
বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী জঙ্গিবাদী ‘ধর্মীয়’ চিন্তাধারা ক্রমাগতভাবে গান, নাটক, অভিনয়, কবিতা, সাহিত্যকে ‘হারাম’ আখ্যা দিয়ে বাঙালির শতাব্দী প্রাচীন সাংস্কৃতিক চর্চাকে বিলুপ্ত করে দিচ্ছে। এটি একটি সুসংগঠিত পরিকল্পিত সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, যা সাংস্কৃতিক গণহত্যার রূপ ধারণ করেছে।
বাঙালির আত্মপরিচয়, সৃজনশীলতা, শিল্পমনস্কতা ও লোকঐতিহ্য ধ্বংসের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে ‘ধর্মের’ মুখোশ।
গত পর্বে ‘সাংস্কৃতিক গণহত্যা লেখায় সাংস্কৃতিক গণহত্যা কী এবং কেন তা বলার চেষ্টা করেছি। আবারও ধারণাটি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই; সাংস্কৃতিক গণহত্যা (Cultural Genocide) মানে একটি জাতির ভাষা, শিল্প, ইতিহাস, পোশাক, সংগীত, সাহিত্য, আচার-আচরণকে পরিকল্পিতভাবে নিঃশেষ করার প্রক্রিয়া। এটি শারীরিক হত্যাকাণ্ড নয়, বরং বাঙালি চেতনার হত্যাকাণ্ড।
একজন তরুণ গায়ক যখন সোশ্যাল মিডিয়ায় বলেন, ‘গান বাজনার টাকা হারাম’ বা একাধিক তরুণী অভিনেত্রী অভিনয় ছেড়ে ‘হিজাব ও পর্দা’ গ্রহণ করতে জানায়- তখন ‘জান্নাতের পথের সন্ধান পেয়েছেন’ এবং ‘অভিনয়’ হারাম তখন সাংস্কৃতিক গণহত্যার ব্যপ্তি স্পষ্ট হয়ে যায়। আজকের বাংলাদেশে বাউলগান, রবীন্দ্রসংগীত, নাটক, অভিনয়- সবকিছুকে হারাম বলার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির ইতিহাস, সাহিত্য ও মননের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে ভিন্ন এক আরবীকৃত সাংস্কৃতিক কাঠামো।
সাংস্কৃতিক গণহত্যার মাঠকর্মী কারা?
বাঙালির সাংস্কৃতিক গণহত্যার পেছনে রয়েছে ইউটিউবভিত্তিক ‘ইসলামি’ বক্তার দল, যারা ক্রমাগত গান, নাটক, সাহিত্যকে দোজখের পথে নিয়ে যাওয়ার মাধ্যম হিসেবে চিহ্নিত করছেন। বাংলাদেশে এক শ্রেণির ‘ধর্মপ্রচারক ও অনলাইন ইসলামি কর্মী’ ক্রমাগত এসব প্রচার করে যাচ্ছে। যেমন- গান-বাজনা, কবিতা, অভিনয়, সাহিত্যচর্চা বেহায়াপনা হারাম; নাটক, চলচ্চিত্র ইসলামবিরোধী; লোকসংস্কৃতি (যাত্রা, বাউল, পালাগান) গুনাহের কাজ; নারীর শিল্প চর্চা/সাংস্কৃতিক কাজে অংশগ্রহণ পর্দাহীনতা ও জাহান্নামের পথ ইত্যাদি ইত্যাদি।
এর ফলে বাংলা সংগীত, নাটক, কবিতা, চারুকলা, আঞ্চলিক ভাষা ও লোকজ ঐতিহ্য ‘ধর্মবিরোধী’ হিসেবে অপমানিত হচ্ছে। শিল্পীরা সমাজে অবমাননার শিকার হচ্ছে, তরুণরা এই পেশা থেকে বিচ্যুত হচ্ছে, নতুন শিল্পী গড়ে ওঠার সমস্ত পথ রুদ্ধ করে দিচ্ছে। একটি জাতির সংগীত ও শিল্প সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখার পরাম্পরা শেষ হয়ে যাওয়ার পথে।
অন্যদিকে তরুণরা স্মার্ট ফোনে পুঁজিবাদী যৌনবাদী কালচারাল পণ্য গ্রহণ করছে। একইসঙ্গে আরবীকৃত সংস্কৃতির দিকে ঝুঁকে পড়ে (যেমন আরব পোশাক, নাম, উচ্চারণ) বাংলা গান বা সাহিত্যের পরিবর্তে ইসলামি ওয়াজ বা হামদ/নাত হয়ে উঠে প্রধান বিনোদন। এভাবে, বাঙালির নিজস্ব সাংস্কৃতিক চর্চা নিঃশেষ হতে শুরু করে- এটিই সাংস্কৃতিক গণহত্যা।
গান বাজনা কি আসলেই ‘ইসলামে’ হারাম? কোন ধর্মতত্ত্ব থেকে এই চিন্তা এসেছে?
কোরআনে কোন আয়াত নেই যেখানে স্পষ্টভাবে পরিষ্কার ভাষায় সঙ্গীত বা শিল্প চর্চাকে হারাম বলা হয়েছে। যারা হারাম বলছে, এরা কোরআনের একটি আয়াত থেকে নিজেদের মনগড়া ব্যাখ্যা দিয়েছে।
এটি হচ্ছে, ‘সূরা লুকমান- আয়াত ৬’। এখানে কি বলা হয়েছে? ‘মানুষের মধ্যে কেউ কেউ অর্থহীন কথাবার্তা (লাহওয়াল হাদীস) কিনে নেয় যাতে মানুষকে অজ্ঞতাবশত আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারে-’। কিছু মুফাসসির, যেমন ইবনে কাসির, ইমাম কুরতুবি প্রমুখ ‘লাহওয়াল হাদীস’ অর্থ করেছেন গান, সংগীত, গল্প, নাটক ইত্যাদি।
বিপরীতে অনেক স্কলার ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তাঁদের মতে এই আয়াত দিয়ে ‘শুধু ধর্মবিরোধী বা বিভ্রান্তিকর তামাশা বোঝায়- গান নয়’। উপরন্তু সূফী ঘরানার মুসলমানদের কাছে গান বাজনা আধ্যাত্মিক চর্চার বা ধর্মের অংশ।
বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক গণহত্যার একটি ঐতিহাসিক পটভূমি আছে। এর সূচনা ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসন থেকে। সাম্প্রদায়িকতা তথা ডিভাইড এন্ড রুল হচ্ছে এই সাংস্কৃতিক গণহত্যার রাজনৈতিক উৎস। সাম্প্রদায়িক বঙ্গভঙ্গ, ১৯৪৭ এর বিভাজন ও পাকিস্তান আমলে উর্দু ভাষা চাপিয়ে দেওয়া, বাংলা গান ও নাটককে হিন্দুয়ানি বলা ইত্যাদি। বাংলাদেশে পাকিস্তানি দেওবন্দি মতবাদ, সৌদি ওয়াহাবি চিন্তা এবং তাবলিগি দাওয়াতের প্রভাবে বাংলা সংস্কৃতির মূলধারা- যাত্রাপালা, গীতিনাট্য, রবীন্দ্র-নজরুল গান, নাট্যকলা- সবকিছুকে ‘কুফরি’ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। এইসব কিছুই ঘটেছে সাম্প্রদায়িকতার ঐতিহাসিক ভিত্তির উপর ১৯৮০ দশক থেকে মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের উত্থানের পটভূমিতে। কারা এই অঞ্চলে মৌলবাদ জঙ্গিবাদের প্রসারে ভূমিকা রেখেছে? মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ সৌদি ও পাকিস্তানি গোয়েন্দা বাহিনীর মাধ্যমে।
ফলে বাঙালির সাংস্কৃতিক গণহত্যা কোন ‘ধর্মীয়’ ব্যাপার নয়। ধর্মের মুখোশে মরু সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসন, মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদ ব্যবহার করে।
কীভাবে প্রতিরোধ সম্ভব?
ধর্মের মনগড়া ব্যাখ্যাকে বিশেষ করে, যা পবিত্র কোরআনে নেই এমন সব ‘ফতোয়ার’ বিরোধিতা করার সাহস একজন সৎসাহসী ধার্মিকের থাকা উচিত।
সেজন্য একটি ‘ধর্মীয় স্বাধীনতার’ রাজনৈতিক পরিবেশ থাকতে হবে। ধর্ম নিয়ে ব্যবসা, ধর্মসন্ত্রাস ও ধর্মের যে উৎকট রাজনৈতিক ব্যবহার হচ্ছে এগুলো বন্ধ হতে হবে। এর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ গড়া এখন সময়ের দাবি। ধর্ম ও সংস্কৃতিকে একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী কিংবা ধর্ম দিয়ে সংস্কৃতিকে গ্রাস করার সাম্রাজ্যবাদী-মৌলবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হবে। বাংলা সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখতে হলে দরকার- আধ্যাত্মিকতার বোধ, ইতিহাস সচেতনতা, শিল্প-সাহিত্যকে মূল্যায়নের জায়গা দেওয়া, সামাজিক আন্দোলন ও শিক্ষায় সংস্কৃতিমনস্কতা ফিরিয়ে আনা।
এই লড়াই কোনো একক শিল্পীর নয়, এটি পুরো বাঙালি জাতিসত্তার সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই।