ্রহী। ক্ষমতা দখলের মধ্য দিয়ে চিন্তা ও চর্চাকে রাষ্ট্রীয় ভাবে প্রতিষ্ঠা করার অভিপ্রায় নিয়ে তৈরি হওয়া ইসলামের রাজনৈতিক বর্গের সাথে এদের বিরোধ ও স্পষ্ট পার্থক্য বর্তমানে একপাক্ষিক দমন ও পীড়ন এ পর্যবসিত হয়েছে। পীর, ফকির, আউলিয়াগণের মাজার- দরবারে হামলা করা, আগুন দেয়া, সাধু-বাঊল-ফকিরদের চুল-দাড়ি কেটে দেয়া, ওরস বন্ধ করে দেয়া যেন প্রকারান্তরে ইসলাম ধর্মানুসারীদের মধ্যে তরিকা, চর্চা ও যাপনের ক্ষেত্রে এক ধরনের ‘প্রবল’ ও ‘প্রান্তিকের’ লড়াই তথা খোদ নিজ ধর্মের মধ্যেই সংখ্যালঘুর উপর সংখ্যাগুরুর আধিপত্যশীল হয়ে উঠার অকাট্য দলিল হিসেবে সাক্ষ্য দিচ্ছে।
গণ-অভ্যুত্থানের শরীকানার ভিত্তিতে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশে ‘তৌহিদী জনতা’ নামে ইসলামের ‘কর্তৃপক্ষ’ হিসেবে ওয়াহাবি এবং সালাফিদের অধিষ্ঠিত হওয়া অনেকটা নতুন ঘটনা হলেও বাংলাদেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে ধর্মীয় চর্চার স্বাধীনতা ও ইসলাম প্রশ্নে ‘শরিয়ত’পন্থীদের তৎপরতা নতুন কিছু না এবং এর শুরুয়াতের সাথে নিখিল বিশ্বের সালাফিস্ট মুভমেন্টের সম্পর্ক থাকুক বা না থাকুক, এদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্টেকের শ্রীবৃদ্ধির ক্ষেত্রে বিগত সময় যারাই সরকার গঠন করেছেন, কেউ কারো চেয়ে কম করেননি। রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে শক্তিশালী একটা বর্গ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন তারা লম্বা সময় ধরে, তাবৎ সরকারের আনুকূল্যেই। ভোটের অঙ্ক বা অন্য যে কোনো কারণেই হোক, সকল সরকারের আমলেই রাজনৈতিক, প্রাতিষ্ঠানিক এবং অর্থনৈতিকভাবে পরিপুষ্ট হওয়ার নিদারুণ সব দৃষ্টান্ত থাকলেও উনাদের পক্ষ থেকে দাবি হচ্ছে সকল সরকারের আমলেই তারা নির্যাতিত হয়েছেন, রাজনৈতিক ইসলামকে এই দেশে অচ্ছুত করার একটা পাঁয়তারা সকল সরকারের সময়ই ছিলো, জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বহু বছর পর তারা শৃঙ্খল মুক্ত হয়েছেন বা স্বাধীনতা অনুভব করছেন।
‘তৌহিদী জনতা’ শব্দবন্ধকে সামনে রেখে ওয়াহাবি এবং সালাফিদের পূর্ণ মাত্রায় স্বাধীনতা উপভোগের নানামাত্রিক তৎপরতার প্রভাবে সংখ্যাগুরু এবং সংখ্যালঘু বিষয়টি ভিন্ন ভিন্ন দুই বা ততোধিক ধর্মের মধ্যে অধিপতিশীল ও নিপীড়িত বোঝার ব্যাকরণে প্রশ্ন তুলে অন্য এক বাস্তবতা হিসেবে চব্বিশের গণ-অভ্যূথান পরবর্তী সময়ে হাজির হয়েছে বাংলাদেশে। এই সময়ে এসে দেখা যাচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠ ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের মধ্যেই বিভাজনের স্পষ্ট রেখা ও বিশ্বাসের প্রবল সংঘাত নিকট অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি। নতুন বাংলাদেশের নতুন বাস্তবতার সাথে এই সমস্ত ঘটনার যোগ থাকুক বা না থাকুক; বাস্তবতা হলো, ধর্মের বহু মত-পথ-স্বরকে ধারণ ও আত্তীকরণ করে বহু বছরের গড়ে উঠা সমাজে অ-শরীয়তিদের ঠ্যাঙানোর নাম করে ইসলাম অনুসারীদের একদল চড়াও হচ্ছে ক্ষমতা কাঠামোর সাথে সংশ্লেষহীন আপাত নিরীহদের উপর। এক্ষেত্রে, চিন্তা-চর্চা-যাপন নিয়ে সাংস্কৃতিক মতপার্থক্যর সাথে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিপত্তি দখলের অথবা ধ্বংস করে দেয়ার বাসনাও যে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে না, তাও জোর গলায় বলা সম্ভব নয় নানাবিধ আলামত দৃশ্যমান থাকার কারণেই।
বৈচিত্রপূর্ণ বহু ঘরানা ও মাজহাবে বিশ্বাসী মুসলমানদের মধ্যে জিইয়ে থাকা বিরোধ নিয়েই বিরোধপূর্ণ সহাবস্থান জারী থাকলেও ২০২৪ এর ৫ আগস্টের পর ঈমান, আকিদা, বিশ্বাস ও চর্চায় ভিন্নমতাবলম্বী মুসলমানদের চর্চায় বলপ্রয়োগ করে বাধাদান ও হামলার বহু ঘটনা সংগঠিত হয়েছে। মাজারকে কেন্দ্র করে যাপন করা অনুসারীরা উচ্ছেদ হয়েছেন বহু জায়গায়, মাজারকে কেন্দ্র করে বহু ধরনের ‘ঐতিহ্যিক’ চর্চা প্রায় অবলুপ্তির দিকে; টিকে আছে কিছু কিছু কোনোরকমে। এক মুসলমান দ্বারা আরেক মুসলমানের বিশ্বাস ও চর্চা সাব্যস্ত হচ্ছে কুফরি, বেদা’আত হিসেবে শুধুমাত্র বিশ্বাসের সাংস্কৃতিক পার্থক্যের কারণে। দুর্বলের গায়ে আঘাত বা স্থাপনার উপরে আঘাত করে প্রতিপত্তি বিস্তারের বাসনার নজির আগের আমল এবং তারও আগের আমলে থাকলেও বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে নতুন বন্দোবস্থীদের সাথে সাম্প্রতিক ঘটনাবলির যোগ বা কার্যকারণ কতটুকু সেই বোঝাপড়াটাও টুকে রাখা জরুরি।
মাজারে হামলা করে, চুল-দাড়ি কেটে পাগলপন্থী সন্ন্যাসী, ফকিরদের বিশ্বাস ও যাপনকে বাধাগ্রস্থ করা বা পালটানোর চেষ্টা নিকট অতীতে এভাবে দেখা না গেলেও ব্যাপারটা যে আচমকা হুট করে ঘটে যাচ্ছে ঠিক তেমনও না। ‘সেক্যুলার’ তকমা লাগানো আওয়ামী লীগের আমলেও অনেক মাজারে ওরশ বন্ধ হয়ে মাহফিল-ওয়াজ চালু হয়েছে। আওয়ামী আমলের আগে অন্য সব সরকারের আমলেই এই সমস্ত আগ্রাসী ঘটনার বড়োসড়ো দৃষ্টান্ত থাকলেও ক্ষমতার সাথে শরীয়তিদের এমন তুমুল গাঁটছড়া সম্পর্ক ১৬ বছরের আওয়ামী শাসনের আগে এতটা শক্তিশালী ছিলো না। নতুন বন্দোবস্তের জিকির উঠানো ইন্টেরিম সরকারের আমলে এসে বোধ হচ্ছে গাঁটছড়া সম্পর্ক প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে, ক্ষমতা কাঠামোর ছত্রছায়ায় ঘটছে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন।
অভ্যূত্থানে সক্রিয় আরবান এলিট পেশাজীবী নাগরিক, সেনাবাহিনী, রাজনৈতিক দল ও অভ্যূত্থানের গুরুত্বপূর্ণ সংগঠকদের মধ্য থেকে ‘চুজেন’ দল, রাজনৈতিক ব্যক্তি ও সংগঠকদের পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে গঠিত এই ইন্টেরিম সরকারের আমলে আধ্যাত্মিক স্থান ও ঐতিহ্যিক স্থাপনায় রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা একেবারে নাই হয়ে গিয়ে গত এক বছরে যে পরিমাণ মাজার ভাঙা হয়েছে, তা আগের একশো বছরেও সম্ভবত ঘটেনি। জুলাই অভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ে বর্গ হিসেবে রাজনৈতিক ইসলামের উত্থান; রাষ্ট্র ও সমাজের ক্ষমতা কাঠামোতে তাদের অবস্থান নেয়াকে অনেকে দোষের কিছু নয় ভাবতে পারেন। যদিও ইনক্লুসিভ রাষ্ট্র গঠনে এতোকাল ব্রাত্য থাকা এই বর্গকে অন্তর্ভুক্তির জরুরি কাজটুকু সম্পন্ন হওয়ার পর নিজ ধর্মের ভিন্ন চর্চা ও মতাবলম্বীদের উপর আধিপত্যবাদী এবং নিপীড়ক চরিত্র হিসেবে প্রবলভাবে হাজির হতে বেশি সময় নেননি তারা।
আধ্যাত্মিক সাধনায় নিবিষ্ট থাকা প্রায় নির্বিবাদী ব্যক্তি ও সমষ্টির উপর আক্রমণ, আধ্যাত্মিক স্মৃতি ও চর্চার সাথে সম্পর্কিত স্থাপনায় হামলা আর কোনো সাধারণ ঘটনা নেই, কোনো ধরনের নিরাপত্তা বিধান না করায় ‘স্টেট স্পন্সর্ড’ ঘটনা হিসেবেই আক্রান্তরা একে সাব্যস্ত করছেন। গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হওয়ার পর দায় ও দরদের বাংলাদেশ গঠনের অভিপ্রায় নিয়ে অভ্যূত্থানের নেতৃত্ব ও ইন্টেরিম সরকার নতুন বন্দোবস্তের অঙ্গীকার করলেও মাজার, দরগার উপর হামলা এবং আধ্যাত্মিক চর্চার উপর ধারাবাহিক আঘাতে নিশ্চুপ, নিশ্চল থাকাটাই হালের নতুন বন্দোবস্ত হিসেবে জনমনে প্রতীতি তৈরি করছে। একই সাথে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এই সরকারের সক্ষমতা এবং সদিচ্ছার প্রশ্নটিও জোরালোভাবে আমাদের সামনে এসে হাজির হয়েছে।
লেখক : সাবেক ছাত্রনেতা