পুরাণ কথা

গ্রীসিয় ঈশ্বরের জন্ম

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email

শুরুতে ছিল আকাশ আর পৃথিবী; আকাশকে ডাকা হতো ইউরেনাস নামে, আর পৃথিবীকে গাইয়া। তারা ছিল প্রেমিক-প্রেমিকা। একে অপরের বাহুতে জড়াজড়ি করে শুয়ে থাকতো তারা। পৃথিবীকে জোরে চেপে ধরেছিল আকাশ, আকাশকে ধরে রেখেছিল পৃথিবী। একটি পাতারও তাদের মাঝ গলে বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ ছিল না। পৃথিবীর অনেক সন্তানের জন্ম হলো, কিন্তু আকাশ তাকে এমনভাবে আটকে ধরে রেখেছিল যে সেই সন্তানদেরও বের হওয়ার জায়গা ছিল না। সন্তানরা তাদের পূর্ণাঙ্গ উচ্চতায় দাঁড়াতে পারছিল না; তারা মায়ের শরীরে নানান খাঁজ আর ফাটল বানিয়ে তার মধ্যেই নত হয়ে থাকতো। পৃথিবীর এই সন্তানেরাই ছিল টাইটান। তারা ছিল কিম্ভূত ধূসর ধরনের; তাদের চামড়া ছিল বছরের পর বছর আবহাওয়ায় ধুয়ে যাওয়া পাথরের মত ভগ্ন, খাঁজকাটা। তারা দাঁড়াতে, হাঁটতে এবং লম্বা লম্বা পা ফেলে পৃথিবী ঘুরে বেড়ানোর মত সাবালক হয়ে উঠেছিল; কিন্তু তাদের বাবা যে ওজন দিয়ে তাদের চেপে রেখেছিল তাতে তারা আটকে পড়েছিল। ধুসর এ টাইটানদের একজন ক্রোনাস। যে জানত, কী উপায়ে বাবা-মাকে আলাদা করতে হবে। একটি শক্ত পাথর নিয়ে সে তাতে শেকল ঘষে ধারাল করে তুললো। এরপর বুকে হেঁটে মায়ের দুই পায়ের মাঝখান দিয়ে সে পৌঁছে গেল বাবার কাছে, আকাশের কুঁচকি আর পেট সেই ধারাল পাথর দিয়ে ছিঁড়ে ফেলল ক্রোনাস। তীব্র ব্যাথায়, ভয়ঙ্কর আর্তনাদ আর কান্নায় পৃথিবীর কাছ থেকে বিচ্ছেদ নিলো আকাশ। সে উড়তে থাকলো, উড়তে থাকলো, উড়তেই থাকলো যেন পৃথিবী থেকে যতটা সম্ভব দূরে যাওয়া যায়। এবং তারপর সে এমন স্থান পেল, যেখানে সে আজও আছে, আমাদের মাথা থেকে অনেক অনেক উপরে। সে যখন উপরে উঠছিল তার ক্ষতস্থান থেকে রক্ত পৃথিবীর শরীরে এসে বিঁধছিল, বৃষ্টির মতো, বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছিল মাটিতে। যেখানেই আকাশের রক্ত ছিটকে পড়ছিল সেখানেই আবির্ভাব হচ্ছিল জীবনের; জন্ম হচ্ছিল গাছ আর উদ্ভিদের, উজ্জ্বল পাখাওয়ালা পোকার, পালকওয়ালা পাখির, আঁশওয়ালা মাছ আর লোমশ প্রাণীর। মূলত তখনই সুন্দর, সবুজ, বাসযোগ্য যে পৃথিবীকে আজকে আমার চিনি এক লহমায় সেই পৃথিবীর সৃষ্টি হয়েছিল। একই সময়ে ধুসর টাইটানগুলোও খাঁজ আর ফাটল ছেড়ে বেরিয়ে এলো। তারা হাত-পা ছুঁড়ছিল, তারা আনন্দে চিৎকার করছিল, বড় বড় পা নিয়ে দৌঁড়ে বেড়াচ্ছিল, আনন্দে নাচছিল। সব টাইটানই নাচছিল। সব টাইটানই নাচছিল, একজন বাদে। সেই একজন, যার নাম ছিল প্রমিথিউস; যার অর্থ ‘দূরদর্শী’। তার ছিল ভিন্ন পরিকল্পনা। ভাই ক্রোনাস যখন শেকল ঘষে পাথর ধার করছিল, প্রমিথিউস তখন বানাচ্ছিল তিনটি পাথরের কৌটা। এখন সবাই যখন নাচছে, প্রমিথিউস তার কৌটাগুলোকে বাইরের আলোতে নিয়ে এসে মাটিতে রেখে তুলতে লাগলো রক্ত শুষে নেয়া মাটি। তার কৌটায় একে একে ভরলো মায়ের শরীরের অংশ, বাবার ছিটকে পড়া রক্ত। কানায় কানায় ভর্তি হওয়ার পর সে খিল দিয়ে কৌটাগুলো আটকে দিল। এরপর তা পুঁতে ফেলল; পুঁতে ফেলল মাটিতে, পুঁতে ফেলল তার মায়ের শরীরের একেবারে গভীরে। মা এবং সন্তানের মধ্যে এটি ‘রহস্য’ হয়ে হয়ে লুকানো থাকলো, একদিন প্রমিথিউস সেগুলো

ফেরত নেবে। এরপরই সে দৌঁড়ে গেল, হাতে হাত মেলাল ভাই-বোনদের সঙ্গে। তার ছুটন্ত পায়ের শব্দ টাইটানদের বৃত্তাকার নাচ আনন্দে ভরিয়ে তুললো। এরপর বছরের পর বছর পার হয়ে গেল। এর মধ্যে দুই ধুসর টাইটান ক্রোনাস ও রীয়া’র কোলে সন্তান এলো। এরইমধ্যে একদিন মা পৃথিবী, ক্রোনাসকে সতর্ক করে বললো- তার সন্তানরা এত বেশি শক্তিশালী হবে যে তারা তাদের বাবাকেই একদিন ছুঁড়ে ফেলে দেবে। কোনোদিনই এটি হতে দেবে না ক্রোনাস, তাই সে সন্তানদের খেয়ে ফেলতে লাগলো। সে তাদের পুরো গিলে ফেলতে লাগলো, একটার পরে একটা করে। ক্রোনাসের সন্তানদের মধ্যে সবচেয়ে ছোটটির নাম ছিল জিউস; মা রীয়া এ সন্তানকে বাঁচাতে চাইলো। রীয়া জিউসকে একটি গুহায় লুকিয়ে ফেলল এবং একটি পাথর কম্বল দিয়ে প্যাঁচিয়ে রাখলো জিউসের দোলনায়। ক্রোনাস ওই পাথরটিকেই জিউস ভেবে গিলে ফেললো। এদিকে জিউস বাড়তে লাগলো অতি গোপনে। যখন সে বয়সী হলো, গুহা থেকে বেরিয়ে সোজা হাজির হলো ক্রোনাসের দরবারে। ‘অপরিচিত’ ছেলেকে ক্রোনাস নিয়োগ দিল পানীয় পরিবেশক হিসেবে। একদিন জিউস তার বাবাকে একটি মধুর স্বাদযুক্ত পানীয় খেতে দেয়, আগে থেকে যেখানে মেশানো ছিল বিষ। ওই পানীয় খেয়ে ক্রোনাস হয়ে পড়ল অসুস্থ। প্রথমে সে পাথর বমি করলো, এরপর একে একে তার গলা দিয়ে বেরিয়ে এলো গিলে ফেলা সন্তানরা- পোসাইডন, হেসটিয়া, হেডেস, ডেমিটার, হেরা। তাৎক্ষণিকভাবে জিউস এবং তার ভাইরা অস্ত্র জব্দ করে ক্রোনাস ও অপর ধুসর টাইটানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল। বছরের পর বছর ধরে এই লড়াই চলতে থাকলো। তারারা খসে পড়লো, পাহাড় সমান হয়ে গেল, পৃথিবীর হৃদয় থেকে উৎসারিত উত্তাপ থুতু আর লাল লাভার আগুন হয়ে ছড়িয়ে পড়লো তার শরীরজুড়ে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলা এ যুদ্ধ একদিন শেষ হলো, জয়ী হরো জিউসরা। পরাজিত ধুসর টাইটানদের হীরকখণ্ডের শেকলে বেঁধে টারটারাস নরকের গভীরে নিক্ষেপ করা হলো; ফেলে দেয়া হলো- গভীরে, আরও গভীরে, পৃথিবীর গভীর তলদেশে। খানিকটা মাফ পেলেন দুই টাইটান। প্রমিথিউস যার অর্থ ‘দূরদর্শী’ আর এপিমেথিউস, যুদ্ধের সময় যে পিঠটান দিয়েছিল। তাদেরকে সবুজ উপত্যাকার মাটিতে কর্ষণ ও চাষ করার অনুমতি দেওয়া হলো। জিউস এবং তার ভাই-বোন ও সন্তানরা মাউন্ট অলিম্পাসের সবচেয়ে উঁচু চুড়ায় তাদের বাসভবন তৈরি করে নিলো। যেহেতু টাইটানরা পরাজিত হয়েছে সুতরাং এখন থেকে তারাই পুরো মহাবিশ্ব শাসনকর্তা। একে একে তারা মহাবিশ্বকে ভাগ করে নেবে। কিছু সময় পর তিন ভাই জিউস, পোসাইডন এবং হেডেস একটি শিরস্ত্রাণের মধ্যে নিজেদের নিক্ষেপ করে, তারপর চোখ বন্ধ করে শিরস্ত্রাণের আরও গভীরে প্রবেশ করে। কিছুক্ষণ পর জিউস উপড়ে নিল স্বর্গ, এখন থেকে এটি তারই পদানত। পোসাইডন বের করল সাগরের বিশাল জলরাশি; আর হেডেস বেছে নিলো পাতাল, দূরে অনেক দূরের এমন এক ভূমি যেখানে একদিন মৃতদের যেতেই হবে। জিউস এবং তার ভাইয়েরা নিজেদের জন্য একটি নামও ঠিক করল। নিজেদের তারা ডাকতে শুরু করল ‘ঈশ্বর’। অনুবাদ : মীর মোশাররফ হোসেন।

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..