‘রাষ্ট্র সংস্কারের’ রাজনীতি না ‘ব্যবস্থাবদলের’ রাজনীতি

এ আর খান আসাদ

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email
‘সিস্টেম’ বা ব্যবস্থা না বুঝলে, ‘সংস্কার’ ও ‘ব্যবস্থাবদল’ এর রাজনীতির মধ্যকার পার্থক্য বোঝা কঠিন। পুঁজিবাদ একটি জটিল ব্যবস্থা, এবং এই ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য এর একটি হাতিয়ার ‘রাষ্ট্রযন্ত্র’। এই রাষ্ট্রযন্ত্র আবার নিজেই একটি ছোট ব্যবস্থা, যা একটি বড় ব্যবস্থার অংশ বা অঙ্গ। রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যে ‘পুলিশ বাহিনী’ আবার একটি ‘মাইক্রো’ ব্যবস্থা। ব্যবস্থা হচ্ছে, অনেকগুলো উপাদান বা অংশের সমষ্টি একটি অস্তিত্ব। এর নানা অংশগুলো আন্তঃসম্পর্কিত। একটি অংশ আরেকটি অংশকে প্রভাবিত করে, অপর অংশের উপর ক্রিয়া করে। এই ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার মিথস্ক্রিয়ায় এরা কোনো সাধারণ লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য সাধনের জন্য একসাথে কাজ করে। একটি ব্যবস্থার উপাদানগুলি একে অপরের সাথে যেহেতু যুক্ত থাকে ফলে একটি কাঠামো থাকে যার ভেতরে মিথস্ক্রিয়া ঘটে। জানি, অনেকের কাছেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়নি। কিন্তু উদহারণ দিলে জলের মতো পরিষ্কার মনে হবে। যেমন- ‘ঘড়ি’ একটি যান্ত্রিক ব্যবস্থা। চাবি, খাঁজকাটা চাকা, ঘণ্টা মিনিটের কাটা- ইত্যাদি নানা অংশ মিলিয়ে এটি ঘুরতে থাকে, ঘুরতেই থাকে। উদ্দেশ্য কী? সময় নির্দেশ। ঠিক ঠাক ১২ ঘণ্টা, ৬০ মিনিট সময় নির্দেশ করে। যেমন- মানুষের শরীর। হাত, পা, মাথা, ঘাড়, পেট নানা অংশ, এগুলো দৃশ্যমান কাঠামো। এবং ভেতরে আবার অনেক অংশ আছে, হৃদপি-, কলিজা, পরিপাকতন্ত্র ইত্যাদি। খাবার খাওয়া হয় এবং তা নানা অংশ প্রসেস করে। উদ্দেশ্য কি শক্তি জোগানো, যাতে মানুষ বেঁচে থাকে, চিন্তা ও কাজ করতে পারে। মানুষের নার্ভাস সিস্টেম একটি আলাদা সিস্টেম, শরীরের ভেতরে। যেমন- সোলার সিস্টেম। সূর্যকে কেন্দ্র করে পৃথিবীসহ গ্রহসমূহ ঘোরে। যেমন- আখের কল। একদিক দিয়ে আখ দেয়া হয়, আরেকদিক থেকে আখের রস বের হয়। যেমন- গার্মেন্টস ব্যবসা, ফ্যক্টরি ও কাঁচামাল আছে, একদিক দিয়ে নারীশ্রম ঢুকে, আরেকদিক দিয়ে মালিকের মুনাফা তৈরি হয়। একদা একজন গ্রামীণ ভূমিহীন নারী আমাকে ‘সিস্টেম’ বুঝিয়েছেন। তাঁর উদাহরণ ছিল চিতোই পিঠা তৈরির ‘ব্যবস্থা’। একবারে ছয়টি ছোট গোল চিতোই পিঠা ভাজা হবে, নাকি দুটি লম্বাটে (ওভাল) বড় পিঠা, তা নির্ভর করে পিঠা ভাজার যে মাটির তাওয়া (পাত্র) সেই কাঠামো ও ব্যবস্থার উপর। মাও সে তুং এর ভাষায় ‘জনগণের কাছ থেকে শেখা’ কি জিনিস- তা আমি এই দরিদ্র শ্রমজীবী নারীর কাছ থেকে শিখেছি। সমাজবিজ্ঞান অনুসারে একটি সমাজব্যবস্থার তিনটি প্রধান অংশ বা উপব্যবস্থা আছে। এগুলি হচ্ছে- অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উপব্যবস্থা। মার্কসবাদীরা মনে করে অর্থনৈতিক উপব্যবস্থা হচ্ছে ভিত্তি কাঠামো, এর উপর দাঁড়িয়ে আছে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উপব্যবস্থা। ‘পরিবার’ সমাজের একটি মাইক্রো ব্যবস্থা। রাষ্ট্র রাজনৈতিক ব্যবস্থার একটি ম্যাক্রো ব্যবস্থা। সংস্কার বনাম ব্যবস্থাবদল আলাপটি সহজ করার জন্য সমাজের একটি মাইক্রো সিস্টেম যেমন ‘পরিবার’ ব্যবস্থা নিয়ে কথা বলা যাক। মনে করেন, জনাব আবদুল আইনুম সাহেব, ইউসুফ মোল্লার পিতৃতান্ত্রিক পরিবারের ‘সংস্কার’ চান। এই পরিবারে চার স্ত্রী আছেন। কর্তা চান যে তিনি ২০ বছরে ৪ জন স্ত্রী থেকে ১০ সন্তান হিসবে ৪০ জন সন্তান পাবেন। জনাব আইনুম সাহেব এমন সংস্কার চান, যাতে সকল স্ত্রীদের ‘মানবাধিকার’ রক্ষা করা হয়, সবাইকে ‘সমান চোখে’ দেখা হয় (বৈষম্যবিরোধী সংস্কার) এবং স্ত্রীরা যেন নির্যাতনের ব্যাপারে ‘আইনি’ ন্যায়বিচার পান। বিপরীতে, মনে করেন- বেগম রুমিন আক্তার, যিনি নারী-পুরুষ সমতায় বিশ্বাসী, রবীন্দ্রসংগীত ভক্ত, নারীর পোশাকের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী, ব্যক্তি নারীর সৃজনশীল প্রতিভা বিকাশে ও নারীদের বিজ্ঞান, সাহিত্য, শিল্পকলা চর্চায় বিশ্বাসী। বেগম রুমিন আক্তার চান যে- বাংলাদেশে পিতৃতান্ত্রিক পরিবার ব্যবস্থার পরিপূর্ণ বিলোপ। বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন, বিপ্লবী রূপান্তর, তথা পরিবার ‘ব্যবস্থাবদল’। এখন দেখা যাক, ‘সংস্কার’ করতে হলে জনাব আইনুম সাহেব কি করবেন? কর্তার সাথে আলাপ করে একটি ‘পারিবারিক সংবিধান’ প্রণয়ন করবেন। কি থাকবে এই সংবিধানে? তিনটে মৌলিক বিষয় থাকতেই হবে। এক. কর্তার ক্ষমতা কতটা, তা তিনি বুঝিয়ে দেবেন। যেমন- স্ত্রীদের পেটাতে হলে, মেছওয়াক বা পুষ্পশাখা ব্যবহার করার নীতি সংবিধানে রাখবেন। দুই. অধিক সমতা। স্ত্রীদের অধিকার দেবেন সিদ্ধান্ত নেবার যে কার ঘরে তিনি কোন সময়ে ঘুমাবেন। বড় বিবির ভূমিকা এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ মিটিংএ মতামত গ্রহণ করার। তিন. পরিবারে কোন স্ত্রীর কি ভূমিকা তা ভালোভাবে লিখিত আকারে থাকতে হবে, এবং সব স্ত্রীদের সেইমতো চলতে হবে। এবার দেখি বেগম রুমিন আক্তার কিভাবে একটি পিতৃতান্ত্রিক পরিবার ব্যবস্থাকে বদলে দিতে চান নারী-পুরুষ সমতার সাম্যবাদী পরিবারে! প্রথমেই তিনি আইন করে বহুবিবাহ ব্যবস্থা বাতিল করে দেবেন। আইনি বলপ্রয়োগে তা বাস্তবায়ন করবেন। পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারে ‘কর্তার’ সিদ্ধান্ত গ্রহণ ব্যবস্থা বাতিল করে, পরিবারের সকল সদস্যের সমান অংশগ্রহণের ব্যবস্থা চালু করবেন। ঘরের কাজে নারী-পুরুষ শ্রমবিভাজন ব্যবস্থা বাতিল করে, ঘরের কাজ সকলের এই ব্যবস্থা চালু করবেন। পরিবারের সকলের জন্য সমতার মূল্যবোধ চর্চার ব্যবস্থা করবেন। পুরুষ সদস্যদের আধিপত্যকারি পৌরুষ (হেজেমোনিক ম্যাস্কুলিনিটি) থেকে মুক্তির জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করবেন। ‘ব্যবস্থাবদলের’ প্রকৃষ্ট উদাহরণ- ১৯১৭ রুশ বিপ্লবের পরে কলন্তাইদের উদ্যোগে আইন করে পতিতাবৃত্তির ব্যবস্থা বিলোপ। মাত্র দুই বছরে সকল ‘পতিতাদের’ যৌন ব্যবসায়ীদের খাঁচা থেকে মুক্ত করে শিক্ষা ও কাজের ব্যবস্থা করা হয়েছিল, এই সব মেয়েদের। এই ক্ষেত্রে নারীবাদী ‘সংস্কারকেরা’ পতিতাবৃত্তিকে ‘যৌনকর্মী’ নামে সংস্কার করে, তাঁদের ‘মানবাধিকার’ ও ‘আইনের শাসন’ অনুযায়ী ন্যায়বিচার পাওয়ার চেষ্টা করছেন। সে কারণে পতিতাবৃত্তি ব্যবস্থাটি অব্যাহত আছে। পিতৃতান্ত্রিক ‘দুঃশাসন হটাও’ বলে আপনি ইউসুফ মোল্লাদের বউ পেটানো ও পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোগত সহিংসতা বন্ধ করতে পারবেন না। সমস্যাটা ইউসুফ মোল্লার সহিংসতা নয়, সমস্যা গোটা পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার। রাজনীতির ক্ষেত্রেও পুলিশের সহিংসতা বা রাষ্ট্রের ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা নয়, সমস্যাটা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার। যা কাগুজে সংস্কার দিয়ে বদলানো যায় না। লেখক : গবেষক ও লেখক

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..