
এই ঐতিহাসিক সত্যটি সামনে রেখে কিছুটা গভীরে যাবার চেষ্টা করলে দুটি বিষয় আমাদের চোখে পড়বে। প্রথমত ছাত্র-সমাজের চেতনার বৃত্তটি ক্রমাগত প্রসারিত হয়ে এসেছে অর্থাৎ ছাত্র-সমাজের চিন্তাধারা নতুন নতুন লক্ষ্যমাত্রা লাভ করেছে। দ্বিতীয়ত ছাত্র-সমাজের নেতৃত্বে পূর্ববাংলার জনগণও মুক্তিসংগ্রামের আদর্শকে প্রসারিত করে নিয়ে এসেছে।
কিন্তু গভীরে যাবার চেষ্টা থেকেই স্বাভাবিকভাবে একটা প্রশ্ন বেরিয়ে আসতে বাধ্য। এই যে চিন্তাধারার বৃত্তের সম্প্রসারণ- এই যে মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার সংগ্রাম থেকে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা যুদ্ধে উত্তরণ- এতে কি ছাত্র-সমাজ এবং জনগণের সম্পর্কের মধ্যে ভিতরে ভিতরে কোন গুণগত পরিবর্তন ঘটেনি? নিপীড়িত শ্রমিকশ্রেণি এবং কৃষকদের সঙ্গে কি ছাত্র-সমাজের চেতনাগত সম্পর্ক স্থাপিত হয়নি? এই প্রশ্নের কিনারা করতে গিয়ে প্রথমত যদি ছাত্র-সমাজের দিকে তাকানো যায়, তবে একটি ছবিও নজরে পড়বে। সেটি এই যে ছাত্র-সমাজের কাঠামোটা গত চব্বিশ বছরে ভিতরে ভিতরে বদলে গিয়েছে এবং এই পরিবর্তনে শ্রমিকশ্রেণি ও কৃষকদের চেতনার ঘনিষ্ঠ সংযোগ রয়েছে। দ্বন্দ্বাত্মক বস্তু-গতিবাদের দর্শনের আলোকে বিষয়টি আলোচনাযোগ্য।
এই প্রসঙ্গে একটা ঘটনার উল্লেখ করা দরকার। পাকিস্তানের শাসক ও শোষকচক্র পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশকে দমন করে রাখার জন্য যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করে এসেছে, তার মধ্যে শিক্ষা-সঙ্কোচন নীতি অন্যতম। আইয়ুব খানের আমলের প্রথম দিকে- গত দশ বছরের মধ্যে- একটা সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা ‘মহাপরিকল্পনা’ বাস্তবায়ন করার জন্য যে বাদশাহিত জারি হয়েছিল, তা দুই তিন বছর পরেই পরিত্যক্ত হয়। কায়েমি শাসক ও শোষকরা অচিরেই বুঝতে পারে, যে কোটি কোটি ছেলে প্রাথমিক শিক্ষালাভ করতে পারে, তারা শুধু মাধ্যমিক শিক্ষার জন্য উচ্চশিক্ষার জন্যও আগ্রহী হয়ে উঠবে। প্রাথমিক শিক্ষার মহাপরিকল্পনা লাটে উঠে। কিন্তু শিক্ষার প্রসারের জন্য পূর্ব বাংলার জনসাধারণের তাগিদকে লাটে উঠানো যায়নি। পূর্ব বাংলার গণ-মুক্তিসংগ্রামের বৈষয়িক লক্ষ্যমাত্রাগুলি অর্জিত হয়নি বলেই অবৈষয়িক বা আত্মিক লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের দিকে জোর পড়েছে বেশি।
পূর্ব বাংলার মুক্তিসংগ্রামের এটি বৈশিষ্ট্য। লোক-অভ্যুদয়ের তরঙ্গরাশি যখন প্রশমিত হয়েছে, তখনো শূন্যতার সৃষ্টি হয়নি। আপাতদৃষ্টিতে যখন ব্যর্থতা এসেছে, তখন প্রস্তুতি চলেছে নতুন অভ্যুত্থানের। এই প্রস্তুতি যতটা বাস্তব উপকরণজাত (অবজেকটিভ), তার চেয়ে বেশি মানসিক উপকরণজাত (সাবজেকটিভ)। যা সাধ্য, তার চেয়ে সাধনা বেশি। যা করণীয় তার চেয়ে ভাবনা বেশি। শিক্ষার ক্ষেত্রে জনগণের নিজস্ব উদ্যোগ-আয়োজনের আপেক্ষিক ব্যাপকতা এই কারণেই সম্ভব হয়েছে। পূর্ব বাংলার জনগণ খালি হাতে-পায়ে বন্যা নিরোধের ব্যবস্থা করতে পারেনি। পারেনি ভারী শিল্প স্থাপন করতে। অথচ নতুন বিজ্ঞানের জগতের দিকে এগিয়ে চলার তাগিদ নষ্ট তো হয়ই নি, বরং প্রত্যেকটা বড় বড় লোক-অভ্যুদয় এই তাগিদকে উস্কে দিয়েছে। এ কারণেই শাসকচক্রের শিক্ষা সঙ্কোচন নীতি অগ্রাহ্য করে নিদারুণ লাঞ্ছনা আর উপেক্ষা এবং অসহনীয় দারিদ্র্যের মধ্যেও পূর্ব বাংলায় শিক্ষাবিস্তার ঘটেছে। গ্রামে গ্রামেও স্থাপিত হয়েছে মহাবিদ্যালয় বা কলেজ। এই শিক্ষাবিস্তারের মধ্য দিয়ে ছাত্র-সমাজের ভিতর শ্রেণিসজ্জার পরিবর্তন ঘটেছে।
(চলবে)