‘কৃষি অর্থনীতি’

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email
দেশের ব্যক্তি-খাতের সবচেয়ে বড় অংশটি হলো ‘কৃষি অর্থনীতি’। এই স্পষ্ট ও সহজ উত্তরটি কিন্তু বেশিরভাগ মানুষের মাথায় সহজে উদয় হয় না। কৃষি অর্থনীতি যে দেশের ব্যক্তি-খাতের বৃহত্তম অংশ তা শোনার পর অনেককেই চমকে উঠতে দেখা যায়। অথচ এই সত্যটি অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। তথাপি সকলের কাছেই এই তথ্যটিকে যেন কেমন-কেমন মনে হয়। সমবেতভাবে কৃষি-খাতের অংশীদার। কৃষি অর্থনীতির সাথে জড়িত রয়েছে কোটি-কোটি ক্ষুদে উৎপাদক। দুই-দশ-বিশ-পঞ্চাশ বিঘা জমির মালিক তারা। অনেকের আবাদি জমিও নেই, আছে শুধু বসতবাড়ি ও হালের জন্য লাঙল-বলদ, কাস্তে-কোদাল। জমি ও কৃষি উৎপাদনের উপকরণের এই ক্ষুদে-ক্ষুদে মালিকরা সমবেতভাবে কৃষিখাতের অংশীদার। তারা সবাই মিলে সংখ্যায়ই শুধু ব্যক্তি মালিকদের বৃহত্তম অংশ নয়, এককভাবে জাতীয় উৎপাদনের সবচেয়ে বড় অংশ তাদের মাধ্যমেই অর্জিত হয়ে থাকে। অথচ এসব দরিদ্র, নেংটি-পরা, পা-ফাঁটা, দাঁদওয়ালা কৃষককে ব্যক্তি-খাতের প্রধান নায়ক বলে মেনে নিতে অনেকেরই কোথায় যেন দ্বিধা হয়। এই দ্বিধার কারণ হলো, প্রচলিত ধারণায় ব্যক্তি মালিকানা খাতের নায়করা হবেন কোটিপতি, বিপুল বিত্তের অধিকারী, তার থাকবে বড় বড় গাড়ি-বাড়ি, চাল-চলন হবে বিদেশি মিলিয়নেয়ারদের সাথে পাল্লা দেয়ার মতো। এমনটা না হলে কোনো মানুষ ‘মালিক’ হয় কীভাবে? বাজেট নিয়ে পরামর্শের প্রায় সবটাই হয়ে থাকে এসব বিত্তবান কোটিপতিদের সাথে সিরিজের পর সিরিজ বৈঠকের মাধ্যমে। যাদের সাথে পরামর্শ হয় তাদের মধ্যে উৎপাদনশীল ধারা ও শক্তির তুলনায় লুটপাটের ধারা ও শক্তির প্রতিনিধিত্বকারী উপাদানের পরিমাণই বেশি। অথচ তারাই দেশের ব্যক্তি-খাতের স্বঘোষিত দাবিদার হয়ে উৎপাদিকা শক্তি ও জাতীয় উৎপাদনের বিকাশের স্বার্থের বদলে নিজেদের লুটপাটের স্বার্থ আদায় করে নেয়। ব্যক্তি-খাতের গুরুত্ব ও প্রাধান্য নিয়ে বক্তৃতা দিতে দিতে তাদের মুখে ফেনা উঠে গেলেও, দেশের সবচেয়ে বড় ব্যক্তি-খাত কৃষি অর্থনীতি নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথাই নেই। বরঞ্চ কৃষিখাত থেকে উদ্বৃত্ত শুষে এনে পুঁজি সঞ্চয়ের যুক্তি তুলে ধরে শহরের লুটেরা বিত্তবানদের বিত্ত-বৈভব বাড়িয়ে তোলাই হয়ে ওঠে তাদের আসল কাজ। মহাশক্তিধর ও সর্বব্যাপী প্রসারিত বাজার ব্যবস্থার ম্যানিপুলেশন এবং আরো নানা আইনি-বেআইনি পন্থায় কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতি থেকে সম্পদ উঠিয়ে এনে কেন্দ্রীভূত করা হয় মুষ্ঠিমেয় ‘ব্যক্তি-খাতের শিরোমণির’ এসব দাবিদারদের হাতে। এর ফলে তাদের বিপুল সহায়-সম্পদ আরো স্ফীত হয় ঠিকই, কিন্তু চরিত্রগতভাবে পরগাছাপরায়ণ ও লুটেরা প্রবণতার কারণে তাদের সেই বিত্তের খুব অল্পই পুঁজিতে পরিণত হয়। বেশির ভাগই সঞ্চালিত হয় কালো-অর্থনীতির সমান্তরাল জগতে, পাচার হয়ে যায় বিদেশে অথবা নিঃশেষ হয় ভোগ-বিলাসে। উৎপাদনশীল কৃষিখাত কর্তৃক সৃষ্ট সম্পদের অপব্যহারের মাধ্যমে এভাবেই লালিত হয় লুটপাটের ক্রমবর্ধমান প্রবণতা ও অপশক্তি। ব্যক্তিখাতের অন্যতম প্রধান ডাইনামিক সেক্টর, কৃষি অর্থনীতি, সামগ্রিক বিচারে ক্রমাগতই ঠকে চলেছে। এই বঞ্চনা ও শোষণ প্রক্রিয়া পরিচালিত হয় নানা পথে। তার মধ্যে সবচেয়ে প্রধান পথটি হলো প্রচলিত বর্তমান পুঁজিবাদী বাজার ব্যবস্থাপনার কারসাজি। কৃষক বাজারে যা বিক্রি করে তার দাম যে অনুপাতে বাড়ে তা থেকে অনেক বেশি পরিমাণে ক্রমাগত বাড়তে থাকে কৃষক যেসব জিনিসপত্র কেনে সেসবের দাম। একসময় একমণ ধান বিক্রি করে বাজার থেকে বউয়ের জন্য একজোড়া শাড়ি, ছেলে-মেয়েদের জন্য এক সেট করে জামা-কাপড়, নিজের জন্য একটি লুঙ্গি কিনেও হাতে এক পাতিল দই ঝুলিয়ে বাড়ি ফিরতে পারতো কৃষক। এখন সেই একই জিনিস নিয়ে বাড়ি ফিরতে হলে দুই থেকে আড়াই মণ ধান বিক্রি না করলে তার সেগুলো কেনার উপায় থাকে না। অর্থনীতির ভাষায় যাকে বাণিজ্য বিনিময় হারে (terms of trade) বলে, তা কৃষি অর্থনীতির প্রতিকূলে ক্রমাগত অবনত হচ্ছে। গত ৪/৫ দশকে এই কৃষিপণ্যের প্রতিকূলে বাণিজ্য বিনিময় হারের ২০০%-২৫০% অবনতি ঘটেছে। আসলে, ব্যক্তি-খাতের স্বার্থরক্ষা করা তাদের উদ্দেশ্য নয়। ব্যক্তি-খাতের কথা বলে লুটপাটের আয়োজনকে আরো প্রসারিত করাই তাদের প্রকৃত লক্ষ্য। ‘ব্যক্তি-খাত পন্থি’ বলে দাবিদাররা কৃষি অর্থনীতি ও কৃষকের কথা না ভাবলেও সমাজতন্ত্রের প্রবক্তা কমিউনিস্টরা এই কল্যাণকর ব্যক্তি-খাতের দেশহিতৈষী ভূমিকার সপক্ষে সবসময় সোচ্চার ছিল, আছে ও থাকবে।
সম্পাদকীয়
অমঙ্গল দূর হোক

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..