কৃষি, ফসল ও তার দাম

মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ্

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email
সারাবছরই কৃষক বঞ্চিত থাকে। তাকে নিয়তির দাস বানানো হয়। কৃষক উৎপাদন করে জানপ্রাণ দিয়ে। রেকর্ড ভেঙে প্রচুর ফলনও হয়। কিন্তু কৃষক কৃষি পন্যের ন্যায্য দাম পায় না। পানির দামে কৃষক ফড়িয়া দালালদের কাছে বিক্রি করে। সেটা স্টক করে অসাধু মজুতদার, যারা সিন্ডিকেট করে। কৃত্রিম সংকট তৈরি করে। তখন তার দাম হয় লাগামছাড়া। ভোক্তারা তখন অসহায়। শোষণতান্ত্রিক অর্থনীতি এই হিসেব কষেই চলছে। সরকার যেই আসুক, সিন্ডিকেট তাদের ঘাড় মটকে খায়। কিছুই বলার নেই। সরকারকে টিকে থাকতে হলে সিন্ডিকেট ভাঙা কঠিন এরকমই ধারণায় পেয়ে বসেছে। বাজারে সবজির দাম হয়তো একটু কমেছে। ভোক্তারা সব খেয়ে শেষ করতে পারেনা। উদ্বৃত্ত কাঁচামালের মজুতদার ওঁৎ পেতে আছে। সিন্ডিকেট ওঁৎ পেতে আছে। পচনশীল কাঁচামাল সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই। আপদকালীন ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা ইউনিয়ন পর্যায়ে থাকা উচিত ছিল। মাঠ পর্যায়ে হিমাগার বা কোল্ড স্টোরেজ নিয়ে আগাম কোনো সুখবর নেই বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে। আমরা ভাবতে ভুলে গেছি আমাদের প্রয়োজন মিটিয়ে এসব কাঁচামাল বিদেশে রপ্তানি করা যায়। আমরা বিদেশী পন্য আমদানি করতেই অভ্যস্ত, অথচ খুবই উদ্বেগের বিষয় যে, আমাদের দেশেই আমাদের কৃষক বেগুন, মূলা, টমেটো, পেঁপে, কপির নায্য দাম না পেয়ে শেষে তা পায়ে মাড়িয়ে রাস্তায় ফেলে দেয়; নয়তো গরু, ভেড়াকে খাওয়ায়, মিডিয়া আর পত্রিকার হেডিং হয়। সত্যিকার অর্থে কৃষক বরাবরই বঞ্চিত, তাদের বুকফাটা চিৎকার কারো কর্ণগোচর হয় না। একজন কৃষক তার পণ্য ফলাতে যেই অর্থ, শারীরিক শ্রম খরচ করে পণ্যটি উৎপাদন করে তার যথাযথ মূল্য না পেয়ে হা-হুতাশ করে ফেরে। পানির দামে উৎপাদিত পণ্যের বিক্রয়কৃত অর্থ তার কোনো উপকারে আসে না। সংসারে তার সংবাৎসরিক টানাপোড়েন থেকেই যায়। মামলা, চিকিৎসা, ছেলেমেয়ের পড়াশোনা, বিয়েশাদিতে খরচ করতে গিয়ে ধারদেনার ঘানি টেনেই চলতে হয়। আগে মহাজনের কাছে গিয়ে হাত পেতে ঋণগ্রস্ত হতো, এখন শর্তসাপেক্ষ ঋণের জন্য এনজিও, দাতা সংস্থা,ব্যাংকের দ্বারস্থ হয়। পরে উৎপাদিত পন্যের উৎপাদন খরচ, পারিবারিক খরচের ভারসাম্য রক্ষা করতে না পেরে নিজেকে দাঁড় করিয়ে দেয় বঞ্চিত মানুষের কাতারে। জাতীয় বাজেটে নেই কৃষকবান্ধব পদক্ষেপ। ঋণ, সহায়তা, প্রণোদনার পরিমাণ নেহায়েত কম। প্রাকৃতিক দুর্যোগে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হলেও নেই। কৃষির জন্য কৃষক এর কৃষি বিমার বন্দোবস্ত নেই। সরকার কর্তৃক গৃহীত কর্মসূচিতে বিগত দিনের নির্বাচিত কিংবা অনির্বাচিত সরকার ভর্তুকি, ক্ষতিপূরণ দিলেও অপ্রতুল। কোনো জবাবদিহি ছিল না। তদুপরি এক শ্রেণির কায়েমি স্বার্থবাদীরা কৃষকের জন্য বরাদ্দের অর্থ লুটপাট করেছে। প্রকৃত কৃষক ঋণ পায়নি। যারা ঋণ নিয়েছিল এনজিও থেকে, ঋণ পরিশোধের তাগাদা একপর্যায়ে কৃষকের ওপর যন্ত্রণা, মানসিক নির্যাতন হিসেবে আবির্ভূত হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘনঘটা আমাদের দেশে লেগেই আছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক এরকম সমস্যা, সংকট কাটিয়ে ওঠার আগেই নতুন সমস্যায় পড়ে। দুর্যোগ থেকে উত্তোরণের পথ অবরুদ্ধ। পরবর্তী সময়ে তার জন্য দুয়ারে দাঁড়ানো থাকে দুর্ভিক্ষ। ফসলের বীজ, সার, কীটনাশক, বালাইনাশকের ওপর আন্তর্জাতিক রাজনীতি, বানিজ্যের হোতাদের থাবা সরেই না। হাইব্রিড, উফসীর বীজ দিয়ে উৎপাদন বহুগুণে বাড়িয়ে মানুষের চাহিদা মেটানোর বিষয়টি ভালো। কিন্তু বাস্তবে ফসলের মৌলিক জাতকে ধ্বংস করে নিজেদের উদ্ভাবিত পন্যকে অন্য কোন জাত তৈরির নামে পণ্যটির স্বতঃস্ফূর্ত উৎপাদন নষ্ট করার খেলা। সাম্রাজ্যবাদীর তকমা গায়ে বীজের বাজার দখলের খেলা। উফসী ফসলের বংশ বিস্তার ক্ষমতা কম। কাজেই কৃষক উৎপাদিত ফসলের পরবর্তী জাতক ফসলের জন্যই বীজের বাজারি কোম্পানির দ্বারস্থ হয়। অথচ বাংলাদেশের অতীত বলে দেয় প্রতিটি কৃষক পরিবার এক সময় বীজ সংগ্রহ, সংরক্ষণ করার লোকজ পদ্ধতিতেই বেশ টেকসই ছিল। বিশেষ করে নারীরা এ কাজ করতো। বর্তমানে উচ্চ ফলনের আশায় এ-ই কৃষক বীজ সংগ্রহ, সংরক্ষণ নিয়ে ব্যস্ত না থেকে বাজারে দৌড়ায়। বীজ বাজারজাত করার জন্য কোম্পানি বিশেষ বিপণন পদ্ধতি ব্যবহার করে। বীজ থেকে চারার পরবর্তী ধাপে সার, বিষ, কীটনাশক, আগাছানাশক, বালাইনাশক, হরমোন কিনতে মোটামুটি বাধ্য। এতে তার উৎপাদন খরচ যা হয় ফসল পাবার পর উৎপাদন খরচের সাথে বিক্রয়কৃত অর্থের পরিমাণে বিস্তর ফারাক থাকে। তখন সে নিরুৎসাহিত হয়ে কৃষিকাজের প্রতি অতি সহজে আস্থা হারিয়ে ফেলে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে কৃষকের ভাগ্য না বদলালে দেশেরই বা কী ক্ষতি? তথাকথিতদের মনোভাব অনুযায়ী কৃষক কেবল চাষাভুষা শ্রেণির হবে। বই পুস্তকে কৃষক মানে কাদাপানিতে লেপ্টে থাকা একদল বকলম। রাজনৈতিক শক্তিগুলোর প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর কাছে কৃষক মানেই ভোটের উৎস। ওদের ভাগ্য না বদলালে দেশ যে এগোতে ব্যর্থ হবে সে-ধরনের চিন্তা কারো মাথায় নেই। তার পরিবর্তে আছে কীভাবে কৃষককে ঠকানো যায়। কেমন করে তার সর্বস্ব কেড়ে নেয়া যায়। কেমন উপায়ে তার ভাগ্য পরিবর্তনের জায়গাটাকে সামাজিক, সাংস্কৃতিক শোষণের দ্বারা ঠেকিয়ে দেয়া যায়। কৃষকের অধিকার আদায়ের পক্ষে কথা বলার রাজনৈতিক দলের সংখ্যা যে দিন দিন কমে এসেছে। লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, শ্যামগঞ্জ শাখা, ময়মনসিংহ

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..