সরকারের বোরো ধান সংগ্রহ ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষা করবে

আবিদ হোসেন

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email
সারাদেশে বোরো ধানের ভরা মৌসুম চলছে। প্রতিবছরের মতো এবারও সরকার ধান ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এবার বোরো ধান উৎপাদন খরচ বিগত বছরগুলোর চেয়ে বৃদ্ধি পেলেও এ বছর কেজি প্রতি মাত্র ৪ টাকা বৃদ্ধি করে ৩৬ টাকা কেজি দরে সাড়ে ৩ লক্ষ টন ধান, ৪৯ টাকা কেজি দরে ১৪ লক্ষ টন সেদ্ধ চাল, সেই সাথে ৩৬ টাকা কেজি ধরে গম ক্রয়ের লক্ষ্য মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই সংগ্রহ কার্যক্রম চলবে ২৪ এপ্রিল থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) তথ্যমতে, ৫০ লাখ হেক্টর জমিতে এবার বোরো আবাদ হয়েছে। আর উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ কোটি ২৬ লাখ টন। ফলনের লক্ষ্যমাত্রা হেক্টরপ্রতি ৪ দশমিক ৪৬ টন। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশে বোরোর উৎপাদন ছিল ২ কোটি ১০ লাখ টন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২ কোটি ৭ লাখ টন, ২০২১-২২ অর্থবছরে ২ কোটি ১ লাখ টন ও ২০২০-২১ অর্থবছরে ১ কোটি ৯৮ লাখ টন ধান উৎপাদন হয়। ফলন বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে লাগামহীনভাবে বৃদ্ধি পায় কৃষকের ফসল উৎপাদনের খরচ। বর্ধিত দামে সার, বীজ, সেচ, কীটনাশক, ধান কাটা, মাড়াই শেষে বাড়ির উঠোন পর্যন্ত নিতে বা বাজারে বিক্রি করে যে দাম পায় তাতে কৃষকের ত্রাহী অবস্থা। উৎপাদন খরচ আর বিক্রির সাথে কোন হিসাব মিলাতে পারেনা। গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে কৃষকের আকাঙ্ক্ষা ছিল, চলতি মৌসুমে বোরো ধান বিগত সময়গুলোর চেয়ে বেশি পরিমাণে ক্রয় করবে। দীর্ঘদিন ধরে কৃষকদের দাবি ছিল- মোট উৎপাদনের ন্যূনতম ২০ লক্ষ টন ধান সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ক্রয় করবে। কিন্তু সরকারের মাত্র সাড়ে ৩ লক্ষ টন ধান আর ১৪ লক্ষ টন চাল ক্রয়ের ঘোষণা কৃষকদের চরমভাবে হতাশ করেছে। গতবছর ধান ক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬ লক্ষ টন। কৃষক কষ্ট করে উৎপাদন করে ধান। ফড়িয়া আর দালালদের মাধ্যমে চাতাল মালিকরা কৃষকের কাছ থেকে নামমাত্র দামে ধান নিয়ে চাল তৈরি করে কমদামে সরকারি গুদামে ও খোলা বাজারে চাল হিসেবে বিক্রি করে। এভাবেই চাতাল মালিক আর চালের ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে সরকারের নির্ধারিত দামকে উপেক্ষা করে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। সরকার চাল এবং ধান ক্রয়ের পরিমাণগত বৈষম্যের মধ্যেদিয়ে মূলত ব্যবসায়ীদের স্বার্থকেই রক্ষা করছে। কৃষকের কাছ থেকে কম পরিমাণে চাল ক্রয়ের কারণ হিসেবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ধান থেকে চাল ভাঙ্গানোর ব্যবস্থা সরকারের নেই, তাছাড়া ধান সংগ্রহের ব্যবস্থাপনাও পর্যাপ্ত নেই। সরকারের এই সিদ্ধান্ত মূলত কৃষকরা ধানের লাভজনক দাম থেকে বঞ্চিত হবে পক্ষান্তরে সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরাই লাভবান হবে। অন্তর্বর্তী সরকার ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করলেও দেশের অর্থনীতিকে শক্ত ভিত্তির উপর টিকিয়ে রাখার মূল শক্তি এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমজীবী কৃষক মানুষ। কৃষকদের জীবন-জীবিকা নিশ্চিত করা ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে ‘কৃষি সংস্কার কমিশন’ গঠন করা জরুরি ছিলো। কিন্তু শ্রমজীবী কৃষকের ফসল উৎপাদন ও বাজার ব্যবস্থার সংস্কার বা বৈষম্য নিরসনের দিকে সরকারের কোনো ভ্রুক্ষেপ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। দীর্ঘদিনের বৈষম্যের স্বীকার এদেশের কৃষকদের জীবন-জীবিকা নিশ্চিত করা ও বৈষম্য দূর করার জন্য সরকারের অবিলম্বে কতিপয় কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান ক্রয়ের ঘোষণা থাকলেও প্রকৃত উৎপাদক কৃষকের কৃষি কার্ড না থাকা এবং ধান ক্রয়ের জটিল ব্যবস্থাপনার কারণে প্রান্তিক কৃষকরা সরকারি গুদামে ধান বিক্রয় করতে পারেনা। কৃষকরা সরকারের কাছে ধান বিক্রি করতে আগ্রহী হন না। এই কারণে প্রতিবছরই সরকার তার খাদ্যশস্য সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়। এজন্য, ভূমিহীন কৃষকসহ প্রকৃত উৎপাদক কৃষকদের কৃষি কার্ড বিতরণ করতে হবে। ইউনিয়ন পর্যায়ে সরকারি ক্রয় কেন্দ্র চালু করে কৃষকের কাছ থেকে ধান ক্রয় করতে হবে। সার, বীজ কীটনাশক, সেচসহ ফসল উৎপাদন উপকরণের দাম কমাতে হবে। কৃষকদের সরাসরি ভর্তুকি দিতে হবে। চাতাল কল মালিক ও চাল ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট ভেঙে কৃষক ও ভোক্তা সমবায় বাজার চালু করতে হবে। সরকার নির্ধারিত দামে কৃষকদের পর্যাপ্ত সার দিতে হবে। বিএডিসি সক্রিয় করতে হবে। পল্লী রেশন ও শস্য বীমা চালু করতে হবে। স্বল্প সুদে ও সহজ শর্তে কৃষি ঋণ দিতে হবে। কৃষকের সার্টিফিকেট মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। আমূল ভূমি সংস্কার, কৃষি জমি রক্ষা ও ভূমি আইনের জটিল প্রক্রিয়া সহজ করতে হবে। সরাসরি উৎপাদক কৃষকের কাছ থেকে ন্যূনতম ২০ লক্ষ টন ধান ক্রয় করতে হবে। চাতাল কলের গুদামগুলোতে কৃষকের কাছ থেকে সরকারের ক্রয়কৃত ধান সংরক্ষণের ব্যবস্থা রাখতে হবে এবং সারাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা চাতাল কলে কৃষকের কাছ থেকে ক্রয় করে সরকারের ধান ভাঙানোর উদ্যোগ দিতে হবে। দ্রুতই সরকারের খাদ্যশস্য সংরক্ষণ সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। ভারতে সরকারিভাবে কৃষকের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ ধান ক্রয় করে ব্যক্তি পর্যায়ে চাতাল কলের গুদামে সংরক্ষণ করে। পরবর্তীতে খাদ্য সংকটকালে সেই ধান ভাঙ্গিয়ে খোলা বাজারে বিতরণের ব্যবস্থা করে ভারতের সরকার। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭০ লক্ষ টন। বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি কৃষক। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, দেশের মোট পরিবারের সংখ্যা ৩,৫৫,৫২,২৯৬টি। এর মধ্যে কৃষক পরিবার ১,৬৮,৮১,৭৫৭টি। মোট জনশক্তির মধ্যে কৃষিতে ৪৫.৪% নিয়োজিত থেকে এদেশের অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখছে। এজন্য শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা রক্ষায় কৃষি ব্যবস্থার সংস্কার জরুরি।

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..