চা বাগানে বসবাসকারীদের ভাষা ও সংস্কৃতি : একটি প্রস্তাবনা

আহমদ সিরাজ

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email

বাংলাদেশ এমন একটা দেশ যার ১৮ কোটির মতো জনসংখ্যার ভূমি মাত্র ১,৪৭,৪৭০ বর্গ কিলোমিটার। পৃথিবীতে এত কম আয়তনে এত অধিক সংখ্যক মানুষের বসবাস বিরল, ব্যতিক্রম বলা চলে। এ দেশটি সমতল-অসমতলের বৈচিত্র্যময় ও সামঞ্জস্যপূর্ণ গড়ন দেশটিকে পৃথিবীর একটা অনন্য দেশে পরিণত করে রেখেছে। জনসংখ্যা আয়তনের তুলনায় প্রবল সম্পদহীনতা থাকলেও মাটি মানুষের সৃজনশীল উর্বরতা শক্তি এমনভাবে জীবন্ত হয়ে আছে প্রবল দুর্যোগ তান্ডবে সবই নিঃশেষিত হয়ে গেলেও দেশের মাটি ও মানুষের অনিঃশেষ উর্বরতা শক্তি এমনি যে, বাংলার শ্যামল শোভা প্রকৃতি স্বাভাবিক ও স্বতোৎসারিত হয়ে উঠতে বিলম্ব ঘটে না। বিট্রিশ ও পাকিস্তান ঔপনিবেশিক শাসনকাঠামো দীর্ঘদিন থাকার পর, দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের মধ্যে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। কিন্তু দেশটির জন্মের ৫৩ বছর অতিবাহিত হয়ে চললেও সুশাসন, গণতন্ত্র, সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়ে উঠেনি। এখনও বৈষম্য শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে নিজ দেশে শাসক শ্রেণির বিরুদ্ধে লড়াই সংগ্রাম করতে হয়েছে-যার পরিণতিতে ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটে। একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মধ্য দিয়ে একটা সুষ্ঠ গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে মুল ধারার বাঙালি জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি আদিবাসী হিসাবে অসংখ্য জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে। ভাষা সংষ্কৃতি, পোশাক, আশাক, খাদ্য বাসস্তান ইত্যাদির দিক থেকে একটা নান্দনিক অবস্থান দৃশ্যমান হয়ে আছে। আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম রাঙামাটি অঞ্চলের জাতিগোষ্ঠীর আলোচ্য বিষয় হয়ে এলেও বাংলাদেশের বৃহত্তম সিলেট অঞ্চলের অন্তর্ভূক্ত একটা জেলা মৌলভীবাজার বাঙালি জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি ৯২টি চা বাগানে ৪ লক্ষাধিক চা জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে। ভাষা ও সংষ্কৃতির দিক থেকে সরকারি তালিকাভূক্ত বড় অংশের জাতিগোষ্ঠী এখানে আছে এবং তালিকার বাইরে শতাধিক জাতিগোষ্ঠী স্বত্বার বসবাস রয়েছে বলে অনুমিত হয়। এখানে এই জেলায় চা জনগোষ্ঠী পরিচয়ে লক্ষ লক্ষ চা শিল্প গোষ্ঠীর বসবাস থাকলেও তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চা রক্ষা ও বিকাশে কোন সাংষ্কৃতিক চর্চাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা পায় নি। আদিবাসী, ক্ষুদ্র জাতিসত্তার নামে দেশের অপরাপর প্রান্তে সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র থাকলেও চা জনগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক একাডেমী বা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের জরুরি তাগিদ থাকলেও গভীরভাবে ভাবা হয়নি। চা বাগানে ব্রিটিশ ভারতবর্ষে একটা নিষিদ্ধ জগতের বাসিন্দা হিসাবে গড়ে তোলা হয়, যাতে তারা একটা বৃত্তাবদ্ধ অবস্থানে থেকে বাইরের জগত ঠিকমতো জানা বুঝা থেকে বঞ্চিত থেকে কাজ করে যায়। কম মজুরিতে তাদের এভাবে চা বাগানের ভেতেরে অনেকটা আটকে রেখে চায়ের উৎপাদন করে মুনাফা করেছে। চা বাগান পত্তন ও চা বাগানে বিট্রিশবিরোধী আন্দোলনে চা বাগান শ্রমিকদের অবদান রয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে ক্ষুদ্র জাতি হিসাবে চিহ্নিত বিরাট অংশের মানুষ বসবাস করে। সঠিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাবে তারা অনেক সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকে। তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চা বিকাশের জন্য নিম্নরুপভাবে মৌলভীবাজার জেলায় একটা চা বাগান ও সংস্কৃতি বিকাশে সাষ্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণ সময়ের দাবি। ভাষা সংস্কৃতি বিষয়ক প্রস্তাবনা বাংলাদেশের কৌনিক সীমান্তে অবস্থিত মৌলভীবাজার জেলা ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বহুবর্ণিল প্রাচীনত্ব যেমন বহন করে আছে তেমনি বৃহত্তর বাঙালি জনগোষ্ঠীর পাশপাশি এ জেলায় সমতল-অসতলে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী হিসেবে অভিহিত অসংখ্য জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে। বাংলাদেশে যতগুলো জেলা আছে তাদের নিজস্ব বৈশিষ্ট থাকার পরও মৌলভীবাজার জেলা বাংলাদেশের অনেকগুলো বৈশিষ্ট্য বহন করে থাকে যা অন্য কোন জেলা এককভাবে এত বৈশিষ্ট্য বহন করে বলে প্রতীয়মান হয় না। যেমন : ১। এই জেলায় ৯২ টির মতো চা বাগান রয়েছে, ক্ষুদ জাতিগোষ্ঠী অধ্যুষিত চা জনগোষ্ঠীর মানুষ সংখ্যার হিসাবে ৪ (চার) লক্ষাধিক। বসবাসরত এই জনগোষ্ঠীর লোকজন বাংলাদেশ সরকারের তালিকাভূক্ত

নৃগোষ্ঠী হিসেবে ৫০টি অর্ন্তভূক্তির হিসাব বিবেচিত থাকলেও কেবলমাত্র মৌলভীবজাার জেলায়ই ৩০-৩৫টির মতো সরকারের তালিকাভূক্ত নৃগোষ্ঠীর অবস্থান রয়েছে। ২। অনুসন্ধান, গবেষণা পরিচালিত হলে এই চা-জনগোষ্ঠীর মাঝে আরও অনেক ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্তির গ্রহণযোগ্যতা বিদ্যমান। ৩। এই জেলায় ৩০-৩৫টির মতো ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষার মানুষ আছেন যাদের ভাষার চর্চা সংরক্ষণের অভাবে তাদের মাতৃভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। ৪। সমতল-অসমতলের বসবাসরত এসব ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষেরা বিচিত্র রকমের শতাধিক উৎসবাদি পালন করে থাকে। যারা সংস্কৃতির অংশ হিসেবে বিবেচনার দাবি রাখে। ৫। এই জেলায় চা বাগান অধ্যুষিত নারী ও পুরুষ চা শিল্পের সাথে যুক্ত থাকায় যা ভিন্ন বৈশিষ্ঠ্যের কৃষিভিত্তিক উৎপাদনশীল শ্রম হিসেবে পরিগণিত হয়ে আছে; কিন্তু এই জনগোষ্ঠীর ভাষা, সংস্কৃতি ও শিক্ষার লক্ষ্যে কোন বিশেষ বিনোদন শিল্প চর্চা কেন্দ্র না থাকায় এই জেলা তথা বাংলাদেশ একটি নান্দনিক শিল্প চর্চা থেকে বঞ্চিত থাকছে। যার ফলে আমাদের জাতীয় সংস্কৃতির বর্ণিল দিক উপেক্ষিত থাকছে। ৬। এই জেলায় ভাষা সংস্কৃতির এমন বিরাটত্ব, সমাহার রয়েছে যে, এখানে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মাত্রাকে স্পর্শ বা চিহ্নিত করে ভাষা চর্চা, ভাষা উৎসব, ভাষা লিপিচর্চা, গবেষণার ক্ষেত্র আছে। ৭। এখানে মণিপুরী, ত্রিপুরী, সাঁওতাল, মুন্ডা, গারো, খাসি, ওরাও, তেলেগু, ভূইয়াসহ শতাধিক জাতিগোষ্ঠীর তথ্য পাওয়া যায়। এখানে কতিপয় নাম উল্লেখ করা যায়, যেমন বাউরী, রবিদাস, চৌহান, গোয়ালা, কৈরি, দেশওয়াল, কন্দ বড়াইক, হাজরা, টটরো, কঙ্খর, পানিকা, কালোয়াড়, সিংহ, রাউত, মাহরা, ঘাটোয়াল, গঞ্জু, ভর, দোষাদ, কুর্মী, টংলা, মৃধা, মাহারা, মুদি, সৌরি, পাত্র কারুয়া, নায়েক, মোদক, খয়রা, পাশী, ঘাষী, হাড়িয়া চাষা, লোহার তাঁতী, বর্মা, বাউতিয়া, বিন, ভুজপুরি, চিসিম, রজক, প্যাটেল, প্রজাপতি ইত্যাদি। ৮। এই জেলায় বিশেষত চা জনগোষ্ঠীর মাঝে উৎসব অনুষ্ঠানদির সংখ্যা আকারে প্রকারে অনেক যার সংখ্যা শতাধিক বলে অনুমিত হয়। এসব উৎসব-অনুষ্ঠানে ইতিহাস-ঐতিহ্য মিথ, পুরানের বহুমাত্রিকতা বহন করে, যা ঠিকমতো সংগ্রহ করা হলে এই জেলার বহুবর্ণিল সংষ্কৃতির একটি আকর ভান্ডার গড়ে উঠতে পারে এবং এতদ বিষয়ক গবেষণাধর্মী গ্রন্থ প্রকাশের সুযোগ আছে। ৯। এ জেলায় এত সব ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষা চর্চার প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ সৃষ্টি হলে স্কুলগামী ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে মাতৃভাষা শিক্ষা বর্ণমালা, প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ সম্বলিত বই প্রণয়ন ও প্রকাশনার সুযোগ ঘটবে। ১০। মহান মুক্তিযুদ্ধে বৃহত্তর বাঙালি জনগোষ্ঠী পাশাপাশি চা শ্রমিক জনগোষ্ঠীর অবদান বিশেষভাবে গৃহীত হয়ে আছে। মৌলভীবাজার জেলার অনেকগুলো চা বাগান কেন্দ্রিক মুক্তিযুদ্ধের স্পষ্ট বিদ্যমান আছে। যেখানে অসংখ্যা চা শ্রমিককে পাকিস্তানিরা হত্যা করেছে, অনেকে আহত হয়েছে, নির্যাতিত হয়েছে। এমনকি এসব স্পটে ঝাকে ঝাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এসবের অনেকগুলি নিদর্শন বিদ্যমান আছে এবং অনেকগুলি অনুসন্ধানের বিষয় হয়ে আছে। ১১। এছাড়া, এ জেলায় দৃষ্টিনন্দন মনিপুরী জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে। যারা ৩ ভাগে মীতৈ, বিষ্ণুপ্রিয়া ও পাঙন হিসেবে অবহিত। ১২। এ জেলায় ত্রিপুরি ও মীতৈ মনিপুরীসহ কতিপয় জাতিগোষ্ঠীর ভাষার লিখিত বর্ণমালা রয়েছে যা চর্চার সুযোগ থাকলে শিক্ষা ক্ষেত্রে অগ্রগতি সূচিত হবে এবং অপরাপর জাতিগোষ্ঠীর ভাষা, বর্ণমালা চর্চায় অনুপ্রানিত হওয়ার সুযোগ থাকবে। পরিশেষে মৌলভীবাজার জেলায় বিশাল এ জনগোষ্ঠীর ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার জন্য একটি জনজাতি কেন্দ্রিক বা ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী কেন্দ্রিক ভাষা ইন্সটিটিউট স্থাপন অতীব জরুরি বিবেচিত হলেও অদ্যাবধি স্থাপিত হয়নি। সামগ্রিক দিক বিবেচনায় বাংলাদেশের মৌলভীবাজার জেলায় ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষা, সাহিত্য ও সংষ্কৃতি চর্চা বিষয়ক ইন্সটিটিউট বা এ জাতীয় কোন প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা যুক্তিযুক্ত বলে মনে করার সংগত কারণ রয়েছে। বিদ্যমান বাস্তবতা এর গ্রহণযোগ্যতা উচ্চকিত করে।

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..