প্রসঙ্গ সংস্কার : স্থানীয় স্বশাসন ও জনগণের ক্ষমতায়ন

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email
২৪-এর ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের এক বছর অতিক্রম হতে চলেছে। সংস্কার বিষয়ে দুটি কথা মনে রাখা প্রয়োজন। প্রথমতঃ সংস্কার বলতে পরিবর্তন বোঝায়। এই পরিবর্তনের গতিমুখ মূলত দু’রকম হতে পারে–সামনের দিকে অথবা পেছনের দিকে। সামনের দিকে পরিবর্তন সাধনের বদলে পরিবর্তনকে পেছন দিকে নিয়ে প্রগতির বদলে রক্ষণশীল এবং এমনকি প্রতিক্রিয়াশীল পরিবর্তনকে সংস্কার বলে চালিয়ে দেয়া হতে পারে। সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। দ্বিতীয়তঃ প্রগতিশীল সংস্কারের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হলে জনগণের অংশগ্রহণ ঘটাতে হবে। দেশের চলমান সমাজ-অর্থনীতি-রাজনীতির ব্যবস্থাপনা (নতুন বয়ানে, ‘বন্দোবস্ত’ সংস্কার করতে হবে বলে প্রায় সবাই বলছে)। ‘বিচার’, ‘সংস্কার’, ‘নির্বাচন’–এই তিনটি বিষয় এখন ‘টক অফ দি নেশনে’ পরিণত হয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের মধ্য দিয়ে যে স্বপ্ন রচিত হয়েছিল এবং যে যুগান্তকারী সংস্কার ও বিশাল সম্ভাবনা জন্ম নিয়েছিল, সেই পথে স্বাধীন দেশের অগ্রগতি সাধিত হয়নি। বরঞ্চ সেই স্বপ্ন ও সম্ভাবনা বিনষ্ট হয়েছে। বলা বাহুল্য, এই বঞ্চনার জন্য ‘একাত্তরের’ স্বপ্ন ও সম্ভাবনার পথ দায়ী নয়। বরঞ্চ সেই ‘ব্যবস্থা’ ও ‘বন্দোবস্ত’ থেকে দেশকে দূরে নিয়ে যাওয়ার কারণেই আজ স্বপ্নভঙ্গ-রুগ্নতা-অবক্ষয়ের সৃষ্টি হয়েছে। তা থেকে পরিত্রাণের জন্যই ২৪-এর জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থান সংগঠিত হয়েছে। কিন্তু যেন-তেন ‘সংস্কার’ দ্বারা এই পরিত্রাণ সম্ভব হবে না। এসব নিয়ে গভীর আলোচনার প্রয়োজন। তা নিয়ে পরবর্তীতে আলোচনা করার চেষ্টা করব। আজ শুধু সংস্কারের ক্ষেত্রে অপরিহার্য হয়ে ওঠা, রাষ্ট্র, প্রশাসন সমাজের ‘গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণ’ তথা জনতার অধিকতর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে স্বশাসিত সংস্থার ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার বিষয়টি সম্পর্কে কিছু আলোচনা করব। সমাজে স্থানীয় স্বশাসনের ব্যবস্থাটি সুপ্রাচীনকাল থেকে প্রচলিত। রাজা-মহারাজারা রাজ্য চালাতেন। পরস্পর যুদ্ধ করতেন। রাজ্যের-সাম্রাজ্যের উত্থান-পতন ভাঙাগড়া চলত। এসবের মাঝেই প্রশান্ত লয়ে আপন তালে প্রবাহিত হতো গ্রামভিত্তিক ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র অর্থনৈতিক-সামাজিক-প্রশাসনিক এককগুলো। অনেকেই একে ‘এশিয়াটিক সোসাইটি’ বলে বিশেষায়িত করেছেন। গ্রামের এই প্রবহমান ফল্গুধারায় লালিত হতো, তারই বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে গড়ে ওঠা, এক বিশেষ ধরনের স্থানীয় স্বশাসিত ব্যবস্থার গণসংস্থাগুলো। কিছুদিন আগে পর্যন্ত ভগ্নরূপে টিকে থাকা মাতবর, সর্দার, পঞ্চায়েত ইত্যাদির মধ্যে সেই প্রাচীন ব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি কিছুটা খুঁজে পাওয়া যেতো। যুগ যুগ ধরে চলে আসা সেই স্বশাসিত স্থানীয় শাসনব্যবস্থার ওপর প্রথম সবচেয়ে বড় রকম ধাক্কা আসে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের থেকে। তাদের দ্বারা পরিচািলত রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় কর্তৃত্বকে তৃণমূল পর্যন্ত প্রসারিত করার রাজনৈতিক প্রয়োজনে তারা বিদ্যমান স্থানীয় স্বশাসন ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করার পদক্ষেপ নিয়েছিল। সেই উদ্দেশ্যে তারা ১৮৮৫ সালে আমাদের দেশে প্রবর্তন করেছিল ইউনিয়ন বোর্ড নামের সংস্থা। এর মাধ্যমেই প্রাচীনকাল থেকে প্রচলিত স্বশাসিত স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় বড় রকম বিকৃতি সাধন করা হয়েছিল। স্থানীয় স্বশাসিত ব্যবস্থাকে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক শাসন প্রক্রিয়ার আওতার মধ্যে নিয়ে আসা হয়েছিল। এগুলোকে পরিণত করা হয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকারের ‘স্থানীয় চৌকি’তে। তবে যেসব কাজ প্রাচীনকাল থেকে স্বশাসিত সংস্থাগুলো পরিচালনা করত, ব্রিটিশদের তৈরি করা ইউনিয়ন বোর্ডের মাধ্যমে সেসব কাজও করতে হতো। ব্রিটিশদের দ্বারা সৃষ্ট ইউনিয়ন বোর্ড, জেলা বোর্ড ইত্যাদির উত্তরাধিকার বহন করেই সমকালীন ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা পরিষদের গঠনধারা রচিত। আইয়ুব আমলে মৌলিক গণতন্ত্রের ব্যবস্থা প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে এদের দলীয় রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্যে আরো এক ধাপ টেনে নেওয়া হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের পর রচিত সংবিধানে ব্রিটিশ শাসকদের দ্বারা স্বশাসিত স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার বিকৃতি সাধন রদ করে তাকে তার প্রকৃত গণতান্ত্রিক মর্মবাণীর ভিত্তিতে পুনঃপ্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। সংবিধানে এ বিষয়ে একটি পৃথক পরিচ্ছেদ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু সংবিধানের সেই বিধান আজও বাস্তবায়িত হয়নি। যে গায়েবি স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর হাতে রাষ্ট্রের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ আগাগোড়া ছিল ও রয়েছে তারা তা বাস্তবায়িত হতে দেয়নি। এখনো তারাই তা হতে দিচ্ছে না। তাছাড়া ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্র স্থানীয় স্তরসহ সর্বত্র একটি প্রধান ‘প্লেয়ার’ এভাবে ক্ষমতার দড়ি টানাটানিতে একদিকে আমলাতন্ত্র আর অন্যদিকে আওয়ামী লীগ-বিএনপি প্রভৃতি বড় বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলো স্থানীয় সংস্থার ওপর তাদের কর্তৃত্ব চাপিয়ে দিতে সচেষ্ট থেকেছে। স্থানীয় সংস্থাকে পূর্ণ স্বশাসনের ক্ষমতা দিলে তাদের নিজেদের দাপট আর থাকবে না, এ ভয়ে তারা গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণের পথে একটি প্রধান বাধা হয়ে থেকেছে। প্রজেক্টের কাজ, বিধবা ভাতা, স্কুল-কলেজের শিক্ষক নিয়োগ, রাস্তা-কালভার্ট নির্মাণ ইত্যাদি হরেকরকমের কাজ স্থানীয় সংস্থার মাধ্যমে করতে হয়। এগুলোই ‘পাওয়ার’ দেখানোর ‘আসল’ জায়গা। এই ‘পাওয়ার’ স্থানীয় সংস্থার হাতে ছেড়ে দিলে এমপি হওয়ার, কিংবা আমলা হওয়ার ‘মজা’ আর কি-বা থাকে? তাই আমলারা ও এমপিরা একেবারেই নারাজ এসব বিষয় তাদের বিদ্যমান চূড়ান্ত কর্তৃত্ব ছাড়তে। ব্যাপারটা শুধু ‘পাওয়ারের’ বিষয় মাত্র নয়। এই পাওয়ারের সঙ্গে রয়েছে আর্থিক স্বার্থের ব্যাপারও। রাস্তাঘাট নির্মাণের টেন্ডার থেকে শুরু করে শিক্ষক নিয়োগ, ছাত্র ভর্তি, বিভিন্ন ভাতা বিতরণ, গমের প্রজেক্ট অনুমোদন–সবকিছুর সঙ্গে জড়িত রয়েছে বিপুল পরিমাণের ক্ষমতায়ন ক্ষমতায়ন উপরি-আয়ের ব্যাপার। এরূপ মোহনীয় আর্থিক সুযোগকে তারা স্বেচ্ছায় হাতছাড়া করতে রাজি নয়। স্থানীয় সরকার একদিকে ‘স্বশাসিত’ তথা নির্বাচিত এবং অন্যদিকে ‘সরকার’। অথচ তার ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব দুদিক থেকেই চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। একদিকে রয়েছে অধিকতর মর্যাদাসম্পন্ন নির্বাচিত প্রতিনিধি বলে দাবিদার জাতীয় সংসদের সদস্যদের কাছ থেকে চ্যালেঞ্জ। এমপি সাহেবরা মনে করেন যে, আমরাই তো ‘আসল’ নির্বাচিত প্রতিনিধি, তোমরা আবার কে? হ্যাঁ, তোমরা নির্বাচিত হয়ে থাকলেও সেই নির্বাচন ‘কম দামের’। তাই জনগণের প্রতিনিধি হিসাবে তোমরা জাতীয় সংসদ সদস্যদের অধীনস্থ একজন ‘জুনিয়র’ পার্টনার মাত্র। অন্যদিকে, রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের কর্তাদের ভাবনা হলো, তোমরা যেহেতু ‘সরকার’ তাই তোমরা দেশের ইউনিটারি (Unitary) সরকার ব্যবস্থার কেন্দ্রীয় কর্তৃত্বের একটি স্থানীয় ব্রাঞ্চ মাত্র। তোমাদের তাই ‘আসল’ সরকারের কর্তৃত্ব; যা কিনা আমলাতান্ত্রিক কাঠামোর মাধ্যমে উপর থেকে নিচ বরাবর প্রবাহিত হয়, তা মেনে নিয়ে কাজ করতে হবে। তাই এ কথা বলায় যায় যে, দুই গালে দুই তরফের বিরাশি সিক্কা ওজনের চপেটাঘাত খেয়ে দেশের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার হাল আজ চিৎপটাং হওয়ার মতো অবস্থা। একদিক থেকে ‘এমপিতন্ত্রের’ দড়াম ঘুষি, অন্যদিক থেকে ‘আমলাতন্ত্রের’ শক্তিশেল। স্থানীয় সরকারের এখন মরণ দশার অবস্থা। যুক্তি দেওয়া হয় যে, আমাদের দেশ যেহেতু একটি এককেন্দ্রিক (unitary) ক্ষমতা কাঠামোর দেশ (অর্থাৎfederative তথা যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার নয়) তাই দেশের ও রাষ্ট্রের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব রয়েছে একটি একক কেন্দ্রে। তাই কেন্দ্র তার সেই সর্বময় ক্ষমতার কিয়দংশ স্থানীয় সরকারের হাতে প্রদান করলেও, চূড়ান্ত কর্তৃত্ব রয়েছে একক কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে। কেন্দ্রের হাতে প্রয়োজনীয় ক্ষমতা সংরক্ষণ নিশ্চিত করার পর, অবশিষ্ট (residual) ক্ষমতা যদি কিছু থাকে কেবল সেটুকুই স্থানীয় সরকারের হাতে অর্পণ করা যেতে পারে। এরূপ প্রস্তাবনার বিপরীতমুখী ধারণা হলো- যেহেতু ‘প্রজাতন্ত্রের মালিক হলো জনগণ’, তাই ক্ষমতার প্রধান ভিত্তি হতে হবে জনগণের সবচেয়ে কাছাকাছিতে থাকা তৃণমূলের স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলো। এসব সংস্থা তাদের বাস্তব প্রয়োজনে কিছু অপরিহার্য ও গুরুত্বপূর্ণ (প্রতিরক্ষা, জাতীয় নিরাপত্তা, জাতীয় যোগাযোগ ব্যবস্থা, জ্বালানি-খনিজ-বিদ্যুৎ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, বৈদেশিক বাণিজ্য, বৈদেশিক সম্পর্ক ইত্যাদি) বিষয়গুলোর কর্তৃত্বকেন্দ্রীয় সরকারকে স্বেচ্ছায় প্রদান করবে। এরূপ ধারণা অনুযায়ী কেন্দ্রীয় সরকার হলো স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোর কাজের সহায়ক ঊর্ধ্বতন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ। ধারণাগত ক্ষেত্রে এ দুটি হলো দুই বিপরীত মেরুর চূড়ান্ত রূপ। এ নিয়ে বিতর্কে না গিয়েও যেটি বেশি দরকার তা হলো- কেন্দ্রীয় সরকার ও স্থানীয় সরকারের মধ্যে কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার ভাগবাটোয়ারা বাস্তবে কী হবে, তা নির্ধারণ করা। সেজন্য স্থানীয় সরকার সম্পর্কে দেশের সংবিধানে কী আছে প্রথমে সেদিকে একটু নজর দেয়া যাক। প্রথমেই দেখা যাক, সংবিধনের দ্বিতীয় ভাগে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি শিরোনামে এ বিষয়ে কী লেখা আছে? এখানে ৯নং ধারায় লেখা হয়েছে, ‘...রাষ্ট্র সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রতিষ্ঠানসমূহকে প্রতিনিধিগণ সমন্বয়ে গঠিত স্থানীয় শাসন সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানসমূহকে উৎসাহ দান করিবেন...’। ‘সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রতিনিধি’ এবং তাদের ‘সমন্বয়ে গঠিত স্থানীয় শাসন-সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান’ শব্দগুলো থেকে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে এ বিষয়ে মর্মকথা স্পষ্ট হয়ে যায়। তারপর ১১নং ধরায় গণতন্ত্র প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘...এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।’ এখানে বিষয়টি আরও সুনির্দিষ্ট হয়েছে ‘সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে’ শব্দগুলো ব্যবহারের দ্বারা। সংবিধানের চতুর্থভাগের (নির্বাহী বিভাগ সংক্রান্ত ভাগ) তৃতীয় পরিচ্ছেদে ‘স্থানীয় শাসন’ শিরোনামে অন্তর্ভুক্ত কথাগুলো। এখানে যেসব কথা বলা হয়ছে, সেগুলো বাধ্যতামূলকভাবে অনুসরণীয় এখানে ৫৯(১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘আইনানুযায়ী নির্বাাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহের ওপর প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক প্রশাসনিক একাংশের স্থানীয় শাসনভার প্রদান করা হইবে।’ এখানে ‘প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক প্রশাসনিক একাংশের স্থানীয় শাসনভার’ শব্দের দ্বারা স্পষ্টতই স্ব-স্ব ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা, পৌর এলাকা ইত্যাদির কথাই বলা হয়ছে। সংশ্লিষ্ট এলাকার স্থানীয় শাসনের ভার কার ওপর অর্পিত থাকবে সে সম্পর্কেও স্পষ্ট নির্দেশনা হলো, ‘আইনানুযায়ী নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহের ওপর’। র্আৎ ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ ইত্যাদি সংস্থা নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত হতে হবে। এসব থেকে এ কথাই প্রতীয়মান হয় যে, ইউনিয়ন স্তরে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা স্তরে উপজেলা পরিষদ, জেলা স্তরে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানসহ পরিষদ ইত্যাদির ওপর সংশ্লিষ্ট এলাকর স্থানীয় শাসনভার অর্পিত হবে। এসব কোনো স্তরের কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রেই সংসদ সদস্য অথবা ইউএনও-কে কর্তৃত্ব প্রদানের প্রশ্ন কোনোক্রমেই আসতে পারে না। স্থানীয় স্বশাসিত সংস্থার প্রকৃত ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হলে তাদেরকে মন্ত্রণালয়ের ওপর নির্ভরতা থেকে মুক্ত করতে হবে। স্বশাসিত সংস্থা আর্থিক বিষয়ে ক্ষমতায়নের পদক্ষেপ নিতে হবে। এমনভাবে আইন করতে হবে যেন জাতীয় বাজেটের একাংশ (৩০% থেকে ৪০%) সরাসরি স্থানীয় সংস্থাকে বণ্টনের সংবিধিবদ্ধ ব্যবস্থা করতে হবে। একটি স্বাধীন সংস্থার দ্বারা কী পরিমাণে এই অর্থ বিভিন্ন স্থানীয় সংস্থার হাতে যাবে, তা উপযোগিতা বিবেচনা করে বরাদ্দ করবে। এই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নের ক্ষেত্রে ‘নিচের স্তর থেকে উপরমুখী’ করে তাকে অধিকতর বাস্তবসম্মত করা সম্ভব হবে। সংবিধানে উল্লিখিত স্থানীয় সরকারের কর্তৃত্ব সম্পর্কিত বিধানাবলি দেশের বুর্জোয়া দলগুলো বাস্তবায়ন করেনি। তারা তা করবে না। কারণ লুটেরা ধনতন্ত্রের যে ধারায় তারা দেশ চালাচ্ছে তার সঙ্গে জনগণের স্বার্থের মৌলিক দ্বন্দ্ব রয়েছে। তাই জনগণের ক্ষমতায়ন ও সেই লক্ষ্যে ক্ষমতার গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রিকরণ, বুর্জোয়া দলগুলোর মৌলিক স্বার্থের পরিপন্থী। লুটেরা ধনবাদের ধারায় বুর্জোয়া দলগুলোর শাসন এবং স্থানীয় সরকারের ক্ষমতায়ন–এ দুটি বিষয় হলো পরস্পর বৈরী তথা একে অপরের ‘অ্যান্টিথেসিস’। স্থানীয় সরকারের ইস্যুটি তাই স্পষ্টতই লুটেরা ধনতন্ত্রের ব্যবস্থার বিরুদ্ধে একটি সমাজ বিপ্লব সংগঠিত করার কর্তব্যের সঙ্গে জড়িত। সমাজ বিপ্লবের কর্তব্য সম্পাদনের জন্য রাষ্ট্রক্ষমতার প্রশ্নটি একটি নির্ধারক ইস্যু। রাষ্ট্রক্ষমতার সঙ্গে স্থানীয় সরকারের ক্ষমতায়নের প্রশ্নটি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। অন্যান্য অনেক বিষয়ের সঙ্গে স্থানীয় সরকারের ক্ষমতায়নের ইস্যুতে তাই সমাজবিপ্লবীদের বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে সংগ্রাম করতে হবে। যেটুকু পার্লামেন্টারি সংগ্রাম চালানোর সুযোগ আছে তা চালানোর পাশাপাশি, স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোর নিয়ন্ত্রকের অবস্থানে অধিষ্ঠিত হওয়ার জন্য এবং সেগুলোর প্রকৃত ক্ষমতা প্রসারিত করার জন্য সমাজ বিপ্লবের কর্মীদের গণসংগ্রামের অগ্রভাগে থেকে লড়াই করতে হবে।

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..