
আমাদের দেশ, সমগ্র বিশ্ব এবং এ অঞ্চলের নানা ধরনের ঐতিহাসিক ঘটনা প্রবাহের মধ্যে আমাদের পার্টির ত্রয়োদশ কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২০২৪-এর ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান উত্তর নতুন পরিস্থিতির মধ্যে পার্টির ত্রয়োদশ কংগ্রেস নানা দিক থেকেই ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ছিল পার্টি ভাঙার অপপ্রচার-গুজব ও শঙ্কা। ছিল দেশ ও সারা বিশ্বের জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতির নির্মোহ বিশ্লেষণের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধভাবে রণকৌশল নির্ধারণের চ্যালেঞ্জ। দরকার ছিল পার্টির মধ্যে আরও দৃঢ় ঐক্য স্থাপন এবং বিভক্ত গণসংগঠনগুলির মধ্যে ঐক্যসাধনের নীতি ও দিকনির্দেশনা তৈরি করা। অপপ্রচার-গুজব ও শঙ্কাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে ত্রয়োদশ পার্টি কংগ্রেস এসব কর্তব্য সফলভাবে সম্পন্ন করেছে।
লুটপাটের ধারা অব্যাহত ও নিরঙ্কুশ রাখতে শেখ হাসিনা ভোটাধিকারসহ জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার পরিকল্পিতভাবে পদদলিত করে দেশে যে স্বৈরাচারী-ফ্যাসিবাদী দুঃশাসন কায়েম করেছিল, ২০২৪-এর জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান সেই ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনের পতন ঘটিয়ে দেশে এক নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। গণঅভ্যুত্থান দেশকে গণতন্ত্রের পথে অগ্রসর করার সম্ভাবনা যেমন তৈরি করে, আবার গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথে অন্তর্বর্তী সময়ে দেশকে বিপথে, এমনকি পেছন দিকে চালিত করার নানামাত্রিক অপ্রচেষ্টার সুযোগও তৈরি হয়। গণঅভ্যুত্থানে সক্রিয় ভূমিকা রাখার মধ্য দিয়ে জামাতসহ ইসলামপন্থি বিভিন্ন অংশ (যাদের মধ্য অতি উগ্রপন্থিরাও আছে) প্রকাশ্যে চলে এসেছে। এতদিন যারা আন্ডারগ্রাউন্ডে শক্তি সঞ্চয় করেছে, তারা সামনে এসে ইসলামপন্থি পরিচয় নিয়ে মাঠে সক্রিয় থাকার চেষ্টা করছে। ইসলামপন্থিদের বিভিন্ন উগ্রবাদী দল আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য-মাজারসহ বিভিন্ন জায়গায় হামলা-ভাঙচুর করছে। আগে যা গোপনে করতো, এখন তা প্রকাশ্যে করছে। সরকারের আনুকূল্য পেয়ে জামাত, এনসিপিসহ কিছু দল ও গোষ্ঠী মুক্তিযুদ্ধবিরোধী নানা ধরনের ন্যারেটিভ সামনে আনছে। পার্টির ত্রয়োদশ কংগ্রেস ঐক্যবদ্ধভাবে এসবের বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান ব্যক্ত করেছে।
পার্টির ত্রয়োদশ কংগ্রেস থেকে বলা হয়েছে, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে দেশে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে, বিপ্লব হয়নি। ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ও আসেনি। একাত্তরের কাউন্টার হিসেবে দ্বিতীয় স্বাধীনতার ন্যারেটিভ সামনে আনা ইতিহাসকে উল্টে দেখার একটি ভয়ঙ্কর স্থ’ূল প্রচেষ্টা। এই প্রজেক্ট সফল হবে না। কংগ্রেস ঘোষণা করেছে আওয়ামী ঘরানার সংকীর্ণ, ক্ষমতার স্বার্থে প্রচলন করা একপেশে, বিকৃত, অনেক ক্ষেত্রে মনগড়া, একতরফা ন্যারেটিভের মধ্যে অবস্থান করে মুক্তিযুদ্ধকে দেখার সময়ও শেষ হয়ে গিয়েছে। ত্রয়োদশ কংগ্রেস এসব ন্যারেটিভ ও দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে এসে বস্তুনিষ্ঠ এবং মার্কসবাদী অবস্থান থেকে শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থের দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে ইতিহাস, বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বামপন্থিদের নিজস্ব ন্যারেটিভ সামনে আনাকে এখন অপরিহার্য কর্তব্য হিসেবে বিবেচনা করেছে।
ত্রয়োদশ কংগ্রেস বাহাত্তর সালের সংবিধান সম্পর্কে পার্টির অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেছে। বাহাত্তর সালের সংবিধানের ভিত্তি ছিল ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে’র সাম্য, সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদার সমাজ এবং রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার। অনেক অসম্পূর্ণতা ও সীমাবদ্ধতা থাকলেও, এই সংবিধানে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী ও অংশগ্রহণকারী দলগুলোর চিন্তা-দর্শনের প্রধান চারটি দিক-গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্রের ধারণার কিছু প্রতিফলন ঘটেছিল। যেহেতু মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছিল, এজন্য জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারের অনেক স্বীকৃতি সংবিধানে আছে। আবার শুরু থেকেই সংবিধানে থেকে গিয়েছিল গুরুত্বপূর্ণ কিছু সীমাবদ্ধতা ও ত্রুটি। বাংলাদেশের সব জাতিগোষ্ঠী সংবিধানে স্বীকৃতি পায়নি। সব নাগরিকের জন্য মৌলিক অধিকার যেমন নিশ্চিত করা হয়নি, তেমনই ধর্ম-বর্ণ-নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব নাগরিকের সমঅধিকার নিশ্চিত করা হয়নি। বৈষম্যমূলক অনেক বিধি, একনায়ক ও স্বৈরশাসক তৈরি হওয়ার অনেক উপাদান ও ভিত্তি ’৭২-এর সংবিধানে থেকে গেছে। কংগ্রেস এমন কৌশল নিয়ে অগ্রসর হওয়ার তাগাদা দিয়েছে, যার মধ্য দিয়ে ভবিষ্যতের নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে বর্তমান সংবিধানের অসম্পূর্ণতা দূর করা যায় এবং সংবিধানের প্রতিক্রিয়াশীল কোনো পরিবর্তনের অপচেষ্টাকে কার্যকরভাবে রুখে দেওয়া যায়।
পার্টির ত্রয়োদশ কংগ্রেসের নীতি ও কৌশল নির্ধারণে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি এবং আমাদের এ অঞ্চলের নানা ধরনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাপ্রবাহকে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। এসময়ে সমগ্র বিশ্বে পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ আরও আগ্রাসী হয়ে উঠেছে। পুঁজিবাদ আরও দক্ষিণপন্থি, রক্ষণশীল, জাতিবাদী-বর্ণবাদী ও অন্যান্য পরিচিতি সত্তার রাজনীতিকে উসকে দিচ্ছে। ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তনে এ ধারা আরও বেগবান হয়েছে। অন্যদিকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের একক নিয়ন্ত্রণের এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে এবং বহুকেন্দ্রিক এক ‘নয়া বিশ্বব্যবস্থা’র দিকে বিশ্ব ধাবিত হচ্ছে। মার্কিনসহ পশ্চিমাদের মোড়লগিরি ঠেকাতে ‘ব্রিকস’ ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক নতুন যুগের সূচনা করেছে। সম্প্রসারিত ‘ব্রিকস প্লাস’ বৈশ্বিক ক্ষেত্রে বিশাল প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। মার্কিন ডলারের বিশ্ব আধিপত্য বিপন্ন হয়ে পড়ছে। বহুমেরুকেন্দ্রিক বিশ্ব গড়ে ওঠার সত্যিকার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে শ্রীলঙ্কার বুর্জোয়া শক্তির নানা চেষ্টা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের অপতৎপরতা সত্ত্বেও, বামপন্থি আনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকের বিজয় থামানো যায়নি। শ্রীলঙ্কায় গণঅভ্যুত্থান-উত্তর নির্বাচনে বামপন্থিদের সাফল্য আমাদের কর্মকৌশল নির্ধারণে কাজে লেগেছে, আবার নেপালের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি আমাদের অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে।
শেখ হাসিনার পতনের পর গত ৮ আগস্ট শপথগ্রহণের মাধ্যমে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এ দেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হয়েছে, তার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহম্মদ ইউনূস এদেশের শাসকশ্রেণিরই প্রতিনিধি এবং শাসকশ্রেণির এক মহাসংকটকালে তাঁকে এনে দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে। এখনো পর্যন্ত সরকারের মূল লক্ষ্য উদার গণতন্ত্রের নামে আন্তর্জাতিক নয়া উদারবাদী নীতি ও ফিনান্স ক্যাপিটালের স্বার্থরক্ষা করা। দেশি-বিদেশি শাসকশ্রেণি নিজ স্বার্থেই এমন কিছু সংস্কার করতে চাইছে, যেন তাদের এ রূপ স্বার্থ অক্ষুণ্ন রাখা যায়। শেখ হাসিনার সরকার অবাধ লুটপাট-দুর্নীতি, বিদেশে সম্পদ পাচার ও ঋণখেলাপি সংস্কৃতির মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে যে পদ্ধতিতে নিঃশেষ করে দিয়েছে, তা থেকে বের হয়ে আসার জন্য অর্থনৈতিক সুশাসন প্রতিষ্ঠার কোনো উদ্যোগ নেই। অর্থনৈতিক সুশাসন না এলে ফ্যাসিবাদের প্রশাসনিক কাঠামোগুলো ঠিকই প্রতি-অভ্যুত্থানের চেহারা নিয়ে ফিরে আসবে। গণঅভ্যুত্থানের ন্যায্যতা, প্রাথমিক সফলতা ও আকাঙ্ক্ষার ওপর দাঁড়িয়ে একটি অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় গণতান্ত্রিক সংস্কারকে তার সফল পরিণতির দিকে এগিয়ে নেয়াকে কংগ্রেস এখন সবচেয়ে জরুরি কর্তব্য হিসেবে বিবেচনা করেছে।
বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বাম-গণতান্ত্রিক বিকল্প শক্তির প্রয়োজনীয়তা আগের তুলনায় আরও বেশি করে অনুভূত হচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতির আশু কর্তব্য হলো, দেশে একটি শোষণ-বৈষম্যবিরোধী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও সরকার প্রতিষ্ঠা করা। সেই লক্ষ্য পূরণের শর্ত হলো সমাজতন্ত্র অভিমুখীন বিকল্প গড়ার অঙ্গীকারসম্পন্ন বাম বিকল্প শক্তির অগ্রবর্তী ও উদ্যোগী ভূমিকা। এজন্য কংগ্রেস জনগণের সক্রিয় সমর্থনের শক্তিতে রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়া ও সরকার গঠনের স্পষ্ট লক্ষ্য নিয়ে পার্টি গড়, ফ্রন্ট গড়- লড়াই কর-এই নীতির ভিত্তিতে অগ্রসর হওয়ার কর্মকৌশল নির্ধারণ করেছে। সমাজ বদলের মূল রণনৈতিক কেন্দ্রীয় কর্তব্যের আলোকে বর্তমান সময়ের জন্য ‘শোষণ-বৈষম্যবিরোধী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও সরকার’ প্রতিষ্ঠার কর্তব্য সম্পন্ন করতে ত্রয়োদশ কংগ্রেস পার্টিকে সত্যিকার অর্থে ঐক্যবদ্ধ, বিপ্লব ও শ্রেণিসংগ্রামের পার্টি, শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি মানুষের পার্টি, জাতীয় স্বার্থরক্ষার পার্টি, স্বাধীন-আত্মনির্ভরশীল পার্টি হিসেবে গড়ে তোলার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে।
একই সাথে ত্রয়োদশ কংগ্রেস এই সংগ্রামে বিজয়ের জন্য কমিউনিস্ট পার্টিকে শক্তিশালী করা, বাম-গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীল বিকল্প শক্তির জাগরণ ও উত্থান ঘটানোর প্রচেষ্টায় সর্বতোভাবে শামিল হতে দেশবাসীর প্রতিও উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছে।