উন্নত বিশ্বের নাগরিকত্ব ও দুনিয়ার দুর্নীতি
শাহ মো. জিয়াউদ্দিন
পৃথিবীতে এমন কিছু দেশ আছে, যে দেশগুলোকে উন্নয়নশীল দেশের মানুষ মনে করে বেহেশত বা স্বর্গ। ঐ দেশগুলোতে যাওয়ার জন্য যা কিছু করার দরকার তা-ই করছে বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশের নাগরিকরা। ফলে উন্নয়শীল দেশগুলোতে বইছে অশান্ত পরিবেশ। বাংলাদেশের মানুষ আমেরিকার নাগরিকত্ব পাওয়াটাকে মনে করে স্বর্গের টিকিট পাওয়ার মতো। আমেরিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া , নিউজিল্যান্ড, এশিয়ার সংযুক্ত আরব আমিরাত, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া এই দেশগুলোতে মাইগ্রেশন হতে পারাটা ঈশ্বরের কৃপা পাওয়ার সমতুল্য বলে মনে করে উন্নয়নশীল দেশের মানুষ। আর এই ভাগ্যটা যে টাকার জোরে পাওয়া যায় সেই ব্যাবস্থাটা করে দিয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নব নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অভিবাসন নীতিতে বড় পরিবর্তন আনার ঘোষণা দিয়েছেন। তাঁর ঘোষণা অনুসারে, যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পেতে হলে গুনতে হবে ৫ মিলিয়ন বা ৫০ লাখ মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৬০ কোটি টাকার মতো। ওই পরিমাণ অর্থ দিলেই মিলবে ‘গোল্ড কার্ড’, যা সে দেশের নাগরিকত্বের প্রমাণ। এই অর্থ উন্নয়নশীল দেশের মানুষ যে কোনো উপায়ে অর্জনের চেষ্টা চালাবে। ফলে বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশে দুর্নীতির পরিমাণ আরো বাড়বে। প্রকৃতার্থে বিশ্বের কথিত উন্নত দেশগুলো কায়দা করে উন্নয়শীল দেশগুলোতে দুর্নীতির পরিবেশ সৃষ্টি করে দেয়। উন্নয়শীল দেশের শাসকগোষ্ঠিরা বড় বড় দুর্নীতি করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে আশ্রয় নেয় কথিত সভ্য উন্নত দেশগুলোতে। আর উন্নয়শীল দেশের লুটেরাদের অর্থ দিয়ে কথিত উন্নত সভ্য দেশগুলোর রাজকোষ ভরে যায়। আর এভাবে কায়দা করে কথিত সভ্য উন্নত দেশগুলো উন্নয়শীল দেশের মানুষগুলোকে দুর্নীতিবাজ বানায়।
‘গোল্ড কার্ড’ থেকে প্রাপ্ত অর্থ সরাসরি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের তহবিলে চলে যাবে। আর্থিক ঘাটতি মেটাতে এটি কাজে লাগবে বলেই জানাচ্ছে সে দেশের প্রশাসন।
বর্তমানে ইউরোপের মাল্টা, সাইপ্রাস, মন্টেনেগ্রো, মলদোভা, লাটভিয়া, গ্রিস ও লিথুয়ানিয়া প্রভৃতি দেশ বিনিয়োগের বিনিময়ে নাগরিকত্ব দিচ্ছে। ক্যারিবীয় দেশ অ্যান্টিগা অ্যান্ড বারমুডা, গ্রানাডা, সেন্ট লুসিয়াতেও এই সুবিধা পাওয়া যায়। এই সুবিধা পাওয়ার জন্য উন্নয়নশীল দেশে জন্ম নেয় ফ্যাসিবাদী সরকার বা দুর্নীতিবাজ শাসক। কারণ, দুর্নীতিবাজ শাসকের সদস্যরা দুর্নীতি করে কথিত সভ্য দেশগুলোর নাগরিক হয়। তার প্রমাণ বাংলাদেশ। সম্প্রতি হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে। কোটি কোটি টাকা হাসিনা সরকারের আমলে দুর্নীতি হয়েছে। তার বিশদ খবর পাওয়া যাচ্ছে বিভিন্ন গণমাধ্যমে। দুর্নীতি করা হাসিনা সরকারের রাঘব বোয়লারা পালিয়েছে দেশ থেকে। এরা কামিয়েছে হাজারা হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশের মানুষের অর্থ লুটকারীরা কথিত সভ্য উন্নত দেশের নাগরিকত্ব নিয়ে বাকি জীবন আরাম আয়েশে কাটিয়ে দেবে।
আমেরিকা ছাড়াও কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, নিউজিল্যান্ড ও ইউরোপের অনেক দেশেই বিনিয়োগের বিনিময়ে স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি পাওয়া যায়। এর মধ্যে কোনো কোনো দেশ পর্যায়ক্রমে নাগরিকত্ব নেওয়ার সুযোগও দেয়।
মালয়েশিয়ার ‘সেকেন্ড হোম কর্মসূচি’ খুবই জনপ্রিয়। এই দেশটিতে মোটা অংকের টাকা বিনিয়োগ করে পাওয়া যায় নাগরিকত্ব। সেকেন্ড হোমের এই সুযোগ নেওয়া বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের মধ্যে বাংলাদেশিদের অবস্থান পঞ্চম। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত মালয়েশিয়ায় দ্বিতীয় নিবাস গড়েছেন ৩ হাজার ৬০৪ জন বাংলাদেশি। ঐ সময় পর্যন্ত মালয়েশিয়ায় সক্রিয় ‘সেকেন্ড হোম’ পাসধারী ছিলেন ৫৬ হাজার ৬৬ জন।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক অভিবাসন প্রতিষ্ঠান হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্সের তথ্যানুসারে, ইউরোপের দেশ মাল্টায় নাগরিকত্ব পেতে ছয় লাখ ইউরো বিনিয়োগ করতে হয়। ইউরোপের আরেক দেশ নর্থ মেসিডোনিয়ায় দুই লাখ ইউরো বিনিয়োগের বিনিময়ে পাওয়া যায় নাগরিকত্ব। ইউরোপ ও এশিয়ার সংযোগস্থল তুরস্কের ক্ষেত্রে এই অঙ্ক চার লাখ মার্কিন ডলার।
ক্যারিবীয় অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে এন্টিগুয়া ও বারমুডার নাগরিকত্ব পাওয়া যায় ২ লাখ ৩০ হাজার ডলার বিনিয়োগের বিনিময়ে। ডমিনিকান রিপাবলিকের ২ লাখ মার্কিন ডলার; গ্রানাডায় ২ লাখ ৩৫ হাজার ডলার, সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিসে ২ লাখ ৫০ হাজার ডলার ও সেন্ট লুসিয়ায় ২ লাখ ৪০ হাজার ডলার বিনিয়োগের বিনিময়ে নাগরিকত্ব পাওয়া যায়। ওশেনিয়া অঞ্চলের নাউরুতে নাগরিকত্ব মেলে ১ লাখ ৩০ হাজার ডলারের বিনিময়ে। এছাড়া কোস্টারিকায় ১ লাখ ৫০ হাজার ডলার এবং পানামায় ১ লাখ ডলার বিনিয়োগের বিনিময়ে পাওয়া যায় নাগরিকত্ব। আফ্রিকা অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে মিসরের নাগরিকত্ব পাওয়া যায় ২ লাখ ৫০ হাজার ডলার বিনিয়োগের বিনিময়ে। মধ্যপ্রাচ্যের জর্ডানে ৭ লাখ ৫০ হাজার ডলার বিনিয়োগের বিনিময়ে নাগরিকত্ব মেলে।
এ ধরনের নাগরিকত্ব বিক্রির কর্মসূচি নিয়ে সারা বিশ্বেই সমালোচনা হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে উন্নত দেশগুলোতে অর্থ চলে যাচ্ছে। ট্রাম্পের নতুন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে এই প্রক্রিয়া আরও জোরদার হবে বলেই আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকেরা। বাংলাদেশে দিন দিন বাড়ছে খেলাপি ঋণের পরিমান। এই খেলাপি ঋণের টাকা কিন্তু বাংলাদেশে নাই। যদি থাকতো তাহলে দেশের অর্থনীতির তারল্য ঘূর্ণায়ন গতিটা স্থবির হয়ে যেতো না। তাহলে এ টাকা গেল কোথায়?
দেশের ব্যাংক ব্যবস্থায় গত ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা, যা গত সেপ্টেম্বর শেষে ছিল ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকেই শ্রেণিকৃত ঋণ বা খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৬০ হাজার ৭৮৭ কোটি টাকা। ডিসেম্বর শেষে মোট বিতরণ করা ঋণের ২০ দশমিক ২০ শতাংশ খেলাপি হয়ে গেছে। যদি ২০ শতাংশ ঋণ খেলাপি ঋণে পরিণত হয় তাহলে মোট বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ১৭ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে বিতরণকৃত ঋণের ১৭ শতাংশ ছিল খেলাপি ঋণ। তিন মাসে তা বেড়েছে প্রায় ৩ শতাংশের বেশি। অপরদিকে নতুনভাবে ঋণ বিতরণ চলছে। তিন মাস অন্তর অন্তর ৩ শতাংশ করে যদি খেলাপি ঋণ বাড়তে থাকে তাহলে বছরান্তে দেখা যাবে ১৭ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকাই খেলাপি হয়ে গেছে।
দেশের ব্যাংকগুলোতে গত সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছিল ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। তিন মাসেই ব্যাংক ব্যবস্থায় খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৩ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংক থেকে নামে বেনামে যে অর্থ বের করে নেওয়া হয়েছে, তা এখন খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হতে শুরু করেছে।
হাসিনার পতনের পর মন্ত্রী-আমলাদের যে সম্পদের পরিমাণ বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে পাওয়া গেছে তাতে প্রমাণ হয় গত ১৫ বছরে নজিরবিহীন দুর্নীতি হয়েছে। পুলিশের বড় কর্তা বেনজিরসহ অন্যান্য পুলিশ কর্মকর্তা ও কতিপয় আমলা যে পরিমাণ টাকার দুর্নীতি করেছে তাতে দেড় থেকে দুই হাজার গোল্ড কার্ড কিনতে পারবেন মাত্র কয়েকজন শীর্ষ সরকারি কর্মকর্তাই।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল সম্প্রতি একটি তথ্য প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায় যে, সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় গত বছর বাংলাদেশের অবস্থান ১২তম হলেও এই বছর হয়েছে ১৩তম। আর বিশ্বের কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় আগের বছর বাংলাদেশ ১৪৮তম দেশ হলেও এই বছর হয়েছে ১৪৭।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ বা টিআইবি বলছে, তালিকার অবস্থানে পরিবর্তন হলেও আসলে বাংলাদেশের দুর্নীতির চিত্রের কোনো পরিবর্তন হয়নি। কারণ, বাংলাদেশে পরির্বতন হয়নি দুর্নীতির সূচকের। অন্য দেশের ভালো-খারাপ করার কারণে তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থানের পরিবর্তন হয়েছে।
সিপিআই অনুযায়ী, ১০০ এর মধ্যে ৯০ স্কোর পেয়ে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছে ডেনমার্ক। অর্থাৎ ১৯০টি দেশের মধ্যে ডেনমার্কে সবচেয়ে দুর্নীতি কম হয়। তারপর সবচেয়ে কম দুর্নীতি থাকা দেশগুলোর মধ্যে ৮৮ স্কোর নিয়ে ফিনল্যান্ড দ্বিতীয়, ৮৪ স্কোর নিয়ে সিঙ্গাপুর তৃতীয়, ৮৩ স্কোর নিয়ে নিউজিল্যান্ড চতুর্থ এবং ৮১ স্কোর নিয়ে যৌথভাবে লুক্সেমবার্গ, নরওয়ে ও সুইজারল্যান্ড পঞ্চম স্থানে রয়েছে। ইউরোপের দেশগুলো দুর্নীতিহীন বলে সিপিআই-এর তথ্য অনুযায়ী বলা যায়, তবে তারাই বিশ্বের দুর্নীতিবাজদের আশ্রয় দেয়। তাহলে প্রকৃত দুর্নীতিবাজ কারা? এই প্রশ্নের উত্তরটা খোঁজা দরকার। বাংলাদেশে গ্রামীণ একটি প্রবাদ আছে- চোরের চেয়ে তার আশ্রয়দাতারাই বেশি অপরাধী।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম দুর্নীতি হয় ভুটানে। ১০০ এর মধ্যে ৭২ স্কোর নিয়ে তাদের অবস্থান ১৮তম। দেশটিতে ২০২৩ সালের তুলনায়ও দুর্নীতি কমেছে। ভুটানের ধারেকাছেও নেই দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলো। ভুটান ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশেই গত বছর দুর্নীতি বেড়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার ৮টি দেশের মধ্যে আফগানিস্তানের পরই বাংলাদেশে দুর্নীতির মাত্রা সবচেয়ে বেশি।
যতদিন পর্যন্ত কথিত সভ্য দেশগুলো নাগরিকত্ব বিক্রি করবে ততদিন উন্নয়শীল দেশগুলোতে অপরাধ ও দুর্নীতি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে তা নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
লেখক : কলামিস্ট
Login to comment..