চা-শ্রমিকদের ন্যূনতম মানবিক জীবন ফিরিয়ে দিন

শেখ রফিক

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email

চা-শ্রমিকদের জীবন যেন দরিদ্রের এক দীর্ঘ কাব্য, যেখানে প্রতিটি দিন লেখা হয় কষ্ট, ঘাম, পরিশ্রম আর অবহেলার কালি দিয়ে। ভোরের স্নিগ্ধ আলো ভেদ করে তারা কাঁধে ঝুলিয়ে ঝুড়ি, হাতে কাঁচা চা পাতা, ঝুম বৃষ্টি ও বিষাক্ত সাপের আতঙ্কে দাঁড়িয়ে কাটায় সারাদিন। তাদের ক্লান্ত দেহ, ক্ষুধার্ত পেট আর অশান্ত মন– সবই আমাদের প্রতিদিনের চায়ের কাপে চুমুকের পেছনে অদৃশ্য থাকে। সারাদিনের পরিশ্রমের বিনিময়ে মেলে সামান্য মজুরি, যা দিয়ে পরিবারের প্রয়োজন মিটে না। কুঁড়েঘরের দেওয়াল ফেটে, ছাদের ছিদ্র দিয়ে রোদ-বৃষ্টি ঢোকে। চিকিৎসা নেই, শিশুদের বিদ্যালয় সীমিত। ঘরের ছোট্ট ছেলেমেয়েরা স্বপ্ন দেখে, কিন্তু বাস্তবতা তাদের হাত থেকে তা ছিনিয়ে নেয়। প্রতিটি দিন যেন তাদের জীবনের একই অধ্যায়, যেখানে ক্লান্তি, কষ্ট আর অসহায়তার ছায়া কখনও শেষ হয় না। বছর ঘুরে, দশক ঘুরে, শতাব্দী পরেও এই চক্র চলতে থাকে। চা-পাতার মতো তাদের শ্রম ছুটে যায়, কিন্তু মানবিক অধিকার, নিরাপদ বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা– কিছুই তারা পায় না। উন্নয়নের গল্প অন্যরা লিখে যায়, আর তাদের জীবনের গল্প থেকে কেটে নেওয়া হয় স্বাভাবিক জীবনের সুখ ও মর্যাদা। তাদের এ জীবন কাব্যের শেষ নেই; বরং নির্মম বাস্তবের অনন্ত অধ্যায়। চায়ের কাপে চুমুক নেওয়া আমাদের প্রতিদিনের স্বল্প সময়ের ছোট আনন্দ। সকাল, দুপুর বা সন্ধ্যা– চা যেন আমাদের ক্লান্তি কাটিয়ে দেয়, কর্মব্যস্ত জীবনের সঙ্গে মানিয়ে যায়। কিন্তু সেই চায়ের পেছনের মানুষের কথা কি আমরা ভাবি? চা-শ্রমিকরা, যারা ভোরে উঠে সারাদিন ধরে ২৩ কেজি পাতা তুলে– ঝুম বৃষ্টিতে, জোঁক বা বিষাক্ত সাপের আতঙ্কের মধ্যে দাঁড়িয়ে। দিনে ২৫০ গাছ ছাঁটতে হয়, কীটনাশক ছিটাতে হয় এক একর জমিতে। বিনিময়ে তাদের দৈনিক মজুরি– মাত্র ১৮৭ টাকা। তাদের জীবনমান ও ন্যূনতম মানবিক অধিকার কতটা অমানবিক– আমরা ভেবে দেখেছি? চা-শ্রমিকরা শুধু চা উৎপাদন করেন না; তারা আমাদের ন্যায্যতা, মর্যাদা ও সামাজিক দায়বদ্ধতার পরীক্ষক। তাদের গল্প আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, উন্নয়ন ও ন্যায্যতার পথে মানবিকতা কখনো উপেক্ষা করা যায় না, অথচ আমরা তা অবিরত উপেক্ষা করে চলছি। নারী শ্রমিকরা সকালে ঘরের কাজ শেষ করে বাগানে যায়। সারাদিনের পরিশ্রম শেষে তারা ফিরে আসে খোলা আবহাওয়ায় ভিজে, কিন্তু স্বাস্থ্য, মাতৃত্বকালীন সেবা, শিক্ষার সুযোগ– সবই সামান্য। শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা নেই, হাসপাতাল বা চিকিৎসা কেন্দ্রের অভাব তাদের জীবনকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে এবং তুলছে, মৃত্যু ছাড়া কোনো নিষ্কৃতি নাই। এই কঠিন বাস্তবতা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, প্রতিটি চা পাতা আমাদের চুমুকের আনন্দের পেছনে কত গভীর সংগ্রাম, বেদনা এবং মানবিক দায়বদ্ধতার গল্প লুকিয়ে আছে। চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি ও সিলেট অঞ্চলে আঠারো শতকে বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ শুরু হয়। ব্রিটিশ শাসনামলে চা বাগানগুলোতে কাজের জন্য মানুষকে সুখের স্বপ্ন দেখিয়ে হাজার হাজার কিলোমিটার দূর থেকে এনে বসতি স্থাপন করতে বাধ্য করা হয়। যদিও তারা দুই শতাব্দী স্থায়ীভাবে বসবাস করলেও, শ্রমিকদের কোনো জমির মালিকানা বা স্বাধীনতার অধিকার দেওয়া হয়নি। চা বাগানগুলো তাদের জন্য যেন এক প্রকার বন্দিদশা– যেখানে স্বাধীনতা নেই, মানবিক অধিকার নেই এবং নাগরিক অধিকারও স্বীকৃত হয়নি। ঐতিহাসিকভাবে চা শ্রমিকরা দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ১৯৩৫ সালে ভোটাধিকার পায়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এটি বাতিল হয়। ১৯৫৪ সালে পুনরায় ফিরে আসে। মহান মুক্তিযুদ্ধে তারা অংশগ্রহণ করলেও স্বাধীনতার পরও জীবনমান উন্নত হয়নি। ব্রিটিশ শোষণ থেকে পাকিস্তানি ও বাংলাদেশি প্রশাসনের অবহেলা– সব মিলিয়ে চা শ্রমিকদের জীবন মানবেতর অবস্থায় কাটছে। বাংলাদেশে প্রায় ৭ লাখ চা শ্রমিক বসবাস করছেন। ১৬৭টি নিবন্ধিত চা বাগানে প্রায় ১ লাখ ২১ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। অস্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ১৯,৫৯২। প্রায় ৫০,০০০ শ্রমিকের মাথা গোঁজার জায়গা নেই। অধিকাংশে ৮-১১ ফুটের কুঁড়েঘরে বসবাস, যেখানে মানুষ ও গবাদি পশু একসাথে থাকে। ফটিকছড়ি উপজেলার ১৮টি চা বাগানে শ্রমিকরা দৈনিক মাত্র ১৭০ টাকায় সংসার চালাচ্ছেন। ভাঙাচুরা ঘর। আজও তাদের ঘর মেরামতের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হয়নি। কর্ণফুলী চা বাগানের শ্রমিকরা সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত কাজ করেন; দুপুরে খাওয়ার সময়ও সীমিত। নারী শ্রমিকরা ভোরে ঘরের কাজ শেষ করে বাগানে যায়। সারাদিন দাঁড়িয়ে কাজ শেষ করে আবার ঘরে ফিরে। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে চা-শ্রমিকরাও সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়েছিল। তারা ভেবেছিল– এই গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে যে পরিবর্তনের সূচনা হবে, তাতে অবশেষে তাদের দীর্ঘদিনের বঞ্চনা ও বৈষম্যের অবসান ঘটবে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যে অধিকার বঞ্চনা, জমির মালিকানাহীনতা, শিক্ষার অভাব ও সামাজিক বৈষম্যের শিকার তারা হয়ে এসেছে, তার সমাধানের একটি নতুন দ্বার খুলবে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বাস্তবতা ভিন্ন হলো– গণঅভ্যুত্থানের ১৩ মাস পরও তাদের জীবনযাত্রায় কাক্সিক্ষত পরিবর্তন এলো না, বৈষম্য ও অবহেলার শেকল একই রকম রয়ে গেল। চা শ্রমিকদের জীবন আধুনিক ক্রীতদাসের মতো। কুঁড়ি তুললেই ভাত জুটে। না তুললে জুটে না। প্রতিবাদী চেতনা দমন করতে বাগানে সহজ প্রাপ্য নেশা ও নিম্নমানের মদের দোকান রাখা হয়। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তারা একই কুঁড়েঘরে বসবাস করে। জমির মালিকানা নেই, পরিবারের অন্তত একজনকে বাধ্যতামূলকভাবে বাগানে কাজ করতে হয়। ২০০৮ সালে দৈনিক মজুরি ছিল ৩২ টাকা, যা ২০২২ সালে ১৭০ টাকায় উন্নীত। পৃথিবীর কোথাও এমন মজুরিতে শ্রমিক আছে বলে মনে হয় না। শিশুদের জীবনও বন্দি। অপুষ্টি, অসংগঠিত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার অভাবে বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত। হবিগঞ্জের ২৪টি চা বাগানে প্রায় ৪০,০০০ শ্রমিক কাজ করছেন, যারা ঘাম, শ্রম, কষ্ট ও বঞ্চনার মধ্যে জীবনকে আটকে দিয়েছেন। অথচ তাদের উৎপাদিত চা বিশ্বের ২৫টি দেশে রপ্তানি হয়ে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে ভূমিকা রাখে। ফুলতলা চা-বাগানে দেড় হাজার শ্রমিক মাসের পর মাস বকেয়া বেতন নিয়ে আন্দোলন করে ন্যায্য পাওনা পায়নি। প্রশাসন হস্তক্ষেপে বাগান পুনরায় চালু হয়। মালিকপক্ষ দায়ী থাকলেও শ্রমিকদের বেতন ও বোনাস কিছুটা দেওয়া হয়। ন্যাশনাল টি কোম্পানির মালিকানাধীন বাগানে শ্রমিকরা বেতন না পেয়ে দিনের পর দিন মানববন্ধন করেও পাওনাটুকু পাননি। সরকারি হস্তক্ষেপে মালিকপক্ষ কিছু বেতন প্রদান করেন। প্রতিটি বাগানে ক্ষেত্রে এসব ঘটনা তাদের জীবনসঙ্গী হয়ে গেছে। সবকিছু সয়ে নিয়েছেন তারা। চা শ্রমিকদের জীবন সীমাবদ্ধ বাগানের সীমানায়। এক মুঠি মুড়ি বা চাল ভাজা, এক কাপ চা খেয়ে ভোরে কাজে নামতে হয়। সারাদিন কঠোর পরিশ্রম, ঝুম বৃষ্টিতে খালি পায়ে, জোঁক ও বিষাক্ত সাপের সঙ্গে লড়াই করে পাতা সংগ্রহ করতে হয়। অথচ বর্তমানের চা শ্রমিকরা জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক। তারা ভোট দেয়, দেশের আইন মানে, নাগরিক কর্তব্য পালন করে, কিন্তু মানবিক ও নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত। দীর্ঘদিনের শোষণ, দারিদ্র্য ও অমানবিক জীবনযাত্রার মধ্যে থেকে তারা সচ্ছলতা, সমানাধিকারের নাগরিকত্ব ও ন্যায্য সুযোগের দাবিতে সোচ্চার। তাদের মানবিক মর্যাদা ও ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করা শুধু নৈতিক দায়িত্ব নয়, দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। সরকার ও রাষ্ট্র এ বিষয়টিকে আমলে নেয়নি। চা শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করতে সর্বপ্রথম তাদের দৈনিক মজুরি বৃদ্ধি করতে হবে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (ওখঙ) মানদণ্ড অনুযায়ী শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। সমস্ত প্রচলিত সুযোগ-সুবিধা বজায় রেখে শ্রমিকদের মজুরি ৭০০-৮০০ টাকা নির্ধারণ করা অত্যাবশ্যক। তাদের পূর্ণাঙ্গ রেশন নিশ্চিত করতে হবে, যাতে পরিবারের সাপ্তাহিক খাদ্য ও প্রয়োজনীয় জিনিস– যেমন চাল, আটা, ডাল, তেল, চিনি বা গুড়, সাবান, চা-পাতা এবং কেরোসিন– প্রতি সপ্তাহে নিশ্চিতভাবে পৌঁছে। এ ছাড়া, দীর্ঘ প্রজন্ম ধরে ব্যবহার করা বসতভিটা ও জমির আইনি স্বত্ব দিতে হবে। চা শ্রমিকদের জাতি, ভাষা ও সংস্কৃতির স্বীকৃতি দেওয়া অপরিহার্য। প্রতিটি বাগানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে এবং সন্তানদের শিক্ষা তাদের মাতৃভাষায় নিশ্চিত করতে হবে। স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে হবে। প্রতিটি বাগানে এমবিবিএস ডিগ্রিধারী ডাক্তারসহ কমিউনিটি ক্লিনিক ও পর্যাপ্ত ওষুধের ব্যবস্থা রাখতে হবে। কীটনাশক ব্যবহারের ফলে সৃষ্ট স্বাস্থ্যঝুঁকি রোধে সুরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিটি বাগানে বিশুদ্ধ পানির জন্য গভীর নলকূপ এবং প্রতি ২০ পরিবারে একটি করে টিউবওয়েল স্থাপন অপরিহার্য। জরুরি পরিস্থিতির জন্য প্রতিটি বাগানে ন্যূনতম একটি অ্যাম্বুলেন্স থাকা আবশ্যক। নারী শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন ছুটি ৬ মাস বা ৮ মাস নিশ্চিত করতে হবে। মাসিকের সময়কালীন প্রত্যেক নারী শ্রমিককে ৩ দিনের সম্পূর্ণ বেতনসহ ছুটি দিতে হবে। কমিউনিটি ক্লিনিকে বিনামূল্যে স্যানেটারি প্যাড সরবরাহ করা জরুরি। প্রসূূতি নারীদের জন্য উন্নতমানের নিরাপদ ডেলিভারি, পুষ্টিকর খাদ্য, প্রয়োজনীয় ওষুধ ও টিকা বিনামূল্যে সরবরাহ করতে হবে। বর্ষাকালে প্রত্যেক নারী শ্রমিককে রেইনকোট দেওয়া উচিত। বাল্যবিয়ে ও নারীনির্যাতন রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। চা-বাগানে অস্থায়ী শ্রমিকদের স্থায়ীকরণ করা অত্যাবশ্যক। তাদের অধিকার নিশ্চিত করলে পরিবার ও সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা বৃদ্ধি পাবে। শ্রমিক স্বার্থবিরোধী সব কালো আইন বাতিল করতে হবে। তাদের অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার নিশ্চিত করতে হবে এবং সংগঠন করার স্বাধীনতা দিতে হবে। মজুরি নির্ধারণে স্বচ্ছতা আনতে একটি নিম্নতম মজুরি বোর্ড গঠন করতে হবে। এভাবে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে চা শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার, মানবিক মর্যাদা এবং জীবিকার নিশ্চয়তা নিশ্চিত করা সম্ভব। এটি শুধু তাদের জন্য নয়, দেশের সামগ্রিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্যও অপরিহার্য। চা-শ্রমিকরা শুধু চা উৎপাদন করেন না; তারা দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি দৃঢ় করেন। তাদের অধিকার, জীবনমান, সুযোগ-সুবিধা উন্নত করা আমাদের নৈতিক ও জাতীয় দায়িত্ব। সমন্বিত, বাস্তবমুখী উদ্যোগ ছাড়া তাদের মানবিক মর্যাদা নিশ্চিত করা অসম্ভব। যখন চা শ্রমিকদের উন্নয়ন হবে, দেশের সামগ্রিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নও ত্বরান্বিত হবে। তাই অতীতের পুনরাবৃত্তি না করে রাষ্ট্র ও সরকার যথাযথ ভূমিকা পালনে এগিয়ে আসবে বলে আশা রাখছি। লেখক : গবেষক ও রাজনৈতিক কলাম লেখক

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..