সমাজ বিপ্লবে কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা

মিজানুর রহমান সেলিম

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির চূড়ান্ত লক্ষ্য, শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে এবং সর্বহারা শ্রেণির একনায়কত্বের ভেতর দিয়ে দেশে সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা করা। পার্টির এই লক্ষ্যকে অগ্রসর করার জন্য প্রয়োজন মার্কসবাদ ও লেনিনবাদী মতাদর্শের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা গণভিত্তিসম্পন্ন একটি সুশৃঙ্খল কমিউনিস্ট পার্টি। যে পার্টি দেশের বিরাজমান বাস্তবতাকে বিচার-বিশ্লেষণ করে তার চলমান আশু কর্তব্য হিসেবে জরুরি কর্মসূচি হাজির করবে এবং এই কর্মসূচির সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে পার্টি তার চূড়ান্ত লক্ষ্যের পথে অগ্রসর হবে। অর্থাৎ এই কর্মসূচি প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নের লড়াই যেন সমাজতন্ত্র অভিমুখী সমাজ বিপ্লব সম্পন্ন করার লক্ষ্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হয়। এক্ষেত্রে যে কোন ধরনের বিচ্যুতি পার্টিকে তার রাজনৈতিক সংগ্রামের লক্ষ্য থেকে বিচ্যূতি ঘটাবে। সমাজতন্ত্র বিনির্মাণ হলো, সমাজ বিপ্লবের একটি গতিশীল প্রক্রিয়া। এই পর্বে সনাতন পুঁজিবাদী ব্যবস্থা উচ্ছেদ করে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের অসমাপ্ত কর্তব্য সম্পাদন করবে। এই কর্তব্য সম্পাদন করেই সমাজে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত তৈরি করতে হবে। এ কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হলে সমাজ ও রাষ্ট্রের চরিত্রে গুণগত পরিবর্তন সাধিত হবে। বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের এ প্রক্রিয়াও একটি কঠোর ও কঠিন প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। কারন রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আমলা মুৎসুদ্দি ও লুটেরা শাসকগোষ্ঠী এবং বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদ খুব স্বাভাবিকভাবে ও সহজে তাদের দখল ছেড়ে দেবে না বরং বিপ্লবের এই প্রক্রিয়াকে ধ্বংস করতে তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করবে। এ কারণেই সমাজ বিপ্লবে জনগণের সমর্থন, জনসচেতনতা ও বিপ্লবী কর্মপ্রক্রিয়া একান্তভাবে আবশ্যক হবে। লুটেরা ধনিক শ্রেণি ও কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠীকে রাষ্ট্র ও সমাজজীবন থেকে রাজনৈতিকভাবে উচ্ছেদ ও পরাভূত করার কর্তব্য পালনে কমিউনিস্ট পার্টিকে দৃঢ় ও অবিচল শক্তি হিসেবে সমাজে আবির্ভূত হতে হবে এবং এ মুহূর্তে শুধু কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষে এ কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব নয় বিধায় বাম প্রগতিশীল ও গণতন্ত্রীদের মিলিত একটি ফ্রন্ট বা জোট গঠন করে ইতিহাস অর্পিত এই দায়িত্ব পালন করতে হবে। ইতিহাস অর্পিত এই দায়িত্ব পালনে সহযোগী শক্তিসমূহকেও অবশ্যই সক্ষম ও যোগ্য করে তুলতে হবে। আমাদের মত দেশে একটি বিপ্লবী সরকারকে রাষ্ট্রক্ষমতায় অসীন হয়ে সমাজতন্ত্রে উত্তরণকালীন পর্বের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করতে হয়। বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের অসমাপ্ত কাজগুলো কী এবং তা কীভাবে সম্পন্ন করতে হবে, সেসব বিষয় পার্টির নেতা কর্মীদের নিকট স্পষ্ট হতে হবে। অসমাপ্ত কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো হলো, দেশের রাজনীতিতে, অর্থনীতিতে এবং সমাজজীবনে সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ ও অপ্রত্যক্ষ কর্তৃত্বের অবসান ঘটানো, ভূমির সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা করা, শিল্পায়ন ও সামন্ততন্ত্রের সাংস্কৃতিক রীতিনীতি ও ঐতিহ্যের অবসান ঘটানো, গ্রামীণ জীবনের আমূল বিপ্লবী পুনর্গঠন। সমবায় ও কৃষির আধুনিকায়ন ও বিজ্ঞানভিত্তিক কৃষি কর্মসূচি বাস্তবায়নের মধ্যদিয়ে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের গন্ডি অতিক্রম করে সর্বহারার গণতন্ত্রকে (একনায়কতন্ত্রকে) নিরন্তর প্রসারিত করা। সমাজে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের গণ্ডি অতিক্রম করে সর্বহারার গণতন্ত্রকে নিরন্তর প্রসারিত করে সমাজতন্ত্র বিনির্মাণের পথ ধরে অগ্রসর হতে হলে, বিপ্লবের পরে রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে আপাতত উচ্ছেদ হওয়া সাম্রাজ্যবাদ, লুটেরা ধণিক শ্রেণি, সাম্প্রদায়িক অপশক্তি ও কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর অস্তিত্ব যেহেতু সমাজ থেকে সম্পূর্ণরূপে বিলোপ হয়ে যায় না সেহেতু প্রতিক্রিয়ার এই শক্তি সমাজের অভ্যন্তরে সর্বহারার গণতন্ত্রকে বাধাগ্রস্ত করবে তাই, শ্রমিক শ্রেণি ও মেহনতি মানুষের নেতৃত্ব ছাড়াও সমাজে এই বিপ্লব বাস্তবায়নে যাদের স্বার্থ রয়েছে তাদেরও এই বিপ্লবী প্রক্রিয়ার সাথে বিপ্লবী শক্তি হিসেবে সমবেত করতে হবে। আধুনিক উৎপাদন ব্যবস্থার প্রধান শক্তি শ্রমিক শ্রেণি, এই শ্রেণির মৌলিক স্বার্থ দেশ ও জনগণের বৃহত্তর স্বার্থের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। নানা দুর্বলতা সত্ত্বেও আমাদের দেশের শ্রমিক শ্রেণি গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। তাই বর্তমান পর্যায়ের সমাজ বিপ্লবের সফল বাস্তবায়নের জন্য শ্রমিক শ্রেণিকে নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করতে হবে। এছাড়াও গ্রামাঞ্চলের বিশাল ক্ষেতমজুর জনগোষ্ঠী মূলত গ্রামীণ সর্বহারা। তারা আমাদের দেশের শ্রমিক শ্রেণির সহোদর। গ্রামীন সর্বহারা ক্ষেতমজুর ও শহরের শ্রমিক শ্রেণিকে সচেতন ও সংগঠিত করার দায় বর্তায় কমিউনিস্ট পার্টির ওপর। তাদের সচেতন ও সংগঠিত করতে পারলে তারা বিপ্লবী প্রক্রিয়ায় অগ্রণী বাহিনীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারবে। নির্মমভাবে শেষিত প্রান্তিক কৃষক এবং গরিব ও মধ্য কৃষক এবং মেহনতি কৃষক হবে বিপ্লবী প্রক্রিয়ার অপর একটি বলিষ্ঠ উপাদান। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি, পেশাজীবী, ক্ষুদে উৎপাদক, কারিগর, স্বনিয়োজিত উদ্যোক্তাদের ভূমিকাও হবে গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশে এখন ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী তরুণদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ২৫ শতাংশ, যা মোট ৪ কোটি ৫৯ লক্ষ প্রায়। এর সাথে শিশু ও কিশোরদের যোগ করলে দাঁড়ায় ৫৭ শতাংশ। ২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থানে তরুণরা তথা জেন-জি অসাধারণ ও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। তরুণদের উদ্ভাবনী শক্তি, কর্মক্ষমতা, দক্ষতা ও সৃজনশীলতাকে দেশ ও জনগণের স্বার্থে বিপ্লবী প্রক্রিয়ায় কাজে লাগাতে হবে। কমিউনিস্ট পার্টি, বামজোট ও গণতন্ত্রীদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে দেশের শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল সংগ্রামে সমাজের সহযোগী শক্তিসমূহকে তাদের ঐতিহাসিক ভূমিকা পালনে সক্ষম করে তোলার দায়িত্ব রয়েছে। পাশাপাশি সমাজের এই শক্তিকে সমাজতন্ত্রে উত্তরণকালীন পর্যায়ে গণতান্ত্রিক বিপ্লবের শত্রুর ভূমিকায় যারা থাকবে তাদের শ্রেণিশত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে দেয়া এবং লড়াইয়ের দিশা নির্ধারণ করে দেয়া একান্ত প্রয়োজন। আমাদের দেশে এই লড়াইয়ে শত্রুর ভূমিকায় থাকবে সাম্রাজ্যবাদ, নয়া উপনিবেশবাদ, দেশের সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র ও লুটেরা পুঁজিপতি শ্রেণি এবং গ্রামাঞ্চলের পরগাছা কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠীসহ মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক প্রতিক্রিয়াশীল চক্র। এছাড়াও বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সুবিধাভোগী, লুটেরা ধনিক শ্রেণির তাবেদার ও প্রতিক্রিয়াশীল ভাবধারার অনুসারীরাও এ বিপ্লবী প্রক্রিয়ার বিরোধিতা করবে এবং শত্রুর ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে। রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে বুর্জোয়া শ্রেণিকে উৎখাত করে বুর্জোয়া বিপ্লবের অসমাপ্ত কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য সমাজের বিপ্লবী শ্রেণিশক্তি সমাবেশ সংগঠিত করা ও শ্রেণি শত্রুকে ঠিক ঠিকভাবে চিহ্নিত করা কমিউনিস্ট ও বামপন্থিদের একটি নৈতিক দায়। এক্ষেত্রে যেকোনো পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক সংগ্রামের পথ বাছাইয়ে ভ্রান্তি ও ভুল দিশা সমাজ বিপ্লবের ইতিহাসে কমিউনিস্টদের অযোগ্যতাকে চিহ্নিত করে রাখবে। তাই সমাজ বিপ্লব সাধনে কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা কী হবে এবং কীভাবে সে ভূমিকা পালন করবে তা নির্ধারণ করা একটি গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য। এই নিবন্ধের শুরুতে বলা হয়েছে কমিউনিস্ট পার্টি চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে সর্বহারা একনায়কত্বের ভেতর দিয়ে সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার লড়াই অব্যাহত রাখবে। এজন্য মার্কসবাদ-লেনিনবাদের আদর্শকে ধারণ করে পার্টিকে তার সকল কর্মসূচি বাস্তবায়নের রাজনৈতিক সংগ্রামে মতাদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গির সৃজনশীল প্রয়োগকে নিশ্চিত করে মূল লক্ষ্যাভিমুখে অগ্রসর হতে হবে। এক্ষেত্রে পার্টির চলমান কর্তব্যসমূহ নির্ধারণের ক্ষেত্রে সবসময় বিরাজমান বাস্তবতাকে বিবেচনায় নিয়ে নির্দিষ্ট মুহূর্তের বাস্তবতা এবং ঐ সময়ে শক্তির ভারসাম্য বিবেচনায় রেখে রণকৌশল গ্রহণের মাধ্যমে সমাজবিপ্লবের লক্ষ্যে রাজনৈতিক সংগ্রাম অগ্রসর করতে হয়। রাজনৈতিক সংগ্রামের পাশাপাশি গণমানুষের দৈনন্দিন সমস্যা সমাধানের সংগ্রামে দৃঢ়, সাহসী ও বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে এসব সংগ্রামে সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদান এবং বাস্তবকাজে পদক্ষেপ গ্রহণ করে পার্টিকে তার স্বাধীন ভূমিকাকে স্পষ্ট করে তুলতে হবে। বিষয়টিকে আরও পরিষ্কার করে বললে বলতে হয়, বাম গণতান্ত্রিক সরকারের নেতৃত্বে সমাজ বিপ্লব সম্পন্ন করার আগে রাষ্ট্রক্ষমতায় নানা ধরণের উত্থান-পতন ও পরিবর্তনের যদি সম্ভাবনা থাকে এবং এ ধরনের কোন সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে ঐক্য ও সংগ্রামের কৌশলের প্রশ্নটি যদি সামনে আসে, তা হলে পার্টি কি করবে? পার্টির লক্ষ্য সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। সমাজ বিপ্লবের মাধ্যমে এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য সমাজ বিপ্লবের পক্ষের রাজনৈতিক, সামাজিক শক্তির এবং ব্যক্তির বৃহত্তর সমঝোতা ও ঐক্য গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তার প্রশ্নে পার্টি আন্তরিক, তবে পার্টি ও বাম গণতান্ত্রিক জোট তাদের স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীন অবস্থানের ওপর দাঁড়িয়ে শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গির নীতিনিষ্ঠ অবস্থানকে ঠিক রেখে এমনভাবে করনীয় কৌশল নির্ধারণ করবে, যাতে তাদের রাজনৈতিক সংগ্রাম সমাজ বিপ্লবের দিকে অগ্রসর হয় এবং শ্রমিকশ্রেণির স্বকীয়তা বজায় রেখে স্বাধীন যাত্রা অব্যাহত থাকে ও ত্বরান্বিত হয়। বলা প্রয়োজন, লড়াই সংগ্রামের রণনীতিগত কর্তব্য সঠিকভাবে নির্ধারিত হলেও এই সংগ্রামের মূল হাতিয়ার হলো পার্টি সংগঠন, সেই পার্টি সংগঠনটি গুনে-মানে-শৃঙ্খলায়, নিষ্ঠায় উন্নত ও শক্তিশালী না হলে এবং পার্টির গণভিত্তি প্রসারিত না হলে ভবিষ্যতে আরও বৃহত্তর বিপ্লবী কর্তব্য সম্পাদন করে পার্টির চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হবে না। তাই কমিউনিস্ট পার্টিকে প্রকৃত কমিউনিস্ট পার্টি রূপে যোগ্য হয়ে ওঠার জন্য তিনটি মৌলিক ভিত্তির ওপর দাঁড়াতেই হবে, প্রথমত, মার্কসবাদ-লেনিনবাদের মতাদর্শগত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে তার চর্চা ও উপলব্ধির স্তর এমনভাবে উন্নত করতে হবে যা তাঁর শ্রেণিদৃষ্টিভঙ্গিকে স্বচ্ছ করে তোলে, যাতে তিনি সেই দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে জগৎ, মানবসমাজ ও মানব চিন্তার ধরণ ও তার বদলের নিয়মকে অনুধাবন করতে পারেন। দ্বিতীয়ত: পার্টির শ্রেণিভিত্তি প্রসঙ্গ। প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলই কোন একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির স্বার্থ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে ঐ শ্রেণির ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে দলটি পরিচালনা করে। তখন দলটির লক্ষ্য থাকে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে মূলত ঐ শ্রেণির স্বার্থ রক্ষা করা। সেভাবেই কমিউনিস্ট পার্টিও শ্রমিক শ্রেণি ও মেহনতি মানুষের শ্রেণিভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্যই লড়াই করে। কারন বুর্জোয়া ব্যবস্থাকে উৎখাত করে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের স্বার্থ রক্ষার দায় ঐতিহাসিকভাবে কমিউনিস্ট পার্টি ও শ্রমিক শ্রেণির ওপরই বর্তিয়েছে। কাজেই শ্রমিক শ্রেণির অগ্রবাহিনী হিসেবে কমিউনিস্ট পার্টিকেই শ্রমজীবী ও মেহনতি মানুষকে সচেতন করে তোলার দায়িত্ব নিয়ে সমাজ বিপ্লবের জন্য উপযুক্ত ও দক্ষ করে তুলতে হবে। তৃতীয়ত: কমিউনিস্ট পার্টির চূড়ান্ত লক্ষ্য সমাজতন্ত্র-সম্রাজ্যবাদ। প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দল তার নিজ শ্রেণির স্বার্থ রক্ষার জন্য চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসেবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে। কমিউনিস্ট পার্টিও শ্রমজীবী-মেহনতি মানুষের মুক্তি অর্জন সহ অপরাপর শ্রেণির মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে সমাজতন্ত্র-সাম্রাজ্যবাদকে চূড়ান্ত লক্ষ্যের পাশাপাশি পার্টির সামনে সবসময়ই কতগুলো আশু লক্ষ্য অর্জনের এবং নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বিশেষ বিশেষ কিছু কর্তব্য হাজির হয়। গুণে-মানে-শৃঙ্খলায় ও নিষ্ঠায় উন্নত একটি পার্টিই কেবল তার ওপর অর্পিত এই ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হবে। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, দেশের বিরাজমান বাস্তবতাকে বিবেচনায় নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে আশু কর্তব্য হিসেবে জরুরি কর্মসূচি হাজির করতে হয় এবং সেই কর্মসূচির সফল বাস্তবায়নেই কেবল পার্টিকে তার মূল লক্ষ্যে অগ্রসর হতে সহায়তা করে। আজকে দেশের বাস্তবতয় দেখা যায় সাধারণ মানুষের জীবনে নানামুখী সংকট, বিশেষ করে শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের জীবনের সংকট আরো গভীর। গার্মেন্টস শ্রমিকদের বকেয়া বেতনের দাবি মালিকপক্ষ মেনে নিচ্ছে না। স্বার্থান্বেষী মহলের স্বার্থে “এক আইডি এক লাইসেন্স” নীতি প্রয়োগ করে লক্ষ লক্ষ মানুষকে কর্মহীন করার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবীও সিটি কর্পোরেশন মেনে নিচ্ছে না। টিসিবি ভোজ্যতেলসহ ডাল-চিনির দাম প্রায় দ্বিগুণ করে নিম্নবিত্ত মানুষদের বিপদে ফেলেছে। কৃষি উপকরণের মূল্যবৃদ্ধির চাপসহ ফসলের লাভজনক মূল্য থেকে কৃষক বঞ্চিত। রাখাইনে মানবিক সহায়তার নামে করিডোর ও বন্দর লিজ দেয়ার তৎপরতায় আজ সমগ্র জাতি উদ্বিগ্ন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে এদেশের ছাত্র-জনতা ও রাজনৈতিক দলগুলো ম্যান্ডেট দিয়েছে প্রয়োজনীয় সংস্কার ও সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন করার জন্য। দেশের স্বার্থ সাম্রাজ্যবাদীদের হাতে বিকিয়ে দেয়ার জন্য নয়। মানবিক করিডোরের নামে আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের সাথে আঁতাত আর অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তিগুলোর সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে ফেলার চক্রান্ত দেশবাসী রুখে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। স্বাধীনতা ও সার্বভোমত্ববিরোধী তৎপরতা থেকে সরকার সরে না আসায় বামপন্থিদের পক্ষ থেকে আগামী ২৭-২৮ জুন চট্টগ্রাম অভিমুখে লংমার্চ ঘোষণা করা হয়েছে। তারা প্রয়োজনে ঘেরাও অবরোধ ও হরতালের মতো কর্মসূচি দেয়ার কথা ঘোষণা করেছে। এছাড়াও গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী গণতন্ত্র ও বৈষম্যমুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়নের জন্য গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের সংস্কারের লক্ষ্যে জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশন গঠন করা হলেও গণভোট, গণপরিষদ সংবিধানের মূলনীতি পরিবর্তন প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যমত্যে পৌঁছাতে পারেনি। এসব কিছু মিলিয়ে দেশবাসী আজ শঙ্কিত ও উদ্বিগ্ন। এভাবে আমরা এক সর্বগ্রাসী বিপদকে মোকাবিলা করছি। তাই এই সংকট থেকে দেশকে উদ্ধারের জন্য শুধু টোটকা সংস্কার নয় বরং সমাজবিপ্লব সাধন করার মহান দেশপ্রেমিক কর্তব্য সমগ্র জাতির সামনে উপস্থিত। এই কর্তব্য একক কোন রাজনৈতিক দলের পক্ষে এমনকি কেবল রাজনীতিবিদদের পক্ষেও এককভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। সমগ্র জাতির সর্বস্তরের জনগণের সম্মিলিত শক্তি সামর্থের সম্মিলিত এবং সে শক্তির সৃজনশীল প্রয়োগের মাধ্যমেই কেবল এই কর্তব্য সম্পাদন করা সম্ভব। যে কর্তব্য সম্পাদন করার উদ্যোগ গ্রহণ করা আজ প্রতিটি দেশপ্রেমিক শক্তি ও ব্যক্তির জরুরি কর্তব্য হয়ে পড়েছে। জাতীয় উজ্জীবনের এমন কর্তব্য পালনের সুমহান সংগ্রামী ঐতিহ্য এবং গৌরবগাঁথা আমাদের সামনে রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকালীন আমরা সমগ্র জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে অপরিসীম ত্যাগ ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মাতৃভূমি স্বাধীন করেছি। আজ পুনরায় জাতীয় উজ্জীবনের জন্য তেমন কর্তব্যই সমগ্র জাতির সামনে উপস্থিত হয়েছে। আজ তাই পুনরায় সমগ্র জাতির সব দেশপ্রেমিক শ্রেণি, স্তর ও ব্যক্তির সম্মিলিত প্রয়াস-শক্তি-সম্পদ-মেধা ও সমবেত সংগঠন-শক্তির মাধ্যমেই জাতীয় উজ্জীবনের কর্তব্য সম্পাদন হতে পারে। আজ তাই জাতীয় উজ্জীবন ঘটিয়ে এই কর্তব্য সম্পাদনের মধ্য দিয়ে সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে সমাজ বিপ্লব সাধন করার সংগ্রামে অংশগ্রহণের জন্য বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে দেশবাসীর কাছে আহ্বান। লেখক : সভাপতি, বরিশাল জেলা কমিটি, সিপিবি

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..