মার্কিন মদদে ইসরাইলের ইরান আক্রমণ মার্কিনের ‘সবুজ বেষ্টনীর’ নয়া ব্যবহার!
এ আর খান আসাদ
১৯৫০-১৯৮০ দশকগুলিতে, পুঁজিবাদের সাথে সমাজতন্ত্রের স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে, মার্কিন সামরিক কৌশলবিদেরা ‘মুসলমান অধ্যুষিত’ অঞ্চলের জন্য একটি তত্ত্ব দাঁড় করায়। তত্ত্বটি হচ্ছে ‘সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদের প্রসারকে স্থানীয় শক্তি দিয়ে প্রতিরোধ করা’। তত্ত্বটি হচ্ছে- লাল কমিউনিজমের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ইসলাম একটি ‘সবুজ বেষ্টনী’।
Zbigniwe Bryeyinski যিনি ছিলেন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের জাতীয় নিরাপতা উপদেষ্টা, তার মাথা থেকে বেরোয় যে “political Islam could serve as a bulwark against Soviet atheistic communism”। অর্থাৎ ‘রাজনৈতিক ইসলাম’ হবে ‘সোভিয়েত নাস্তিক্যবাদী সাম্যবাদের’ বিপক্ষে একটি মতাদর্শগত প্রতিপক্ষ। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ পূর্বানুমান করে যে, ইসলামি মতবাদ (রাজনৈতিক ইসলাম, মৌলবাদ), যেটি ধর্মভিত্তিক ও রক্ষণশীল- তা মার্কসবাদী বস্তুবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষ বিপ্লবের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী সামাজিক বাধা হিসেবে কাজ করতে পারে। এই ধারণার উপর ভিত্তি করে সিআইএ ‘মুসলিম বিশ্বে’ তার রণকৌশল ঠিক করে, এবং বাস্তবায়ন করে। নিচে ঐতিহাসিক উদহারণ দেওয়া হলো।
মিসর- মুসলিম ব্রাদারহুডকে (১৯৫০-৬০ এর দশক) কাজে লাগানো। নাসেরের নেতৃত্বে আরব সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত অবস্থান ছিল। ব্রিটিশ ও সৌদি গোয়েন্দা চ্যানেলের মাধ্যমে মুসলিম ব্রাদারহুডকে সাহায্য করে, এবং তা নাসের বিরোধী শক্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
ইরান- (১৯৫৩) ধর্মীয় ও বাজারপন্থিদের সহায়তায় মোসাদ্দেকের পতন। ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী মোহাম্মদ মোসাদ্দেকের সরকারকে উৎখাতে মার্কিন সিআইএ এবং ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা ধর্মীয় নেতা ও বনিক শ্রেণির সহযোগিতা নেয়। এর মাধ্যমে ধর্মীয় গোষ্ঠী রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
ইন্দোনেশিয়া- (১৯৬৫-৬৬) ইসলামপন্থিদের মাধ্যমে প্রায় ১০ লক্ষ কমিউনিস্ট ও প্রগতিশীল হত্যা করা হয় (‘জাকার্তা মেথড’)। ইন্দোনেশিয়ায় কমিউনিস্ট নিধনে ইসলামপন্থি সংগঠনগুলো, বিশেষ করে ‘নাহদাতুল উলামার যুব শাখা’ প্রধান ভূমিকা পালন করে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এই গণহত্যামূলক দমনকে Cold War-এর একটি “বড় বিজয়” হিসেবে বিবেচনা করে।
মধ্যপ্রাচ্য- নাসেরবাদ ও বাথবাদকে মোকাবেলায় সৌদি ইসলামপন্থার ব্যবহার। নাসেরের মিশর ও বাথ দল শাসিত সিরিয়া ও ইরাক ছিল সমাজতান্ত্রিক ও সোভিয়েত ঘেঁষা। যুক্তরাষ্ট্র এতে উদ্বিগ্ন ছিল। তাই যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন দেয় সৌদি আরবের ইসলামি রাজতন্ত্রকে, যাতে তারা ওয়াহাবি মতবাদের মাধ্যমে ইসলামি ভাবধারা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয় এবং সমাজতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদকে দমন করে।
আফগানিস্তান- ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র সিআইএ’র “অপারেশন সাইক্লোন”-এর মাধ্যমে মুজাহিদিনদের অস্ত্র, অর্থ ও প্রশিক্ষণ দেয়। পাকিস্তান, বিশেষ করে জেনারেল জিয়া উল হকের নেতৃত্বে, ইসলামপন্থি গোষ্ঠীদের অগ্রাধিকার দেয়। এই সময়েই ওসামা বিন লাদেন ও অন্যান্য জিহাদি নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠে- যা পরবর্তীতে আল-কায়েদাতে রূপ নেয়। এরপর বিশ্বব্যাপ্তি ইসলামি জঙ্গিবাদী নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে পড়ে। এই সময়কালেই প্যালেস্টাইনে হামাস শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ধারণা করা হয় সিয়াইএ এবং মোসাদের প্রত্যক্ষ সহায়তায়। দুই দিক থেকেই ‘শত্রুর শত্রু মিত্র’ ধারণা এই ধরনের ‘সহযোগিতা’ গ্রহণযোগ্যতা দেয়। (যেমন বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের শত্রু জামায়াত, ফলে জামায়াত আমার বন্ধুদের বিশেষ করে বিভ্রান্ত বামপন্থি তরুণদের গেলানোর চেষ্টা হয়েছে।)
বাংলাদেশ- ১৯৭১ সালে রাজাকার-আলবদর বাহিনী তৈরির কৌশলগত পরামর্শ সিয়াইএর এবং ১৪ ডিসেম্বর সেক্যুলার বুদ্ধিজীবী হত্যা মূলত পরবর্তীতে ‘রাজনৈতিক ইসলামকে’ প্রতিষ্ঠা করার লং টার্ম প্লান থেকে।
মার্কিন ‘সবুজ বেষ্টনী’ কৌশলের কিছু উল্টো প্রতিক্রিয়া ঘটে যেমন ৯/১১ টুইন টাওয়ার হামলা। তবে মার্কিন সামরিক কৌশলবিদেরা এই উল্টো হাওয়াকেও সুযোগে পরিণত করার নয়া কৌশল নেয়। রাজনৈতিক ইসলামকে ব্যবহার করে রেজিমচেঞ্জ ও অস্ত্রবাণিজ্যের কাজে।
মার্কিন সমর্থিত ইসলামপন্থি গোষ্ঠীগুলোর তাত্ত্বিকেরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধেই দাঁড়ায়, এবং সাংস্কৃতিক উপনিবেশবাদী, সামরিক দখলদার ও বিশ্বাসঘাতক হিসেবে আখ্যা দেয়। ৯/১১ সন্ত্রাসী হামলা মার্কিন সমাজতন্ত্র ঠেকানোর নীতির উল্টো প্রতিক্রিয়া। ইসলামি মৌলবাদীদের মার্কিন ঘৃণা কারণ ওরা ‘ইহুদি নাসার’ যা একটি বিপরীত বর্ণবাদী অবস্থান। এই অবস্থান বামপন্থিদের থেকে মৌলিকভাবে আলাদা, কারণ বামপন্থিরা মূলত পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী।
মার্কিনের পুরনো মতাদর্শগত লড়াই ‘লাল সাম্যবাদ’ ঠেকানো রাজনৈতিক ইসলামের ‘সবুজ বেষ্টনী’ দিয়ে, তা কি বাতিল করা হয়েছে? না তা বাতিল করা হয়নি। সমাজতন্ত্র ঠেকানোর নীতি আবার ফিরে এসেছে চীনের ‘সমাজতন্ত্র’ অব্যাহত থাকায় ও ল্যাটিন আমেরিকার বামপন্থিদের উত্থানের কারণে।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের এই সময়ে নতুন লক্ষ্য কী? এটি হচ্ছে মার্কিন ভূ-রাজনীতির স্বার্থে ‘রাজনৈতিক ইসলামের’ তথা জঙ্গিবাদকে ভিন্ন ভাবে ব্যবহার। দুই কৌশলে : (১) মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলকে শক্তিশালী করা, আগ্রাসন ঘটানো, সেজন্য ইসরাইলের হাতে সন্ত্রাসবাদের ‘অজুহাত’ তুলে দেয়া। এই কাজে মৌলবাদী জঙ্গিদের ব্যবহার করা, উস্কানিমূলক হামলা ঘটিয়ে। (২) মৌলবাদী জঙ্গিদের দিয়ে ‘আরববসন্ত’ ধরনের আন্দোলনে সহিংসতা ঢুকিয়ে রেজিমচেঞ্জ করা, এবং পুরো দেশ/অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করা, যা নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করে। নিরাপত্তা ঝুঁকি সৃষ্টি হলে অস্ত্র বাণিজ্যের প্রসার অনিবার্য। আরবিয় ও অন্যান্য সরকারগুলোকে তখন অস্ত্র বাণিজ্যের চক্রে ঢুকিয়ে ফেলা সহজ হয়।
কিছু বামরাও নিজেদের অজান্তে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে। ইসলামকে ‘ধর্মের’ বদলে ঐতিহ্য, সভ্যতা ও জীবনবিধান ইত্যাদি নামে প্রচার করে। সেক্যুলারিজমের বিরোধিতা করে, মৌলবাদ বিরোধিতাকে ‘ইসলামোফোব’ বলে গলা মেলায়, বাস্তবে রাজাকারের সাথে ঐক্য করে। সাম্প্রদায়িকতা মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের পরোক্ষ বৈধতা দেয়, ফলত অসচেতন বিশ্বাসঘাতক হিসেবে দেশদ্রোহী ভূমিকা রাখে।
লেখক : গবেষক ও লেখক
Login to comment..