
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সকালে দেশবাসী হরতাল পালন করছিল। হঠাৎ করেই ধসে পড়লো রানা প্লাজা, চাপা পড়লো তিন শত শ্রমিক। মুনাফালোভী হিংস্র ব্যবস্থা কেড়ে নিলো ১ হাজা ১৭৫ তাজাপ্রাণ, আহত হয় ২ হাজারের বেশি শ্রমিক।
হরতাল ভুলে সমগ্র দেশ এবং সমগ্র দুনিয়া কাঁদছিল রানা প্লাজার শ্রমিকদের বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার আর আর্তনাদে। কিন্তু কেঁদেছিল কি পুঁজিপতি মালিকরা? মোটেই না। বিশ্ববাসীর দাবি, আন্দোলন আর চাপের মুখে তখন খুনি মালিককে গ্রেফতার করলেও কিছুদিন পরেই ছেড়ে দেয়। বহাল তবিয়তে নিরাপদ জীবনযাপন করেন মালিকেরা কিন্তু সন্তান হারা মা-বাবা, পিতা-মাতা হারা এতিম সন্তানেরা, ভাই হারা বোন কিংবা বোন হারা ভাইটি এখনো ক্ষত নিয়ে কাঁদছে। বিচারের দাবিতে এখনো রাজপথে নামছে। স্থায়ী পঙ্গুত্বের অভিশপ্ত জীবন নিয়ে অমানবিক জীবনযাপন করছেন শত শত শ্রমিক-কর্মচারী।
পরবর্তীতে ভবনটিতে উদ্ধার কাজ চললো, বিপুল অর্থের বিনিময়ে চিকিৎসা সেবা দিলেন এনাম মেডিকেল। ফলে এনাম মেডিকেলের মালিক ডাক্তার এনামুর রহমানকে সংসদ সদস্য হলেন। জীবনে একদিনও রাজনীতি করেননি, একদিনও দেশ এবং মানুষের সেবা করননি অথচ সংসদ সদস্য হলেন তিনি। তাই শ্রমিক ও জনগণ ডা. এনামুরকে মুখে মুখে রানা প্লাজা এমপি বলে উপাধি দিলেন। সেবা করার ফলে প্রচুর বিদেশি অর্থ পেলেন অনেক সরকারি বেসরকারি এনজিও সংগঠন থেকে। সরকার কয়েকটি কমিটি করলেন যার ফলাফল শ্রমিকের ঘরে পর্যন্ত পৌছে নি।
রানা প্লাজা হত্যাকাণ্ডের ৬ মাস আগে তাজরীন ফ্যাশনের অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে ছাই হয়েছিল ১২৮ জন তাজা প্রাণের মানুষ। শুধু রানা প্লাজা কিংবা তাজরীন নয়- সারাকা গার্মেন্টস, মাইকো সোয়েটার, চৌধুরী নিটওয়্যার, গরীব এন্ড গরীব, হামীম গার্মেন্টস, স্পেকট্রাম, কে.টি.এস গার্মেন্টস, শান নিটওয়্যার ও চৌধুরী নীটওয়্যারসহ শত শত কারখানায় হাজার হাজার শ্রমিক প্রাণ দিয়েছিল। সে সব কারখানার মালিকদেরও বিচার হয়নি। বিচারহীনতা, দায়িত্বহীনতা, শ্রমিক মেহনতিদের মানুষ হিসেবে বিবেচনায় না নিয়ে উৎপাদনের যন্ত্র হিসেবে বিবেচনা করার ফলে বার বার শ্রমিকদের জীবন দিতে হয়েছে। আন্তর্জাতিক চাপে পড়েছিল গার্মেন্টস শিল্প। বিদেশি ভোক্তারা ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, বাংলাদেশের শ্রমিকদের রক্ত মাখা পোশাক তারা পরবেননা। ভোক্তারা বাংলাদেশের তৈরি পোশাক বর্জনের ঘোষণা দেওয়ায়, ইউরোপ আমেরিকার বায়ার ব্যান্ড নতুন কৌশল অবলম্বন করে গড়ে তুলেছিল এ্যাকোর্ড ও এ্যালায়েন্স। তারাও প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করে বিল্ডিং, আগুন ও বিদ্যুৎ বিষয়ে নিরাপত্তা কার্যক্রম পরিচালনা করেন। তিনটি বিষয়ে নিরাপত্তার সাথে শ্রমিকদের দীর্ঘদিনের দাবি রেশন ব্যবস্থা চালুর মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা, হাসপাতাল নির্মাণসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা- সে বিষয়ে আজও কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
ন্যায্য মজুরি, অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার, আবাসনসহ কোনো দাবির বিষয়েই আজ পর্যন্ত ন্যায্যতা নিশ্চিত করা হয়নি। রানা প্লাজার শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ পরিমাণ নির্ণয়ের জন্য বিশেষজ্ঞদের দ্বারা একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সেই কমিটির সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য রাষ্ট্রের আরও অনেক সুচারু হওয়া প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তা করা হয়নি। এভাবে চললে এই শিল্পের অগ্রগতি থেমে যাওয়া ছাড়া বিকল্প কোন উপায় থাকবেনা।
আইএলও কনভেনশন অনুসারে কারখানায় কর্মরত অবস্থায় কোনো শ্রমিকের মৃত্যু হলে তার নমিনী বা উত্তরাধিকার মৃত শ্রমিকের ভবিষ্যৎ সমগ্র জীবনের আয়ের সমপরিমাণ ক্ষতিপূরণ, আহতদের সুচিকিৎসা, স্থায়ী অক্ষমদের পূর্নর্বাসন, চাকরি ও মজুরির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ছিল সকলের দাবি। বিজিএমইএ/মালিকদের শর্তানুযায়ী চলা সরকার শ্রমিকদের কন্ঠরোধ করতে দমন নির্যাতন চালিয়েছেন সবসময়ই। যার ফলে ট্রেড ইউনিয়নের মৌলিক কাজ শ্রমিক স্বার্থে দাবি/দাবিনামা পেশ, যৌথ দরকষাকষি এবং প্রয়োজনে ধর্মঘটসহ যেকোনো গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আন্দোলন সংগ্রাম করা। কিন্তু তার কোনো সুযোগই বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্পে হয়ে উঠেনি। বকেয়া বেতন আদায়ের আন্দোলনের মধ্যেই শ্রমিক আন্দোলন আটকা পড়ে আছে। এমন পরিস্থিতিতে যদি ন্যায়সঙ্গত দাবিদাওয়ার ভিত্তিতে সংগঠন এবং সংগ্রাম অগ্রসর করা না যায় তাহলে ভবিষ্যতে হয়তোবা আরও অনেক কারখানায় নানাভাবে জীবন দিতে হবে। মালিকরা আইন মানলে কারখানায় নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকতো। নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিত। শ্রমিকদেরকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নিরাপত্তা বিষয়ে দক্ষ ও সচেতন করা হতো। এসবের কোনোটাই ছিল না। এমনকি বিল্ডিং কোড মানা হয়নি। ৬ তলা ভবনের অনুমতি না মেনে অথচ ৯ তলা ভবন তৈরি করা হয়।
তাহলে সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তর কি এর দায় এড়াতে পারে? ভবনটিতে অগ্নি নির্বাপন যন্ত্র ও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ছিল না। ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ কি এর দায় এড়াতে পারে?
ঘটনার আগেরদিন অর্থাৎ ২৩ এপ্রিল সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলী বলেছিলেন, রানা প্লাজা ভবনটি নিরাপদ নয়, যেকোন সময় ভেঙ্গে পড়তে পারে- তাই ভবনের সব কার্যক্রম বন্ধ রাখা উচিত। সে অনুযায়ী ঐ ভবনের দোকান, ব্যাংকসহ সবগুলো প্রতিষ্ঠানই বন্ধ ছিল, কিন্ত মুনাফাখোর গার্মেন্ট মালিকরা শ্রমিকদের জীবনের তুলনায় তাদের মুনাফাকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে কারখানা খোলা রেখেছিলেন।
এমনকি কারখানায় শ্রমিকরা প্রবেশ করতে রাজি না হওয়ায় তাদেরকে ‘রানা বাহিনী’ নামক সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে মারধর করে জোরপূর্বক কাজে যোগ দিতে বাধ্য করা হয়েছিল। যার ফলে নির্মম পরিণতি হাজার হাজার শ্রমিক-কর্মচারীকে মৃত্যুকুপে ঠেলে দিয়েছিল। রানা প্লাজার ভবন মালিক ও কারখানাসমূহের মালিক ও দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষের শাস্তি, নিহত-আহতদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ ও সুচিকিৎসা, অক্ষমদের পূর্নর্বাসন, চাকরি-কর্ম ও মজুরির নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি রানা প্লাজার জায়গা অধিগ্রহণ করে সেখানে বহুতলবিশিষ্ট নিরাপদ ভবন নির্মাণ করে শ্রমিকদের পূর্নর্বাসন কেন্দ্র করা, স্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ, ২৪ এপ্রিলকে গার্মেন্ট শ্রমিক শোক দিবস এবং সেদিন গার্মেন্ট শিল্পে ছুটি ঘোষণা করার দাবি জানানো হয়েছিল। নানাবিধ চাপের মুখে কিছু কিছু আশ্বাস দিয়ে পরে তা পূরণ করা হয়নি।
বর্তমানে কতিপয় দায়িত্বশীল ট্রেড ইউনিয়ন ব্যতিত সকলেই ভূলে গেছে রানা প্লাজা হত্যাকাণ্ড। ভবন ধস, অগ্নিকাণ্ডের হত্যা সাময়িক সময়ের জন্য মানুষের দৃষ্টিতে থাকে, কিন্তু প্রতিদিনের অত্যাচার-নির্যাতন আর হত্যার খবর কি কারো নজরে পড়ে? বকেয়া বেতন চাইলে গুলি করে হত্যা করা হয়।