একতা বিদেশ ডেস্ক :
সিরিয়ায় চলমান যুদ্ধের কারণে শিশুদের উপর কী মারাত্মক প্রভাব পড়ছে তার একটি চিত্র সম্প্রতি ইউনিসেফ তুলে ধরেছে। তাতে উঠে এসেছে এক নজিরবিহীন চিত্র। জাতিসংঘের এই শিশু বিষয়ক সংস্থাটি গত বছরকে সিরিয়ার শিশুদের জন্য সবচেয়ে ভয়াবহ বছর বলে অভিহিত করেছে। মাসের ১৩ তারিখ প্রকাশিত সংস্থাটির এক প্রতিবেদনে বিষয়টি উল্লেখ করা হয়।
ইউনিসেফের বরাত দিয়ে বিবিসির এক খবরে বলা হয়, সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধের যে কোনো বছরের তুলনায় ২০১৬ সালেই সবচেয়ে বেশি শিশু নিহত হয়েছে। ইউনিসেফের হিসেবে, গত বছর নিহত হয়েছে অন্তত ৬৫২ শিশু। এদের মধ্য ২৫৫ জনের প্রাণ গেছে স্কুলে কিংবা স্কুলের আশপাশে। শিশু মৃত্যুর এ সংখ্যা ২০১৫ সালের তুলনায় ২০ শতাংশ বেশি। কেবল যাচাই করা মৃতের সংখ্যা হিসাব করেই সংস্থাটি এ হিসাব দিয়েছে। ফলে প্রকৃত মৃতের সংখ্যা আরও বেশিও হতে পারে বলে জানিয়েছে ইউনিসেফ।
সংস্থাটির মতে, গেল বছর প্রায় ৮৫০ জনের বেশি শিশুকে লড়াইয়ের ময়দানে নামানো হয়েছিল। আগের বছর ২০১৫ সালের তুলনায় এ সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি। যুদ্ধে যোগ দেওয়া এসব শিশুরা সম্মুখ যুদ্ধে লড়াই করার পাশাপাশি কখনো আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী, বন্দিশালার প্রহরী এমনকি জল্লাদ হিসেবেও কাজ করেছে। ইউনিসেফের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা বিষয়ক আঞ্চলিক পরিচালক গ্রিট ক্যাপেলেয়ার বলেছেন, ‘সিরিয়ার শিশুরা এভাবে নজিরবিহীন দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। লাখ লাখ শিশু সেখানে প্রতিদিন হামলার শিকার হচ্ছে। তাদের জীবন ওলট পালট হয়ে যাচ্ছে।’ সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধের কয়েক বছরের মধ্যে শিশুদের হত্যা, বিকলাঙ্গ করা অথবা কোনো সশস্ত্র সংগঠনে নিয়োগ করার মতো ঘটনা গত বছরই সবচেয়ে বেশি হয়েছে
উপরের পরিসংখ্যান থেকে মৃতের অথবা আহতের কিছু সংখ্যা জানা সম্ভব কিন্তু সিরিয়ায় শুধুমাত্র সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর বিমান হামলায় এ যাবত কত শিশু নিহত হয়েছে তার পরিসংখ্যান কোনো ‘সংস্থা’ আজ পর্যন্ত দেয়নি। সিরিয়ার যুদ্ধে, আরও স্পষ্ট করে বললে সিরিয়াকে কেন্দ্র করে আমেরিকা এবং রাশিয়া এই দুই পরাশক্তির সামরিক হস্তক্ষেপের কারণে কী পরিমাণ জানমালের ক্ষতি হচ্ছে অথবা কত শিশু নিহত হয়েছে তার কোনো প্রকৃত হিসাব পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোতে পাওয়া যায়না। যা পাওয়া যায় তা খণ্ডিত আকারে।
সিরিয়ায় এক দিকে আছে বাশার বিরোধী গ্রুপগুলো, তাদের মধ্যে ‘মডারেট’ গ্রুপগুলোকে সমর্থন দিচ্ছে আমেরিকা। অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট বাশার এবং তার সরকারি বাহিনীকে সমর্থন দিচ্ছে রাশিয়া। আরেকদিকে আইএস তার তথাকথিত খেলাফত প্রতিষ্ঠার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। এই দুইপক্ষের হামলা পাল্টা হামলার সাথে যুক্ত হয়েছে আইএসের বর্বরতা এবং বলাই বাহুল্য এই সবগুলো পক্ষের সবচেয়ে সহজ শিকারে পরিণত হচ্ছে শিশুরা।
শিশুদের উপর ভয়াবহ আগ্রাসনের জাজ্বল্যমান উদাহরণ ভিয়েতনাম। তারা এখনো মার্কিন আগ্রাসনের দাগ বয়ে বেড়াচ্ছে। ভিয়েতনামের প্রতিরক্ষা বিভাগের ২০০৯ সালের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, ভিয়েতনামে মার্কিনীদের হামলার ৩৫ বছর পরও ভূমি মাইন ও অবিষ্ফোরিত গোলাবারুদ এখনও ভিয়েতনামের মাটিতে বিদ্যমান আছে। দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে, তাঁদের ভূমির ছয় ভাগের এক ভাগ এখনও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। তাঁদের মতে ৬.৬ মিলিয়ন হেক্টর ভূমি এখনও দূষিত।
অধিকন্তু, ভিয়েতনামের মানুষ এখনও মার্কিনীদের রাসায়নিক দ্রব্যের কারণে নানা প্রকার স্বাস্থ্য সমস্যায় আক্রান্ত হচ্ছেন। তাঁদের পরিবেশ এখনও দূষণমুক্ত হতে পারেনি। মিলিয়ন মিলিয়ন গ্যালন রাসায়নিক তরল ভিয়েতনামের গ্রামে গঞ্জে আমেরিকানরা নিক্ষেপ করেছিলো। তাঁদের নিক্ষিপ্ত রাসায়নিক বোমা মানবতার জন্য একটি মারাত্মক বিষাক্ত দ্রব্য হিসাবে পরিগণিত হয়। ২০০৩ সালে ভিয়েতনামের মাটি পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, তা সাধারণ মাটির তুলনায় ১৮০ গুণ বেশি দূষিত।
প্রায় ১,৫০,০০০ শিশুকে চিহ্নিত করা হয়েছে যারা তাঁদের মা বাবার শরীরে অরেঞ্জ এজেন্টের দূষণজনিত কারণে কোনো না কোনো ত্রুটি নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছে। কেবল মাত্র অরেঞ্জ এজেন্টের কারণে প্রায় ৩ মিলিয়ন মানুষ আক্রান্ত হয়েছিলেন। ফলে তাঁদের শরীরে নানা প্রকার স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয়। ভিয়েতনামে মার্কিন আগ্রাসনকালীন একটি ঘটনা এখানে উল্লেখ না করলেই নয়। ১৯৭২ সালের ৮ জুন মার্কিন সমর্থিত ভিয়েতনামি আর্মির ২৫ ডিভিশনের ফোর্স ট্রাং ব্যাং গ্রামে (বর্তমান হোচিমিন সিটি) বোমা হামলায় চালায়। এ সময় গ্রামের রাস্তা ধরে একদল শিশু ছুটে পালিয়ে যাবার সময় তাদের উপর প্রায় ৪ ড্রাম নাপাম বোমা ফেলা হয়।
ভিয়েতনামে আমেরিকা যা করেছিল ইরাকেও তারা ঠিক একই কাজ করেছে। ইরাকি শিশুরাও মার্কিন আগ্রাসনের নির্মম শিকার। ভিয়েতনামের মতই ইরাকেও ইতিমধ্যেই নানা সমস্যা নিয়ে শিশুদের জন্ম হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে পরিমাণ ইউরেনিয়াম ইরাকে নিক্ষেপ করা হয়েছে তাতে সেই দেশের জনগণকে দীর্ঘ সময় তার পরিণাম ফল ভোগ করতে হবে। মার্কিনিদের ট্রেনিং ম্যানুয়ালে বলা হয়েছে যে, ইউরেনিয়ামের ২৫ মিটারের মধ্যে আসতে হলে শ্বাসযন্ত্র ও চামড়ার সুরক্ষার জন্য মাস্ক ব্যবহার করা উচিৎ। কিন্তু ইরাকের মাটিতে সর্বত্র আজ এই বিপদজনক দ্রব্য ছড়িয়ে আছে। যার স্পর্শে শিশুরা প্রতিদিন আসছে আর আক্রান্ত হয়ে চলেছে। ক্যান্সার এবং কিডনি ফেইলিয়র ব্যাপক আকারে দেখা দিচ্ছে।
এভাবেই দেশে দেশে শিশুরা সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের সহজ শিকারে পরিণত হয়েছে।